সোনার মানুষ by মোস্তফা কামাল

১৯৯৫ সালের ১৯ অক্টোবর আমরা হারিয়েছি ক্ষণজন্মা 'সোনার মানুষ' জহুরুল ইসলামকে। মহত্ত্ব, কৃতিত্ব, পরিশ্রম, সততা, একনিষ্ঠতা এবং আত্মবিশ্বাস তাকে 'সোনার মানুষ'-এ পরিণত করেছিল। বাঙালির ব্যবসা-বাণিজ্যের পথিকৃৎ তিনিই।


সমাজ ও দেশের আদর্শের এ প্রবাদপুরুষ জীবন ও কর্মে বাংলাকে সোনালি রূপ-মাধুরী দিয়ে গেছেন। এ অসাধারণ বাঙালি কৃতী সন্তানের তুলনা শুধু তিনি নিজেই।
কিশোরগঞ্জের বাজিতপুর থানার বর্ধিষ্ণু গ্রাম ভাগলপুরের এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে ১৯২৮ সালের ১ আগস্ট জহুরুল ইসলামের জন্ম। শৈশবে জহুরুল ইসলামের ডাকনাম ছিল 'সোনা'। পারিবারিক উত্তরাধিকার বা বাপের তালুকেই তিনি বড় হতে পারতেন। কিন্তু তা না করে কাজের মাধ্যমে এগোতে চেয়েছেন তিনি। কর্মফলের মাধ্যমে ছোট থেকে বড় হওয়ার দৃষ্টান্ত প্রতিষ্ঠা করে গেছেন জহুরুল ইসলাম। ভাগ্যান্বেষণে সততা-পরিশ্রম-আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে একজন মানুষ কত মহীয়ান-গরীয়ান হতে পারেন তিনি সেই বিস্ময়কর উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন।
কর্মজীবন শুরু হয় ১৯৪৮ সালে। মাত্র ৮০ টাকা মাসিক বেতনে সিঅ্যান্ডবির ওয়ার্ক এসিস্ট্যান্টের চাকরিতে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। তিন বছর পর ১৯৫১ সালে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে শুরু করেন ঠিকাদারি ব্যবসা। সরকারি অফিসে স্টেশনারি সরবরাহের ব্যবসাও করেছেন। পশ্চিমাদের রাজত্বে তখন সীমিত পুঁজিতে কোনো বাঙালির ঠিকাদারি বা ব্যবসার কথা ভাবনায় আসাও ছিল অস্বাভাবিক। ঠিকাদারি জীবনের শুরুতে তিনি কিশোরগঞ্জ পোস্ট অফিস নির্মাণের কাজ পান। পরে পান গুলিস্তান থেকে টিকাটুলী সড়কের কাজ। এরপর তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি। কাজের সততা ও গুণমানের জন্য মাত্র দুই বছরের মাথায় তিনি নিজেকে একজন প্রথম শ্রেণীর ঠিকাদার হিসেবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন।
জহুরুল ইসলামের মধ্যে ছিল দ্বিমুখী মননশীলতা_ অন্তর্দৃষ্টি ও দূরদৃষ্টি। কাছে-দূরে সমানতালে দেখা ও পর্যবেক্ষণের এ দ্বিমুখী ক্ষমতা ছিল বিশ্বের খুব কম সংখ্যক মনীষীরই। বর্তমানকে যথাযথভাবে উপলব্ধি এবং ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এ অনন্য ক্ষমতাকে অনেকে ঐশ্বরিক মনে করে থাকেন। অতুলনীয় প্রজ্ঞা, দৃঢ়তা, বিচক্ষণতা তাকে ব্যবসা-বাণিজ্য, বিনিয়োগ, সমাজসেবা ইত্যাদিতে উদ্ভাবনী শক্তি জুগিয়েছে। ভাষা আন্দোলন, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও একাত্তরের যুদ্ধে জহুরুল ইসলামের অবদান আমাদের ইতিহাসেরই অংশ। তিনি ফলাও করে বা প্রচারের উদ্দেশ্যে কখনও ওই অবদানের কথা উল্লেখ করতেন না। বরাবরই দান-অনুদানের মতো মহৎ কাজগুলোতে তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করতেন। তার সেই বিশেষ অবদান প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি বিচারপতি মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর লেখা, 'প্রবাসে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি' নামক গ্রন্থে কিছু উল্লেখ রয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, জহুরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ জুন ঢাকা ত্যাগ করে লন্ডন চলে যান। সেখানে তিনি সুবেদ আলী ছদ্মনাম ধারণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে কার্যক্রম চালাতে থাকেন। সে কার্যক্রমের অংশ হিসেবে মরহুম আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে মোটা অঙ্কের নগদ অর্থ প্রদান করেন। ঐতিহাসিক আগরতলা মামলায় বঙ্গবন্ধুর খরচও ব্যক্তিগতভাবে বহন করেন তিনি।
জহুরুল ইসলাম ছিলেন ধর্মাচারী ব্যক্তিত্ব। তবে তার ধর্মকর্ম চর্চায় ছিল ব্যতিক্রমী ধারা। দীন-দুনিয়াকে তিনি খুব আলাদাভাবে দেখতেন না। দেশপ্রেমকেও তিনি দেখতেন দীন-দুনিয়ার অংশ হিসেবে। এ প্রেমসাধনা যে তিনি শুধু '৭১-এ করেছেন তা নয়। '৭১-এর আগে-পরেও সারাক্ষণ দেশ গঠন ও দেশ সমৃদ্ধকরণে তিনি ছিলেন সাধকের ভূমিকায়।
mostofa71@gmail.com
 

No comments

Powered by Blogger.