বিচিত্র গল্পের ইশারা by আলতাফ শাহনেওয়াজ
গল্পের ভেতর কী থাকে, কী ঘটে—সোজাসাপটা জবাব খুঁজলে বলা যাবে, গল্পের শরীরে গল্পটাই মুখ্য। কাহিনি সূত্রে চরিত্রের জন্ম-বিকাশ-পরিণতি—সব মিলেমিশে পাঠকের চোখে একসময় পুরো গল্পের আকার ফরসা হয়ে ওঠে। এ রকম হিসাব মাথায় রেখে মশিউল আলমের সাম্প্রতিক গল্পগ্রন্থ পাকিস্তান পড়তে গেলে কেন জানি না মনের মধ্যে অতর্কিতে ধন্দ এসে উপস্থিত হয়। ধন্দ এই জন্য যে, গল্পের চেনাজানা আবরণের মধ্যে শেষ অবধি গল্পগুলো কতটা এবং কীভাবে গল্প হয়ে ওঠে; আর কেমন করেই বা পরিণতি পায় চরিত্রগুলো? কেননা, গোটা বইয়ে মশিউল যেভাবে একের পর এক গল্প বলে যান, তার মধ্যে টলটলে গল্প আছে বটে; কিন্তু গল্পের চরিত্রগুলো কতটা পরিণতি পায় কিংবা এখানে চরিত্রের পরিণতি সেভাবে আবশ্যিক কি না—এ রকম গুটিকয় প্রশ্ন মাথার ভেতর বন বন করে পাকিস্তান-এর পাট চুকানোর পরেও।
এই গ্রন্থে জায়গা পেয়েছে নয়টি গল্প। গল্পগুলো আবার বিচিত্রমুখী—নির্দিষ্টভাবে বিষয়গত কোনো কেন্দ্র নেই বইটির। একেকটি গল্প পাঠককে একেক রকম অভিজ্ঞতার সামনে নিয়ে যায়। তবে ঐক্যের বিচার করলে মধ্যবিত্ত মানুষজনের বর্ণিল মনোভঙ্গিই গ্রন্থে নানামাত্রায় ছড়ানো ছিটানো।
কথাসাহিত্যিক হিসেবে মশিউল আলম মোটেই অচেনা নন। হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক-পরবর্তী গল্পকারদের সারিতে তিনি এর মধ্যেই নিজেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছেন। লেখক সম্পর্কে কোনো পূর্ব ধারণা না রেখে শুধু এই বইটি পড়লেও পাঠক বুঝতে পারবেন, বিচিত্র আইডিয়ার পাশাপাশি গল্প নির্মাণকৌশলও তাঁর কতটা করায়ত্ত।
প্রথম গল্প ‘ঘোড়া’কে দৃষ্টান্তে রেখেই আলোচনা বিস্তারিত করা যাক। ‘ঘোড়া’ গল্পের পুরো কাহিনির মধ্যে দুটি উপকাহিনী আছে—একটি বাবার, অন্যটি ছেলের। এখানে দুই প্রজন্মের মানুষের শৈশবের চোখ দিয়ে ঘোড়াকে দেখেছেন লেখক—‘একটা শাদা ঘোড়ার স্বপ্ন দেখতাম, যার পাখা ছিল। সে ঘোড়া দৌড়াত না, উড়ে-উড়ে যেত।’ এটা হলো বাবার শৈশবের চোখে দেখা। অন্যদিকে পরের প্রজন্মে পৌঁছে ছেলে যখন ঘোড়াটিকে দেখে, তখন তার চোখে নিরেট বাস্তবতার ছাপ ঢুকিয়ে দেন লেখক। ছেলে বাবাকে বলে, ‘ঘোড়া তো পাখি না, ঘোড়ার কেন পাখা থাকবে!’ আলাদাভাবে দুই প্রজন্মের দুই ব্যক্তির মধ্যে দেখার যে ফারাক, সেটি জলবৎ তরলং। স্কুলপড়ুয়া ছেলের চোখে যেখানে বাস্তব ও কল্পনার মিশেলে এক ধরনের স্বপ্ন-আবেশ থাকার কথা, সেখানে ছেলের চোখে বাস্তবতার ঘাই ছাড়া অন্য কোনো স্বপ্ন নেই। ঘোড়ার পাখা গজানোর ব্যাখ্যা হিসেবে বাবা যতই তার সামনে রূপকথার জগৎ পেশ করেন, ছেলে কিন্তু বিভ্রান্ত নয় মোটেই। “আমি বলি, ‘মানুষেরা তাদের বলেছে, এই ঘোড়ারা, তোমরা তো পাখি না। তোমাদের পাখা থাকতে পারবে না। তোমরা যদি তোমাদের পাখাগুলি ঝরিয়ে না ফ্যালো তাহলে আমরা তোমাদের পাখির মতো গুলি করে মারব, তারপর রান্না করে খেয়ে ফেলব।’ তারপর থেকে ঘোড়ারা মানুষের ভয়ে পাখাগুলি লুকিয়ে রাখে, কিন্তু ইচ্ছা করলেই তারা পাখা মেলাতে পারে। অবশ্য সেটা তারা করে শুধু রাতের বেলা, বিশেষ করে যেসব রাতে পূর্ণিমা হয়, যখন চাঁদের আলোয় ভরে যায় সারা পৃথিবী।”—বাবার স্বপ্নজড়ানো ছেলেভোলানো কাহিনির পর ‘তুমি আমাকে এখনো বাচ্চা ছেলেই মনে করো, তাই না?’ প্রশ্নের মতো করে ছেলের এই উত্তর দুই প্রজন্মের দৃষ্টিভঙ্গিতে ব্যবধানকেই নির্দেশ করে। বিষয়টি আরও খোলাসা হয়ে ওঠে গল্পের শেষে। ছেলের বর্ণনা দিতে গিয়ে বাবার বয়ান—‘রাজ্যের বইখাতায় ঠাসা ভারী স্কুলব্যাগটির দুটি ফিতার ভেতরে ক্ষিপ্র দুই হাত গলিয়ে দিয়ে সেটিকে পর্বতারোহীর মতো পিঠে নিয়ে কাঁধ দুটো বার দুয়েক ঝাঁকিয়ে আমার মুখের দিকে চেয়ে ভদ্রলোকের মতো সৌজন্যের মৃদু হাসি হেসে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে সে গট গট করে হেঁটে গেল স্কুলভবনের প্রধান ফটকের দিকে।’ সামান্য ঘোড়াকে কেন্দ্র করে লতিয়ে ওঠা গল্পটি সত্যিই অসাধারণ, নতুন ঢঙে লেখা। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, গল্পের চরিত্ররা কি ঠিকঠাক পরিণতি পেয়েছে? পাক আর না পাক গল্পে বলা কথাটি কিন্তু ঠিকই বলা হয়ে গেছে—পাঠক বুঝতেই পারবেন না গল্পটি এর মধ্যেই শেষ হয়ে যাচ্ছে! গল্পকার হিসেবে মশিউলের অভিনবত্ব এখানেই। অপ্রত্যাশিত ঝলকানি লাগিয়ে তিনি গল্পের নটেগাছটি মুড়িয়ে ফেলতে পারেন!
‘ঘোড়া’র মতো প্রভুভক্ত অন্য গল্পগুলোও সরল-সহজভাবে হুট করে শুরু হয়। তেমন কোনো বাড়তি আয়োজনের দরকার পড়ে না। লেখকের সাবলীল ভাষাভঙ্গি গল্পের মধ্যে পাঠককে টেনে নিয়ে যায়। ‘পাকিস্তান’, ‘জামিলা’, ‘ট্রয়ের হেলেন’, ‘কোকিল ডেকে যায়’—সব গল্পের একই অবস্থা। ‘পাকিস্তান’ গল্পের ইমতিয়াজ, রূপিন্দর বা ফারহানা; ‘ট্রয়ের হেলেন’-এর হাবিব বা হ্যাপি; ‘অপরাধ ও শাস্তির গল্প’-এর কাজী মাজেদুর রহমান—সব চরিত্রের মুখ দিয়ে লেখক তাঁর কথাটি বলিয়ে নিলেন। ওদিকে গল্প থেকে গল্পে পৌঁছে শুরুর প্রশ্নটি যদি আরও একবার করা যায়, চরিত্রগুলো কী রকম পরিণতি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকল শেষ পর্যন্ত? থাকল। পড়া শেষে নিশ্চিত মনে হবে মশিউল তাঁর গল্পের চরিত্রগুলোকে যেনবা এমনভাবে নির্মাণ করেছেন, যেখানে গল্পের শুরু থেকেই চরিত্রটি পরিণত। গল্প বলার নিজস্ব কৌশলের কারণেই লেখকের হাতে এমনটি ঘটেছে, তিনি তাঁর করণকৌশলগুলো আড়াল করতে পেরেছেন।
তাই বলা যায়পাকিস্তান বইয়ের গল্পগুলো এমনই সহজাত-সাবলীল; আরোপ কিংবা জবরদস্তির চিহ্নমাত্র নেই।
No comments