অনেক নাটক, অতঃপর শামীম-আইভী প্রতিদ্বন্দ্বী by পাভেল হায়দার চৌধুরী

নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র পদে শেষ পর্যন্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতা হলো সেলিনা হায়াত আইভী ও শামীম ওসমানের মধ্যে। বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে এই দুজনের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতার পথ তৈরি হয়।সরকারি দল আওয়ামী লীগের এই দুই প্রার্থীর মধ্যে শামীম ওসমান দলীয় সমর্থন পেলেও ভোটারদের রায়ে শেষ হাসিটি হাসলেন সেলিনা হায়াত আইভী।স্থানীয় রাজনৈতিক মহল মনে করছেন, আইভীর এই বিজয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন বিএনপি সমর্থিত মেয়র পদপ্রার্থী তৈমূর আলম খন্দকার। তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর কারণে তাঁর ভোট পেয়েছেন আইভী।


ভোটের আগের দিন মধ্যরাতে বিএনপি নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত নেয়। দলের এ সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান তৈমূর।
নবগঠিত এই নগর সংস্থার নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগ কাকে সমর্থন দেবে_এ নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি হয় প্রথম দিকে। চলতি মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় বৈঠক করেও মেয়র প্রার্থীর ব্যাপারে সমঝোতায় আসতে পারেনি আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্ব।
দফায় দফায় বৈঠক : নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক শামীম ওসমান ও শহর আওয়ামী লীগের নেতা আইভী_এ দুজনের মধ্যে কাকে সমর্থন দেওয়া হবে, এ নিয়ে দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের মাসজুড়ে দফায় দফায় বৈঠক হয়। তাঁরা কখনো শামীম, কখনো আইভীর প্রতি ঝুঁকেছিলেন।
২ অক্টোবর প্রথম নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী দুই পরিবারের সদস্য শামীম ও আইভীকে নিয়ে গণভবনে বসেছিলেন আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন কোনো সমঝোতা হয়নি। তার পরদিন শনিবারও এ বিষয়ে দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা।
৯ অক্টোবর : শামীম ও আইভীকে সমঝোতায় আনার দায়িত্ব পড়ে সংসদ উপনেতা ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী, ওবায়দুল কাদের ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফকে। ৯ অক্টোবর তাঁরা প্রথমে বৈঠক করেন শামীম ওসমানের সঙ্গে। পরে বৈঠক হয় আইভীর সঙ্গে। শামীম দলীয় যেকোনো সিদ্ধান্ত মেনে নিতে রাজি হন। অন্যদিকে আইভী নির্বাচন করার ব্যাপারে তাঁর অনড় অবস্থানের কথা জানান। এতে করে সমঝোতা বৈঠক ভেঙে যায়। ওইদিন রাতে আইভীর সিদ্ধান্তের বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে জানানো হয়। তখন শেখ হাসিনা একজনকে সমর্থন দেওয়ার এবং অন্যজনকে প্রতিমন্ত্রী করার আশ্বাস দেন। তবে কেউ এ আশ্বাসে রাজি হননি। সাজেদা চৌধুরীর বাসায় বৈঠক শেষে হানিফ সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, ১১ অক্টোবরের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রার্থী সমর্থনের বিষয়টি ঘোষণা করবে।
হানিফ বলেন, 'আমরা শামীম ওসমান এবং সেলিনা হায়াত আইভীর সঙ্গে পৃথক বৈঠক করে কথা বলেছি। এলাকায় তাঁদের সম্পর্কে নেতা-কর্মীদের মতামতও নিয়েছি। দুজনের পক্ষে নেতা-কর্মীদের সমর্থন রয়েছে। দুজনই অত্যন্ত জনপ্রিয়। শেষ পর্যন্ত দল কাকে সমর্থন দেবে তা এখনই বলা যাচ্ছে না।' এ বিষয়ে দলের পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা দেওয়ার আগে নির্বাচনী আচরণবিধি ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা হবে উল্লেখ করে হানিফ বলেন, 'যেহেতু এটি স্থানীয় নির্বাচন, তাই কাউকে দলের পক্ষ থেকে মনোনয়ন দেওয়া যাবে না। সমর্থন দেওয়ার ক্ষেত্রেও আচরণবিধি অনুসরণ করা হবে। ১২ অক্টোবর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। তার আগের দিনই এর সুরাহা করা হবে।'
১১ অক্টোবর : এ দিন দলের সমর্থন বিষয়ে জানতে চাইলে মাহবুব-উল আলম হানিফ কালের কণ্ঠকে বলেন, আজ (১২ অক্টোবর) দুপুরের মধ্যে সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার হবে। তার আগে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা করবেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, 'স্থানীয় নির্বাচনে দলীয়ভাবে কোনো প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া যায় না। তবে সমর্থন দেওয়ার বিধিবিধান আছে। আমরা সেভাবেই সমর্থন দেব।'
১২ অক্টোবর : এ দিন ছিল মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিন। শামীম ও আইভী কেউই সরে না দাঁড়ানোয় আওয়ামী লীগ জটিলতার মধ্যে পড়ে। এর আগে শামীম ও আইভী গণভবনে শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং যাওয়ার সময় বলেন, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর কাছে দোয়া চাইতে এসেছেন। প্রার্থিতা চূড়ান্ত হওয়ার পরদিন ১৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী, আহমেদ হোসেন ও আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন নারায়ণগঞ্জ গিয়ে শামীম ওসমানকে সমর্থন দেওয়ার কথা ঘোষণা করেন।
১৪ অক্টোবর : আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির কার্যালয়ে দলের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ দলের তিন সাংগঠনিক সম্পাদক নারায়ণগঞ্জ গিয়ে শামীম ওসমানকে সমর্থন দেওয়ার ঘোষণার বিষয়ে বলেন, 'তাঁরা দলের কার নির্দেশে সেখানে গিয়েছেন আমার জানা নেই। ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে যে কেউ যেতে পারেন। দলের মুখপাত্র হিসেবে এটা নিয়ে আমার মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।'
হাফিন আরো বলেন, 'সেখানে আমাদের দুজন প্রার্থী রয়েছেন। তাঁদেরকে আমরা বলেছিলাম নিজেদের মধ্যে সমঝোতা করতে। কিন্তু তাঁরা এক হতে পারেননি। সেই কারণে এ নির্বাচনে দল হিসেবে আমাদের কতটুকু করণীয় তা আমরা আলোচনা করে মূল্যায়ন করব এবং সিদ্ধান্ত নেব।' একই দিন দলের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, আওয়ামী লীগ নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে কাউকে সমর্থন দেয়নি।
১৮ অক্টোবর : অবশেষে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন (নাসিক) নির্বাচনে দলের সমর্থনের বিষয়টি পরিষ্কার করে শাসক দল। প্রায় দুই সপ্তাহ ধরে লুকোচুরির পর এ দিন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ নিজেই শামীম ওসমানকে দলের সমর্থনের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেন। বঙ্গবন্ধু এভিনিউর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সাংবাদিকদের কাছে সমর্থনের বিষয়টি খোলাসা করে তিনি জানান, নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থী শামীম ওসমান। আজ থেকে আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী নিয়ে আর কোনো বিভ্রান্তির সুযোগ নেই। পরে যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগসহ দলের বিভিন্ন স্তরের নেতারা নারায়ণগঞ্জ গিয়ে শামীম ওসমানের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারে অংশ নেন। কেবল সমর্থন নয়, শামীম ওসমানের বিজয় নিশ্চিত করতে দলের সভানেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সর্বস্তরের নেতা-কর্মীকে নির্দেশ দেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর দুজন সদস্যকে নির্বাচন দেখভালের দায়িত্বও দেওয়া হয়।
১৮ অক্টোবর দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা সভাপনেত্রীর ধানমণ্ডির কার্যালয়ে এক অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেন। সেখান থেকে কাজী জাফর উল্যাহ ও মাহবুব-উল আলম হানিফ গণভবনে গিয়ে শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করেন। এ সময় শেখ হাসিনা শামীম ওসমানের পক্ষে কাজ করে তাঁকে নির্বাচিত করার নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে অপর প্রার্থী সেলিনা হায়াত আইভীকে সংরক্ষিত মহিলা আসনে সংসদ সদস্য হওয়ার প্রস্তাব পাঠানো হবে এবং এতে রাজি না হলে আইভীকে ভবিষ্যতে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হবে বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।

No comments

Powered by Blogger.