হৃদয়নন্দন বনে-আজ এই শারদ প্রাতে...! by আলী যাকের
পশ্চিমবঙ্গের প্রয়াত কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের একটি বহুল আলোচিত কবিতার লাইন এরকম, 'ফুল ফুটুক, না ফুটুক, আজ বসন্ত।' অসাধারণ একটি পঙ্ক্তি! পহেলা ফাল্গুন এলেই যখন দখিনা বাতাস বইতে শুরু করে, শীতের শেষে, তখনও দু'চারটি পাতা ঝরে পড়ে বড় বড় বৃক্ষ থেকে। আমাদের মনটা কেমন যেন হুহু করে ওঠে।
এই মন-কেমন-করা অনুভূতি কোনো দুঃখবোধ থেকে নয়। শীত শেষে পত্রপুষ্পের আসন্ন আন্দোলনে আমাদের হৃদয় তখন উন্মুখ। মন বলে 'কী দিয়ে বরণ করি তোমায়?' তবে এটাও ঠিক, আমি লক্ষ্য করেছি যে, বাংলার ষড়ঋতুর যে কোনো একটির আগমনে প্রকৃতিতে কতগুলো পরিবর্তন ঘটে যায়, প্রায় আমাদের অজান্তেই। এ বিষয়ে সুভাষ দা বেঁচে থাকতে একবার তর্কও বেধেছিল আমার সঙ্গে, তারই শহর কলকাতায় বসে। আমি বলেছিলাম, 'সুভাষ দা, ইট-পাথরের জঙ্গলে বসে থাকলে আসলেই টের পাওয়া যায় না, বসন্ত এসেছে, কি আসেনি। এই কৃত্রিম জঙ্গল থেকে একটু বেরিয়ে আসল জঙ্গলের সানি্নধ্যে যদি যান, তাহলে সহজেই টের পাবেন, বসন্ত এলে ফুল ফোটেই।' এই আবিষ্কারটি আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাপ্রসূত। প্রয়াত ড. নোয়াজেশ আহমেদ, প্রখ্যাত উদ্ভিদবিজ্ঞানী এবং আলোকচিত্রী আর আমি প্রায় পাঁচ-ছয় বছর বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়িয়েছি বুনোফুলের ছবি তুলতে। হরেক রকম ফুলের সাক্ষাৎ পেয়েছি। ছবি তুলেছি দেদার। সেইসব ছবি দিয়ে পরে ইংরেজিতে একটি বই প্রকাশিত হয়েছে, ঞযব ডরষফ ঋষড়বিৎং ড়ভ ইধহমষধফবংয. এবং পরবর্তীকালে নোয়াজেশ ভাই বাংলাদেশের বনফুল নামে ওই ছবিগুলো দিয়ে আরও একটি সচিত্র গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এই সময় আমরা আবিষ্কার করি যে, বাংলাদেশের বিভিন্ন ঋতুতে নানা রঙের ফুলের ডালি নিয়ে প্রকৃতি আমাদের কাছে হাজির হয়। এর বেশির ভাগই প্রায় অপরিচিত বুনোফুল, লতা এবং গুল্ম। অসাধারণ দেখতে এসব। আমি তখন এ বিষয়ে একটা অতি ভাবালুতাশ্রয়ী লেখা লিখেছিলাম। এবং লেখার শেষে আমি পাঠককে অনুরোধ করেছিলাম, ভবিষ্যতে তারা যদি গ্রামবাংলার কোনো বিরান প্রান্তরে হেঁটে যান যে কোনো ঋতুতে, তাহলে দয়া করে যেন নিচের দিকে তাকিয়ে দেখেন। সহজেই দেখতে পাবেন তাদের পায়ে মাথা কুটে মরছে বেগুনি, হলুদ, সাদা কিংবা গাঢ় নীল_ অজানা সব অবহেলিত বনফুল। আমরা যে নিসর্গের এই অবদানকে লক্ষ্য করতে পারি না, সেটা এ কারণে নয় যে, তারা নেই। বরং এ কারণে যে, আমাদের জাগতিক কর্মকাণ্ডের তাড়না আমাদের সর্বস্বকে এমনভাবে দখল করে থাকে সর্বদা, আমরা এই নয়নাভিরাম সৌন্দর্য দেখতে চাই না।
কথাগুলো মনে এলো বাংলা বর্ষের পহেলা কার্তিকে। আমি যথারীতি সকাল ৭টার দিকে আমার পড়ার টেবিলে এসে বসেছি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি মেঘহীন উন্মুক্ত আকাশ। সদ্য উদিত সূর্যের সোনাচ্ছটা আমার জানালার আলসেতে রাখা ছোট ছোট গাছগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আমার বন্ধু চড়ূইগুলো এরই মধ্যে হাজির। তারা তাদের প্রাত্যহিক প্রাপ্য খাদ্যকণার জন্য ইতিমধ্যেই ঘাড় হেলিয়ে-দুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কিচিরমিচির করতে শুরু করে দিয়েছে। হেমন্ত আমার প্রিয় ঋতুগুলোর একটি। হঠাৎ করেই আমার শরীর-মন আনন্দে নেচে উঠল। কতকিছু লেখার ছিল, সব ভুলে আমি হেমন্ত সকালের সৌন্দর্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। মনে আছে ওই দিন আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল। দ্বিগুণ কর্মস্পৃহায় উজ্জীবিত আমি সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ ইচ্ছা হলো, আজ আমি আমার চিরাচরিত কাজে সময় অপব্যয় করব না। অফিসে ফোন করে বলে দিলাম, আমি আজ নেই। তারপর আমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতি সন্দর্শনে। আপাতত যাত্রা শুরু করেছি ময়মনসিংহের দিকে। উদ্দেশ্য, রাজেন্দ্রপুরে জাতীয় উদ্যানের ভেতরে অবস্থিত প্রজাপতি খামারে কিছু সময় রঙিন প্রজাপতি এবং তাদের প্রিয় নানা রকমের ফুলের সানি্নধ্যে কাটানো। ১০টায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম। ১২টা যখন বাজে, তখনও আমি টঙ্গীতে, যানজটের মাঝে বসে। আজ আমার কোনো কাজ নেই। অতএব কোনো তাড়া নেই। ভাবলাম দেখিই না কতক্ষণ লাগে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে। মানুষের মনের ওপর চাইলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব। আমি যদি চাই কোনোভাবেই আমি বিদ্যমান কোনো অব্যবস্থার দ্বারা বিরক্ত হবো না, তাহলে আমার ভেতরের আমিকে অস্থির করে তোলে কার সাধ্য! তবুও দীর্ঘক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে থাকতে থাকতে কিছু কিছু বিষয় তো দেখতে না চাইলেও দেখতে পাই। দেখতে পাই আমাদের বাসচালকদের অস্থির ব্যবহার। পথ পারাপার সেতু দিয়ে মানুষ যাতায়াত না করে রাস্তা পার হতে গিয়ে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে অবলীলায়। ভিড়ে বসে থাকা বিভিন্ন যানবাহন থেকে কর্কশ স্বরে ভেঁপুর অযাচিত ব্যবহার। রাজপথের দু'কূল ছাপিয়ে রাস্তা দখলদার ফেরিওয়ালাদের অবাধ ব্যবসা। এসব ভয়াবহ আরতি। ফিরে আসি ধরণীতে আজ। কিন্তু কে-ই বা আসতে চায়? হেমন্তের প্রথম দিনের ওই আহ্বান ছেড়ে কে-ই বা চায় বাস্তব এই পৃথিবীর কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হতে? কিন্তু যে সত্য অবধারিত, তাকে অবজ্ঞা, অবহেলা করার উপায় তো জানি না আমরা।
আজ সকালেই কোনো এক দৈনিকে দেখলাম আমাদের এক মন্ত্রী আবেদন করেছেন, গণমানুষের সহায়তা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আইনবিরোধী এবং আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অবসান একক প্রচেষ্টায় সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি এই অভিমত দিয়েছিলেন ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের ওপরে মন্তব্য করতে গিয়ে। আমরা চারদিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাব, কেবল ওই একটি বিষয়ে নয়, জীবন ধারণের তাবৎ বিষয়ে গণমানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত এবং স্বতঃস্টম্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো একটি সমাজ, কি দেশকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি এর আগেও আমার একাধিক কলামে উল্লেখ করেছি এবং সুযোগ পেলেই আমি কথাগুলো বলে থাকি যে, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের জীবন ধারণে আধুনিকত্ব আসছে। আমরা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ছুটে চলেছি ক্রমাগত। আমাদের সন্তানদের লেখাপড়ায় উন্নততর মান দেখতে পাই চারদিকে। আজকে গ্রামবাংলায় একেবারে পশ্চাৎপদ এলাকাতেও আমাদের কন্যা সন্তানরা বিনা পয়সায় বিদ্যার্জন করতে পারছে। রাস্তায় ক্রমাগত যানজট দেখে এ-ই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের হাতে পয়সা আসছে, যার ফলে কোনোদিন যারা নিজস্ব মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ি ক্রয় করার কথা চিন্তাও করতে পারত না, তারা ভিড় করে আসছে রাজপথ, জনপথে। কিন্তু বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, এই আপাত জাগতিক উন্নতি সত্ত্বেও মানসিক এবং সামাজিক সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা এখনও রয়ে গেছি সেই পঞ্চাশ দশকের মানসিকতার জগতে। আমরা কখনও সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করতে পারি না। কেবলই এককভাবে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কথা ভেবে চলি।
প্রসঙ্গত একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আফ্রিকার একটি ঘটনা। আফ্রিকার কোনো একটি গ্রামে এক স্কুলশিক্ষক একটি দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। দৌড়ের শেষে একটি ঝুড়িভর্তি সুস্বাদু ফল রেখে দেওয়া হয়। শর্ত থাকে যে, এই দৌড়ে যে শিশুটি প্রথম হবে, সে ওই ঝুড়িভর্তি ফল পুরস্কার হিসেবে পাবে। শিক্ষক যখন দৌড় শুরু করতে বললেন, বাচ্চারা একে অন্যের হাত ধরে একসঙ্গে দৌড়ে গিয়ে ফলের ঝুড়ি থেকে ফলগুলো ভাগাভাগি করে খেতে থাকল। যখন শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা এভাবে একসঙ্গে দৌড়ালে কেন? যখন তোমাদের যে কোনো একজন এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে একাই ফলগুলো পেতে পারতে?' তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠল, 'উবুন্তু! যদি একজন পুরস্কার পেয়ে খুশি হয়, তাহলে যে অন্যরা অখুশি থেকে যাবে?' উবুন্তু হচ্ছে একটি আফ্রিকান দর্শন, যার অর্থ হলো 'আমি আছি, কেননা সবাই আছে'। কী অসাধারণ এক দর্শন! যেদিন আমাদের দেশের সব মানুষ এ ধরনের সামষ্টিক বেঁচে থাকায় এবং অগ্রযাত্রায় বিশ্বাসী হবেন, সেদিন এই দেশের চেহারা বদলে যাবে। আপনাদের সবাইকে শরৎ-হেমন্তের হার্দিক শুভেচ্ছা।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
কথাগুলো মনে এলো বাংলা বর্ষের পহেলা কার্তিকে। আমি যথারীতি সকাল ৭টার দিকে আমার পড়ার টেবিলে এসে বসেছি। জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখি মেঘহীন উন্মুক্ত আকাশ। সদ্য উদিত সূর্যের সোনাচ্ছটা আমার জানালার আলসেতে রাখা ছোট ছোট গাছগুলোকে প্রাণবন্ত করে তুলেছে। আমার বন্ধু চড়ূইগুলো এরই মধ্যে হাজির। তারা তাদের প্রাত্যহিক প্রাপ্য খাদ্যকণার জন্য ইতিমধ্যেই ঘাড় হেলিয়ে-দুলিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে কিচিরমিচির করতে শুরু করে দিয়েছে। হেমন্ত আমার প্রিয় ঋতুগুলোর একটি। হঠাৎ করেই আমার শরীর-মন আনন্দে নেচে উঠল। কতকিছু লেখার ছিল, সব ভুলে আমি হেমন্ত সকালের সৌন্দর্যে সম্পূর্ণ নিমজ্জিত হয়ে গেলাম। মনে আছে ওই দিন আমার সব ক্লান্তি দূর হয়ে গিয়েছিল। দ্বিগুণ কর্মস্পৃহায় উজ্জীবিত আমি সারাদিন নানা কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছি। হঠাৎ ইচ্ছা হলো, আজ আমি আমার চিরাচরিত কাজে সময় অপব্যয় করব না। অফিসে ফোন করে বলে দিলাম, আমি আজ নেই। তারপর আমার গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম প্রকৃতি সন্দর্শনে। আপাতত যাত্রা শুরু করেছি ময়মনসিংহের দিকে। উদ্দেশ্য, রাজেন্দ্রপুরে জাতীয় উদ্যানের ভেতরে অবস্থিত প্রজাপতি খামারে কিছু সময় রঙিন প্রজাপতি এবং তাদের প্রিয় নানা রকমের ফুলের সানি্নধ্যে কাটানো। ১০টায় বাড়ি থেকে রওনা হলাম। ১২টা যখন বাজে, তখনও আমি টঙ্গীতে, যানজটের মাঝে বসে। আজ আমার কোনো কাজ নেই। অতএব কোনো তাড়া নেই। ভাবলাম দেখিই না কতক্ষণ লাগে আমার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেঁৗছতে। মানুষের মনের ওপর চাইলে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা সম্ভব। আমি যদি চাই কোনোভাবেই আমি বিদ্যমান কোনো অব্যবস্থার দ্বারা বিরক্ত হবো না, তাহলে আমার ভেতরের আমিকে অস্থির করে তোলে কার সাধ্য! তবুও দীর্ঘক্ষণ গাড়ির ভেতরে বসে থাকতে থাকতে কিছু কিছু বিষয় তো দেখতে না চাইলেও দেখতে পাই। দেখতে পাই আমাদের বাসচালকদের অস্থির ব্যবহার। পথ পারাপার সেতু দিয়ে মানুষ যাতায়াত না করে রাস্তা পার হতে গিয়ে যান চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি করছে অবলীলায়। ভিড়ে বসে থাকা বিভিন্ন যানবাহন থেকে কর্কশ স্বরে ভেঁপুর অযাচিত ব্যবহার। রাজপথের দু'কূল ছাপিয়ে রাস্তা দখলদার ফেরিওয়ালাদের অবাধ ব্যবসা। এসব ভয়াবহ আরতি। ফিরে আসি ধরণীতে আজ। কিন্তু কে-ই বা আসতে চায়? হেমন্তের প্রথম দিনের ওই আহ্বান ছেড়ে কে-ই বা চায় বাস্তব এই পৃথিবীর কুৎসিত সত্যের মুখোমুখি হতে? কিন্তু যে সত্য অবধারিত, তাকে অবজ্ঞা, অবহেলা করার উপায় তো জানি না আমরা।
আজ সকালেই কোনো এক দৈনিকে দেখলাম আমাদের এক মন্ত্রী আবেদন করেছেন, গণমানুষের সহায়তা যদি না পাওয়া যায়, তাহলে আইনবিরোধী এবং আইনবহির্ভূত কর্মকাণ্ডের অবসান একক প্রচেষ্টায় সরকারের পক্ষে করা সম্ভব নয়। আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি এই অভিমত দিয়েছিলেন ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের ওপরে মন্তব্য করতে গিয়ে। আমরা চারদিকে দৃষ্টি ফেরালে দেখতে পাব, কেবল ওই একটি বিষয়ে নয়, জীবন ধারণের তাবৎ বিষয়ে গণমানুষের স্বতঃপ্রবৃত্ত এবং স্বতঃস্টম্ফূর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া কোনো একটি সমাজ, কি দেশকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। আমি এর আগেও আমার একাধিক কলামে উল্লেখ করেছি এবং সুযোগ পেলেই আমি কথাগুলো বলে থাকি যে, আমাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। মানুষের জীবন ধারণে আধুনিকত্ব আসছে। আমরা জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে ছুটে চলেছি ক্রমাগত। আমাদের সন্তানদের লেখাপড়ায় উন্নততর মান দেখতে পাই চারদিকে। আজকে গ্রামবাংলায় একেবারে পশ্চাৎপদ এলাকাতেও আমাদের কন্যা সন্তানরা বিনা পয়সায় বিদ্যার্জন করতে পারছে। রাস্তায় ক্রমাগত যানজট দেখে এ-ই প্রতীয়মান হয় যে, মানুষের হাতে পয়সা আসছে, যার ফলে কোনোদিন যারা নিজস্ব মোটরসাইকেল কিংবা গাড়ি ক্রয় করার কথা চিন্তাও করতে পারত না, তারা ভিড় করে আসছে রাজপথ, জনপথে। কিন্তু বড় দুঃখের সঙ্গে বলতে হয় যে, এই আপাত জাগতিক উন্নতি সত্ত্বেও মানসিক এবং সামাজিক সংস্কৃতির দিক থেকে আমরা এখনও রয়ে গেছি সেই পঞ্চাশ দশকের মানসিকতার জগতে। আমরা কখনও সমষ্টিগতভাবে চিন্তা করতে পারি না। কেবলই এককভাবে নিজের স্বার্থসংশ্লিষ্ট কথা ভেবে চলি।
প্রসঙ্গত একটি ঘটনা মনে পড়ে গেল। আফ্রিকার একটি ঘটনা। আফ্রিকার কোনো একটি গ্রামে এক স্কুলশিক্ষক একটি দৌড় প্রতিযোগিতার আয়োজন করেন। দৌড়ের শেষে একটি ঝুড়িভর্তি সুস্বাদু ফল রেখে দেওয়া হয়। শর্ত থাকে যে, এই দৌড়ে যে শিশুটি প্রথম হবে, সে ওই ঝুড়িভর্তি ফল পুরস্কার হিসেবে পাবে। শিক্ষক যখন দৌড় শুরু করতে বললেন, বাচ্চারা একে অন্যের হাত ধরে একসঙ্গে দৌড়ে গিয়ে ফলের ঝুড়ি থেকে ফলগুলো ভাগাভাগি করে খেতে থাকল। যখন শিক্ষক জিজ্ঞেস করলেন, 'তোমরা এভাবে একসঙ্গে দৌড়ালে কেন? যখন তোমাদের যে কোনো একজন এই প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে একাই ফলগুলো পেতে পারতে?' তখন সবাই সমস্বরে বলে উঠল, 'উবুন্তু! যদি একজন পুরস্কার পেয়ে খুশি হয়, তাহলে যে অন্যরা অখুশি থেকে যাবে?' উবুন্তু হচ্ছে একটি আফ্রিকান দর্শন, যার অর্থ হলো 'আমি আছি, কেননা সবাই আছে'। কী অসাধারণ এক দর্শন! যেদিন আমাদের দেশের সব মানুষ এ ধরনের সামষ্টিক বেঁচে থাকায় এবং অগ্রযাত্রায় বিশ্বাসী হবেন, সেদিন এই দেশের চেহারা বদলে যাবে। আপনাদের সবাইকে শরৎ-হেমন্তের হার্দিক শুভেচ্ছা।
আলী যাকের : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
No comments