২০১২ সালের নোবেল বিজয়ী চীনা লেখক মো ইয়ানকে নিয়ে বিশেষ আয়োজনলোক ঐতিহ্য ও সমকালীন ইতিহাসই যাঁর উপন্যাসের বিষয়-আশয় -প্রাচ্যকথাবিদ মো ইয়ান by মাসুদুজ্জামান
মো ইয়ান। কোনো সন্দেহ নেই, আমাদের কাছে খুবই অপরিচিত এক ঔপন্যাসিক। এই বঙ্গদেশে হাল আমলের আন্তর্জাতিক কিংবা বিশ্বসাহিত্য যাঁদের নখদর্পণে, তাঁদের কেউ কেউ হয়তো তাঁর নাম শুনে থাকবেন। কিন্তু অন্যদের কাছে এই নাম একেবারেই অপরিচিত, লেখা পাঠ করা তো দূরের কথা।
কিন্তু সত্যিই কি তিনি এতটা অপরিচিত, বিশেষ করে সাহিত্যবিশ্বে? ঘটনা কিন্তু তা নয়।
একবিংশ শতকের সূচনাবর্ষ, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি বিশ্বসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নির্দেশ করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে যে ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে সাময়িকী, তার বেশ কয়েকটি সংখ্যায় বেশ কয়েক বছর ধরে ইয়ানের সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু প্রবন্ধ, বুক রিভিউ তো আছেই। এমনকি জন আপডাইকের মতো প্রখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক প্রভাবশালী মার্কিন সাপ্তাহিক নিউ ইয়র্কার-এ ইংরেজিতে অনূদিত মো ইয়ানের বিগ ব্রেস্টস অ্যান্ড ওয়াইড হিপেসর ওপর প্রবন্ধ পর্যন্ত লিখেছেন। এই প্রবন্ধেই চীন-মার্কিন বংশোদ্ভূত আরেক খ্যাতিমান লেখক অ্যামি ট্যানের কথার সূত্রে মন্তব্য করেছেন, ‘যেভাবে লেখক হিসেবে মিলান কুন্ডেরা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মার্কিন পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছেন, সেই একইভাবে মো ইয়ানও মার্কিনদের মন জয় করে নেবেন।’ ইয়ান অবশ্য এর আগেই তাঁর প্রথম উপন্যাস লোহিত জোয়ারের খেত-এর (হোং গাওলিয়াং জিয়াজু—রেড সরগাম) ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রের (পরিচালক ঝাং ইমো, ১৯৮৭) সুবাদে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি অর্জন করে ফেলেছিলেন। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবির পুরস্কারপ্রাপ্তি (গোল্ডেন বিয়ার) মো ইয়ানকে আরও খ্যাতিমান করে তোলে। এরপর ১৯৯৩ সালে উপন্যাসটি যখন ইংরেজিতে অনূদিত (মূল রচনাকাল ১৯৮৭) হয়ে পশ্চিমা পাঠকদের হাতে পৌঁছায়, তখনই আখ্যানপ্রেমীরা তাঁর লেখায় মার্কেস, ফকনার, ফ্লবেয়ার ও জয়েসের ছায়া দেখতে পান। তাঁর রচনার সূত্র ধরে চীনা সাহিত্য যে বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে, সাহিত্য সমালোচকেরা এ রকম কথা বলতে দ্বিধা করেননি।
রূপান্তর প্রক্রিয়াটি আসলে শুরু হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে, মাও-উত্তর চীনে। লেখক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে যে শিল্পসাহিত্যের চর্চা করাটা জরুরি, আধুনিকতার এই অভিঘাত তাঁদের সচকিত করে তোলে। পার্টি প্রোপাগান্ডার ছায়াতলে না থেকে সত্যিকারের সর্বজনীন সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হতে শুরু করেন। মো ইয়ানের আবির্ভাবও ঘটেছিল ঠিক এই পথে। পিতৃপ্রদত্ত গুয়ান মোয়ে নামটি ব্যবহার না করে মো ইয়ান লেখক নাম ধারণ করে শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। স্বনির্বাচিত এই নামের অর্থ ‘কথা বোলো না’ বা ‘নীরব থাকো’। মাওয়ের সময়ে মানবিক সংবেদনশীল লেখকদের এভাবেই নীরব বা নিয়ন্ত্রিত থাকতে হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বী অনেকেই হয়েছেন নিগৃহীত। নিজের কথা নিজের মতো করে তাঁরা বলতে পারেননি, আত্মবীক্ষণ আর সামাজিক অনুষঙ্গের প্রতিফলন তাঁদের রচনায় সেভাবে ঘটেনি। কিন্তু গত শতকের আশির দশকে শুরু হয় চীনা সাহিত্যের অভূতপূর্ব উত্থান। এ প্রসঙ্গে মো ইয়ান নিজেই লিখেছেন, ‘যখন লোহিত জোয়ার খেত নামের উপন্যাসটি লিখি, তখনো আমি পিএলএর (পিপল্স লিবারেশন আর্মি) আর্ট স্কুলে কাজ করছি। আশির দশকের শুরুর দিকের কথা, চলছে তথাকথিত “চীনা সাহিত্যের সোনালি যুগ”। উদ্দীপ্ত পাঠকের কথা ভেবে সাহিত্যচর্চা করব বলে ঠিক করলাম।’ লেখালেখি শুরুর আগে আক্ষরিক অর্থেই মো ইয়ান ছিলেন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একজন সক্রিয় সদস্য। কাজ করেছেন গ্রন্থাগারিক হিসেবে আর ১৯৮৬ সালে সামরিক কলেজ থেকে সাহিত্যে স্নাতক হয়েছেন। আশির দশকেই তিনি যখন অনুবাদের মাধ্যমে মার্কেস ও অন্যান্য জাদুবাস্তববাদী লেখকদের রচনা পড়তে শুরু করেন, তখন তাঁর মনে হয়েছে, ‘আমিও তো এ রকম মুক্তভাবে লিখতে পারি।’ অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন নিজের লেখালেখিতে বিদেশি বিভিন্ন লেখকের প্রভাবের কথা। এই লেখকদের মধ্যে আছেন গুন্টার গ্রাস, ডি এইচ লরেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও লিও টলস্তয়।
এভাবেই শুরু হয় মো ইয়ানের লেখালেখি। লোহিত জোয়ার খেতই প্রথম মাও আর মাও-উত্তরকালের সাহিত্যের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে দেয়। সম্পূর্ণ নতুন পথে বাঁক নেয় চীনা সাহিত্য, বিশেষ করে কথাসাহিত্য। লোহিত জোয়ার খেত একটি এপিকধর্মী বংশানুক্রমিক পারিবারিক উপাখ্যান। যৌনতা, যুদ্ধ, ইতিহাস ও সমকালীন অনুষঙ্গের জান্তব বিমিশ্রণে রচিত এই আখ্যানের পটভূমি ইয়ানের জন্মস্থান জানডং প্রদেশের গ্রামীণ শহর উত্তর-পূর্ব গায়োমি। শুধু এই উপন্যাস নয়, তাঁর সব রচনাই চীনের গ্রামীণ পটভূতিতে লেখা আর ওই পটভূমি হলো তাঁর জন্ম শহর। ফলে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ‘নেটিভিস্ট’ তকমা জুটে যায় তাঁর। এর অবশ্য বড় কারণ হলো, ইয়ান নিজেই বলছেন, ‘প্রথম পাঠে মনে হতে পারে যে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনা হচ্ছে এই উপন্যাসের বিষয়আশয়। কিন্তু বাস্তবে আমার আত্মীয়স্বজন যেসব লোককাহিনি, কিংবদন্তির কথা শোনাতেন, এ হচ্ছে সেই গল্প। সেই সঙ্গে জীবনের প্রতি ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য আমার যে ব্যাকুলতা, অনিবার্যভাবে সেই আখ্যানও।’ এই উপন্যাসের সূত্র ধরেই সমুচ্চারিত হয় মার্কেসের ‘শত বর্ষের নৈঃশব্দ’ উপন্যাসটি। জনপ্রিয় হতে থাকে ইয়ানের উপন্যাস। তবে তিনি যে গল্প বলেছেন, তা বিশেষভাবে চীনেরই গল্প, চীনেরই ইতিহাস, প্রাচ্যের কথাকাহিনি।
অনুপ্রাণিত ইয়ান এর পরপরই লিখলেন অসংখ্য লেখা। তাঁর রচনার বিপুলতা ও বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। তবে কোনো মহৎ লেখকের মান ও নন্দনশৈলী সংখ্যাধিক্য দিয়ে বিবেচনা করলে ভুল হবে, ইয়ানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। তাঁর লেখার মান ও বৈচিত্র্য জনপ্রিয়তার যেকোনো মাপকাঠিতে শীর্ষস্পর্শী, অনন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে লিখলেন আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস রসুনগাথা (তিয়াংতান সুয়ানতাই জিহ্ জে)। স্থানীয় কোনো এক লোকালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত অসহিষ্ণু সরকারি আমলাদের অন্ধকারময় জীবনের গল্পকে চমৎকারভাবে তুলে আনা হয়েছে এই উপন্যাসে। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনমেন স্কয়ারে যখন গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ চীনা আন্দোলন করছিল, তখন বিভিন্ন পাঠাগার আর বইয়ের দোকানের তাক থেকে এই উপন্যাসটি সরিয়ে ফেলা হয়। শাসকশ্রেণীর আশঙ্কা ছিল, এই বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রভাবে ওই আন্দোলন হয়তো আরও শাণিত হয়ে উঠবে।
ইয়ানের পরবর্তী উপন্যাস সুরা প্রজাতন্ত্র (জিউ গুয়ো)। আধুনিক চীনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষক ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস। তীব্র শ্লেষ আর কৌতুকে ঠাসা এর কাহিনি। দ্রোহী দৃষ্টিকোণ থেকে এই উপন্যাসে চীনা সমাজকে ইয়ান তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। নরমাংস ভক্ষণ আর মদ্যপানই যেন চীনা সংস্কৃতির মূল কথা—এমন ধারণাই পাওয়া যাবে উপন্যাসটি পড়লে। মো ইয়ানের সমকালীন আরও দুটি উপন্যাস হচ্ছে চন্দনকাঠের নির্যাতন (তা সিয়াং শিং) ও ত্রয়োদশ পদক্ষেপ (সিশান বু)। প্রথমটি একটি প্রেমের উপন্যাস। বক্সার বিদ্রোহে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীনারা যে সংগ্রাম করেছিল, সেই পটভূমিতে রচিত। দ্বিতীয় উপন্যাসটি অতি আধুনিকতার আখ্যান। চন্দ্রাহত এই পৃথিবীতে মানুষ যে বন্দী, খাঁচায় আটকে থাকা একজন মানুষের গল্প লিখে সে কথাই পাঠককে জানাতে চেয়েছেন মো ইয়ান।
সুরা প্রজাতন্ত্র পাঠকনন্দিত হওয়ায় ইয়ান লিখলেন আরেকটি কৌতুক আখ্যান একচল্লিশটি বোমা। মাংসের স্থানটি এখানে দখল করে নিল মদ। মদই হয়ে উঠেছে সমকালীন চীনা সমাজের সাংস্কৃতিক প্রতীক। শব্দ ও ভাষার কৌতুকপূর্ণ ব্যবহার, নানা উল্লেখ, গদ্যশৈলীর স্তরবহুল বহুমাত্রিক বুনন—যেসব বৈশিষ্ট্য তার স্বভাবজ, প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায়—এই উপন্যাসেও সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইয়ানের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো গদ্যশৈলীর দিক থেকে বহুস্তরময়, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনন্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ এখন তাঁর শেষের দিকের উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাসে ইয়াং বিশ শতকের চীনা ইতিহাসকে ধারাবাহিকভাবে উপজীব্য করে চলেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর একজন গ্রন্থ সমালোচক তাই সহজেই বলতে পেরেছিলেন, ‘মো ইয়ানের নোবেল মুকুট পরতে খুব বেশি দেরি হবে বলে মনে হয় না।’ এ রকমই দুটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস হচ্ছে বৃহৎ স্তন আর চওড়া কোমর আর জীবন ও মৃত্যু আমাকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে তুলছে (শেংসি পিলাও)। প্রথম উপন্যাসটি বিশ শতকের প্রথম দিকের একটি পরিবারের নারীদের নিয়ে লেখা। গল্পের জায়গাজমিন সেই নিজের শহর গায়োমি। ১৯০০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এর কাহিনি প্রসারিত। তবে চীনের ইতিহাসে যে প্রতিরোধযুদ্ধ (১৯৩৭-১৯৪৫) হয়েছিল, উপন্যাসের মূল কাহিনি সেই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঘনিয়ে উঠেছে। স্বদেশের নির্মম করুণ রূপান্তর, যুদ্ধে যা পূর্ণতা পায়, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিগ্রহ, ধর্ষণ, যৌনজীবিকা, বন্দিত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে এই লেখায়। খুব সহজ নয় এই কাহিনি, বরং কিছুটা জটিল ও গভীর।
পরবর্তী উপন্যাস জীবন ও মৃত্যু আমাকে ক্লান্তশ্রান্ত করে তুলছে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পটভূমিতে লেখা অ্যাবসার্ডধর্মী ট্র্যাজিক আখ্যান। প্রসারিত মানবীয় বীক্ষণ আর সৃষ্টিশীলতার গুণে উপন্যাসটি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর ঘটনাকাল আরও সাম্প্রতিক: ১৯৫০-২০০০ সাল। চীনে তখন মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডামাডোলের মধ্যে চলছে ভূমি সংস্কার। জোতদার শিমেন নাওয়ের ফাঁসি হয়েছে, কিন্তু সে পাঁচ ধরনের প্রাণী (গাধা, ষাঁড়, শূকর, কুকুর ও বানর) এবং সবশেষে বিশাল মাথার এক বালকের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে, অর্থাৎ তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। আখ্যানের বুনটটি যদিও বিভিন্ন বর্ণনাকারীর বহুস্তরময় গদ্যের কারণে কিছুটা জটিল কিন্তু ভীষণ কৌতুকপ্রদ। দ্রোহকালেও যে মানবিক গুণগুলো লুপ্ত হয়ে যায় না, এ হচ্ছে সে রকমই এক আখ্যান। ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতার মিশেল, সমালোচকদের মতে এই উপন্যাসকে করে তুলেছে একটি মেটাফিকশন, গহনস্পর্শী ডিসকোর্স। আধুনিক, আঁভাগার্দ ও উত্তর-আধুনিক রচনা হিসেবে এই লেখা পাঠকপ্রিয়তাও অর্জন করে। মো ইয়ানের সব রচনার একক অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্লাট বলেছেন, পাঠকেরা তাঁর এ ধরনের লেখা পড়েই আনন্দ পায়।
গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকদেরও কখনো কখনো একটা সমস্যা হয়—ধারাবাহিকভাবে তাঁরা ভালো লিখে যেতে পারেন না। সব আখ্যানই সমমানের হয় না। কিন্তু মো ইয়ান ব্যতিক্রম হিসেবে অবশ্যই বিবেচিত হবেন। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে, হয়েছে প্রসংশিত। মানবিক বীক্ষণের প্রসারিত পটভূমিতে লেখা তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই গভীর, মর্মস্পর্শী। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর এক প্রতিভা। বহুবিচিত্র শৈলী, প্রকরণ, গদ্যরীতিরও তিনি একজন উঁচু মানের কাহিনিকার। লোককাহিনি থেকে জাদুবাস্তবতা, জান্তব বস্তুনিষ্ঠতা থেকে অনুসূক্ষ্ম বর্ণনা, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা—সবকিছুই নানা স্তরে, নানাভাবে বিমিশ্ররীতিতে আখ্যানের স্তরে স্তরে বুনে দিয়েছেন তিনি। হোর্হে লুইস বোর্হেস ও মার্কেসের পরে তিনিই হচ্ছেন সমকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক। প্রাচ্যের অবিসংবাদিত মহান কথাকার। তাঁর নির্মিত কল্পলোক আর বাস্তবভূমি দুই-ই সমান আকর্ষক; তাঁর প্রতিভা তাই নিঃসন্দেহে শিখরস্পর্শী। ঘটনা ও চরিত্রের সম্মিলিত ভাবার্পণের অভিঘাতে সব লেখাই সমানভাবে উজ্জ্বল। বিশ্বজুড়ে দু-তিন দশক ধরে সাহিত্য সমালোচকেরা এমন কথাই বলে আসছেন। ইয়ান নিজেও জানিয়েছেন, ‘অসৌজন্য হলেও সবিনয়ে বলতে চাই—আমার উপন্যাসগুলো সৃষ্টি করেছে সমকালীন চীনা সাহিত্যের অনন্য শৈলী (্স্টাইল)।’
নিন্দুকের দ্বারা সর্বত্রই উঠতি খ্যাতিমানদের বিদ্ধ হতে হয়, ইয়ানও হয়েছেন। মানবাধিকারবাদী কিছু কর্মী ও লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, যে লেখক মাওয়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করতে পারেন, তিনি এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। মো ইয়ান জানতেন, তাঁকে নিয়ে অনেকেই এ রকম কথা বলাবলি করে থাকে। এর মোক্ষম জবাবটা তাই আগেই বোধ হয় দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালের ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই চিৎকার করতে পারেন; কিন্তু যাঁরা ঘরের নিভৃত কোণে বসে সাহিত্য রচনার মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে চলেন, তাঁদের কথাও শুনতে হবে।’
ইয়ানের নিন্দুকেরা এ কথা উপলব্ধি করেছেন কি না, বলা মুশকিল। তবে নোবেল পুরস্কার শুধু তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি নয়, জাতীয় লেখকের মর্যাদাও পাচ্ছেন তিনি। খোদ চীনেই এখন অসংখ্য ভক্ত পাঠকদের দ্বারা অভিষিক্ত হচ্ছেন। কেননা, তিনিই সেই সৌভাগ্যবান প্রথম চীনা লেখক, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন (যদিও এর আগে ২০০০ সালে গাও সিঙজিয়াং সাহিত্যে নোবেল পেলেও তিনি বসবাস করেন ফ্রান্সে)। নোবেল পুরস্কারের ১১১তম বর্ষে এসে এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটল।
মো ইয়ান
জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫
পিতৃপ্রদত্ত নাম: গুয়ান মোয়ে
মো ইয়ান নামটি ছদ্মনাম
পেশা: লেখক, শিক্ষক
ভাষা: চীনা
শিক্ষা: স্নাতক, বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটি (১৯৯১)
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: রেড সরগাম, দ্য রিপাবালক ওয়াইন, দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অয়্যারিং মি আউট
পুরস্কার: নোবেল পরস্কার ২০১২
একবিংশ শতকের সূচনাবর্ষ, অর্থাৎ ২০০০ সাল থেকেই দেখতে পাচ্ছি বিশ্বসাহিত্যের গতি-প্রকৃতি নির্দেশ করে প্রকাশিত হয়ে চলেছে যে ওয়ার্ল্ড লিটারেচার টুডে সাময়িকী, তার বেশ কয়েকটি সংখ্যায় বেশ কয়েক বছর ধরে ইয়ানের সাহিত্যপ্রতিভা নিয়ে একের পর এক প্রকাশিত হয়েছে বেশ কিছু প্রবন্ধ, বুক রিভিউ তো আছেই। এমনকি জন আপডাইকের মতো প্রখ্যাত মার্কিন ঔপন্যাসিক প্রভাবশালী মার্কিন সাপ্তাহিক নিউ ইয়র্কার-এ ইংরেজিতে অনূদিত মো ইয়ানের বিগ ব্রেস্টস অ্যান্ড ওয়াইড হিপেসর ওপর প্রবন্ধ পর্যন্ত লিখেছেন। এই প্রবন্ধেই চীন-মার্কিন বংশোদ্ভূত আরেক খ্যাতিমান লেখক অ্যামি ট্যানের কথার সূত্রে মন্তব্য করেছেন, ‘যেভাবে লেখক হিসেবে মিলান কুন্ডেরা ও গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস মার্কিন পাঠকদের মন জয় করে নিয়েছেন, সেই একইভাবে মো ইয়ানও মার্কিনদের মন জয় করে নেবেন।’ ইয়ান অবশ্য এর আগেই তাঁর প্রথম উপন্যাস লোহিত জোয়ারের খেত-এর (হোং গাওলিয়াং জিয়াজু—রেড সরগাম) ওপর ভিত্তি করে নির্মিত চলচ্চিত্রের (পরিচালক ঝাং ইমো, ১৯৮৭) সুবাদে বিশ্বজুড়ে পরিচিতি অর্জন করে ফেলেছিলেন। বার্লিন চলচ্চিত্র উৎসবে এই ছবির পুরস্কারপ্রাপ্তি (গোল্ডেন বিয়ার) মো ইয়ানকে আরও খ্যাতিমান করে তোলে। এরপর ১৯৯৩ সালে উপন্যাসটি যখন ইংরেজিতে অনূদিত (মূল রচনাকাল ১৯৮৭) হয়ে পশ্চিমা পাঠকদের হাতে পৌঁছায়, তখনই আখ্যানপ্রেমীরা তাঁর লেখায় মার্কেস, ফকনার, ফ্লবেয়ার ও জয়েসের ছায়া দেখতে পান। তাঁর রচনার সূত্র ধরে চীনা সাহিত্য যে বিশ্বমানে পৌঁছে গেছে, সাহিত্য সমালোচকেরা এ রকম কথা বলতে দ্বিধা করেননি।
রূপান্তর প্রক্রিয়াটি আসলে শুরু হয়েছিল গত শতকের আশির দশকে, মাও-উত্তর চীনে। লেখক, চিত্রশিল্পী, নাট্যকার, চলচ্চিত্র নির্মাতাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের বাইরে গিয়ে যে শিল্পসাহিত্যের চর্চা করাটা জরুরি, আধুনিকতার এই অভিঘাত তাঁদের সচকিত করে তোলে। পার্টি প্রোপাগান্ডার ছায়াতলে না থেকে সত্যিকারের সর্বজনীন সাহিত্যচর্চায় নিবেদিত হতে শুরু করেন। মো ইয়ানের আবির্ভাবও ঘটেছিল ঠিক এই পথে। পিতৃপ্রদত্ত গুয়ান মোয়ে নামটি ব্যবহার না করে মো ইয়ান লেখক নাম ধারণ করে শুরু করেন সাহিত্যচর্চা। স্বনির্বাচিত এই নামের অর্থ ‘কথা বোলো না’ বা ‘নীরব থাকো’। মাওয়ের সময়ে মানবিক সংবেদনশীল লেখকদের এভাবেই নীরব বা নিয়ন্ত্রিত থাকতে হয়েছে। ভিন্নমতাবলম্বী অনেকেই হয়েছেন নিগৃহীত। নিজের কথা নিজের মতো করে তাঁরা বলতে পারেননি, আত্মবীক্ষণ আর সামাজিক অনুষঙ্গের প্রতিফলন তাঁদের রচনায় সেভাবে ঘটেনি। কিন্তু গত শতকের আশির দশকে শুরু হয় চীনা সাহিত্যের অভূতপূর্ব উত্থান। এ প্রসঙ্গে মো ইয়ান নিজেই লিখেছেন, ‘যখন লোহিত জোয়ার খেত নামের উপন্যাসটি লিখি, তখনো আমি পিএলএর (পিপল্স লিবারেশন আর্মি) আর্ট স্কুলে কাজ করছি। আশির দশকের শুরুর দিকের কথা, চলছে তথাকথিত “চীনা সাহিত্যের সোনালি যুগ”। উদ্দীপ্ত পাঠকের কথা ভেবে সাহিত্যচর্চা করব বলে ঠিক করলাম।’ লেখালেখি শুরুর আগে আক্ষরিক অর্থেই মো ইয়ান ছিলেন চীনের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের একজন সক্রিয় সদস্য। কাজ করেছেন গ্রন্থাগারিক হিসেবে আর ১৯৮৬ সালে সামরিক কলেজ থেকে সাহিত্যে স্নাতক হয়েছেন। আশির দশকেই তিনি যখন অনুবাদের মাধ্যমে মার্কেস ও অন্যান্য জাদুবাস্তববাদী লেখকদের রচনা পড়তে শুরু করেন, তখন তাঁর মনে হয়েছে, ‘আমিও তো এ রকম মুক্তভাবে লিখতে পারি।’ অকপটে স্বীকার করে নিয়েছেন নিজের লেখালেখিতে বিদেশি বিভিন্ন লেখকের প্রভাবের কথা। এই লেখকদের মধ্যে আছেন গুন্টার গ্রাস, ডি এইচ লরেন্স, আর্নেস্ট হেমিংওয়ে ও লিও টলস্তয়।
এভাবেই শুরু হয় মো ইয়ানের লেখালেখি। লোহিত জোয়ার খেতই প্রথম মাও আর মাও-উত্তরকালের সাহিত্যের মধ্যে ব্যবধান রচনা করে দেয়। সম্পূর্ণ নতুন পথে বাঁক নেয় চীনা সাহিত্য, বিশেষ করে কথাসাহিত্য। লোহিত জোয়ার খেত একটি এপিকধর্মী বংশানুক্রমিক পারিবারিক উপাখ্যান। যৌনতা, যুদ্ধ, ইতিহাস ও সমকালীন অনুষঙ্গের জান্তব বিমিশ্রণে রচিত এই আখ্যানের পটভূমি ইয়ানের জন্মস্থান জানডং প্রদেশের গ্রামীণ শহর উত্তর-পূর্ব গায়োমি। শুধু এই উপন্যাস নয়, তাঁর সব রচনাই চীনের গ্রামীণ পটভূতিতে লেখা আর ওই পটভূমি হলো তাঁর জন্ম শহর। ফলে আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে ‘নেটিভিস্ট’ তকমা জুটে যায় তাঁর। এর অবশ্য বড় কারণ হলো, ইয়ান নিজেই বলছেন, ‘প্রথম পাঠে মনে হতে পারে যে জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘটনা হচ্ছে এই উপন্যাসের বিষয়আশয়। কিন্তু বাস্তবে আমার আত্মীয়স্বজন যেসব লোককাহিনি, কিংবদন্তির কথা শোনাতেন, এ হচ্ছে সেই গল্প। সেই সঙ্গে জীবনের প্রতি ভালোবাসা আর স্বাধীনতার জন্য আমার যে ব্যাকুলতা, অনিবার্যভাবে সেই আখ্যানও।’ এই উপন্যাসের সূত্র ধরেই সমুচ্চারিত হয় মার্কেসের ‘শত বর্ষের নৈঃশব্দ’ উপন্যাসটি। জনপ্রিয় হতে থাকে ইয়ানের উপন্যাস। তবে তিনি যে গল্প বলেছেন, তা বিশেষভাবে চীনেরই গল্প, চীনেরই ইতিহাস, প্রাচ্যের কথাকাহিনি।
অনুপ্রাণিত ইয়ান এর পরপরই লিখলেন অসংখ্য লেখা। তাঁর রচনার বিপুলতা ও বৈচিত্র্য বিস্ময়কর। তবে কোনো মহৎ লেখকের মান ও নন্দনশৈলী সংখ্যাধিক্য দিয়ে বিবেচনা করলে ভুল হবে, ইয়ানের ক্ষেত্রে কিন্তু এমন কিছু ঘটেনি। তাঁর লেখার মান ও বৈচিত্র্য জনপ্রিয়তার যেকোনো মাপকাঠিতে শীর্ষস্পর্শী, অনন্য। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৮৮ সালে লিখলেন আরেকটি অসাধারণ উপন্যাস রসুনগাথা (তিয়াংতান সুয়ানতাই জিহ্ জে)। স্থানীয় কোনো এক লোকালয়ের দুর্নীতিগ্রস্ত অসহিষ্ণু সরকারি আমলাদের অন্ধকারময় জীবনের গল্পকে চমৎকারভাবে তুলে আনা হয়েছে এই উপন্যাসে। ১৯৮৯ সালে বেইজিংয়ের তিয়েনমেন স্কয়ারে যখন গণতন্ত্রকামী লাখ লাখ চীনা আন্দোলন করছিল, তখন বিভিন্ন পাঠাগার আর বইয়ের দোকানের তাক থেকে এই উপন্যাসটি সরিয়ে ফেলা হয়। শাসকশ্রেণীর আশঙ্কা ছিল, এই বইয়ের বিষয়বস্তুর প্রভাবে ওই আন্দোলন হয়তো আরও শাণিত হয়ে উঠবে।
ইয়ানের পরবর্তী উপন্যাস সুরা প্রজাতন্ত্র (জিউ গুয়ো)। আধুনিক চীনের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও আকর্ষক ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস। তীব্র শ্লেষ আর কৌতুকে ঠাসা এর কাহিনি। দ্রোহী দৃষ্টিকোণ থেকে এই উপন্যাসে চীনা সমাজকে ইয়ান তীব্রভাবে সমালোচনা করেছেন। নরমাংস ভক্ষণ আর মদ্যপানই যেন চীনা সংস্কৃতির মূল কথা—এমন ধারণাই পাওয়া যাবে উপন্যাসটি পড়লে। মো ইয়ানের সমকালীন আরও দুটি উপন্যাস হচ্ছে চন্দনকাঠের নির্যাতন (তা সিয়াং শিং) ও ত্রয়োদশ পদক্ষেপ (সিশান বু)। প্রথমটি একটি প্রেমের উপন্যাস। বক্সার বিদ্রোহে পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে চীনারা যে সংগ্রাম করেছিল, সেই পটভূমিতে রচিত। দ্বিতীয় উপন্যাসটি অতি আধুনিকতার আখ্যান। চন্দ্রাহত এই পৃথিবীতে মানুষ যে বন্দী, খাঁচায় আটকে থাকা একজন মানুষের গল্প লিখে সে কথাই পাঠককে জানাতে চেয়েছেন মো ইয়ান।
সুরা প্রজাতন্ত্র পাঠকনন্দিত হওয়ায় ইয়ান লিখলেন আরেকটি কৌতুক আখ্যান একচল্লিশটি বোমা। মাংসের স্থানটি এখানে দখল করে নিল মদ। মদই হয়ে উঠেছে সমকালীন চীনা সমাজের সাংস্কৃতিক প্রতীক। শব্দ ও ভাষার কৌতুকপূর্ণ ব্যবহার, নানা উল্লেখ, গদ্যশৈলীর স্তরবহুল বহুমাত্রিক বুনন—যেসব বৈশিষ্ট্য তার স্বভাবজ, প্রায় সব উপন্যাসেই দেখা যায়—এই উপন্যাসেও সহজেই খুঁজে পাওয়া যাবে। লক্ষ করলে দেখা যাবে, ইয়ানের প্রথম দিকের উপন্যাসগুলো গদ্যশৈলীর দিক থেকে বহুস্তরময়, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনন্য। কিন্তু পরবর্তী সময়ে, অর্থাৎ এখন তাঁর শেষের দিকের উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাসে ইয়াং বিশ শতকের চীনা ইতিহাসকে ধারাবাহিকভাবে উপজীব্য করে চলেছেন। ওয়াশিংটন পোস্ট-এর একজন গ্রন্থ সমালোচক তাই সহজেই বলতে পেরেছিলেন, ‘মো ইয়ানের নোবেল মুকুট পরতে খুব বেশি দেরি হবে বলে মনে হয় না।’ এ রকমই দুটি উচ্চাকাঙ্ক্ষী উপন্যাস হচ্ছে বৃহৎ স্তন আর চওড়া কোমর আর জীবন ও মৃত্যু আমাকে ক্লান্ত-শ্রান্ত করে তুলছে (শেংসি পিলাও)। প্রথম উপন্যাসটি বিশ শতকের প্রথম দিকের একটি পরিবারের নারীদের নিয়ে লেখা। গল্পের জায়গাজমিন সেই নিজের শহর গায়োমি। ১৯০০ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত এর কাহিনি প্রসারিত। তবে চীনের ইতিহাসে যে প্রতিরোধযুদ্ধ (১৯৩৭-১৯৪৫) হয়েছিল, উপন্যাসের মূল কাহিনি সেই যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ঘনিয়ে উঠেছে। স্বদেশের নির্মম করুণ রূপান্তর, যুদ্ধে যা পূর্ণতা পায়, দারিদ্র্য, ক্ষুধা, নিগ্রহ, ধর্ষণ, যৌনজীবিকা, বন্দিত্ব ইত্যাদি প্রসঙ্গ স্থান পেয়েছে এই লেখায়। খুব সহজ নয় এই কাহিনি, বরং কিছুটা জটিল ও গভীর।
পরবর্তী উপন্যাস জীবন ও মৃত্যু আমাকে ক্লান্তশ্রান্ত করে তুলছে বিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধের পটভূমিতে লেখা অ্যাবসার্ডধর্মী ট্র্যাজিক আখ্যান। প্রসারিত মানবীয় বীক্ষণ আর সৃষ্টিশীলতার গুণে উপন্যাসটি সমালোচকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এর ঘটনাকাল আরও সাম্প্রতিক: ১৯৫০-২০০০ সাল। চীনে তখন মাওয়ের সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডামাডোলের মধ্যে চলছে ভূমি সংস্কার। জোতদার শিমেন নাওয়ের ফাঁসি হয়েছে, কিন্তু সে পাঁচ ধরনের প্রাণী (গাধা, ষাঁড়, শূকর, কুকুর ও বানর) এবং সবশেষে বিশাল মাথার এক বালকের রূপ নিয়ে পৃথিবীতে, অর্থাৎ তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে এসেছে। আখ্যানের বুনটটি যদিও বিভিন্ন বর্ণনাকারীর বহুস্তরময় গদ্যের কারণে কিছুটা জটিল কিন্তু ভীষণ কৌতুকপ্রদ। দ্রোহকালেও যে মানবিক গুণগুলো লুপ্ত হয়ে যায় না, এ হচ্ছে সে রকমই এক আখ্যান। ফ্যান্টাসি আর বাস্তবতার মিশেল, সমালোচকদের মতে এই উপন্যাসকে করে তুলেছে একটি মেটাফিকশন, গহনস্পর্শী ডিসকোর্স। আধুনিক, আঁভাগার্দ ও উত্তর-আধুনিক রচনা হিসেবে এই লেখা পাঠকপ্রিয়তাও অর্জন করে। মো ইয়ানের সব রচনার একক অনুবাদক হাওয়ার্ড গোল্ডব্লাট বলেছেন, পাঠকেরা তাঁর এ ধরনের লেখা পড়েই আনন্দ পায়।
গুরুত্বপূর্ণ ঔপন্যাসিকদেরও কখনো কখনো একটা সমস্যা হয়—ধারাবাহিকভাবে তাঁরা ভালো লিখে যেতে পারেন না। সব আখ্যানই সমমানের হয় না। কিন্তু মো ইয়ান ব্যতিক্রম হিসেবে অবশ্যই বিবেচিত হবেন। তাঁর প্রতিটি উপন্যাস আন্তর্জাতিকভাবে সমাদৃত হয়েছে, হয়েছে প্রসংশিত। মানবিক বীক্ষণের প্রসারিত পটভূমিতে লেখা তাঁর প্রতিটি উপন্যাসই গভীর, মর্মস্পর্শী। তিনি সত্যিকার অর্থেই বিস্ময়কর এক প্রতিভা। বহুবিচিত্র শৈলী, প্রকরণ, গদ্যরীতিরও তিনি একজন উঁচু মানের কাহিনিকার। লোককাহিনি থেকে জাদুবাস্তবতা, জান্তব বস্তুনিষ্ঠতা থেকে অনুসূক্ষ্ম বর্ণনা, আধুনিকতা, উত্তর-আধুনিকতা—সবকিছুই নানা স্তরে, নানাভাবে বিমিশ্ররীতিতে আখ্যানের স্তরে স্তরে বুনে দিয়েছেন তিনি। হোর্হে লুইস বোর্হেস ও মার্কেসের পরে তিনিই হচ্ছেন সমকালের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঔপন্যাসিক। প্রাচ্যের অবিসংবাদিত মহান কথাকার। তাঁর নির্মিত কল্পলোক আর বাস্তবভূমি দুই-ই সমান আকর্ষক; তাঁর প্রতিভা তাই নিঃসন্দেহে শিখরস্পর্শী। ঘটনা ও চরিত্রের সম্মিলিত ভাবার্পণের অভিঘাতে সব লেখাই সমানভাবে উজ্জ্বল। বিশ্বজুড়ে দু-তিন দশক ধরে সাহিত্য সমালোচকেরা এমন কথাই বলে আসছেন। ইয়ান নিজেও জানিয়েছেন, ‘অসৌজন্য হলেও সবিনয়ে বলতে চাই—আমার উপন্যাসগুলো সৃষ্টি করেছে সমকালীন চীনা সাহিত্যের অনন্য শৈলী (্স্টাইল)।’
নিন্দুকের দ্বারা সর্বত্রই উঠতি খ্যাতিমানদের বিদ্ধ হতে হয়, ইয়ানও হয়েছেন। মানবাধিকারবাদী কিছু কর্মী ও লেখক প্রশ্ন তুলেছেন, যে লেখক মাওয়ের ৭০তম জন্মবার্ষিকী উদ্যাপন করতে পারেন, তিনি এই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য নন। মো ইয়ান জানতেন, তাঁকে নিয়ে অনেকেই এ রকম কথা বলাবলি করে থাকে। এর মোক্ষম জবাবটা তাই আগেই বোধ হয় দিয়ে রেখেছিলেন তিনি। ২০০৯ সালের ফ্রাঙ্কফুর্ট বইমেলায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনেকেই চিৎকার করতে পারেন; কিন্তু যাঁরা ঘরের নিভৃত কোণে বসে সাহিত্য রচনার মাধ্যমে নিজেদের মতামত প্রকাশ করে চলেন, তাঁদের কথাও শুনতে হবে।’
ইয়ানের নিন্দুকেরা এ কথা উপলব্ধি করেছেন কি না, বলা মুশকিল। তবে নোবেল পুরস্কার শুধু তাঁর সৃষ্টিশীলতার স্বীকৃতি নয়, জাতীয় লেখকের মর্যাদাও পাচ্ছেন তিনি। খোদ চীনেই এখন অসংখ্য ভক্ত পাঠকদের দ্বারা অভিষিক্ত হচ্ছেন। কেননা, তিনিই সেই সৌভাগ্যবান প্রথম চীনা লেখক, যিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পেলেন (যদিও এর আগে ২০০০ সালে গাও সিঙজিয়াং সাহিত্যে নোবেল পেলেও তিনি বসবাস করেন ফ্রান্সে)। নোবেল পুরস্কারের ১১১তম বর্ষে এসে এই অভূতপূর্ব ঘটনাটি ঘটল।
মো ইয়ান
জন্ম: ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫
পিতৃপ্রদত্ত নাম: গুয়ান মোয়ে
মো ইয়ান নামটি ছদ্মনাম
পেশা: লেখক, শিক্ষক
ভাষা: চীনা
শিক্ষা: স্নাতক, বেইজিং নরমাল ইউনিভার্সিটি (১৯৯১)
উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ: রেড সরগাম, দ্য রিপাবালক ওয়াইন, দ্য লাইফ অ্যান্ড ডেথ অয়্যারিং মি আউট
পুরস্কার: নোবেল পরস্কার ২০১২
No comments