নরক গুলজার by তৈমুর রেজা
‘এইভাবে কথাগুলো বলতে পারলাম, ...হয়ত তাতে করে আমার কোন রিডার তৈরি হবে না।’ (মামুন হুসাইন: নিক্রপলিস) এই বইটি পাঠকের সঙ্গে ‘গোস্বা’ করে লেখা। আম-পাঠকের পক্ষে তাই এখানে দাঁত বসানো প্রায় বারণ। সাহিত্য যাঁদের ‘ব্যবসা’, এ বইয়ের বাঁধা পাঠক বলতে শুধু তাঁদের ধরতে হবে। মামুন হুসাইন স্বয়ং এ ব্যাপারে যে বেখেয়াল নন, তার নজির হিসেবে ওপরের উদ্ধৃতিটি তুলে রাখা হলো।
মামুন হুসাইনের নিক্রপলিস আনকোরা ফিকশন, সে কারণেই অনাত্মীয়, যোগাযোগ পদে পদে ঠেকে। যেসব লক্ষণ বিচারে আমরা উপন্যাস চিনি, সেগুলো খুব গরজ নিয়ে তিনি হাপিশ করে ফেলেন। বাঙালি পাঠকের চিরকেলে প্রেম ‘কিচ্ছা’র সঙ্গে, এই সৃষ্টিছাড়া লেখক কাহিনির পুঁথিটাই কুটি কুটি করে ছেঁড়েন। তিনি আমাদের শহরের অভিধা করেছেন ‘নিক্রপলিস’ (সিটি অব ডেড); তাঁর ব্যাখ্যা: ‘উন্নয়ন-রাজনীতির সহজবোধ্য উদাহরণ তৈরির লক্ষ্যে, বহুকাল আগে পুরো শহর এবং আমাদের জনপদ একটি সমাধিক্ষেত্রে রূপান্তরিত’ হয়েছে।
মামুন হুসাইনের নির্মিত সিমেট্রিতে পা দিয়েই আকলমন্দ পাঠকের হুঁশ হবে, তিনি প্রায় অকুল পাথারে পড়েছেন। অস্বস্তির প্রথম খুন বেরোবে ভাষা থেকে। মামুন হুসাইনের বাঁধো-বাঁধো কাব্যিক গদ্যে সিন্দবাদের ভূতের মতো সওয়ার হয়েছে ইংলিশ ঢং-ঢাং; হঠাৎ সন্দেহ হয়, যেন কাঠের ঘোড়ার ‘ড্যান্স’। একটা বাক্য পড়া যাক: ‘ম্যাগডোনাল্ড, ডোমিনো এবং গিওভানির টিনটেড গ্লাসডোরের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিজাহাট-এ ভিড় দেখলেন—টেস্টস আর অলসো ভেসটেড উইথ পাওয়ার!’ সঙ্গে যোগ করুন এ রকম দুর্বোধ্য কাব্য: ‘...শরীর হারাচ্ছে বেঁচে থাকার আর্দ্রতা, জরুরি সোহাগ ছেড়ে মৃত্যু এসে ঘুম নেবে শেষ মৃত্যুর’।
ফিকশনের পাঠকের একটা খিদে থাকে ডিটেইলের জন্য। নিক্রপলিসে ডিটেইল তো আছে বেশ, কিন্তু সেসব পাঠকের জন্য ‘পুষ্পশয্যা’ নয়। কাহিনির চাক বাঁধিয়ে তুলতে এসব ডিটেইলের মধ্যে কোনো গরজ নেই, এর দশ আনাই খরচ হয়েছে লেখকের রাজনৈতিক মনোভাব জানান দিতে (যেমন: ‘এশিয়ান ব্যাংকের ড্রেজিং করা নদীতে’ বা ‘বহুজাতিক কোম্পানির সুশ্রী মনিটরে’ বা ‘গভীর রাজনৈতিক টাকি মাছ’)। তাঁর বহুমুখী খাতের জ্ঞানের ভার বইতে গিয়েও বাক্যগুলোর কুঁজো-দশা। জ্ঞান যেখানে ভারিক্কি, মন্তব্য যেখানে আলটপকা—লেখক সেখানে বন্ধনী ব্যবহার করেন; ফলে বন্ধনী দেখলেই ধড়ফড় লাগে।
তাঁর ন্যারেশনের ধরনটিও পাঠকের অতি অনাত্মীয় এবং কিছুটা রগচটা। কে কখন ন্যারেট করছে, তার খেই পেতে পেতেই পাঠক বেছবর হয়ে যেতে পারেন। ন্যারেশনের এই রীতিটি সাহিত্যের এক ক্ষীণতোয়া ধারা। উইলিয়াম ফকনার তাঁর অ্যাজ আই লে ডাইং উপন্যাসে ‘মাল্টিপল ন্যারেটর’ ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর এন্তার নজির পাওয়া যাবে সেখানে। নিক্রপলিস প্রসঙ্গে কুটুম হিসেবে এই উপন্যাসের কথা তোলা যায়; এখানে বহু-কথক যেমন আছে, তেমনি আছে ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ নমুনা।
কাহিনির কথা উঠলে পাঠক ঘোর আতান্তরে পড়ে যাবেন। লেখকের কাছে কাহিনি হয়তো নিছক বিড়ম্বনা। এখানে প্রথম পাওয়া কাহিনি-সূত্র হচ্ছে: সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার পাণ্ডুলিপি পড়া হচ্ছে। তার পরই শুরু হয়ে যাবে তেজি ঘোটকীর মতো তেপান্তরের মাঠে কাহিনির দিশাহীন ছোটাছুটি, পাঠকের সাধ্য নেই এই পর্যটনের কোনো পূর্বাপর নির্ণয় করে।
কোনো প্রটাগনিস্ট নেই বইতে, ন্যারেটর ফুস করে বদলে যাচ্ছে দৈবিক আইনে; গল্প আছে তবু গল্প কোথাও যাচ্ছে না। মনোলগের দোর্দণ্ড ঝাপটার মুখে হাবুডুবু খাবেন পাঠক, দম ছোট হলে দাঁড়ানোর কোনো আশাই নেই।
এই তীব্র অভাব-অভিযোগ সম্বল করে কোনোমতে বইয়ের অর্ধেক পেরোতে পারলেই একটা জাদুর মতো ব্যাপার ঘটে। ফুল যেমন কাউকে জানান না দিয়ে নীরবে ফোটে, পাঠক হঠাৎ টের পাবেন, বইটিও তেমনি অলক্ষ্যে মাথা জাগিয়েছে; এত দূর পর্যটনে যার দিক-দিশা কিছুই ঠাহর হয়নি, সেই বইটি হঠাৎ মানুষের গলায় কথা বলছে, সে বাক্য অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে আপনার মন। যে যন্ত্রণা এতক্ষণ ঘুরে মরছিল, যাকে আমাদের অভ্যস্ত মন সইতে পারছে না, লেখক তো সেই যন্ত্রণার কাসুন্দিই ঘাঁটতে বসেছেন। স্মৃতির হদ্দ ঘেঁটে তিনি আমাদের দেখাচ্ছেন জাতীয় ক্ষতগুলো, পুরো দেশের ওপর দিয়ে যেসব কান্না ঝড়ের মতো বয়ে গেছে, সেসব ভুলে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলো তিনি মেলে ধরেছেন। বইটা তাই পত্রিকার পুরোনো ফাইল ঘাঁটার মতোই: ব্যারাকে গণহত্যা, বোমা, গ্রেনেড, বাংলা ভাই—যেন এক নিঃশ্বাসে আগুনের হলকার ওপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া।
মামুন হুসাইন নীলকণ্ঠের মতো পুরো জাতির বিষ পান করেছেন। তিনি একটা ফিকশনের আদলে বাংলাদেশের কান্নার ইতিহাস লিখেছেন।
শুরুতে যে ভাষাটাকে মনে হচ্ছিল ‘কাঠের ঘোড়া’, শেষ হতে হতে সেই ভাষা পার্সিয়াসের ঘোড়া হয়ে উঠল। এলায়িত গদ্যে বোমা হামলার কয়েক পৃষ্ঠাজোড়া একটা প্রায়-জ্যান্ত বিবরণ, আবার কাটা কাটা থেমে থেমে লেখা দীর্ঘ ভাষ্যে বেঁচে থাকার অর্থহীন অনড় প্রতিমা। লেখক যেন পাঠকের ওপর অস্ত্রোপচার করছেন। বাড়ি মেরে মেরে আগে অবশ করে তারপর বিষ ঢালছেন কানে, যেন সে বাধ্য হয় চাপা কান্নাগুলো শুনতে, যেন তার ‘মৃত্যু কিঞ্চিৎ সহজ হয়’। নিক্রপলিস তাই সর্বজনীন দুর্গাপূজার মণ্ডপ নয়। এটা নতুন, স্বতন্ত্র, আকস্মিক—এবং এসব গুণ নিয়েই শুধু এক গুহ্য সমাজের মন্ত্র।
মামুন হুসাইনের নির্মিত সিমেট্রিতে পা দিয়েই আকলমন্দ পাঠকের হুঁশ হবে, তিনি প্রায় অকুল পাথারে পড়েছেন। অস্বস্তির প্রথম খুন বেরোবে ভাষা থেকে। মামুন হুসাইনের বাঁধো-বাঁধো কাব্যিক গদ্যে সিন্দবাদের ভূতের মতো সওয়ার হয়েছে ইংলিশ ঢং-ঢাং; হঠাৎ সন্দেহ হয়, যেন কাঠের ঘোড়ার ‘ড্যান্স’। একটা বাক্য পড়া যাক: ‘ম্যাগডোনাল্ড, ডোমিনো এবং গিওভানির টিনটেড গ্লাসডোরের সামনে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে পিজাহাট-এ ভিড় দেখলেন—টেস্টস আর অলসো ভেসটেড উইথ পাওয়ার!’ সঙ্গে যোগ করুন এ রকম দুর্বোধ্য কাব্য: ‘...শরীর হারাচ্ছে বেঁচে থাকার আর্দ্রতা, জরুরি সোহাগ ছেড়ে মৃত্যু এসে ঘুম নেবে শেষ মৃত্যুর’।
ফিকশনের পাঠকের একটা খিদে থাকে ডিটেইলের জন্য। নিক্রপলিসে ডিটেইল তো আছে বেশ, কিন্তু সেসব পাঠকের জন্য ‘পুষ্পশয্যা’ নয়। কাহিনির চাক বাঁধিয়ে তুলতে এসব ডিটেইলের মধ্যে কোনো গরজ নেই, এর দশ আনাই খরচ হয়েছে লেখকের রাজনৈতিক মনোভাব জানান দিতে (যেমন: ‘এশিয়ান ব্যাংকের ড্রেজিং করা নদীতে’ বা ‘বহুজাতিক কোম্পানির সুশ্রী মনিটরে’ বা ‘গভীর রাজনৈতিক টাকি মাছ’)। তাঁর বহুমুখী খাতের জ্ঞানের ভার বইতে গিয়েও বাক্যগুলোর কুঁজো-দশা। জ্ঞান যেখানে ভারিক্কি, মন্তব্য যেখানে আলটপকা—লেখক সেখানে বন্ধনী ব্যবহার করেন; ফলে বন্ধনী দেখলেই ধড়ফড় লাগে।
তাঁর ন্যারেশনের ধরনটিও পাঠকের অতি অনাত্মীয় এবং কিছুটা রগচটা। কে কখন ন্যারেট করছে, তার খেই পেতে পেতেই পাঠক বেছবর হয়ে যেতে পারেন। ন্যারেশনের এই রীতিটি সাহিত্যের এক ক্ষীণতোয়া ধারা। উইলিয়াম ফকনার তাঁর অ্যাজ আই লে ডাইং উপন্যাসে ‘মাল্টিপল ন্যারেটর’ ব্যবহার করেছেন। পাশাপাশি ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর এন্তার নজির পাওয়া যাবে সেখানে। নিক্রপলিস প্রসঙ্গে কুটুম হিসেবে এই উপন্যাসের কথা তোলা যায়; এখানে বহু-কথক যেমন আছে, তেমনি আছে ‘স্টিম অব কনশাসনেস’-এর স্তম্ভিত হয়ে যাওয়ার মতো অসাধারণ নমুনা।
কাহিনির কথা উঠলে পাঠক ঘোর আতান্তরে পড়ে যাবেন। লেখকের কাছে কাহিনি হয়তো নিছক বিড়ম্বনা। এখানে প্রথম পাওয়া কাহিনি-সূত্র হচ্ছে: সশস্ত্র বাহিনীর গণহত্যার পাণ্ডুলিপি পড়া হচ্ছে। তার পরই শুরু হয়ে যাবে তেজি ঘোটকীর মতো তেপান্তরের মাঠে কাহিনির দিশাহীন ছোটাছুটি, পাঠকের সাধ্য নেই এই পর্যটনের কোনো পূর্বাপর নির্ণয় করে।
কোনো প্রটাগনিস্ট নেই বইতে, ন্যারেটর ফুস করে বদলে যাচ্ছে দৈবিক আইনে; গল্প আছে তবু গল্প কোথাও যাচ্ছে না। মনোলগের দোর্দণ্ড ঝাপটার মুখে হাবুডুবু খাবেন পাঠক, দম ছোট হলে দাঁড়ানোর কোনো আশাই নেই।
এই তীব্র অভাব-অভিযোগ সম্বল করে কোনোমতে বইয়ের অর্ধেক পেরোতে পারলেই একটা জাদুর মতো ব্যাপার ঘটে। ফুল যেমন কাউকে জানান না দিয়ে নীরবে ফোটে, পাঠক হঠাৎ টের পাবেন, বইটিও তেমনি অলক্ষ্যে মাথা জাগিয়েছে; এত দূর পর্যটনে যার দিক-দিশা কিছুই ঠাহর হয়নি, সেই বইটি হঠাৎ মানুষের গলায় কথা বলছে, সে বাক্য অনায়াসে পড়ে নিচ্ছে আপনার মন। যে যন্ত্রণা এতক্ষণ ঘুরে মরছিল, যাকে আমাদের অভ্যস্ত মন সইতে পারছে না, লেখক তো সেই যন্ত্রণার কাসুন্দিই ঘাঁটতে বসেছেন। স্মৃতির হদ্দ ঘেঁটে তিনি আমাদের দেখাচ্ছেন জাতীয় ক্ষতগুলো, পুরো দেশের ওপর দিয়ে যেসব কান্না ঝড়ের মতো বয়ে গেছে, সেসব ভুলে যাওয়া পৃষ্ঠাগুলো তিনি মেলে ধরেছেন। বইটা তাই পত্রিকার পুরোনো ফাইল ঘাঁটার মতোই: ব্যারাকে গণহত্যা, বোমা, গ্রেনেড, বাংলা ভাই—যেন এক নিঃশ্বাসে আগুনের হলকার ওপর দিয়ে দৌড়ে যাওয়া।
মামুন হুসাইন নীলকণ্ঠের মতো পুরো জাতির বিষ পান করেছেন। তিনি একটা ফিকশনের আদলে বাংলাদেশের কান্নার ইতিহাস লিখেছেন।
শুরুতে যে ভাষাটাকে মনে হচ্ছিল ‘কাঠের ঘোড়া’, শেষ হতে হতে সেই ভাষা পার্সিয়াসের ঘোড়া হয়ে উঠল। এলায়িত গদ্যে বোমা হামলার কয়েক পৃষ্ঠাজোড়া একটা প্রায়-জ্যান্ত বিবরণ, আবার কাটা কাটা থেমে থেমে লেখা দীর্ঘ ভাষ্যে বেঁচে থাকার অর্থহীন অনড় প্রতিমা। লেখক যেন পাঠকের ওপর অস্ত্রোপচার করছেন। বাড়ি মেরে মেরে আগে অবশ করে তারপর বিষ ঢালছেন কানে, যেন সে বাধ্য হয় চাপা কান্নাগুলো শুনতে, যেন তার ‘মৃত্যু কিঞ্চিৎ সহজ হয়’। নিক্রপলিস তাই সর্বজনীন দুর্গাপূজার মণ্ডপ নয়। এটা নতুন, স্বতন্ত্র, আকস্মিক—এবং এসব গুণ নিয়েই শুধু এক গুহ্য সমাজের মন্ত্র।
No comments