সরকারকে বিরোধী দলের বন্ধুই মনে হলো by মাহবুব মিঠু
নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে মজার মজার সার্কাস হয়ে গেল। ধরি মাছ না ছুঁই পানি করে সরকার বেশ কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘোমটার নিচে নাচ দিলেও শেষ পর্যন্ত ঘোমটা খুলে দেখিয়ে দিলেন আইভীর মতো সজ্জন লোকের চেয়ে দলে শামীম ওসমানদের মতো লোকদের কদরই বেশি। সেনা মোতায়নের ব্যাপারে শামীম ওসমান বাদে বাকি প্রার্থীদের জোর দাবি সত্ত্বেও সেটা করতে না পারায় বোঝা গেল ঘুড্ডি ততোটুকুই স্বাধীন যতোটুকু লাটাইধারী ব্যক্তি সূতো ছাড়তে ইচ্ছুক।
লাটাই হাতে না পেয়ে ঘুড্ডির মতো একটু আকাশে উড়েই স্বাধীন স্বাধীন বলে চিতকার করাটা যে বড্ড বোকামি সে কথা বলে আর নির্বাচন কমিশনকে লজ্জা দিলাম না। নকল জিনিস আসল হিসেবে প্রচার করতে গেলে যেমন একটু বাড়াবাড়ি করতে হয়, বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনের জন্য, সে রকম ক্ষমতাহীন নির্বাচন কমিশন নিজেদের মেকি ক্ষমতাকে আসল প্রমাণ করতে গিয়ে মাঝে মাঝে দায়িত্বের বাইরে কথা বলে সমালোচিতও হয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের টাকা নিয়ে ভোট না দেবার আহবানকে তার পদের সাথে মেলানো যায়নি।
মেঘ বেশি গর্জন করলে ভাবার কোনো কারণ নেই যে মুষলধারে বৃষ্টি হবে। বরং মেঘের এই গর্জন তার বৃষ্টি দিতে না পারার অক্ষমতার অসহায় কষ্ট প্রকাশ। আমরা দুঃখিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার! এরপরে আপনাদের হুংকারে আর কখনো সাময়িক আশান্বিত হবো না। বরঞ্চ দুঃখ পাবো দন্তহীন বাঘের অসহায় চিৎকার শুনে।
এর বাইরে, নির্বাচনের শুরু থেকে নির্বাচনী প্রচারে তৈমূরের ঢিলেমি এবং পরে ঝাপিয়ে পড়ে আবার দপ করে নিভে যাওয়াটাও একটা নির্বাচনী সার্কাস। সত্যিই যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবার ইচ্ছা থাকতো তবে খামোখা সেনাবাহিনী না দিয়ে বিতর্কিত হতে গেল কেন সরকার? শামীম ওসমান চায়নি বলে? অনেকে বলছেন যে, শামীমের আস্থাভাজন দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন নাকি বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলে যেটা শামীম ওসমানের পছন্দ হয়নি। তাই সেনাবাহিনী মোতায়েন করার মতো আরেকটি বাড়াবাড়ি কাজ থেকে সরকার কমিশনকে নিবৃত্ত করে।
সেনা মোতায়েন না করে নির্বাচন কমিশনকে ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে সরকার প্রকারান্তরে বিরোধী জোটের করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার আন্দোলনকেই যৌক্তিকতা দিয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় দিলো। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের চলমান আন্দোলন আরও জোরদার হতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে আখেরে বিপদ ডেকে আনবে সেটা সরকার আরো একবার বুঝিয়ে দিল। আরও বোঝা গেল নির্বাচন কমিশনের মতো দন্তহীন বাঘের বিরুদ্ধে দলীয় সরকার বেকে বসলে কিছু করার নেই।
জনগণের কাছে পরিস্কার হলো কয়েকটি বিষয়, এগুলো হচ্ছে সন্ত্রাসীরা এখনো রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। খুলনার নুরু এবং মুক্তার পরে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান যেমন প্রমাণ করে সরকারের সন্ত্রাসী-প্রীতি, তেমনি খুলনার শিবির নুরু ঘটনা প্রমাণ করে প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে দলের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢোকানোর অপতৎপরতা।
বিভিন্ন সূত্রে গত কয়েকদিন ধরে আলাপ করে জানা গেছে যে, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের গভীর একটা ষড়যন্ত্র কাজ করছিল। তৈমুর বাদে বাকি দুজন শক্তিশালী প্রার্থী উভয়েই আওয়ামি লীগের। শুরু থেকে দলীয় র্প্রার্থী নির্বাচনে যে লুকোচুরি চলছিল সেটা আসলে ছিল মহা পরিকল্পনার অংশ। পরিস্থিতি বুঝে যেভাবেই হোক শামীম ওসমানকেই জিতিয়ে আনার চেষ্টা করা হোত। সে রকম কিছু ঘটলে আরেকটা মাগুরা নির্বাচন জনগণ দেখতে পেত। আইভীর প্রতি যেভাবে গণজোয়ার তৈরি হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই জোয়ারে তার দলীয় পরিচয় হারিয়ে গিয়ে আইভী হয়ে পড়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা আইকন। তাই আইভী জিতে আসলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। যেহেতু আইভী আওয়ামি লীগেরই লোক এবং দলের কেউ কেউ আইভীর পক্ষ নিয়ে নির্বাচনে কাজও করেছে, সেকারণে আইভীর বিজয় সরকার তার নিজের বিজয় বলে চালিয়ে দিতে পারতো। এ দুজনের বাইরে তৈমূর জিতে গেলেও সরকারের কোনো ক্ষতি ছিল না। তখন জোর গলায় বলতে পারতো, দলের অধীনেও নিরপেক্ষ এবং সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন সম্ভব। এভাবে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেত।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতো সব সুবিধাজনক অবস্থানকে শুধুমাত্র সেনা মোতায়েন না করে তৈমুরের নির্বাচন থেকে সরে আসার সুযোগ করে দিয়ে সরকার হাত ছাড়া করলো কেন? এ বিষয়ে দুটো গুঞ্জন আছে। প্রথমটি হলো, দলের ভিতরের একটা অংশের চাপ, যারা কিনা যে কোনো প্রকারে শামীমকে জিতিয়ে আনতে চেয়েছিল। সেনা মোতায়েন করে সে পথে তারা বাধা সৃষ্টি করতে চায়নি। অন্য গুঞ্জনটি হলো, সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনার একটা উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকে আরও গ্র্রহণযোগ্য করার জন্য সেনা মোতায়েন ছাড়াই যে সেটা সম্ভব তা প্রমাণ করা।
এখন প্রশ্ন থাকে বিএনপি কেন নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালো? রাজনীতির বেশীরভাগ সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো কারণ এক সঙ্গে কাজ করে। বিশেষ করে, আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক অবিশ্বাসের সম্পর্ক। কোনো সিদ্ধান্তের সঠিক একক কারণ খুঁজে পাওয়া যেমন দুষ্কর তেমনি অনেক সময় বহু পরস্পর বিরোধী কারণও একযোগে কাজ করে কোন সিদ্ধান্ত নেবার পিছনে। যেমনটি শোনা যাচ্ছে, বিএনপি আইভী-সুনামি হবে বুঝতে পেরে আগেভাগে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে পরাজয়ের গ্লানি থেকে দূরে থাকল।
আরেকটি কানাঘুসা আছে, একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দলের ভেতরের কেউ কেউ দলীয় প্রধানকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে এবং ইভিএম পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই সাথে সরকারের অধীনে ও ইভিএম পদ্ধতি মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া গতিপ্রাপ্ত আন্দোলনের বুকে ছুরি মারার শামিল।
তৈমুর জিতে গেলেও সারা দেশের প্রেক্ষিতে সেটা হবে দলের জন্য বড় পরাজয়। তৈমুরের বিজয় হবে আসলে সরকারের কৌশলের বিজয়। যে কৌশলের মাধ্যমে সরকার এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে পারবে। সরকার বলতে পারবে আমাদের অধীনে নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ। ইভিএম পদ্ধতির কার্যকারিতাও সেই সঙ্গে মেনে নেওয়া হবে। সব কিছু চিন্তা করে সরকারের দেওয়া সেনা মোতায়েন না করার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিএনপি তৈমূরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাচন থেকে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ায়।
বিএনপির অভিযোগ ছিল, সেনা মোতায়েন না করায় নির্বাচনে সন্ত্রাস সৃষ্টিরই ইঙ্গিত দেয়।
অপর প্রার্থী আইভীর আশংকাও সে সত্যকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে। যেখানে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আইভী বলছেন, সন্ত্রাসী দুই ভাই শামীম ও সেলিম ওসমান বিভিন্নভাবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের দিনেও তিনি বলেছেন, রায় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের অতীত এবং বর্তমান কীর্তি এতোই দীপ্তিমান যে, সন্ত্রাস এবং ওনারা দুইভাই বিষয়ক যে কোনো কথাবার্তাই সত্যমিথ্যা যাই হোক সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল দুটো জিনিস হারিয়েছে। প্রথমত, আইভীকে সমর্থন না দিয়ে দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করা এবং দ্বিতীয়ত সেনা মোতায়েনে অসম্মতি করে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কৃতিত্ব না নিতে পারা। তৈমূরবিহীন নির্বাচন যতোই অবাধ হোক না কেন ছন্দপতন ঘটেছে। নারায়নগঞ্জ নির্বাচনের ফলাফল রাজনীতিতে ‘টপ ডাইন’ সিদ্ধান্তের প্রতি স্থানীয় কর্মীদের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। তৃণমূলের কর্মীদের মতামত এবং সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব না দিলে কি ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে এটা তারই উদাহরণ। রাজনৈতিক কর্মী এবং জনগণের এই ইতিবাচক ধারা ও মানসিকতা যদি পরবর্তীতে দেশের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সারা দেশে ভাল মানুষের রাজনীতিতে ফিরে আসা যেমন বেড়ে যাবে তেমনি টাকা বা তথাকথিত ডোনেশনের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের নোঙরা খেলাও বন্ধ হবে। সাবাশ নারায়ণগঞ্জবাসী!
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে দুটো বিষয় দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করতে হবে। প্রথমত, সেনা মোতায়েন বিষয়ে সরকার যেভাবে তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে হস্তক্ষেপ করেছে সেটার আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের সাংবিধানিক ক্ষমতার কার্যকারিতাকে প্রমাণ করে কমিশনের উপরে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, শামীম বলেছেন, তিনি তার উপরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও দায়ের করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছে, অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অভিযোগ মিথ্যা হলে শামীম ওসমানের প্রার্থিতা বাতিল হবে। এর পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারা দেশেই কোনো জঙ্গি নাই। শামীম ওসমান নির্বাচনে জেতেননি। কিন্তু তারপরেও এ ধরনের অভিযোগের যদি কোনো ভিত্তি পাওয়া না যায় তবে তার বিরুদ্ধে আর কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটা বের করতে হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভীতি সৃষ্টির জন্য অহেতুক অভিযোগের মাত্রা কমে যাবে।
নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো কা- ঘটিয়ে এই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়াটা তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না যতোটুকু গুরুত্ব পেত তৈমূর সরে না দাঁড়ালে। প্রশ্ন এখানে থেকেই যায়, তৈমূর সরে না দাঁড়ালে কি ঘটতো? শামীম তো তার মাত্র একদিন আগেই সাংবাদিকদের সামনে বলেছিল, তিনি নাকি দৌড় দিলে পুরো নারায়ণগঞ্জ খালি হয়ে যাবে। নিজের পরিচয় তিনি আরও একবার দিলো এভাবে, তাকে যেন পূর্বের ভূমিকায় ফিরে যেতে বাধ্য করা না হয়।
প্রথম দিকে নির্বাচনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য সরকারের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সেনা মোতায়েন বিষয়ক জটিলতায় যখন নির্বাচন কমিশন নাড়াচাড়া দেয়া শুরু করলো তখন সরকার এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেনার বিকল্প হিসেবে র্যাব মোতায়েন করে। কমিশনের অনুরোধে সেনা মোতায়েন করা ছিল সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এক নারায়ণগঞ্জ বিষয়ে যখন তারা সেই দায়িত্ব থেকে সরে আসল তখন পুনর্বার ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদের অধীনে পুরো দেশের নির্বাচন করাটা কতোটুকু ঝুকিপূর্ণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে রাজনীতিতে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে সেই বিশ্বাষযোগ্যতা এক দল আরেক দলের আনতে পারে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে কমিশনের সেই সাংবিধানিক ক্ষমতাকেই অবজ্ঞা করেছে। তিনি এখানেই ভয়ের আশংকা করেছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার মুখে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বললেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
এ যেন এক নিঃশব্দ সুনামি। যে সুনামিতে ভেসে গেছে সন্ত্রাসী আর তাদের পৃষ্ঠপোষকদের চাপিয়ে দেওয়া স্বিদ্ধান্ত। আইভীর জিতে যাওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য একটা সতর্ক সংকেত। নির্বাচনের আগে জনগণ ভয়ে যতো কথাই বলুক না কেন, নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলে মানুষ শান্তির পক্ষে। যেখানে আওয়ামি লীগের পুরো টিম বলতে গেলে শামীমের পক্ষে কাজ করেছে, প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে, কিন্তু আখেরে জিতলো ভালো ইমেজের আইভী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক এই ধারা নারায়ণগঞ্জ থেকেই শুরু হোক। রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাসী তোষণ এবং পোষণ থেকে সরে আসুক। নারায়ণগঞ্জবাসীর মতো সারা দেশবাসীর সেটাই কাম্য।
মেঘ বেশি গর্জন করলে ভাবার কোনো কারণ নেই যে মুষলধারে বৃষ্টি হবে। বরং মেঘের এই গর্জন তার বৃষ্টি দিতে না পারার অক্ষমতার অসহায় কষ্ট প্রকাশ। আমরা দুঃখিত প্রধান নির্বাচন কমিশনার! এরপরে আপনাদের হুংকারে আর কখনো সাময়িক আশান্বিত হবো না। বরঞ্চ দুঃখ পাবো দন্তহীন বাঘের অসহায় চিৎকার শুনে।
এর বাইরে, নির্বাচনের শুরু থেকে নির্বাচনী প্রচারে তৈমূরের ঢিলেমি এবং পরে ঝাপিয়ে পড়ে আবার দপ করে নিভে যাওয়াটাও একটা নির্বাচনী সার্কাস। সত্যিই যদি নিরপেক্ষ নির্বাচন দেবার ইচ্ছা থাকতো তবে খামোখা সেনাবাহিনী না দিয়ে বিতর্কিত হতে গেল কেন সরকার? শামীম ওসমান চায়নি বলে? অনেকে বলছেন যে, শামীমের আস্থাভাজন দুজন পুলিশ কর্মকর্তাকে বদলি করে দিয়ে নির্বাচন কমিশন নাকি বেশ বাড়াবাড়ি করে ফেলে যেটা শামীম ওসমানের পছন্দ হয়নি। তাই সেনাবাহিনী মোতায়েন করার মতো আরেকটি বাড়াবাড়ি কাজ থেকে সরকার কমিশনকে নিবৃত্ত করে।
সেনা মোতায়েন না করে নির্বাচন কমিশনকে ঠুটো জগন্নাথ বানিয়ে সরকার প্রকারান্তরে বিরোধী জোটের করা তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বহাল রাখার আন্দোলনকেই যৌক্তিকতা দিয়ে বন্ধুত্বের পরিচয় দিলো। এর মাধ্যমে বিরোধী দলের চলমান আন্দোলন আরও জোরদার হতে পারে। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন যে আখেরে বিপদ ডেকে আনবে সেটা সরকার আরো একবার বুঝিয়ে দিল। আরও বোঝা গেল নির্বাচন কমিশনের মতো দন্তহীন বাঘের বিরুদ্ধে দলীয় সরকার বেকে বসলে কিছু করার নেই।
জনগণের কাছে পরিস্কার হলো কয়েকটি বিষয়, এগুলো হচ্ছে সন্ত্রাসীরা এখনো রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। খুলনার নুরু এবং মুক্তার পরে নারায়ণগঞ্জের শামীম ওসমান যেমন প্রমাণ করে সরকারের সন্ত্রাসী-প্রীতি, তেমনি খুলনার শিবির নুরু ঘটনা প্রমাণ করে প্রগতিশীলতার ছদ্মবেশে দলের ভেতরে প্রতিক্রিয়াশীলতা ঢোকানোর অপতৎপরতা।
বিভিন্ন সূত্রে গত কয়েকদিন ধরে আলাপ করে জানা গেছে যে, নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনকে ঘিরে সরকারের গভীর একটা ষড়যন্ত্র কাজ করছিল। তৈমুর বাদে বাকি দুজন শক্তিশালী প্রার্থী উভয়েই আওয়ামি লীগের। শুরু থেকে দলীয় র্প্রার্থী নির্বাচনে যে লুকোচুরি চলছিল সেটা আসলে ছিল মহা পরিকল্পনার অংশ। পরিস্থিতি বুঝে যেভাবেই হোক শামীম ওসমানকেই জিতিয়ে আনার চেষ্টা করা হোত। সে রকম কিছু ঘটলে আরেকটা মাগুরা নির্বাচন জনগণ দেখতে পেত। আইভীর প্রতি যেভাবে গণজোয়ার তৈরি হচ্ছিল, শেষ পর্যন্ত সেই জোয়ারে তার দলীয় পরিচয় হারিয়ে গিয়ে আইভী হয়ে পড়ে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে একটা আইকন। তাই আইভী জিতে আসলেও কোনো ক্ষতি ছিল না। যেহেতু আইভী আওয়ামি লীগেরই লোক এবং দলের কেউ কেউ আইভীর পক্ষ নিয়ে নির্বাচনে কাজও করেছে, সেকারণে আইভীর বিজয় সরকার তার নিজের বিজয় বলে চালিয়ে দিতে পারতো। এ দুজনের বাইরে তৈমূর জিতে গেলেও সরকারের কোনো ক্ষতি ছিল না। তখন জোর গলায় বলতে পারতো, দলের অধীনেও নিরপেক্ষ এবং সন্ত্রাসমুক্ত নির্বাচন সম্ভব। এভাবে তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুতে বিরোধী দলের আন্দোলনকে প্রশ্নবিদ্ধ করা যেত।
কিন্তু কথা হচ্ছে, এতো সব সুবিধাজনক অবস্থানকে শুধুমাত্র সেনা মোতায়েন না করে তৈমুরের নির্বাচন থেকে সরে আসার সুযোগ করে দিয়ে সরকার হাত ছাড়া করলো কেন? এ বিষয়ে দুটো গুঞ্জন আছে। প্রথমটি হলো, দলের ভিতরের একটা অংশের চাপ, যারা কিনা যে কোনো প্রকারে শামীমকে জিতিয়ে আনতে চেয়েছিল। সেনা মোতায়েন করে সে পথে তারা বাধা সৃষ্টি করতে চায়নি। অন্য গুঞ্জনটি হলো, সরকার বিশেষ করে শেখ হাসিনার একটা উদ্দেশ্য ছিল নির্বাচনকে আরও গ্র্রহণযোগ্য করার জন্য সেনা মোতায়েন ছাড়াই যে সেটা সম্ভব তা প্রমাণ করা।
এখন প্রশ্ন থাকে বিএনপি কেন নির্বাচন থেকে সরে দাড়ালো? রাজনীতির বেশীরভাগ সিদ্ধান্তের পেছনে অনেকগুলো কারণ এক সঙ্গে কাজ করে। বিশেষ করে, আমাদের মতো দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে রয়েছে ব্যাপক অবিশ্বাসের সম্পর্ক। কোনো সিদ্ধান্তের সঠিক একক কারণ খুঁজে পাওয়া যেমন দুষ্কর তেমনি অনেক সময় বহু পরস্পর বিরোধী কারণও একযোগে কাজ করে কোন সিদ্ধান্ত নেবার পিছনে। যেমনটি শোনা যাচ্ছে, বিএনপি আইভী-সুনামি হবে বুঝতে পেরে আগেভাগে নিজেদের সরিয়ে নিয়ে পরাজয়ের গ্লানি থেকে দূরে থাকল।
আরেকটি কানাঘুসা আছে, একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে দলের ভেতরের কেউ কেউ দলীয় প্রধানকে বুঝাতে সক্ষম হয়েছে যে, একই সঙ্গে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির পক্ষে এবং ইভিএম পদ্ধতির বিরুদ্ধে আন্দোলন এবং সেই সাথে সরকারের অধীনে ও ইভিএম পদ্ধতি মেনে নিয়ে নির্বাচনে যাওয়া গতিপ্রাপ্ত আন্দোলনের বুকে ছুরি মারার শামিল।
তৈমুর জিতে গেলেও সারা দেশের প্রেক্ষিতে সেটা হবে দলের জন্য বড় পরাজয়। তৈমুরের বিজয় হবে আসলে সরকারের কৌশলের বিজয়। যে কৌশলের মাধ্যমে সরকার এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে পারবে। সরকার বলতে পারবে আমাদের অধীনে নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ। ইভিএম পদ্ধতির কার্যকারিতাও সেই সঙ্গে মেনে নেওয়া হবে। সব কিছু চিন্তা করে সরকারের দেওয়া সেনা মোতায়েন না করার সুযোগ পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে বিএনপি তৈমূরের অনিচ্ছা সত্ত্বেও নির্বাচন থেকে শেষ মুহূর্তে সরে দাঁড়ায়।
বিএনপির অভিযোগ ছিল, সেনা মোতায়েন না করায় নির্বাচনে সন্ত্রাস সৃষ্টিরই ইঙ্গিত দেয়।
অপর প্রার্থী আইভীর আশংকাও সে সত্যকে বিশ্বাসযোগ্যতা দিয়েছে। যেখানে নিজ দলের বিদ্রোহী প্রার্থী আইভী বলছেন, সন্ত্রাসী দুই ভাই শামীম ও সেলিম ওসমান বিভিন্নভাবে সন্ত্রাসের মাধ্যমে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। নির্বাচনের দিনেও তিনি বলেছেন, রায় ছিনতাই হয়ে যেতে পারে। ওসমান ভ্রাতৃদ্বয়ের অতীত এবং বর্তমান কীর্তি এতোই দীপ্তিমান যে, সন্ত্রাস এবং ওনারা দুইভাই বিষয়ক যে কোনো কথাবার্তাই সত্যমিথ্যা যাই হোক সেটা বিশ্বাসযোগ্যতা পাবে।
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল দুটো জিনিস হারিয়েছে। প্রথমত, আইভীকে সমর্থন না দিয়ে দলের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণœ করা এবং দ্বিতীয়ত সেনা মোতায়েনে অসম্মতি করে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কৃতিত্ব না নিতে পারা। তৈমূরবিহীন নির্বাচন যতোই অবাধ হোক না কেন ছন্দপতন ঘটেছে। নারায়নগঞ্জ নির্বাচনের ফলাফল রাজনীতিতে ‘টপ ডাইন’ সিদ্ধান্তের প্রতি স্থানীয় কর্মীদের অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ। তৃণমূলের কর্মীদের মতামত এবং সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব না দিলে কি ভয়াবহ বিপর্যয় আসতে পারে এটা তারই উদাহরণ। রাজনৈতিক কর্মী এবং জনগণের এই ইতিবাচক ধারা ও মানসিকতা যদি পরবর্তীতে দেশের সব অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে তাহলে সারা দেশে ভাল মানুষের রাজনীতিতে ফিরে আসা যেমন বেড়ে যাবে তেমনি টাকা বা তথাকথিত ডোনেশনের মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচনের নোঙরা খেলাও বন্ধ হবে। সাবাশ নারায়ণগঞ্জবাসী!
নারায়ণগঞ্জ নির্বাচন নিয়ে নির্বাচন কমিশনকে দুটো বিষয় দেশবাসীর কাছে প্রমাণ করতে হবে। প্রথমত, সেনা মোতায়েন বিষয়ে সরকার যেভাবে তার সাংবিধানিক ক্ষমতাকে হস্তক্ষেপ করেছে সেটার আইনানুগ ব্যবস্থা নিয়ে নিজেদের সাংবিধানিক ক্ষমতার কার্যকারিতাকে প্রমাণ করে কমিশনের উপরে জনগণের আস্থা ফিরিয়ে আনা। দ্বিতীয়ত, শামীম বলেছেন, তিনি তার উপরে জঙ্গি হামলার আশঙ্কা করছে এবং এ ব্যাপারে নির্বাচন কমিশনে অভিযোগও দায়ের করেছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছে, অভিযোগ সত্য হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর অভিযোগ মিথ্যা হলে শামীম ওসমানের প্রার্থিতা বাতিল হবে। এর পরপরই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, শুধু নারায়ণগঞ্জ নয়, সারা দেশেই কোনো জঙ্গি নাই। শামীম ওসমান নির্বাচনে জেতেননি। কিন্তু তারপরেও এ ধরনের অভিযোগের যদি কোনো ভিত্তি পাওয়া না যায় তবে তার বিরুদ্ধে আর কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যায় সেটা বের করতে হবে। এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে প্রার্থীদের পক্ষ থেকে ভীতি সৃষ্টির জন্য অহেতুক অভিযোগের মাত্রা কমে যাবে।
নির্বাচন শেষ পর্যন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে। কিন্তু অনেকগুলো কা- ঘটিয়ে এই সুষ্ঠু নির্বাচন সম্পন্ন হওয়াটা তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না যতোটুকু গুরুত্ব পেত তৈমূর সরে না দাঁড়ালে। প্রশ্ন এখানে থেকেই যায়, তৈমূর সরে না দাঁড়ালে কি ঘটতো? শামীম তো তার মাত্র একদিন আগেই সাংবাদিকদের সামনে বলেছিল, তিনি নাকি দৌড় দিলে পুরো নারায়ণগঞ্জ খালি হয়ে যাবে। নিজের পরিচয় তিনি আরও একবার দিলো এভাবে, তাকে যেন পূর্বের ভূমিকায় ফিরে যেতে বাধ্য করা না হয়।
প্রথম দিকে নির্বাচনকে সন্ত্রাসমুক্ত করার জন্য সরকারের তেমন উদ্যোগ চোখে পড়েনি। সেনা মোতায়েন বিষয়ক জটিলতায় যখন নির্বাচন কমিশন নাড়াচাড়া দেয়া শুরু করলো তখন সরকার এক প্রকার বাধ্য হয়েই সেনার বিকল্প হিসেবে র্যাব মোতায়েন করে। কমিশনের অনুরোধে সেনা মোতায়েন করা ছিল সরকারের সাংবিধানিক দায়িত্ব। এক নারায়ণগঞ্জ বিষয়ে যখন তারা সেই দায়িত্ব থেকে সরে আসল তখন পুনর্বার ক্ষমতায় যাবার জন্য তাদের অধীনে পুরো দেশের নির্বাচন করাটা কতোটুকু ঝুকিপূর্ণ সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। আমাদের দেশে রাজনীতিতে এমন কোনো উদাহরণ নেই যে সেই বিশ্বাষযোগ্যতা এক দল আরেক দলের আনতে পারে।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান বলেন, সাংবিধানিক ক্ষমতাবলে নির্বাচন কমিশন সেনা মোতায়েন করতে চেয়েছিল। কিন্তু সরকার তাতে সাড়া না দিয়ে কমিশনের সেই সাংবিধানিক ক্ষমতাকেই অবজ্ঞা করেছে। তিনি এখানেই ভয়ের আশংকা করেছেন। তিনি সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, সরকার মুখে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার কথা বললেও তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
এ যেন এক নিঃশব্দ সুনামি। যে সুনামিতে ভেসে গেছে সন্ত্রাসী আর তাদের পৃষ্ঠপোষকদের চাপিয়ে দেওয়া স্বিদ্ধান্ত। আইভীর জিতে যাওয়া রাজনীতিবিদদের জন্য একটা সতর্ক সংকেত। নির্বাচনের আগে জনগণ ভয়ে যতো কথাই বলুক না কেন, নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষ হলে মানুষ শান্তির পক্ষে। যেখানে আওয়ামি লীগের পুরো টিম বলতে গেলে শামীমের পক্ষে কাজ করেছে, প্রকাশ্য সমর্থন জানিয়েছে, কিন্তু আখেরে জিতলো ভালো ইমেজের আইভী। বাংলাদেশের রাজনীতিতে ইতিবাচক এই ধারা নারায়ণগঞ্জ থেকেই শুরু হোক। রাজনৈতিক দলগুলো সন্ত্রাসী তোষণ এবং পোষণ থেকে সরে আসুক। নারায়ণগঞ্জবাসীর মতো সারা দেশবাসীর সেটাই কাম্য।
No comments