সংস্কৃতি অঙ্গনের আপসহীন যোদ্ধা by গোলাম কুদ্দুছ
সংস্কৃতিযোদ্ধা কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী আর নেই। সোমবার দুপুরে খবর পেয়েই ছুটে গেলাম ধানমণ্ডি আনোয়ার খান মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে তার পরিবারের সঙ্গে ইতিমধ্যে হাজির হয়েছেন আমাদের সহকর্মী হাসান আরিফ, রফিকুল ইসলাম ও শাহাদাৎ হোসেন নিপু।
খবরটা সত্য নয়_ জাফর ভাই তখনও জীবিত। আছেন আইসিইউতে, কৃত্রিমভাবে বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে তাকে। ডাক্তাররা বললেন_ অবস্থা ভালো নয়, যে কোনো পরিস্থিতির জন্য আপনারা তৈরি থাকুন। সে সময়টা এসে গেল গভীর রাতে। মহানগরীর সব মানুষের সঙ্গে আমাদের জাফর ভাইও ঘুমিয়ে গেলেন। তবে পার্থক্য হলো সকালবেলা সবাই আবার জেগে উঠল, কিন্তু জাফর ভাই চলে গেলেন না-ফেরার দেশে।
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক আপসহীন যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে জাতির অনেক সংকটকালে সব ভয়ভীতি এবং রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি আমাদের পথচলার শক্তি জুগিয়েছেন। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থার সময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যখন ডুব মেরে নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টায় রত ছিলেন, তখনও ক্যান্সার আক্রান্ত এ মানুষটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী প্রতিরোধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তার উপস্থিতি, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং কখনও কখনও আবৃত্তির গমগম উচ্চারণ শ্রোতা-দর্শকদের উদ্বেলিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় নিজেকে উজাড় করে দেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। প্রযোজক হিসেবে নানা ধরনের সৃষ্টিশীল নির্মাণের পাশাপাশি একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী এবং কবি হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র, গীতি আলেখ্য কিংবা প্রামাণ্যচিত্রে তার হৃদয়গ্রাহী ধারাবর্ণনা নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। চাকরি জীবনে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নিজস্ব বিশ্বাসকে কখনও অপমানিত হতে দেননি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অবসর নিলেও তার ত্যাগ, যোগ্যতার কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার তাকে দু'দফায় তিন বছরের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে। এই সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের আধুনিকায়ন, অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ষাটের দশকে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে একজন নাট্যশিল্পী হিসেবে তিনি তালিকাভুক্ত হন এবং বহু নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আবৃত্তিকেই তিনি প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পূর্বকালে হাতেগোনা কয়েকজন আবৃত্তি করতেন এবং তাদের প্রায় সবাই ছিলেন নাট্যশিল্পী। তারা হলেন ফতেহ লোহানী, গোলাম মুস্তাফা, আলী মনসুর, সৈয়দ হাসান ইমাম, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী প্রমুখ। আশির দশক থেকে একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে আবৃত্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে যে ক'জন মানুষ অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী অগ্রগণ্য। নিয়মিত আবৃত্তিচর্চা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে নতুন নতুন আবৃত্তিশিল্পী এবং সংগঠন গড়ে তোলায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত আবৃত্তি অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকাকে কখনও অস্বীকার করা যাবে না। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি। বর্তমান সরকার কর্তৃক আবৃত্তিশিল্পীদের জন্য প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত 'সব্যসাচী আবৃত্তি পদক' নজরুল জয়ন্তীতে কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীর হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সৎ, ত্যাগী, আদর্শবান, বিনয়ী এই ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
গোলাম কুদ্দুছ : সহ-সভাপতি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন আমাদের প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক আন্দোলনের এক আপসহীন যোদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বুকে ধারণ করে জাতির অনেক সংকটকালে সব ভয়ভীতি এবং রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে তিনি আমাদের পথচলার শক্তি জুগিয়েছেন। বিশেষ করে বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের জরুরি অবস্থার সময় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি যখন ডুব মেরে নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণের চেষ্টায় রত ছিলেন, তখনও ক্যান্সার আক্রান্ত এ মানুষটি গণতন্ত্র এবং মানবাধিকার রক্ষার আন্দোলনে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছিলেন। সাম্প্রদায়িক জঙ্গিগোষ্ঠী প্রতিরোধ এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের প্রতিটি পর্যায়ে তার উপস্থিতি, যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য এবং কখনও কখনও আবৃত্তির গমগম উচ্চারণ শ্রোতা-দর্শকদের উদ্বেলিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুন উৎসাহ-উদ্দীপনায় নিজেকে উজাড় করে দেন বাংলাদেশ টেলিভিশনে। প্রযোজক হিসেবে নানা ধরনের সৃষ্টিশীল নির্মাণের পাশাপাশি একজন খ্যাতিমান আবৃত্তিশিল্পী এবং কবি হিসেবেও নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেন। যে কোনো জাতীয় অনুষ্ঠান, তথ্যচিত্র, গীতি আলেখ্য কিংবা প্রামাণ্যচিত্রে তার হৃদয়গ্রাহী ধারাবর্ণনা নতুন প্রজন্মের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে নিঃসন্দেহে। চাকরি জীবনে নানা প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও নিজস্ব বিশ্বাসকে কখনও অপমানিত হতে দেননি। বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাব্যবস্থাপক হিসেবে অবসর নিলেও তার ত্যাগ, যোগ্যতার কথা বিবেচনা করে বর্তমান সরকার তাকে দু'দফায় তিন বছরের জন্য বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক হিসেবে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করে। এই সময় তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের আধুনিকায়ন, অভ্যন্তরীণ সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, অনুষ্ঠান নির্মাণের সঙ্গে সম্পৃক্তদের যথাযথ প্রশিক্ষণ এবং নিম্ন বেতনভুক্ত কর্মচারীদের কল্যাণে নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
ষাটের দশকে তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানে একজন নাট্যশিল্পী হিসেবে তিনি তালিকাভুক্ত হন এবং বহু নাটকে অভিনয় করে প্রশংসিত হয়েছেন। তবে সবকিছু ছাপিয়ে আবৃত্তিকেই তিনি প্রধান হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। স্বাধীনতা-পূর্বকালে হাতেগোনা কয়েকজন আবৃত্তি করতেন এবং তাদের প্রায় সবাই ছিলেন নাট্যশিল্পী। তারা হলেন ফতেহ লোহানী, গোলাম মুস্তাফা, আলী মনসুর, সৈয়দ হাসান ইমাম, কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী প্রমুখ। আশির দশক থেকে একটি স্বতন্ত্র শিল্পমাধ্যম হিসেবে আবৃত্তির যে যাত্রা শুরু হয়েছে, তাতে যে ক'জন মানুষ অসাধারণ ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী অগ্রগণ্য। নিয়মিত আবৃত্তিচর্চা, প্রশিক্ষণ প্রদান এবং সাংগঠনিক তৎপরতায় নিজেকে নিয়োজিত রেখে নতুন নতুন আবৃত্তিশিল্পী এবং সংগঠন গড়ে তোলায় ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। বাংলাদেশ টেলিভিশনে নিয়মিত আবৃত্তি অনুষ্ঠান প্রচারের ক্ষেত্রেও তার ভূমিকাকে কখনও অস্বীকার করা যাবে না। কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী ছিলেন বাংলাদেশ আবৃত্তি সমন্বয় পরিষদের উপদেষ্টামণ্ডলীর অন্যতম সদস্য এবং বঙ্গবন্ধু আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি। বর্তমান সরকার কর্তৃক আবৃত্তিশিল্পীদের জন্য প্রথমবারের মতো প্রবর্তিত 'সব্যসাচী আবৃত্তি পদক' নজরুল জয়ন্তীতে কাজী আবু জাফর সিদ্দিকীর হাতে তুলে দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
সৎ, ত্যাগী, আদর্শবান, বিনয়ী এই ব্যক্তিত্বের প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা।
গোলাম কুদ্দুছ : সহ-সভাপতি সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট
No comments