কিবরিয়াঙ্গনে বিষণ্ন রবীন্দ্রনামা by সিলভিয়া নাজনীন
শিল্পীর সংবেদনশীল অন্বেষণ শিল্পের পৃথিবীকে নতুন সম্ভাবনায় ঋদ্ধ করে। শিল্পগুরু মোহাম্মদ কিবরিয়া বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের অন্যতম পথিকৃৎ, আধুনিক বিমূর্ত ধারার জনক এবং এ দেশের ছাপচিত্রের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ একজন শিল্পী। বিষাদের উপলব্ধি, আকাঙ্ক্ষার উদিগরণ- অভিজ্ঞতার ক্ষয়িষ্ণু দেয়ালে সরব হয়ে ওঠে তাঁর ক্যানভাস। শিল্পী কিবরিয়া এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন ৭ জুন, ২০১১। ধূসর এই দিনে ঢাকা আর্ট সেন্টারের ‘কিবরিয়া প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’-এর প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন ছিল। এ বছরের প্রথম দিকে এই স্টুডিও যাত্রা শুরু করে পুরোধা চিত্রকর, সুদক্ষ ছাপচিত্রী শিল্পী কিবরিয়ার নামানুসারে।
এক মাসব্যাপী এই স্টুডিওতে ছবি এঁকেছেন এ দেশের বরেণ্য ও তরুণ শিল্পীরা। ‘রবীন্দ্রনামা’ শিরোনামের এই প্রদর্শনীর আয়োজন মূলত রবীন্দ্রনাথের সার্ধশত জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে। এই প্রদর্শনী ঢাকা আর্ট সেন্টারের পক্ষ থেকে শিল্পী গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা এবং উৎসর্গকৃত। ঢাকা আর্ট সেন্টারের সঙ্গে শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়ার আত্মিক বন্ধন প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকেই। শিল্পী কিবরিয়া জন্মগ্রহণ করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের বীরভূমে, ১ ঁজানুয়ারি ১৯২৯ সালে। নিভৃতচারী এই শিল্পীর জন্মদিনকে স্মরণ ও উদ্যাপনের পরিকল্পনা থেকেই আর্ট সেন্টারের প্রতিষ্ঠার দিন এই তারিখে নির্দিষ্ট করা হয়। ঢাকা আর্ট সেন্টারের অন্যতম একজন ট্রাস্টি শিল্পী নিসার হোসেন বলেন, ‘বাংলাদেশের আধুনিক বিমূর্ত শিল্পের একমাত্র জনক মোহাম্মদ কিবরিয়া। এ দেশে ছাপচিত্রের যে চর্চা হয়েছে, এর আগে তা ব্রিটিশ একাডেমিক ধারণা থেকে বের হতে পারেনি, ছাপচিত্রের কৌশলগত দিকই যার প্রধান পথ। কিন্তু শিল্পী কিবরিয়া ড্রইং অ্যান্ড পেইন্টিংয়ে লেখাপড়া শেষ করে জাপানে প্রিন্টমেকিংয়ের কৌশলগত দীক্ষা নিয়ে প্রাচ্যের রথকো হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁর ছাপচিত্র একাডেমিক সীমাবদ্ধতা অতিক্রম করে শিল্পমাত্রায় এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। এই শিল্পীর প্রতিটি শিল্পকর্মে জীবনের আস্বাদটুকু পরিপূর্ণ মাত্রায় উপস্থাপিত।’
কলকাতা আর্ট কলেজে লেখাপড়া শেষ করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুরোধে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পশিক্ষায়তন, বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পঞ্চাশের দশকে শিক্ষকতা শুরু করেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছিলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে। অল জাপান প্রিন্ট এক্সিবিশন এবং ইয়ং আর্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন সেখানে। এ দেশের চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে অভিষিক্ত করেছে।
শিরোনামহীন বিমূর্ততায় তিনি মায়াময় অধ্যায় সৃজন করেছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর মনোভূমির ক্ষরণে প্রতিটি ক্যানভাস বিভাজিত হয়েছে আলো-আঁধারির দ্বান্দ্বিক কম্পোজিশনে। নৈঃশব্দ বিষাদ শিল্পীকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। সাদা শূন্যতা, কালো গভীর রেখা বা ধূসর গড়ন শিল্পী কিবরিয়ার ক্যানভাসকে অভিব্যক্তিময় করে তুলেছে।
‘রবীন্দ্রনামা’ প্রদর্শনী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতিকে নতুন নিরীক্ষা- সৃজনে এ সময়ের শিল্পীরা উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন দর্শকের সঙ্গে সরাসরি দৃষ্টি বিনিময়ের ভঙ্গিতে। সেই দৃষ্টি স্পষ্ট, দৃঢ়, সাবলীল, অপলক! তিনি তাঁর সৃষ্টিকে আনন্দের লীলা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন; জীবন বোধে গভীর প্রেম অনুপ্রেরণা হয়েছিল। কবির জীবনের শেষ দশকে চিত্রকলা তাঁর সৃজনশীলতার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। এ সময়ের শিল্পীরা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে, রেখার গভীরতায়, রূপের ভিন্নতায় এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়বের হুবহু প্রতিরূপ, বিমূর্ত আদল, পুনর্নির্মাণ, সৌম প্রতিকৃতি, চিঠি, গান, কবিতা, আঁকিবুঁকি চিত্রতলে বারবার ফিরে এসেছে।
রেখা, বর্ণ, সৌন্দর্যের উৎসবের পরিবেশে আচ্ছন্ন হয়ে কেটেছে শৈল্পিক সময়। চিত্রকর্ম একটি নিশ্চিত অস্তিত্বের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এই দীর্ঘ দেড় শ বছর পরও রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনা, শিল্পসূত্র, উপলব্ধির পূর্ণতা আমাদের শিল্প-অভিযাত্রাকে সমকালীন গণ্ডি অতিক্রমের স্পর্ধায় পূর্ণ হতে সাহস জোগায়।
ছাপচিত্রে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন ৬৬ জন শিল্পী। ‘কিবরিয়া প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’র এই ছাপচিত্র প্রদর্শনী এবং শিল্পকর্মের সমন্বয়ে তিনটি ফোলিওর মোড়ক উন্মোচন করা হয় ৭ জুন, ২০১১।
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, তরুণ ঘোষ, রনজিৎ দাস, বীরেন সোম, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, জামাল আহমেদ, ওয়াকিলুর রহমান, হামিদুজ্জামান খান, ঢালী আল মামুন, আইভী জামান, দিলারা বেগম জলি, ফারেহা জেবা প্রমুখ।
শিল্পীর এপিটাফে লেখা শোকগাথা শিল্পের এই নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা এবং বিদীর্ণ বিষাদ আরও করুণ রাগে ভাসিয়ে নেবে বাংলার জল-মাটি-বাতাসকে। শিল্পী কিবরিয়ার অস্তিত্বের নির্বস্তুক উপস্থিতি বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের চিত্রময় রূপকে সুসংহত করে চলবে অনাগতকালের শিল্পবিভায়।
কলকাতা আর্ট কলেজে লেখাপড়া শেষ করে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের অনুরোধে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পশিক্ষায়তন, বর্তমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদে পঞ্চাশের দশকে শিক্ষকতা শুরু করেন শিল্পী মোহাম্মদ কিবরিয়া। তিনি উচ্চতর ডিগ্রি নিয়েছিলেন জাপানের টোকিও ইউনিভার্সিটি অব ফাইন আর্টস অ্যান্ড মিউজিক থেকে। অল জাপান প্রিন্ট এক্সিবিশন এবং ইয়ং আর্টিস্ট হিসেবে বিভিন্ন পুরস্কারও তিনি পেয়েছেন সেখানে। এ দেশের চিত্রশিল্পে অবদানের জন্য একুশে পদক এবং স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হয়েছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘প্রফেসর ইমেরিটাস’ পদে অভিষিক্ত করেছে।
শিরোনামহীন বিমূর্ততায় তিনি মায়াময় অধ্যায় সৃজন করেছেন প্রতিনিয়ত। তাঁর মনোভূমির ক্ষরণে প্রতিটি ক্যানভাস বিভাজিত হয়েছে আলো-আঁধারির দ্বান্দ্বিক কম্পোজিশনে। নৈঃশব্দ বিষাদ শিল্পীকে আবিষ্ট করে রেখেছিল। সাদা শূন্যতা, কালো গভীর রেখা বা ধূসর গড়ন শিল্পী কিবরিয়ার ক্যানভাসকে অভিব্যক্তিময় করে তুলেছে।
‘রবীন্দ্রনামা’ প্রদর্শনী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতিকৃতিকে নতুন নিরীক্ষা- সৃজনে এ সময়ের শিল্পীরা উপস্থাপন করেছেন। শিল্পী রবীন্দ্রনাথ তাঁর আত্মপ্রতিকৃতি এঁকেছেন দর্শকের সঙ্গে সরাসরি দৃষ্টি বিনিময়ের ভঙ্গিতে। সেই দৃষ্টি স্পষ্ট, দৃঢ়, সাবলীল, অপলক! তিনি তাঁর সৃষ্টিকে আনন্দের লীলা হিসেবেই আখ্যায়িত করেছেন; জীবন বোধে গভীর প্রেম অনুপ্রেরণা হয়েছিল। কবির জীবনের শেষ দশকে চিত্রকলা তাঁর সৃজনশীলতার প্রধান মাধ্যম হয়ে ওঠে। এ সময়ের শিল্পীরা নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে, রেখার গভীরতায়, রূপের ভিন্নতায় এঁকেছেন রবীন্দ্রনাথ। রবীন্দ্রনাথের মুখাবয়বের হুবহু প্রতিরূপ, বিমূর্ত আদল, পুনর্নির্মাণ, সৌম প্রতিকৃতি, চিঠি, গান, কবিতা, আঁকিবুঁকি চিত্রতলে বারবার ফিরে এসেছে।
রেখা, বর্ণ, সৌন্দর্যের উৎসবের পরিবেশে আচ্ছন্ন হয়ে কেটেছে শৈল্পিক সময়। চিত্রকর্ম একটি নিশ্চিত অস্তিত্বের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ এই দীর্ঘ দেড় শ বছর পরও রবীন্দ্রনাথের চিত্রভাবনা, শিল্পসূত্র, উপলব্ধির পূর্ণতা আমাদের শিল্প-অভিযাত্রাকে সমকালীন গণ্ডি অতিক্রমের স্পর্ধায় পূর্ণ হতে সাহস জোগায়।
ছাপচিত্রে রবীন্দ্রনাথ এঁকেছেন ৬৬ জন শিল্পী। ‘কিবরিয়া প্রিন্টমেকিং স্টুডিও’র এই ছাপচিত্র প্রদর্শনী এবং শিল্পকর্মের সমন্বয়ে তিনটি ফোলিওর মোড়ক উন্মোচন করা হয় ৭ জুন, ২০১১।
প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণকারী শিল্পীরা হলেন মনিরুল ইসলাম, রফিকুন নবী, সৈয়দ আবুল বারক আলভী, সমরজিৎ রায় চৌধুরী, তরুণ ঘোষ, রনজিৎ দাস, বীরেন সোম, শিশির ভট্টাচার্য, নিসার হোসেন, জামাল আহমেদ, ওয়াকিলুর রহমান, হামিদুজ্জামান খান, ঢালী আল মামুন, আইভী জামান, দিলারা বেগম জলি, ফারেহা জেবা প্রমুখ।
শিল্পীর এপিটাফে লেখা শোকগাথা শিল্পের এই নিঃসঙ্গতা, নির্জনতা এবং বিদীর্ণ বিষাদ আরও করুণ রাগে ভাসিয়ে নেবে বাংলার জল-মাটি-বাতাসকে। শিল্পী কিবরিয়ার অস্তিত্বের নির্বস্তুক উপস্থিতি বাংলাদেশের শিল্প ইতিহাসের চিত্রময় রূপকে সুসংহত করে চলবে অনাগতকালের শিল্পবিভায়।
No comments