গুম প্রতিরোধ দিবস: 'সে কোথায় আছে আমি জানি না, আমার বাচ্চা তার বাবাকে খোঁজে' by ফারহানা পারভীন
বাংলাদেশে
গত দশ বছরে নিখোঁজ হওয়া মানুষের মধ্যে ১৭০ জনের এখানো কোন হদিস পাওয়া
যাচ্ছে না। মানবাধিকার সংগঠনগুলো এবং নিখোঁজ হওয়া ব্যক্তিদের পরিবার বলছে,
এরা সবাই গুম হয়েছে।
বছরের
পর বছর ধরে এসব নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবার আইনশৃঙ্খলা বাহিনীসহ প্রশাসনের
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সবার সাথে বার বার করে কথা বলেছেন। কিন্তু তাদের কোন
খোঁজ পাওয়া যায়নি।
শুক্রবার আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো তাদের সংগ্রামের কথা জানিয়েছেন।
ঢাকায় গুম হওয়া ব্যক্তিদের স্বজনদের সমাবেশ। |
ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে ধানমন্ডির নাসরিন আক্তার কথা বলতে বলতে বার বার কান্নায় ভেঙ্গে পড়ছিলেন।
ছোট ছেলেকে সাথে নিয়ে নিখোঁজ বড় ছেলের একটি ছবি হাতে এসেছিলেন তিনি।
নাসরিন আক্তারের সাথে কথা বলে জানতে পারি, ২০১৭ সালে অগাস্ট মাসে তার ছেলে ইসরাক আহমেদ ক্যানাডা থেকে দেশে আসেন ঈদ করতে।
সেখানে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিলেন ইসরাক।
কিন্তু যেদিন বাংলাদেশ থেকে তার ক্যানাডায় ফিরে যাওয়ার কথা, সেদিনই তিনি নিখোঁজ হন, বলছিলেন নাসরিন জাহান।
তিনি
বলছিলেন, "ছেলে বললো মা আজ শেষ দিন বন্ধুদের সাথে বাইরে রেস্টুরেন্টে দেখা
করবো। রাত আটটা নাগাদ বাসায় না ফিরলে তাকে আমি ফোন করি। তার বাবাকে
দিয়েও ফোন করাই। কিন্তু তার ফোন বন্ধ পাই। সেই থেকে আজ পর্যন্ত তার কোন
খোঁজ পাইনি আমরা।"
ঘটনার সময় ২০১৩, ২রা ডিসেম্বর। স্থান ঢাকার
শাহবাগ। রেশমা নামে এক ব্যক্তি বলছিলেন, তার স্বামী মো. চঞ্চলসহ চারজন
নিখোঁজ হন ঢাকার শাহবাগ মোড় থেকে।
তিনি জানান, সাদা পোশাক পরিহিত ব্যক্তিরা এই চারজনকে তুলে নিয়ে যায়, যেটা দেখেন সেখানে থাকা তাদের আরো দুই বন্ধু।
রেশমার সন্তান এখনও বাবাকে খোঁজে |
তিনি
বলছিলেন, "এই যে সে নাই, বা থাকলে কোথায় আছে সেটা আমি জানি না। আমার
বাচ্চা তার বাবাকে খোঁজে। যখন তার বয়স দুই বছর তখন আমার স্বামী নিখোঁজ
হয়।"
"আমি বলি 'তোমার বাবা বিদেশে'। আমরা ছবি হাতে মানববন্ধন করি। বাচ্চাকে তো উত্তর দিতে পারি না।"
তিনি
বলছিলেন, "যদি জানতাম আমার স্বামী মারা গেছে বা কোথায় দাফন করা হয়েছে
তাহলে তো সেখানে যেয়ে জিয়ারত করতে পারতাম। কিন্তু আমরা কিছুই করতে পারি
না। শুধুই অপেক্ষা আর অপেক্ষা।"
আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে শুক্রবার বাংলাদেশে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া
ব্যক্তিদের পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় একত্রিত হন 'মায়ের ডাক' নামে এক
সংগঠনের ব্যানারে।
সংগঠনটি বলছে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মোট
৫৩৮ জন গুম হয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ জন অনেক দিন পর ফিরে এসেছে। আটষট্টি জনের
মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এবং ১৭০জন এখনো নিখোঁজ।
ভাইয়ের আশায় এখনও অপেক্ষা করছেন মারুফা ইসলাম। |
মায়ের ডাকের
আয়োজক সানজিদা ইসলাম বলছিলেন, গুম করার প্রবণতা বেশি দেখা গেছে ২০১৪ সালের
জাতীয় নির্বাচনের আগে। "এবং এর শিকার হয়েছেন বিশেষ করে বিরোধী দলের
নেতা-কর্মীরা," বলছিলেন তিনি।
দু'হাজার তের সালের ৪ঠা ডিসেম্বর আরো
একজন নিখোঁজ হন। তার নাম সাজেদুল ইসলাম সুমন। তিনি ঢাকা ২৫ নং ওয়ার্ডের
বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
তার বোন মারুফা ইসলাম বলছিলেন,
প্রশাসনের এমন কোন স্তর নেই যেখানে তারা যোগাযোগ করেন নি। কিন্তু আজ প্রায়
ছয় বছর হতে চললেও তার কোন খবর নেই।
শুক্রবার যেসব নিখোঁজ পরিবারের সদস্যরা একত্রিত হন তারা বলছেন, নিখোঁজদের কারো কারো হয়তো রাজনৈতিক পরিচয় ছিল।
কিন্তু গুমের তালিকায় অনেকেই রয়েছেন রাজনৈতিক পরিচয়ের একেবারে বাইরে।
ছেলের ছবি হাতে নাসরিন আক্তার। |
No comments