মনিরুল ইসলামের শিল্পবীক্ষণ by মইনুল ইসলাম জাবের
একটি ছবি কীভাবে দেখব? ছবিটিতে কী দেখব? আর ছবিটি আঁকার সময় শিল্পী কী দেখছিলেন—এ প্রশ্নগুলোর উত্তর জানার জন্য আমাদের যেতেই হবে শিল্পী মনিরুল ইসলামের কাছে। আমরা যারা ঢাকাবাসী তাদের ভাগ্য ভালো; ছবির দর্শনকে সাধারণ দর্শকের সামনে বারবার উপস্থাপন করতে সক্ষম এমন অনেক শিল্পী আছেন আমাদের মাঝে। এমন শিল্পীদের একেবারে প্রথম সারিতেই স্থান নিয়েছেন শিল্পী মনির।
আমরা অনেকেই ছবিকে বেশ করে বুঝে নিতে চাই। প্রাণান্ত চেষ্টা চালাই ছবির মাঝে—একটা মানুষ, একটা পাখি কিংবা বিড়াল কিংবা মাছ বা নদী-আকাশ-গাছ এসবকে খুঁজে পেতে।
পৃথিবীতেই যেহেতু বাস, তাই চারপাশের পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে, তার নানান উপাদান ক্যানভাসে বা পেপারে না তুলে অন্য কিছু একটা করা আদতে প্রায় অসম্ভব। তবে আধুনিক অনেক শিল্পী চারপাশের এই বস্তু-রং বা আকার—এ সবকিছুকেই মনের গহনে বেশ করে রান্না করে নিয়ে তবেই তাঁর ক্যানভাসে কিংবা পেপারে ঢেলে দেন। তাই এঁদের আঁকা গাছ-মাছ-নদী-মানুষ প্রকৃতির সাধারণ বস্তুটি মাত্র নয়, একদম নতুন সৃষ্টি। সার্থক আধুনিক শিল্পীর মনের ভেতরের এই রন্ধন রেসিপিই তাঁকে ক্যানভাসে বা পেপারে নানা কসরত করতে বাধ্য করে—আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে যা হয়তো স্রেফ আঁকিবুঁকি কিংবা রঙের খেলা।
রঙের খেলাই বটে। তবে তা একটু ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন রসের। একটি প্রজাপতি ফুলের ওপর বসলে আমরা কতই না আনন্দ পাই। তার ছবি কাগজে বা ক্যামেরায় তুলে নিতে চাই। আমরা যারা সাধারণ, তারা প্রজাপতির ফুলের ওপর বসার মুহূর্তকেই কেবল উপলব্ধি করি। আর মনিরুল ইসলামের মতো দার্শনিক শিল্পী আমাদের জানান শুধু ফুলে বসা প্রজাপতি নয়, ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানোর কালে প্রজাপতির যাত্রাপথের রঙিন ভুবনটিও উপভোগ করতে হয়। মনির এই ওড়াউড়ি দেখেন আর মনের মধ্যে তাকে নানা রঙের নানা গল্পে মিশিয়ে, শেষে প্রিন্ট কিংবা ক্যানভাসে পরিবেশন করেন। আমরা যারা দর্শক তারা মনিরের ছবির এই বাইরের দিকটি দেখেই আবার নতুন করে মনের মধ্যে এঁকে নিই আরেক নতুন ছবি। শিল্পী যখন দার্শনিক হন, তখন তিনি শুধু ছবিই আঁকেন না, দর্শকের অবচেতন মনকে দিয়ে আঁকিয়েও নেন। আমাদের চারপাশকে নতুন করে দেখা আর শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গেই শিল্পী হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা হয় শুধু এমন দার্শনিক-শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীতেই। তাই অজান্তেই আমরা রং-রেখার খেলায় ভেসে যাই—মনিরের ভুবন থেকে উড়ে যাই নিজের কল্পনার ভুবনে।
বিশ্বের সব বড় শিল্পীই কেবল কিছু কাজেই তাঁদের দর্শনকে তুলে ধরতে পেরেছেন। মনিরুল ইসলামের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কিন্তু তাঁর ছবিতে যে অন্যকেও আঁকিয়ে নেওয়ার দর্শন রয়েছে, তার মূল্য কোনোভাবেই পরিমেয় নয়।
গ্যালারি চিত্রকে ‘মনির ২০১১’ পরিবেশনায় আমরা শিল্পীর দর্শনকে বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। গোধূলিবেলায় পদ্মার রং কিংবা কাতালনিয়ার উজ্জ্বল সকাল, স্প্যানিস গিটার কিংবা বাংলার একতারা, চাঁদপুরের পান্তা-ইলিশ কিংবা মাদ্রিদের পাআইয়া, বাংলার লোকগান কিংবা স্প্যানিশ কবিতা—এ সবকিছু থেকেই মনির যে স্বাদ আস্বাদন করেছেন, তাকেই তাঁর মনের জারকে জারিত করে পরিবেশন করেছেন আমাদের সামনে। সাধারণ দর্শক হয়তো এই বিষয়গুলোকে সরাসরি খুঁজে পাবেন না মনিরের ক্যানভাসে, তবে মনের আয়না দিয়ে ছবিগুলো দেখলে খুব কম আবেশেই এই ভাব বুঝতে পারবেন।
মনিরের ছবির সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তি। চারপাশের খুব সাধারণ ঘটনা কিংবা মনের কোনো ভাব-সুখের বা দুঃখের—মনির তা যেন কবিতার মতো লিখে যান ছবির ওপর। মাধ্যম কখনো প্লাস্টিক রং, কখনো ডিমের খোসা, কখনো ফেলে দেওয়া আবর্জনা, কখনো এসিড, কখনো টুকরো কাগজ বা ঘরে বানানো রং। কখনো তিনি ব্যবহার করেন টাইপোগ্রাফি, কখনো মোটা ব্রাশ দিয়ে ক্যানভাসের জমিনে লেপে দেন রং। রেখা আর রঙের খেলায় মেতে কখনো নিয়ে আসেন আমাদের চেনাজানা অবয়ব, কখনো ছবিটি থাকে সম্পূর্ণ নির্বত্তক। এক কথায় মনিরের ছবির বিষয় তাঁর চারপাশ নয় বরং তাঁর কাব্যিক মন—তাই দর্শকের পক্ষে ছবি বুঝে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। একটি সুন্দর ফুলকে আমরা যেমন সচরাচর বুঝি না, আধুনিক কবিতার প্রতিটি শব্দ চেনা লাগলেও সম্পূর্ণ কবিতা যেমন বোঝার নয়—তেমনি মনিরের ছবিও বুঝতে নেই। এ শুধু অনুভব করার—তাতে কারও লাগবে ভালো, কারও তেমন নাও লাগতে পারে। কিন্তু মনিরের ভুবন থেকে বের হয়ে নিশ্চিতভাবেই দর্শকের চোখটি শিল্পীর চোখে পরিণত হয়—আর এখানেই মনির অনন্য।
মনির অ্যাক্রেলিক, প্রিন্ট, কোলাজ কিংবা হালের ডিজিটাল মিডিয়ার সম্ভারে, মাধ্যম ব্যবহারের যে মুনশিয়ানা দেখান, তা এক কথায় অতুলনীয়। এবারের প্রদর্শনীতে মনিরের প্রায় তিন দশকের কাজের উপস্থিতির কারণে এতে যেমন রয়েছে শিল্পরসিকের রস আস্বাদনের উপকরণ, তেমনি আছে শিল্পের ছাত্রের জন্য টেকনিকের পাঠ। ছবির প্রয়োজনেই নানান উপাদান ব্যবহার করেন মনির। তবে সব বড় শিল্পীর মতোই তিন মাধ্যমের জন্য আঁকেন না, ছবির প্রয়োজনে মাধ্যম বা উপকরণ বেছে নেন মাত্র। ছবি তৈরির সময় হয়তো তাই বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় তাঁকে। আর গ্যালারিতে আমরা যখন সেগুলোকে দেখি, তখন মনে হয়—এমনই তো দেখতে চেয়েছিলাম। এখানেই সার্থকতা মনিরুল ইসলামের আর এখান থেকেই শিখতে হবে ছাত্রদের।
এত বছরের এত কাজ একসঙ্গে উপস্থাপনার জন্য চিত্রক যথার্থই ধন্যবাদ পাবে। তবে মনিরের চিত্রমালা উপস্থাপনার কালে আরেকটু যত্নশীলতা দাবি করে বৈকি। মনির যেহেতু শিল্পীমাত্র নন, তাঁর দর্শনকে দর্শকের কাছে আরও অর্থবহ করে দেখানোর বিষয়টি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্যালারি চিত্রক কর্তৃপক্ষ সে কাজটি হয়তো আরও ভালোভাবে করতে পারত।
ছবির যে অন্য একটি ভাষা আছে, সে ভাষায় যে লেখা যায় অনবদ্য কবিতা, আর সে ভাষার সৃষ্টিতে যে থাকতে পারে অমোঘ দর্শন—মনির তা আমাদের খুব সহজে বুঝিয়ে দেন। ছাত্র, শিল্পী, শিল্পরসিক, সাধারণ দর্শক—সবার জন্যই মনিরের এই প্রদর্শনী একটি অতি প্রয়োজনীয় শিল্পশিক্ষাসফর।
পৃথিবীতেই যেহেতু বাস, তাই চারপাশের পরিবেশকে পাশ কাটিয়ে, তার নানান উপাদান ক্যানভাসে বা পেপারে না তুলে অন্য কিছু একটা করা আদতে প্রায় অসম্ভব। তবে আধুনিক অনেক শিল্পী চারপাশের এই বস্তু-রং বা আকার—এ সবকিছুকেই মনের গহনে বেশ করে রান্না করে নিয়ে তবেই তাঁর ক্যানভাসে কিংবা পেপারে ঢেলে দেন। তাই এঁদের আঁকা গাছ-মাছ-নদী-মানুষ প্রকৃতির সাধারণ বস্তুটি মাত্র নয়, একদম নতুন সৃষ্টি। সার্থক আধুনিক শিল্পীর মনের ভেতরের এই রন্ধন রেসিপিই তাঁকে ক্যানভাসে বা পেপারে নানা কসরত করতে বাধ্য করে—আমাদের সাধারণ দৃষ্টিতে যা হয়তো স্রেফ আঁকিবুঁকি কিংবা রঙের খেলা।
রঙের খেলাই বটে। তবে তা একটু ভিন্ন ধরনের, ভিন্ন রসের। একটি প্রজাপতি ফুলের ওপর বসলে আমরা কতই না আনন্দ পাই। তার ছবি কাগজে বা ক্যামেরায় তুলে নিতে চাই। আমরা যারা সাধারণ, তারা প্রজাপতির ফুলের ওপর বসার মুহূর্তকেই কেবল উপলব্ধি করি। আর মনিরুল ইসলামের মতো দার্শনিক শিল্পী আমাদের জানান শুধু ফুলে বসা প্রজাপতি নয়, ফুলে ফুলে উড়ে বেড়ানোর কালে প্রজাপতির যাত্রাপথের রঙিন ভুবনটিও উপভোগ করতে হয়। মনির এই ওড়াউড়ি দেখেন আর মনের মধ্যে তাকে নানা রঙের নানা গল্পে মিশিয়ে, শেষে প্রিন্ট কিংবা ক্যানভাসে পরিবেশন করেন। আমরা যারা দর্শক তারা মনিরের ছবির এই বাইরের দিকটি দেখেই আবার নতুন করে মনের মধ্যে এঁকে নিই আরেক নতুন ছবি। শিল্পী যখন দার্শনিক হন, তখন তিনি শুধু ছবিই আঁকেন না, দর্শকের অবচেতন মনকে দিয়ে আঁকিয়েও নেন। আমাদের চারপাশকে নতুন করে দেখা আর শিল্পীর সঙ্গে সঙ্গেই শিল্পী হয়ে ওঠার অভিজ্ঞতা হয় শুধু এমন দার্শনিক-শিল্পীর চিত্র প্রদর্শনীতেই। তাই অজান্তেই আমরা রং-রেখার খেলায় ভেসে যাই—মনিরের ভুবন থেকে উড়ে যাই নিজের কল্পনার ভুবনে।
বিশ্বের সব বড় শিল্পীই কেবল কিছু কাজেই তাঁদের দর্শনকে তুলে ধরতে পেরেছেন। মনিরুল ইসলামের ক্ষেত্রে তার ব্যতিক্রম হবে কেন? কিন্তু তাঁর ছবিতে যে অন্যকেও আঁকিয়ে নেওয়ার দর্শন রয়েছে, তার মূল্য কোনোভাবেই পরিমেয় নয়।
গ্যালারি চিত্রকে ‘মনির ২০১১’ পরিবেশনায় আমরা শিল্পীর দর্শনকে বেশ ভালোভাবেই উপলব্ধি করতে পারি। গোধূলিবেলায় পদ্মার রং কিংবা কাতালনিয়ার উজ্জ্বল সকাল, স্প্যানিস গিটার কিংবা বাংলার একতারা, চাঁদপুরের পান্তা-ইলিশ কিংবা মাদ্রিদের পাআইয়া, বাংলার লোকগান কিংবা স্প্যানিশ কবিতা—এ সবকিছু থেকেই মনির যে স্বাদ আস্বাদন করেছেন, তাকেই তাঁর মনের জারকে জারিত করে পরিবেশন করেছেন আমাদের সামনে। সাধারণ দর্শক হয়তো এই বিষয়গুলোকে সরাসরি খুঁজে পাবেন না মনিরের ক্যানভাসে, তবে মনের আয়না দিয়ে ছবিগুলো দেখলে খুব কম আবেশেই এই ভাব বুঝতে পারবেন।
মনিরের ছবির সবচেয়ে বড় গুণ তাঁর কাব্যিক অভিব্যক্তি। চারপাশের খুব সাধারণ ঘটনা কিংবা মনের কোনো ভাব-সুখের বা দুঃখের—মনির তা যেন কবিতার মতো লিখে যান ছবির ওপর। মাধ্যম কখনো প্লাস্টিক রং, কখনো ডিমের খোসা, কখনো ফেলে দেওয়া আবর্জনা, কখনো এসিড, কখনো টুকরো কাগজ বা ঘরে বানানো রং। কখনো তিনি ব্যবহার করেন টাইপোগ্রাফি, কখনো মোটা ব্রাশ দিয়ে ক্যানভাসের জমিনে লেপে দেন রং। রেখা আর রঙের খেলায় মেতে কখনো নিয়ে আসেন আমাদের চেনাজানা অবয়ব, কখনো ছবিটি থাকে সম্পূর্ণ নির্বত্তক। এক কথায় মনিরের ছবির বিষয় তাঁর চারপাশ নয় বরং তাঁর কাব্যিক মন—তাই দর্শকের পক্ষে ছবি বুঝে মিলিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা বৃথা। একটি সুন্দর ফুলকে আমরা যেমন সচরাচর বুঝি না, আধুনিক কবিতার প্রতিটি শব্দ চেনা লাগলেও সম্পূর্ণ কবিতা যেমন বোঝার নয়—তেমনি মনিরের ছবিও বুঝতে নেই। এ শুধু অনুভব করার—তাতে কারও লাগবে ভালো, কারও তেমন নাও লাগতে পারে। কিন্তু মনিরের ভুবন থেকে বের হয়ে নিশ্চিতভাবেই দর্শকের চোখটি শিল্পীর চোখে পরিণত হয়—আর এখানেই মনির অনন্য।
মনির অ্যাক্রেলিক, প্রিন্ট, কোলাজ কিংবা হালের ডিজিটাল মিডিয়ার সম্ভারে, মাধ্যম ব্যবহারের যে মুনশিয়ানা দেখান, তা এক কথায় অতুলনীয়। এবারের প্রদর্শনীতে মনিরের প্রায় তিন দশকের কাজের উপস্থিতির কারণে এতে যেমন রয়েছে শিল্পরসিকের রস আস্বাদনের উপকরণ, তেমনি আছে শিল্পের ছাত্রের জন্য টেকনিকের পাঠ। ছবির প্রয়োজনেই নানান উপাদান ব্যবহার করেন মনির। তবে সব বড় শিল্পীর মতোই তিন মাধ্যমের জন্য আঁকেন না, ছবির প্রয়োজনে মাধ্যম বা উপকরণ বেছে নেন মাত্র। ছবি তৈরির সময় হয়তো তাই বেশ ঝক্কি পোহাতে হয় তাঁকে। আর গ্যালারিতে আমরা যখন সেগুলোকে দেখি, তখন মনে হয়—এমনই তো দেখতে চেয়েছিলাম। এখানেই সার্থকতা মনিরুল ইসলামের আর এখান থেকেই শিখতে হবে ছাত্রদের।
এত বছরের এত কাজ একসঙ্গে উপস্থাপনার জন্য চিত্রক যথার্থই ধন্যবাদ পাবে। তবে মনিরের চিত্রমালা উপস্থাপনার কালে আরেকটু যত্নশীলতা দাবি করে বৈকি। মনির যেহেতু শিল্পীমাত্র নন, তাঁর দর্শনকে দর্শকের কাছে আরও অর্থবহ করে দেখানোর বিষয়টি তাই খুবই গুরুত্বপূর্ণ। গ্যালারি চিত্রক কর্তৃপক্ষ সে কাজটি হয়তো আরও ভালোভাবে করতে পারত।
ছবির যে অন্য একটি ভাষা আছে, সে ভাষায় যে লেখা যায় অনবদ্য কবিতা, আর সে ভাষার সৃষ্টিতে যে থাকতে পারে অমোঘ দর্শন—মনির তা আমাদের খুব সহজে বুঝিয়ে দেন। ছাত্র, শিল্পী, শিল্পরসিক, সাধারণ দর্শক—সবার জন্যই মনিরের এই প্রদর্শনী একটি অতি প্রয়োজনীয় শিল্পশিক্ষাসফর।
No comments