বেদনার্ত সময়- by মোবাশ্বির আলম মজুমদার
‘শিল্পীর সৃষ্টিকর্মের বিষয় নির্দিষ্ট গণ্ডিতে আবদ্ধ না থাকা। সময়ের সঙ্গে যেমন চিন্তার পরিবর্তন হয়, জীবনের পরিবর্তন হয়, তেমনি ছবির বিষয়েও পরিবর্তন আসে। ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগে (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট) পড়ার সময়ই ছবির বিষয় নিয়ে নিরীক্ষায় মনোযোগী হন আশরাফুল হাসান।
প্রকৃতির নানা রূপ এ সময় এবং পরেও তাঁর ক্যানভাসে স্পষ্ট হয়ে উঠতে শুরু করে।
১২ অক্টোবর উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে আশরাফুল হাসানের একক প্রদর্শনী। এবারের প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে ১১টি তেলরং ও অ্যাক্রিলিক, নয়টি কাগজের ওপর কলমের ড্রয়িং, ১৭টি লিথোগ্রাফ প্রিন্ট। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ট্রমা অ্যান্ড টাইম’। ২০১১ সালের প্রদর্শনীর কাগজগুলোতে শিল্পী গাছের কাণ্ডের সঙ্গে শক্ত রশির বাঁধন দেখিয়েছিলেন। কোনো রশির রং ছিল লাল, নীল, কোনোটি সবুজ রঙের। এবারের প্রদর্শনীতে বৃক্ষের আহতাবস্থার সঙ্গে শূন্যে ভাসমান বৃক্ষ উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে শিল্পী মনে করেন, ‘সময়ের সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধনে চিড় ধরেছে। অতিযন্ত্রণায় স্থবির হয়ে আছে মানুষ ও প্রকৃতি। নগরায়ণের ফলে কেটে ফেলা গাছের আকৃতিতে আমি একজন মানুষের দেহাবয়ব খুঁজে পাই।’
ডাচ পেইন্টার রেমব্রান্টের প্রভাব খুব স্পষ্ট আশরাফুলের কাজে। রেমব্রান্টের মতো আলো-ছায়ার বৈপরীত্য আশরাফুলের কাজেও উপস্থিত। বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা পেশিবহুল মানুষও আশরাফুলের কাছে প্রেরণা হয়ে এসেছে। কিন্তু তাঁর কাজে সুলতানের সরাসরি প্রভাব নেই।
আশরাফুল কিছু কাজে নগর স্থাপনাকে প্রধান করেছেন। কারণ তিনি ভেবেছেন, নগরায়ণের ফলেই প্রকৃতি অপসারিত হয়, হুমকির মধ্যে পড়ে। আমরা উঁচু দালানকোঠা, কলকারখানা গড়ে তুলে সবুজ বৃক্ষকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করছি। শিল্পী প্রকৃতির কোলে মৃত গাছের আহাজারি দেখেন বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায়। সকাল-বিকেল দুই বেলায়ই ওখানকার দূর পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ভেদ করে ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলেছে গাছের কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা। গাছটি এখানে মানুষের আকৃতির পেয়েছে।
প্রিন্ট মাধ্যমের কাজে আশরাফুল বরাবরই আনন্দ পান। ২০০৯ সালে শান্তিনিকেতনে এক বছরের সংক্ষিপ্ত কোর্সে তিনি ছাপচিত্র মাধ্যমের কলাকৌশল রপ্ত করেন। ঢাকায় ফিরে এসে বেশ কিছুদিন ছাপচিত্র মাধ্যমে কাজ করেছেন। এ প্রদর্শনীতে ১৭টি লিথোগ্রাফ প্রিন্ট হাজির করেছেন শিল্পী।
‘উনডেড নেচার’ ৪ ছবিতে কাটা গাছের টুকরো পড়ে আছে মাটিতে। ছবির জমিনে শুকনো গাছের ডালপালা ছড়িয়ে কম্পোজিশনে বৈচিত্র্য এনেছেন। তরুণ শিল্পী আশরাফুল হাসানের এবারের প্রদর্শনী নিয়ে গ্যালারি কায়ার প্রধান নির্বাহী শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী মনে করেন, ‘একজন তরুণ শিল্পী তাঁর সৃজনীক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখান ক্যানভাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা বাদ দিয়ে শুধু ছবি এঁকে একজন নবীন শিল্পী জীবন যাপন করছেন। আশরাফুল হাসানের কাজে সৃজনশীলতার পূর্ণ প্রয়োগের সঙ্গে শিল্পের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমাদের আশাবাদী করে তোলে।’
কালি ও কলমে, রেখা ও বিন্দুর সাহায্যে আঁকা দুটি ছবি উইথ ডার্ক ইমেজ ২, ৩, রাতের নগরে গাছের আহতাবস্থা এঁকেছেন, রাতের মৃদু আলোয় গাছের আকৃতিকে নারীর শরীর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী আশরাফুল ছাপচিত্র, তেল ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা ছবিতে বিষয়ের মিল রেখেছেন। তবে কাগজ-কলম মাধ্যমে আঁকা ছবিগুলো প্রাণহীন মনে হয়েছে। ‘ন্যাচার অ্যান্ড ওমেন’ ছবিতে প্রকৃতি ও নারীর অবয়বকে এক করে দেখিয়েছেন। এতে রং প্রয়োগে যত্নের ছাপ আছে কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও আশরাফুলের এ নিরন্তর পথ চলা আমাদের প্রাণিত করে। শিল্পসৃষ্টির জন্য শিল্পীর নিজের সঙ্গে নিজের যে নিত্য লড়াই করতে হয়, সেই লড়াকু তরুণ আশরাফুল হাসানের লড়াই অব্যাহত থাকুক। ‘ট্রমা অ্যান্ড টাইম’ প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৩ অক্টোবর।
আশরাফুল হাসান: জন্ম ১৯৭৭ ফেনী। চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে স্নাতক ও ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগ (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে কলকাতার বিশ্বভারতী থেকে এক বছরের ডিপ্লোমা নেন। দুটি একক প্রদর্শনী ছাড়াও অসংখ্য দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১১ সালে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার ও ২০০৭ সালে সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেন।
১২ অক্টোবর উত্তরার গ্যালারি কায়ায় শুরু হয়েছে আশরাফুল হাসানের একক প্রদর্শনী। এবারের প্রদর্শনীতে প্রদর্শিত হচ্ছে ১১টি তেলরং ও অ্যাক্রিলিক, নয়টি কাগজের ওপর কলমের ড্রয়িং, ১৭টি লিথোগ্রাফ প্রিন্ট। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘ট্রমা অ্যান্ড টাইম’। ২০১১ সালের প্রদর্শনীর কাগজগুলোতে শিল্পী গাছের কাণ্ডের সঙ্গে শক্ত রশির বাঁধন দেখিয়েছিলেন। কোনো রশির রং ছিল লাল, নীল, কোনোটি সবুজ রঙের। এবারের প্রদর্শনীতে বৃক্ষের আহতাবস্থার সঙ্গে শূন্যে ভাসমান বৃক্ষ উপস্থাপন করেছেন। এ প্রসঙ্গে শিল্পী মনে করেন, ‘সময়ের সঙ্গে প্রকৃতি ও মানুষের বন্ধনে চিড় ধরেছে। অতিযন্ত্রণায় স্থবির হয়ে আছে মানুষ ও প্রকৃতি। নগরায়ণের ফলে কেটে ফেলা গাছের আকৃতিতে আমি একজন মানুষের দেহাবয়ব খুঁজে পাই।’
ডাচ পেইন্টার রেমব্রান্টের প্রভাব খুব স্পষ্ট আশরাফুলের কাজে। রেমব্রান্টের মতো আলো-ছায়ার বৈপরীত্য আশরাফুলের কাজেও উপস্থিত। বাংলাদেশের বিখ্যাত শিল্পী এস এম সুলতানের আঁকা পেশিবহুল মানুষও আশরাফুলের কাছে প্রেরণা হয়ে এসেছে। কিন্তু তাঁর কাজে সুলতানের সরাসরি প্রভাব নেই।
আশরাফুল কিছু কাজে নগর স্থাপনাকে প্রধান করেছেন। কারণ তিনি ভেবেছেন, নগরায়ণের ফলেই প্রকৃতি অপসারিত হয়, হুমকির মধ্যে পড়ে। আমরা উঁচু দালানকোঠা, কলকারখানা গড়ে তুলে সবুজ বৃক্ষকে দূরে সরে যেতে বাধ্য করছি। শিল্পী প্রকৃতির কোলে মৃত গাছের আহাজারি দেখেন বান্দরবানের পাহাড়ি এলাকায়। সকাল-বিকেল দুই বেলায়ই ওখানকার দূর পাহাড়ের গা ঘেঁষে ধোঁয়াচ্ছন্ন আকাশ। কুণ্ডলী পাকানো ধোঁয়া ভেদ করে ঊর্ধ্বমুখে ছুটে চলেছে গাছের কাণ্ড, শাখা-প্রশাখা। গাছটি এখানে মানুষের আকৃতির পেয়েছে।
প্রিন্ট মাধ্যমের কাজে আশরাফুল বরাবরই আনন্দ পান। ২০০৯ সালে শান্তিনিকেতনে এক বছরের সংক্ষিপ্ত কোর্সে তিনি ছাপচিত্র মাধ্যমের কলাকৌশল রপ্ত করেন। ঢাকায় ফিরে এসে বেশ কিছুদিন ছাপচিত্র মাধ্যমে কাজ করেছেন। এ প্রদর্শনীতে ১৭টি লিথোগ্রাফ প্রিন্ট হাজির করেছেন শিল্পী।
‘উনডেড নেচার’ ৪ ছবিতে কাটা গাছের টুকরো পড়ে আছে মাটিতে। ছবির জমিনে শুকনো গাছের ডালপালা ছড়িয়ে কম্পোজিশনে বৈচিত্র্য এনেছেন। তরুণ শিল্পী আশরাফুল হাসানের এবারের প্রদর্শনী নিয়ে গ্যালারি কায়ার প্রধান নির্বাহী শিল্পী গৌতম চক্রবর্তী মনে করেন, ‘একজন তরুণ শিল্পী তাঁর সৃজনীক্ষমতার সর্বোচ্চ প্রয়োগ দেখান ক্যানভাসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা বাদ দিয়ে শুধু ছবি এঁকে একজন নবীন শিল্পী জীবন যাপন করছেন। আশরাফুল হাসানের কাজে সৃজনশীলতার পূর্ণ প্রয়োগের সঙ্গে শিল্পের প্রতি গভীর মমত্ববোধ আমাদের আশাবাদী করে তোলে।’
কালি ও কলমে, রেখা ও বিন্দুর সাহায্যে আঁকা দুটি ছবি উইথ ডার্ক ইমেজ ২, ৩, রাতের নগরে গাছের আহতাবস্থা এঁকেছেন, রাতের মৃদু আলোয় গাছের আকৃতিকে নারীর শরীর হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী আশরাফুল ছাপচিত্র, তেল ও অ্যাক্রিলিক মাধ্যমে আঁকা ছবিতে বিষয়ের মিল রেখেছেন। তবে কাগজ-কলম মাধ্যমে আঁকা ছবিগুলো প্রাণহীন মনে হয়েছে। ‘ন্যাচার অ্যান্ড ওমেন’ ছবিতে প্রকৃতি ও নারীর অবয়বকে এক করে দেখিয়েছেন। এতে রং প্রয়োগে যত্নের ছাপ আছে কিন্তু বিষয় বৈচিত্র্য খুঁজে পাওয়া যায় না। তবুও আশরাফুলের এ নিরন্তর পথ চলা আমাদের প্রাণিত করে। শিল্পসৃষ্টির জন্য শিল্পীর নিজের সঙ্গে নিজের যে নিত্য লড়াই করতে হয়, সেই লড়াকু তরুণ আশরাফুল হাসানের লড়াই অব্যাহত থাকুক। ‘ট্রমা অ্যান্ড টাইম’ প্রদর্শনীটি শেষ হবে ২৩ অক্টোবর।
আশরাফুল হাসান: জন্ম ১৯৭৭ ফেনী। চট্টগ্রাম সরকারি চারুকলা কলেজ থেকে ১৯৯৮ সালে স্নাতক ও ২০০৪ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা বিভাগ (বর্তমানে চারুকলা ইনস্টিটিউট) থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ২০০৯ সালে কলকাতার বিশ্বভারতী থেকে এক বছরের ডিপ্লোমা নেন। দুটি একক প্রদর্শনী ছাড়াও অসংখ্য দলীয় প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেন। ২০১১ সালে জাতীয় চারুকলা প্রদর্শনীতে শিল্পকলা একাডেমী পুরস্কার ও ২০০৭ সালে সম্মানসূচক পুরস্কার লাভ করেন।
No comments