সন্ত্রাসী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ-যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশি তরুণ গ্রেপ্তার

নিউ ইয়র্কের কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ব্যাংক বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনার অভিযোগে বাংলাদেশি এক তরুণকে গ্রেপ্তার করেছে যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এফবিআই) ও নিউ ইয়র্ক পুলিশ বিভাগ। অভিযুক্ত যুবকের নাম কাজী মোহাম্মদ রেজওয়ানুল আহসান (২১)। ডাকনাম নাফিস।


আদালতে পেশ করা এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে দেখা যায়, নাফিস এই গোয়েন্দা সংস্থার পাতা ফাঁদে পা দিয়ে গোয়েন্দাদের আল-কায়েদার সদস্য মনে করে তাদের সঙ্গে নিয়েই পরিকল্পনা নিয়ে এগোয়। এফবিআই তার ওপর নজর রাখছিল গত জুলাই থেকেই।
বার্তা সংস্থা এপি বলেছে, নাফিস যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামাকেও হত্যা করতে চেয়েছিল। এ প্রসঙ্গে এফবিআইয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, নাফিস যুক্তরাষ্ট্র সরকারের একজন 'গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা' হত্যার ইচ্ছা তাদের কাছে ব্যক্ত করে।
নাফিসের পরিবারের বাসা রাজধানীর যাত্রাবাড়ীতে। পরিবারের সদস্যরা বিশ্বাসও করতে পারছেন না পড়ালেখা করতে গিয়ে নাফিস এ ধরনের কোনো কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়াতে পারে। তাঁরা গোটা বিষয়টিকেই ষড়যন্ত্র মনে করছেন।
নিউ ইয়র্কের ডিস্ট্রিক্ট কোর্টে পেশ করা এফবিআইয়ের প্রতিবেদেনে দেখা যায়, নাফিস স্থানীয় সময় বুধবার সকালে (বাংলাদেশ সময় বুধবার সন্ধ্যা) ম্যানহাটানে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে 'বিস্ফোরকভর্তি' একটি গাড়ি দাঁড় করায়। এরপর পাশের মিলেনিয়াম হিলটন হোটেলে যায়। সেখানে নাফিস তার হামলার বিষয়টি উল্লেখ করে একটি ভিডিও বার্তাও রেকর্ড করে। এরপর সে দূর-নিয়ন্ত্রিত মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে এক হাজার পাউন্ড (৪৫৪ কেজি) ওজনের বিস্ফোরকে বিস্ফোরণ ঘটানোর জন্য প্রয়োজনীয় ডিভাইস সক্রিয়ও করে। হাতেনাতে ধরার জন্য এই মুহূর্তটির জন্যই অপেক্ষা করছিল এফবিআই। তারা ঘটনাস্থল থেকেই নাফিসকে গ্রেপ্তার করে।
পরিকল্পনার সহযোগী হিসেবে নাফিস আল-কায়েদার সদস্য মনে করে একাধিক ব্যক্তিকে সঙ্গে নিয়েছিল এবং তাঁরা ছিলেন আসলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দা। নাফিস এই একজন গোয়েন্দাকে সঙ্গে নিয়েই এই বিস্ফোরক কেনে এবং পরে তা পাতে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ বলছে, নাফিস আসলে এফবিআইয়ের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছে। তার ওপর নজর রাখা হচ্ছিল গত জুলাই থেকেই। তার পরিকল্পনার ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে সহযোগী সেজে এফবিআই কর্মকর্তারাই তাকে ২০ ব্যাগ 'নকল' বিস্ফোরক সরবরাহ করে, যাতে তাকে হাতেনাতে গ্রেপ্তার করা যায়। গাড়িতে সত্যিকারের বিস্ফোরক না থাকায় সেটি আর বিস্ফোরিত হয়নি।
বুধবার গ্রেপ্তারের পরপরই নাফিসের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। মামলায় বলা হয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে শিক্ষা ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে আসে নাফিস। গত জুলাইয়ে এফবিআইয়ের নজরে পড়ে, আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করছে বাংলাদেশের এই তরুণ। এর পরই তারা তাকে ধরার জন্য চতুর্মুখী ফাঁদ পাতে। এজাহারে আরো বলা হয়, ধর্মীয় অজুহাতের দোহাই দিয়ে নাফিস এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে চেয়েছিল, যাতে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি ধ্বংস হয়ে যায়। শুরুর দিকে তার ভাবনা ছিল যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোনো ব্যক্তিকে হত্যা করার। এরপর সে রিজার্ভ ব্যাংক, নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ ও বাল্টিমোরে সেনাবাহিনীর স্থাপনায় বোমা হামলার পরিকল্পনা করে।
এফবিআই কর্তৃপক্ষ দাবি করছে, নাফিস জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত। এমনকি এফবিআইয়ের এক চরকে সে দলে ভেড়ানোরও চেষ্টা করেছে। এফবিআই আদালতে দেওয়া প্রতিবেদনে বলেছে, বিভিন্ন সময় তাদের চরের সঙ্গে নাফিসের যে কথা হয়েছে, সবই ধারণ করা হয়েছে। এমনকি ফেসবুকের মাধ্যমেও নাফিস আল-কায়েদা নেটওয়ার্কের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের চেষ্টা করে এবং এ ক্ষেত্রেও সে এফবিআইয়ের ফাঁদে পা দেয়। ফেসবুকে একবার নাফিস লিখেছে, ছোট কিছু নয়, বড় কিছু করতে চাই। খুব বড় কিছু, যা সমগ্র আমেরিকাকে কাঁপিয়ে দেবে। এর মাধ্যমে আমেরিকা তার ধ্বংসনীতি বদলাতে বাধ্য হবে। নাফিস পরিকল্পনার একপর্যায়ে এও বলেছে, সে আত্মঘাতী হামলা চালাবে এবং এর আগে শেষবারের মতো স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে সে বাংলাদেশে আসবে। এফবিআই প্রথমে এই প্রস্তাবে রাজি হলেও পরে কৌশলে তাকে নিবৃত্ত করে।
এফবিআইয়ের প্রতিবেদন : আদালতে পেশ করা গোয়েন্দা সংস্থাটির ২১ পৃষ্ঠার প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে কিভাবে নাফিস সরল বিশ্বাসে গোয়েন্দাদের আল-কায়েদার লোক মনে করে পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়েছে। নাফিসের সঙ্গে কথোপকথনের সব তথ্য রেকর্ড করা আছে বলেও তারা জানিয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, ৫ জুলাই নাফিস এফবিআইয়ের এক চরকে টেলিফোনে বলে, সে যুক্তরাষ্ট্রে জিহাদ সংঘটিত করতে চায় এবং তার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রে তার একজন সহযোগী এবং বাংলাদেশে একজন 'ভাই' রয়েছে। পরদিনও নাফিস বলে, অন্য উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রে ঢুকে জিহাদ সংঘটিত করার ব্যাপারে ইসলামে বিধিনিষেধ নেই বলে বাংলাদেশের একজন তাকে জানিয়েছে। ১১ জুলাই নাফিস জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের একজন 'হাই র‌্যাংকিং অফিসিয়াল'কে সে হত্যা করতে চায়।
১৪ জুলাই নাফিস এফবিআইয়ের চরকে জানায়, সে ২০১২ সালের ডিসেম্বরের দিকে বাংলাদেশে ফিরে 'আল-কায়েদা' থেকে প্রশিক্ষণ নিতে চায়। ১৯ জুলাই 'করিম' (ইউসি) নাম দিয়ে আল-কায়েদা পরিচয়ে আরেকজন গোয়েন্দা নাফিসের সঙ্গে কথা বলেন। ২৭ আগস্ট নাফিস মন্তব্য করে, তার সাম্প্রতিক যোগাযোগের ভিত্তিতে এ বিশ্বাস জন্মেছে, সে এখন আল-কায়েদার সদস্য। ১৫ সেপ্টেম্বর নাফিস জানায়, সে আত্মঘাতী হামলা চালাবে এবং এর আগে সে বাংলাদেশে আসবে স্বজনদের সঙ্গে দেখা করতে। গোয়েন্দারা কৌশলে নাফিসকে এ থেকে নিবৃত্ত করেন। ২৭ সেপ্টেম্বর নাফিস এক প্রশ্নের উত্তরে ছদ্মবেশধারী গোয়েন্দাদের বলে, তার হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের নভেম্বরের নির্বাচন যে ব্যাহত হতে পারে- এ বিষয়টি তারও মাথায় আছে। ১২ অক্টোবর নাফিস ও ইউসি (এফবিআই গোয়েন্দা, নাফিস যাকে মনে করেছিল আল-কায়েদার লোক) দুজনে মিলেই বিস্ফোরক কিনতে যায়। ওই দিনই নাফিস একটি লেখা দেয় আল-কায়েদার ম্যাগাজিন 'ইন্সপায়ার'-এ ছাপানোর জন্য। এতে নাফিস এক জায়গায় বলে, 'আমাদের প্রিয় নেতা ওসামা বিন লাদেন।' চূড়ান্ত হামলার দিন ১৭ অক্টোবর বুধবার সকালে নাফিস এফবিআইয়ের চর 'ইউসি'কে নিয়েই হামলার স্থলে যায় পূর্ণ প্রস্তুতি নিয়ে। নিউ ইয়র্ক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সামনে 'বিস্ফোরক'বাহী গাড়ি রেখে নাফিস ও ইউসি পাশের একটি হোটেলে ঢোকে। সেখানে নাফিস মুখ ঢেকে, সানগ্লাস পরে এবং কণ্ঠ নকল করে একটি ভিডিও বার্তা রেকর্ড করে। এতে নাফিস বলে, 'বিজয় বা শাহাদাত অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা থামব না।' ভিডিওটি ধারণ করার পর নাফিস সেলুলার টেলিফোনে একাধিক কল করে বিস্ফোরণ ঘটানোর চেষ্টা করে। এর ফলে ডেটোনেটর সচল হয়ে যায় এবং ইউসিসহ অন্য গোয়েন্দারা নাফিসকে গ্রেপ্তার করেন।
এদিকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক মার্কিন কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আল-কায়েদাই যে নাফিসকে পরিচালনা করেছে, এমন কোনো প্রমাণ এফবিআই কর্মকর্তারা এখনো দেখাতে পারেননি। যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসের হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির চেয়ারম্যান পিটার কিং স্থানীয় সাংবাদিকদের বলেন, কাজী নাফিস গ্রেপ্তার হওয়ার ঘটনায় আবারও প্রমাণিত হলো যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীচক্র এখনো যুক্তরাষ্ট্রে মারাত্মক আঘাত হানার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত।
ঢাকার যাত্রাবাড়ীতে বাসা : নাফিসের পরিবারের বাসা ১০৭/৪ উত্তর যাত্রাবাড়ী। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, বাসায় পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে নাফিস সম্পর্কে তাঁরা বিভিন্ন তথ্য নিচ্ছেন। মনিরুল ইসলাম কালের কণ্ঠকে বলেন, নাফিসের বাবা কাজী মো. আহসান উল্লাহ ন্যাশনাল ব্যাংকের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। নাফিসরা এক ভাই ও এক বোন। বোন পেশায় ডাক্তার। যাত্রাবাড়ীর বর্তমান বাসা নাফিসের নানার। বিভিন্ন সূত্রে নাফিসের পৈতৃক বাড়ি নোয়াখালী বলা হলেও এ ব্যাপারে এখনো পর্যন্ত কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
পরিবারের সদস্যরা জানান, ২০০৬ সালে মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এসএসসি এবং ২০০৮ সালে ঢাকা কলেজ থেকে জিপিএ ৪ পেয়ে এইচএসসি পাস করে নাফিস। এরপর নাফিস নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে ছয় সেমিস্টার শেষ করে যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেয়। পারিবারিক সূত্র মতে, গত বছর এক নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে নাফিস স্টুডেন্ট ভিসায় যুক্তরাষ্ট্রে যায়। স্টেট ইউনিভার্সিটি অফ মিসৌরিতে পড়াশোনা করার কথা থাকলেও পরে সে নিউ ইয়র্কে পড়াশোনার জন্য চলে আসে।
গতকাল সকালে নাফিসের খবর জানার পর তার পরিবারের সদস্যরা কান্নায় ভেঙে পড়েন। নাফিসের বাবা ব্যাংকার কাজী মো. আহসান উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, 'আমার ছেলে এমন কাজ করতে পারে না। তাকে ফাঁসানো হয়েছে। এটা ষড়যন্ত্র। সে কোনো ধর্মীয় উগ্রতায় বিশ্বাসী নয়। নাফিস আমাদের পরিবারের গর্ব।' নাফিসের ভগ্নিপতি বলেন, 'দেশে নাফিসের মধ্যে আমরা কোনো রকম উগ্রতা দেখিনি। নাফিস পড়াশোনায় নিবেদিত ছিল। পরিবারের সবার সঙ্গে তার ভালো সম্পর্ক আছে।'
এদিকে নাফিসের বাবা বাংলাদেশ সরকারের কাছে আর্জি জানিয়েছেন, ছেলেকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য। তিনি মার্কিন সরকারের কাছেও ছেলেকে ফেরত চেয়ে এবং ঘটনার সঠিকভাবে বিচার করার জন্য আবেদন জানাবেন বলে জানিয়েছেন।
ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত আকরামুল কাদের জানিয়েছেন, নাফিস নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যামাইকায় বসবাস করত বলে তাঁরা জানতে পেরেছেন। তার সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য উদ্ঘাটনের চেষ্টা করছেন তাঁরা।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি এ কে মোমেন বলেন, নাফিস যদি বাঙালি হয়েও থাকে, তবে নাফিসের কাজ বিচ্ছিন্ন একটি ঘটনা। বাংলাদেশের মানুষ এবং সরকার কখনোই সন্ত্রাসবাদে বিশ্বাসী নয়। অথচ মিডিয়ায় বাংলাদেশের নাম ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে বলে অভিযোগ করেন রাষ্ট্রদূত।
আতঙ্ক, অস্বস্তি : বুধবার ম্যানহাটানে নাফিস গ্রেপ্তার হওয়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের সব গণমাধ্যম একে ফলাও করে প্রচার করে। অনেকে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। নতুন করে অস্বস্তিতে পড়েন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাংলাদেশিরা। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে টুইন টাওয়ারে হামলার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে বাংলাদেশি-আমেরিকানদের নানা ধরনের বিপদের সম্মুখীন হতে হয়েছে। এ ছাড়া টুইন টাওয়ারে হামলার অভিযোগ তুলে আল-কায়েদা নির্মূলের জন্য আফগানিস্তানে মার্কিন সেনাদের বিধ্বংসী যুদ্ধের কথা ভুলে যায়নি সারা বিশ্ব। তেমন শঙ্কা অনুভব করছেন প্রবাসী বাংলাদেশি ও স্থানীয় বাংলাদেশি নাগরিকরা।

No comments

Powered by Blogger.