দুই এডওয়ার্ডসের দিন

দুজনই এডওয়ার্ডস। দুজনই বার্বাডিয়ান। ফিদেল এডওয়ার্ডস ও কার্ক এডওয়ার্ডসের মধ্যে সম্পর্ক থাকাটা তাই অস্বাভাবিক না। আবার একই দ্বীপ থেকে উঠে আসা একই উপাধির দুজনের সম্পর্ক যে থাকবেই, তাও তো না। কাল দিন শেষের সংবাদ সম্মেলনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মিডিয়া ম্যানেজার সেই না থাকার সম্পর্কের কথা জানাতেই পেছন থেকে দুজনের ফিসফিসিয়ে ওঠা। 'এখন দাবি করছে, ওরা কাজিন'_কৌতুকটা সহাস্যে জানালেন মিডিয়া ম্যানেজার।আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই দুই এডওয়ার্ডসের, তবে কাল হরিহর আত্মা হয়ে এ দুজনই কিন্তু ধসিয়ে দিলেন বাংলাদেশকে। ব্যাটিংয়ে কার্ক, বোলিংয়ে ফিদেল। প্রথমজনের সেঞ্চুরি, দ্বিতীয়জনের ৫ উইকেট।


দুই এডওয়ার্ডসের যুগলবন্দিতে মিরপুর টেস্টের দুই দিন শেষে স্বাগতিকদের ছন্নছাড়া অবস্থা।কার্ক এডওয়ার্ডসের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আঙ্গিনায় পা রাখা মাত্র মাস তিনেক আগে। ভারতের বিপক্ষে প্রথম টেস্ট খেলতে নেমেই বাজিমাত। অভিষেকেই সেঞ্চুরি। বাংলাদেশের বিপক্ষে সিরিজের প্রথম টেস্টটি ছিল তাঁর ক্যারিয়ারের দ্বিতীয়। প্রথম ইনিংসে ১৭ রান করে আউট হওয়ার পর দ্বিতীয়টিতে অপরাজিত ২৮। মিরপুর টেস্টে আবারও তিন অঙ্কের জাদুকরী ফিগার স্পর্শ। তিন টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি, ব্যাটিং গড় ৭০.৫০_এর চেয়ে স্বপ্নের শুরু আর কী হতে পারে! নিশ্চয়ই টেস্ট ক্রিকেটকে খুব সহজ মনে হচ্ছে কার্কের। জিজ্ঞেস করতেই তাঁর কণ্ঠে তীব্র প্রতিবাদ, 'টেস্ট সেঞ্চুরি করা কখনোই খুব সহজ ব্যাপার না। এখানে রানের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়। সে জন্যই এর নাম টেস্ট।' সেঞ্চুরির আনন্দ অবশ্য লুকাননি তিনি, 'দল যা চেয়েছে, আমি সেটি করতে পেরেছি। আমি তাই ভীষণ খুশি।'
আগের দিন অপরাজিত ছিলেন ৭১ রানে। কাল সেঞ্চুরি করতে খুব বেশি সময় নেননি কার্ক। এর মধ্যে একবার অবশ্য বেঁচে গেছেন মুশফিকুর রহিমের সৌজন্যে। ৯০ রানের সময় তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে আসা বলটি গ্লাভসবন্দি করতে পারেননি বাংলাদেশ অধিনায়ক। ওই ওভারেই নাসিরকে দুটো বাউন্ডারি মেরে পেঁৗছে যান ৯৮-তে। এরপর সোহরাওয়ার্দীকে মারা আরেক চারে সেঞ্চুরি। শেষ পর্যন্ত সাকিবের বলে যখন এলবিডাবি্লউ হন, ততক্ষণে ২৭৩ বলে ১২১ রানের ঝলমলে ইনিংস কার্ক এডওয়ার্ডসের নামের পাশে। ইনিংসে ১৪টি বাউন্ডারির পাশাপাশি আলো ছড়াচ্ছে নাসির ও সোহরাওয়ার্দীকে মারা দুটো ছক্কা। ক্যারিবিয়ানি ক্রিকেটের এই অন্ধকার যুগে আলোর মশাল নিয়ে আসা কার্ক দিনশেষে তাঁর ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়ে গেলেন স্পষ্ট করে, 'আমার ব্যক্তিত্বটাই এমন যে সব সময় ইতিবাচক থাকি। লোকে যখন আমার সম্পর্কে নেতিবাচক কিছু বলে, আমি তা হেসে উড়িয়ে দিই। কারণ আমি জানি, আমি তাদের ভুল প্রমাণ করতে পারব।'
ফিদেল এডওয়ার্ডসের ক্যারিয়ার অবশ্য কার্কের মতো আনকোরা নয়। তবে শুরুটা তেমনই আলো ঝলমলে। নেটের অনুশীলনে দেখে ব্রায়ান লারা তাঁকে সুপারিশ করেছিলেন মূল দলে নিতে। প্রথম টেস্টেই ৫ উইকেট, অভিষেক ওয়ানডেতে ৬ উইকেট_লারার বিশ্বাসের মর্যাদা ভালোই দিয়েছেন ফিদেল। মাঝে ইনজুরি ও ফর্মহীনতায় হারিয়ে যেতে বসেছিলেন। আবার যে বিধ্বংসী ফর্মের চূড়ায় উঠেছেন, কালকের বোলিংয়েই এর প্রমাণ।
চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টে খুব একটা ভালো বোলিং করতে পারেননি। শাহরিয়ার নাফীসের রক্ত ঝরালেও দুই ইনিংসে দুটির বেশি উইকেট পাননি। কাল নিলেন প্রথম পাঁচটিই। সেটিও নিজের করা প্রথম ২৯ বলের মধ্যেই। দ্রুততম সময়ে টেস্ট ইনিংসে ৫ উইকেট নেওয়ায় পাঁচ নম্বরে এখন ফিদেল।
ইনিংসের প্রথম ওভার ছিল গড়পড়তা। ফিদেলের তৃতীয় বল ছিল অফ স্ট্যাম্পের বেশ বাইরে। শেষ তিনটি লেগ স্ট্যাম্পের ওপারে। জাদু শুরু পরের ওভার থেকেই। রাউন্ড দ্য উইকেট থেকে করা ফিদেলের শর্ট বল সামলাতে পারেননি তামিম। তাঁর ব্যাট ছুঁয়ে আসা বল শর্ট লেগে দারুণভাবে তালুবন্দি করেন ড্যারেন ব্রাভো। তামিমকে আউট করার এক বল পরই ইমরুলের ক্যাচ গালিতে ছাড়েন স্যামুয়েলস। এরপর ইমরুল কায়েসের কানা ছুঁয়ে আসা বল ফাঁকি দেয় স্লিপ ফিল্ডারদের। তাতে কি দমার পাত্র ফিদেল! পরের ওভারের দ্বিতীয় বলে রকিবুল এলবিডাবি্লউ হওয়ায় এবং তৃতীয় বলে মুশফিককে স্লিপে ক্যাচ দেওয়ায় হ্যাটট্রিকের সামনে বসে দাঁড়ান এই ফাস্ট বোলার। ইয়র্কারটি কোনোরকমে ঠেকিয়ে তা সামাল দেন সাকিব। এরপর সাকিবের এজ গালির বাঁ পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেলেও ইমরুলকে ঠিকই ফেরান ফিদেল। ৭-০-৪০-৫ আগুনঝরানো ফিদেলের প্রথম স্পেল।
আগের টেস্টের গড়পড়তা ফিদেল কিভাবে এমন বিস্ফোরক হয়ে উঠলেন? সংবাদ সম্মেলনে এসে উইকেট-কন্ডিশনের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়ার কথাই বললেন তিনি, 'আমি বাংলাদেশে আগে কখনো খেলিনি। গত টেস্টটিই ছিল আমার প্রথম টেস্ট। আমি উইকেট বুঝেছি, এবার খুঁজে পেয়েছি বল করার জায়গা। এটি আমার পক্ষে দারুণভাবে কাজ করেছে।' আরেকটি ব্যাপারও গেছে ফিদেলের পক্ষে। টেস্টে বাংলাদেশি ব্যাটসম্যানদের টোয়েন্টি টোয়েন্টি মানসিকতা। পরোক্ষে তাই প্রতিপক্ষের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানালেন তিনি, 'ব্যাটসম্যানদের বেশি বেশি শট খেলতে দেখা আমার জন্য উৎসাহব্যঞ্জক। কারণ তারা যত বেশি শট খেলবে, আমার উইকেট নেওয়ার সম্ভাবনাও বাড়বে তত।'
কার্ক এডওয়ার্ডসের সেঞ্চুরির ধাক্কা সামলে ক্যারিবিয়ানদের ৩৫৫-তে গুটিয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। এরপর ফিদেল এডওয়ার্ডসের পাঁচ শিকারের ধাক্কা সামলে ৭ উইকেটে ২০৪ পর্যন্ত যেতে পারে তারা। কিন্তু দুই এডওয়ার্ডস মিলে যে ক্ষত তৈরি করলেন, ম্যাচের ফল কি তাতেই নির্ধারিত হয়ে গেল না!

No comments

Powered by Blogger.