কবির জীবনাখ্যান by সৈয়দ আজিজুল হক
আমাদের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বের জীবনরস অবলম্বনে উপন্যাস রচনায় সেলিনা হোসেনের রয়েছে এক দীর্ঘ ও গভীর অভিনিবেশ। তাঁর এ ধারার উপন্যাসে ইতিমধ্যে চিত্রিত হয়েছে চর্যাপদ-এর জীবনপরিবেশ, মনসামঙ্গল-এর অন্তর্ভুক্ত চাঁদ সওদাগরের লোকপ্রিয় কাহিনি, চণ্ডীমঙ্গল-এর অন্তর্গত কালকেতু ও ফুল্লরার বৈচিত্র্যময় জীবনগাথা, আমাদের শিল্প-সাহিত্য ও সংস্কৃতির সবচেয়ে আরাধ্য ব্যক্তিত্ব রবীন্দ্রনাথের বর্ণাঢ্য জীবন, বিপ্লবী নারী প্রীতিলতা ও ইলা মিত্রের কঠিন সংগ্রামশীলতা, বাংলাদেশের ১৯৫২ থেকে ১৯৭১ কালপর্বের সামাজিক-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস প্রভৃতি। তাঁর এরূপ উপন্যাসভাবনার ক্ষেত্রে সর্বশেষ সংযোজন হলো, উর্দু গজলের কিংবদন্তি-পুরুষ মির্জা গালিবের কবিত্বময় জীবনযন্ত্রণা অবলম্বনে যমুনা নদীর মুশায়রা।
এ ক্ষেত্রে ঔপন্যাসিকের কল্পনাপ্রতিভা এই প্রথম বাংলা ভূখণ্ড অতিক্রম করে দিল্লি-আগ্রাকে স্পর্শ করেছে। ফলে স্বাভাবিকভাবে ঔপন্যাসিকের কল্পনাসূত্রকে বাস্তবমণ্ডিত করে তোলার আন্তর্গরজে ভৌগোলিক ও কালিক দূরত্বকে জয় করার জন্য তাঁকে ব্যাপৃত হতে হয়েছে এক কঠিন সংগ্রামে।
মির্জা গালিবের জীবৎকালে (১৭৯৭-১৮৬৯) দিল্লি-আগ্রার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সেখানকার উর্দু ও ফারসিভাষী অভিজাত মুসলমানদের জীবনধারা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও রাজদরবারকেন্দ্রিক কাব্যচর্চার আবহ প্রভৃতিকে বাস্তবোচিত করে তোলার অভিপ্রায়ে লেখককে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক উত্তম কল্পনারসের। এ জন্য মির্জা গালিবের জীবন ও জীবনব্যাখ্যার বিচিত্রমুখী তথ্য সংগ্রহ, দিল্লি-আগ্রার ভৌগোলিক জীবনপরিবেশকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণসহ নিজেকে এমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় পর্যাপ্তভাবে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে লেখককে পরিচয় দিতে হয়েছে গবেষণামূলক নিষ্ঠার। ইতিহাসের তথ্য নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে হলে ইতিহাসরস ও জীবনরসের মধ্যে যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, এ ব্যাপারে লেখক সচেতন ছিলেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি স্মরণীয়। রাজসিংহ উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হূদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে হইয়াছে—’। সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ করি, তিনি মির্জা গালিবের জীবৎকালে সংঘটিত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বহুলপ্রচলিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের ঘটনাটিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিহাস-সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও কবিহূদয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে মান্য করেছেন। বিদ্রোহী সেপাইদের দ্বারা সৃষ্ট রক্তপাত এবং পরবর্তীকালে বিজয়ী ইংরেজদের সৃষ্ট রক্তপাত—এই উভয়ই যে কবিহূদয়ে সমান যন্ত্রণার কারণ হয়, তা উল্লেখে লেখক পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক সততার।
সংগত কারণেই সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে কবি মির্জা গালিবই উপন্যাসে বড় হয়ে উঠেছেন। সমগ্র উপন্যাসেই বর্ণিত হয়েছে একজন মহৎ কবির জীবনালেখ্য। ফলে কবিত্বশক্তির জাগরণেই উপন্যাসটি প্রাণবন্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের সমগ্র আবহটিই কবিত্বময়। কবি গালিবের জন্ম-ইতিহাসের মধ্যে লেখক প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন কবিত্বের এক চমৎকার ব্যঞ্জনা। যমুনা নদীর কাছ থেকেই কবি গালিবের জন্মের অগ্রিম বার্তাটি লাভ করেন আগ্রার এক প্রসিদ্ধ কবি। এই ঘটনার মধ্যে উপন্যাসোচিত বাস্তবতা ক্ষুণ্ন হলেও ইতিহাসখ্যাত এক কবির জীবনাখ্যানের সূচনাসূত্র হিসেবে এটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পাঠক এর কাব্যিকতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
লেখক জোর দিয়েছেন কবির জীবনবৈশিষ্ট্যের ওপর, যেখানে বিষয়বুদ্ধিহীন সুরাসেবী এক কবির জীবনযন্ত্রণাই মুখ্য। দ্রাক্ষারসের আসক্তির মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর কবিত্বের উৎসশক্তি। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি সংসারকে শৃঙ্খল মনে করে অন্তরে লালন করেন এক বিবাগী সত্তাকে। ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের যোগ্য উত্তরসাধক এই কবির কাছে সুরা আর কবিতাই শেষ কথা। তার মধ্যে সুরাশক্তির পাশাপাশি রয়েছে বাইজি-আসক্তিও। বাইজি-সন্নিধানে বিপুলভাবে তৃপ্তি বোধ করে তার সৃজনশীল সত্তা। ঋণ করে ঘি খাওয়ার চার্বাকনীতিতেও তিনি বিশ্বাসী। আমৃত্যু তাঁর জীবন ঋণভারে জর্জরিত হলেও আসক্তিবিহীন পৃথিবী তাঁর কাম্য নয় মোটেই। তিনি তাঁর বংশবৃত্তির পারম্পর্য ভেঙে তলোয়ারকে পরিণত করেছেন কলমে, যে কলমে আছে প্রেম, যে প্রেম দিয়ে চেয়েছেন জগজ্জয় করতে। হূদয়ের আগুন দিয়ে তিনি কবিতার আলো জ্বালেন। লেখকের চমৎকার ভাষাভঙ্গিটিও মির্জা গালিবের কাব্যময় জীবনপরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।
বৃহদায়তনের এই গ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেখক গালিবের জীবনস্রোতের মধ্যেই গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কাব্যপ্রবাহকে। লেখকের জন্য এটি সহজসাধ্য ছিল না। গালিবের সমস্ত জীবন যে কাব্যসাধনায় উৎসর্গীকৃত সেই সত্যটিই পরস্ফুিট হয়েছে এরূপ বিন্যাসে।
মির্জা গালিবের জীবৎকালে (১৭৯৭-১৮৬৯) দিল্লি-আগ্রার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ, সেখানকার উর্দু ও ফারসিভাষী অভিজাত মুসলমানদের জীবনধারা, ব্যক্তিকেন্দ্রিক ও রাজদরবারকেন্দ্রিক কাব্যচর্চার আবহ প্রভৃতিকে বাস্তবোচিত করে তোলার অভিপ্রায়ে লেখককে আশ্রয় নিতে হয়েছে এক উত্তম কল্পনারসের। এ জন্য মির্জা গালিবের জীবন ও জীবনব্যাখ্যার বিচিত্রমুখী তথ্য সংগ্রহ, দিল্লি-আগ্রার ভৌগোলিক জীবনপরিবেশকে ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণসহ নিজেকে এমন একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস রচনায় পর্যাপ্তভাবে দক্ষ করে তোলার লক্ষ্যে লেখককে পরিচয় দিতে হয়েছে গবেষণামূলক নিষ্ঠার। ইতিহাসের তথ্য নিয়ে উপন্যাস রচনা করতে হলে ইতিহাসরস ও জীবনরসের মধ্যে যে সামঞ্জস্য বিধান করতে হয়, এ ব্যাপারে লেখক সচেতন ছিলেন। প্রসঙ্গত, ঐতিহাসিক উপন্যাসের বৈশিষ্ট্য নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি উক্তি স্মরণীয়। রাজসিংহ উপন্যাস বিশ্লেষণ করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: ‘ইতিহাস এবং উপন্যাসকে একসঙ্গে চালাইতে গিয়া উভয়কেই এক রাশের দ্বারা বাঁধিয়া সংযত করিতে হইয়াছে। ইতিহাসের ঘটনাবহুলতা এবং উপন্যাসের হূদয়বিশ্লেষণ উভয়কেই কিছু খর্ব করিতে হইয়াছে—’। সেলিনা হোসেনের ক্ষেত্রেও আমরা লক্ষ করি, তিনি মির্জা গালিবের জীবৎকালে সংঘটিত ‘সিপাহী বিদ্রোহ’ নামে বহুলপ্রচলিত ভারতের প্রথম স্বাধীনতাসংগ্রামের ঘটনাটিকে উপস্থাপনের ক্ষেত্রে ইতিহাস-সত্যের প্রতি বিশ্বস্ত থেকেও কবিহূদয়ের পরিপ্রেক্ষিতকে মান্য করেছেন। বিদ্রোহী সেপাইদের দ্বারা সৃষ্ট রক্তপাত এবং পরবর্তীকালে বিজয়ী ইংরেজদের সৃষ্ট রক্তপাত—এই উভয়ই যে কবিহূদয়ে সমান যন্ত্রণার কারণ হয়, তা উল্লেখে লেখক পরিচয় দিয়েছেন ঔপন্যাসিক সততার।
সংগত কারণেই সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসকে ছাপিয়ে কবি মির্জা গালিবই উপন্যাসে বড় হয়ে উঠেছেন। সমগ্র উপন্যাসেই বর্ণিত হয়েছে একজন মহৎ কবির জীবনালেখ্য। ফলে কবিত্বশক্তির জাগরণেই উপন্যাসটি প্রাণবন্ত। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত উপন্যাসের সমগ্র আবহটিই কবিত্বময়। কবি গালিবের জন্ম-ইতিহাসের মধ্যে লেখক প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন কবিত্বের এক চমৎকার ব্যঞ্জনা। যমুনা নদীর কাছ থেকেই কবি গালিবের জন্মের অগ্রিম বার্তাটি লাভ করেন আগ্রার এক প্রসিদ্ধ কবি। এই ঘটনার মধ্যে উপন্যাসোচিত বাস্তবতা ক্ষুণ্ন হলেও ইতিহাসখ্যাত এক কবির জীবনাখ্যানের সূচনাসূত্র হিসেবে এটি যেন সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়ে ওঠে এবং পাঠক এর কাব্যিকতায় গভীরভাবে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
লেখক জোর দিয়েছেন কবির জীবনবৈশিষ্ট্যের ওপর, যেখানে বিষয়বুদ্ধিহীন সুরাসেবী এক কবির জীবনযন্ত্রণাই মুখ্য। দ্রাক্ষারসের আসক্তির মধ্যে তিনি খুঁজে পান তাঁর কবিত্বের উৎসশক্তি। সংসারের মধ্যে থেকেও তিনি সংসারকে শৃঙ্খল মনে করে অন্তরে লালন করেন এক বিবাগী সত্তাকে। ফারসি কবি ওমর খৈয়ামের যোগ্য উত্তরসাধক এই কবির কাছে সুরা আর কবিতাই শেষ কথা। তার মধ্যে সুরাশক্তির পাশাপাশি রয়েছে বাইজি-আসক্তিও। বাইজি-সন্নিধানে বিপুলভাবে তৃপ্তি বোধ করে তার সৃজনশীল সত্তা। ঋণ করে ঘি খাওয়ার চার্বাকনীতিতেও তিনি বিশ্বাসী। আমৃত্যু তাঁর জীবন ঋণভারে জর্জরিত হলেও আসক্তিবিহীন পৃথিবী তাঁর কাম্য নয় মোটেই। তিনি তাঁর বংশবৃত্তির পারম্পর্য ভেঙে তলোয়ারকে পরিণত করেছেন কলমে, যে কলমে আছে প্রেম, যে প্রেম দিয়ে চেয়েছেন জগজ্জয় করতে। হূদয়ের আগুন দিয়ে তিনি কবিতার আলো জ্বালেন। লেখকের চমৎকার ভাষাভঙ্গিটিও মির্জা গালিবের কাব্যময় জীবনপরিবেশ সৃষ্টির সহায়ক হয়েছে।
বৃহদায়তনের এই গ্রন্থের রন্ধ্রে রন্ধ্রে লেখক গালিবের জীবনস্রোতের মধ্যেই গেঁথে দিয়েছেন তাঁর কাব্যপ্রবাহকে। লেখকের জন্য এটি সহজসাধ্য ছিল না। গালিবের সমস্ত জীবন যে কাব্যসাধনায় উৎসর্গীকৃত সেই সত্যটিই পরস্ফুিট হয়েছে এরূপ বিন্যাসে।
No comments