এম্বুলেন্স সিন্ডিকেট জিম্মি রোগী by শুভ্র দেব
দেশের
এম্বুলেন্স সেবায় নিয়মের বালাই নেই। সরকারি হাসপাতালগুলোতে এম্বুলেন্স
সেবাকে জিম্মি করে রেখেছে সিন্ডিকেট। এ সিন্ডিকেটের ছত্রছায়ায় চালকরা রোগী ও
তাদের স্বজনদের কাছ থেকে আদায় করছে লাগামহীন ভাড়া। কেউ ইচ্ছা করলেই
হাসপাতালের বাইরে থেকে এম্বুলেন্স এনে সেবা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। এছাড়া
সিন্ডিকেট সাধারণ মানের গাড়িকে এম্বুলেন্স বানিয়ে সেবা দিচ্ছে। এসব
এম্বুলেন্সে রোগী বহন করার প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদি থাকে না। কিছু কিছু গাড়ি
শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত থাকলেও চালকরা নানা অজুহাতে সেটা ব্যবহার করছেন না।
রোগীর স্বজনরা কিছু বললে উল্টো তাদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করা হয়।
এতে করে প্রায়শই রোগী ও স্বজনরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ঢাকায় এখন প্রায় আড়াই হাজার এম্বুলেন্স চলাচল করে। এর মধ্যে সাত’শ বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালের। আর ভাড়ায় চলাচল করে বাকি ১ হাজার ৮০০টি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভাড়ার কোন নিয়মনীতি নাই। একেক চালক ও একেক হাসপাতালে একেক রকম ভাড়া নেয়া হচ্ছে। চালকরা জানিয়েছেন, এম্বুলেন্স মালিকদের সংগঠনের বাইরে হাসপাতাল ভিত্তিক আলাদা আলাদা সংগঠন রয়েছে। মূলত তারাই এক একটি হাসপাতালের এম্বুলেন্স সেবা নিয়ন্ত্রণ করছেন। একাধিক চালক জানিয়েছেন, নিয়মনীতি না থাকায় হাসপাতাল ভিত্তিক সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছামত ভাড়ায় সার্ভিস দিচ্ছেন। তাদের কথামত চালকরাও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ওইভাবে ভাড়া আদায় করছেন। স্বজনরা হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন এম্বুলেন্স যাচাই-বাচাই করার সুযোগ থাকলেও খুব একটা সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ এখানকার বেশিরভাগ চালকই কমিশন ভিত্তিক গাড়ি চালান। এক্ষেত্রে ভাড়া যত বেশি আদায় করতে পারবেন কমিশন তত বেশি পাবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) এম্বুলেন্স চালক সবুজ বলেন, কোন নির্ধারিত ভাড়া নেই। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে যা নেয়া যায়। আমরা একটা ভাড়া বলে দেই পরে দরদাম করে ঠিক হয়। আমরা ভাড়া বলার আগে সড়কে গ্যাস, টোল, ফেরিভাড়া, খাওয়া, গ্যাসসহ অন্যান্য খরচ কত লাগবে তা হিসাব করে নেই। কারণ খরচ বাদ দিয়ে মালিককে এনে যা দিব তার মধ্যে থেকেই চালকের কমিশন দেয়া হয়। ইব্রাহিম নামের আরেক চালক জানান, ভাড়া নির্ধারণ হয় সাধারণত গাড়ি এসি, নন এসি আর ছোট-বড় গাড়ির ওপর। নন এসি গাড়ির ভাড়া তুলনামূলক কম। এসি গাড়ির ভাড়া একটু বেশি নেয়া হয়। এছাড়া সড়কে খরচের ওপর ভাড়া কম- বেশি হয়। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে ঢামেকের এম্বুলেন্স চালকরা একটু কম ভাড়া নেয়। অন্যান্য হাসপাতালে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া নেয়া হয়। মিটফোর্ড হাসপাতালের চালক রহিম মিয়া জানান, দীর্ঘদিন ধরে এম্বুলেন্স চালক হিসাবে কাজ করছি। ঢাকার ২/৩টি হাসপাতালের এম্বুলেন্স চালিয়েছি। কিন্তু এক হাসপাতালের এম্বুলেন্স ভাড়ার সঙ্গে আরেক হাসপাতালের মিল নাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী আসা যাওয়া করে। যাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। এসব হাসপাতালে এম্বুলেন্সের চাহিদাও বেশি থাকে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগায় সিন্ডিকেট। বাইরে থেকে আসা অনেক রোগীর স্বজন তাদের সঙ্গে যুক্তিতর্ক ও যাচাই বাচাই করে পেরে উঠেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের কাছে যেতে হয়। বিশেষকরে হাসপাতালে কোন রোগী মারা গেলে তাদের স্বজনরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। এমন মুহূর্তেও চালকরা সহযোগিতা না করে আরও বেশি ভাড়া আদায় করে। রোগীর তুলনায় মরদেহ পৌঁছে দেয়ার জন্য বাড়তি ভাড়া দিতে হয়।
এম্বুলেন্স চালকরা জানিয়েছেন, ঢাকার পাশ্ববর্তী কুমিল্লায় কোন এম্বুলেন্স গেলে ৫ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হয়। ফরিদপুরে নেয়া হয় সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। সিলেটে যেতে কোন ফেরি ভাড়া না লাগার কারণে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা কেউ কেউ নিচ্ছেন। হাসপাতাল ভেদে এই ভাড়া আরও বেশি। একাধিক চালক জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেলে এক সময় মাত্র তিনটি এম্বুলেন্স ছিল। এখন এই সংখ্যা সত্তরের ওপরে। বেশি এম্বুলেন্স থাকায় অনেক চালকই প্রতিদিন ট্রিপ পায় না। আবার কেউ কেউ কেউ দিনে ছোট-বড় ২/৩টি ট্রিপ পায়।
রোগীর স্বজনরা বলেছেন, এম্বুলেন্স চালকরা লাগামহীন ভাড়া হাঁকিয়ে বসে। তারা যে ভাড়া চায় ওই ভাড়া থেকে খুব একটা কমানোর সুযোগ থাকে না। ঢামেকের সকল চালক প্রায় একই ভাড়া দাবি করেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা এম্বুলেন্সে কিছুটা কম ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগ থাকে তবে ঢামেকের চালকদের কারণে সেটা আর সম্ভব হয় না। ঢামেকের রোগীদের নাকি এখানকার এম্বুলেন্সে করে যেতে হয়। এ কারণে ভাড়াও বেশি রাখা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে কথা হয় কুমিল্লাগামী এক রোগীর স্বজন আসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুমিল্লা যাওয়ার ভাড়া প্রথমে সাত হাজার টাকা চায় এক চালক। পরে অনেক দরাদরি করে ৫ হাজার ২০০ টাকায় রাজি করিয়ে এখন রওয়ানা দিচ্ছি। মৌলভীবাজারের এক রোগীর স্বজন রুবেল হোসেন বলেন, ৯ হাজার টাকা ভাড়ায় মৌলভীবাজার নিয়ে যাচ্ছি একটি এম্বুলেন্স। কেন এত বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ওই চালক জানান, রোগীকে নামিয়ে দিয়ে আসার সময় খালি আসতে হয়। এজন্য যাওয়া আসার খরচসহ ভাড়া নেয়া হয়। এছাড়া সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টরা আটকালে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মামলা দেয়। এক একটি মামলা ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা হয়।
এদিকে একটি সূত্র বলছে, বিগত কয়েক বছর থেকে এম্বুলেন্স ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে অনেকের। স্বল্প পুঁজিতে লাভজনক ও নগদ আয়ের ব্যবসা, ঝক্কি-ঝামেলা কম থাকায় এ আগ্রহ। এম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক কম থাকায়ও অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ রোড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৪ টি। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত এই সংখ্যা দাড়িয়েছে ২ হাজার ৩৩৬ টিতে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৩৭টি, ২০১২ সালে ১১৪টি, ২০১৩ সালে ১৯০টি, ২০১৪ সালে ২৫৪টি, ২০১৫ সালে ৩৫৮টি, ২০১৬ সালে ২৮৭টি, ২০১৭ সালে ৪০০টি, ২০১৮ সালে ৪৫৬টি ও ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে ১৪০টি। সব মিলিয়ে বিআরটিএ শুধুমাত্র ঢাকাতেই ৩ হাজার ৭১০টি এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছে। যা সারা বাংলাদেশে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের অর্ধেকের চেয়ে অনেক বেশি।
বিআরটিএ জানিয়েছে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারা দেশে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৯৩টি। আর ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেটি গিয়ে দাড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৭১টিতে। এর মধ্যে ২০১১ সালে হয়েছে ২১৯টি, ২০১২ সালে ১৮১টি, ২০১৩ সালে ২৪৩টি, ২০১৪ সালে ৩৩৮টি, ২০১৫ সালে ৪৮০টি, ২০১৬ সালে ৩৭৮টি, ২০১৭ সালে ৪৯৫টি, ২০১৮ সালে ৫৬৪টি ও ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হয়েছে ১৮০ টি। সব মিলিয়ে সারা দেশে মোট ৫ হাজার ৮৭১টি এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এম্বুলেন্সের কোন নীতিমালা না থাকা ও হাসপাতাল ভিত্তিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠার কারণে ভাড়া বেশি নেয় চালকরা। নীতিমালা হয়ে গেলে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে এম্বুলেন্স মালিকদের টেক্স দিতে হচ্ছে। এই টেক্স মওকূপ হয়ে গেলে আরও কম টাকায় সেবা দেয়া যাবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই একটা নীতিমালা হোক। এজন্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নীতিমালা চেয়ে লিখিত আবেদন করেছি। এছাড়া হাইকোর্টে রিটও করেছি। নীতিমালা হয়ে গেলে কি কি সুবিধা মিলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা রোগীদের সঠিক সেবা দিকে চাই। একটি মানসম্মত এম্বুলেন্স যাতে অক্সিজেন, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, এসিসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু থাকবে। কারণ অনেকেই পুরাতন গাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে নিম্নমানের সুবিধা দিয়ে এম্বুলেন্স সার্ভিস দিচ্ছে। এসব এম্বুলেন্স থেকে রোগীরা ভালো সুবিধা পায় না।
দিন দিন এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন কেন বেড়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক সময় এই ব্যবসায় নানা ঝামেলা ছিল, গাড়ির দামও বেশি ছিল। কিন্তু এখন দাম অনেক কমেছে। এম্বুলেন্স আমদানিতে টেক্স অনেক কমে গেছে। একটি মাইক্রোবাস কিনতে ৩০ লাখ টাকা লাগলে এম্বুলেন্সে ২০ লাখ টাকা লাগছে। তাই অনেকেই এখন মাইক্রোবাস না কিনে এম্বুলেন্স কিনছে।
এতে করে প্রায়শই রোগী ও স্বজনরা নানা হয়রানির শিকার হচ্ছেন।
ঢাকায় এখন প্রায় আড়াই হাজার এম্বুলেন্স চলাচল করে। এর মধ্যে সাত’শ বিভিন্ন প্রাইভেট ক্লিনিক ও হাসপাতালের। আর ভাড়ায় চলাচল করে বাকি ১ হাজার ৮০০টি। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের এম্বুলেন্স চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে ভাড়ার কোন নিয়মনীতি নাই। একেক চালক ও একেক হাসপাতালে একেক রকম ভাড়া নেয়া হচ্ছে। চালকরা জানিয়েছেন, এম্বুলেন্স মালিকদের সংগঠনের বাইরে হাসপাতাল ভিত্তিক আলাদা আলাদা সংগঠন রয়েছে। মূলত তারাই এক একটি হাসপাতালের এম্বুলেন্স সেবা নিয়ন্ত্রণ করছেন। একাধিক চালক জানিয়েছেন, নিয়মনীতি না থাকায় হাসপাতাল ভিত্তিক সিন্ডিকেট তাদের ইচ্ছামত ভাড়ায় সার্ভিস দিচ্ছেন। তাদের কথামত চালকরাও রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে ওইভাবে ভাড়া আদায় করছেন। স্বজনরা হাসপাতালের ভেতরে বিভিন্ন এম্বুলেন্স যাচাই-বাচাই করার সুযোগ থাকলেও খুব একটা সুবিধা পাচ্ছে না। কারণ এখানকার বেশিরভাগ চালকই কমিশন ভিত্তিক গাড়ি চালান। এক্ষেত্রে ভাড়া যত বেশি আদায় করতে পারবেন কমিশন তত বেশি পাবেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের (ঢামেক) এম্বুলেন্স চালক সবুজ বলেন, কোন নির্ধারিত ভাড়া নেই। রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে যা নেয়া যায়। আমরা একটা ভাড়া বলে দেই পরে দরদাম করে ঠিক হয়। আমরা ভাড়া বলার আগে সড়কে গ্যাস, টোল, ফেরিভাড়া, খাওয়া, গ্যাসসহ অন্যান্য খরচ কত লাগবে তা হিসাব করে নেই। কারণ খরচ বাদ দিয়ে মালিককে এনে যা দিব তার মধ্যে থেকেই চালকের কমিশন দেয়া হয়। ইব্রাহিম নামের আরেক চালক জানান, ভাড়া নির্ধারণ হয় সাধারণত গাড়ি এসি, নন এসি আর ছোট-বড় গাড়ির ওপর। নন এসি গাড়ির ভাড়া তুলনামূলক কম। এসি গাড়ির ভাড়া একটু বেশি নেয়া হয়। এছাড়া সড়কে খরচের ওপর ভাড়া কম- বেশি হয়। তিনি বলেন, ঢাকা শহরের অন্যান্য হাসপাতালের চেয়ে ঢামেকের এম্বুলেন্স চালকরা একটু কম ভাড়া নেয়। অন্যান্য হাসপাতালে আমাদের চেয়ে অনেক বেশি ভাড়া নেয়া হয়। মিটফোর্ড হাসপাতালের চালক রহিম মিয়া জানান, দীর্ঘদিন ধরে এম্বুলেন্স চালক হিসাবে কাজ করছি। ঢাকার ২/৩টি হাসপাতালের এম্বুলেন্স চালিয়েছি। কিন্তু এক হাসপাতালের এম্বুলেন্স ভাড়ার সঙ্গে আরেক হাসপাতালের মিল নাই।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে সারাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী আসা যাওয়া করে। যাদের অধিকাংশই ঢাকার বাইরে থেকে আসেন। এসব হাসপাতালে এম্বুলেন্সের চাহিদাও বেশি থাকে। আর এই সুযোগটা কাজে লাগায় সিন্ডিকেট। বাইরে থেকে আসা অনেক রোগীর স্বজন তাদের সঙ্গে যুক্তিতর্ক ও যাচাই বাচাই করে পেরে উঠেন না। তাই বাধ্য হয়ে তাদের কাছে যেতে হয়। বিশেষকরে হাসপাতালে কোন রোগী মারা গেলে তাদের স্বজনরা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত থাকেন। এমন মুহূর্তেও চালকরা সহযোগিতা না করে আরও বেশি ভাড়া আদায় করে। রোগীর তুলনায় মরদেহ পৌঁছে দেয়ার জন্য বাড়তি ভাড়া দিতে হয়।
এম্বুলেন্স চালকরা জানিয়েছেন, ঢাকার পাশ্ববর্তী কুমিল্লায় কোন এম্বুলেন্স গেলে ৫ হাজার থেকে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা ভাড়া নেয়া হয়। ফরিদপুরে নেয়া হয় সাড়ে ৭ হাজার থেকে ৮ হাজার টাকা। সিলেটে যেতে কোন ফেরি ভাড়া না লাগার কারণে ৯ থেকে ১০ হাজার টাকা কেউ কেউ নিচ্ছেন। হাসপাতাল ভেদে এই ভাড়া আরও বেশি। একাধিক চালক জানিয়েছেন, ঢাকা মেডিকেলে এক সময় মাত্র তিনটি এম্বুলেন্স ছিল। এখন এই সংখ্যা সত্তরের ওপরে। বেশি এম্বুলেন্স থাকায় অনেক চালকই প্রতিদিন ট্রিপ পায় না। আবার কেউ কেউ কেউ দিনে ছোট-বড় ২/৩টি ট্রিপ পায়।
রোগীর স্বজনরা বলেছেন, এম্বুলেন্স চালকরা লাগামহীন ভাড়া হাঁকিয়ে বসে। তারা যে ভাড়া চায় ওই ভাড়া থেকে খুব একটা কমানোর সুযোগ থাকে না। ঢামেকের সকল চালক প্রায় একই ভাড়া দাবি করেন। ঢাকার বাইরে থেকে আসা এম্বুলেন্সে কিছুটা কম ভাড়ায় যাওয়ার সুযোগ থাকে তবে ঢামেকের চালকদের কারণে সেটা আর সম্ভব হয় না। ঢামেকের রোগীদের নাকি এখানকার এম্বুলেন্সে করে যেতে হয়। এ কারণে ভাড়াও বেশি রাখা হয়।
মঙ্গলবার দুপুরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের জরুরী বিভাগের সামনে কথা হয় কুমিল্লাগামী এক রোগীর স্বজন আসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, কুমিল্লা যাওয়ার ভাড়া প্রথমে সাত হাজার টাকা চায় এক চালক। পরে অনেক দরাদরি করে ৫ হাজার ২০০ টাকায় রাজি করিয়ে এখন রওয়ানা দিচ্ছি। মৌলভীবাজারের এক রোগীর স্বজন রুবেল হোসেন বলেন, ৯ হাজার টাকা ভাড়ায় মৌলভীবাজার নিয়ে যাচ্ছি একটি এম্বুলেন্স। কেন এত বেশি ভাড়া নেয়া হচ্ছে জানতে চাইলে ওই চালক জানান, রোগীকে নামিয়ে দিয়ে আসার সময় খালি আসতে হয়। এজন্য যাওয়া আসার খরচসহ ভাড়া নেয়া হয়। এছাড়া সড়কে ট্রাফিক সার্জেন্টরা আটকালে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে মামলা দেয়। এক একটি মামলা ১৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৪০০ টাকা হয়।
এদিকে একটি সূত্র বলছে, বিগত কয়েক বছর থেকে এম্বুলেন্স ব্যবসার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে অনেকের। স্বল্প পুঁজিতে লাভজনক ও নগদ আয়ের ব্যবসা, ঝক্কি-ঝামেলা কম থাকায় এ আগ্রহ। এম্বুলেন্স আমদানিতে শুল্ক কম থাকায়ও অনেকে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। বাংলাদেশ রোড ট্র্যান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) সূত্র জানিয়েছে, ২০১০ সাল পর্যন্ত ঢাকায় রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ১ হাজার ৩৭৪ টি। ২০১১ থেকে ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত এই সংখ্যা দাড়িয়েছে ২ হাজার ৩৩৬ টিতে। এর মধ্যে ২০১১ সালে ১৩৭টি, ২০১২ সালে ১১৪টি, ২০১৩ সালে ১৯০টি, ২০১৪ সালে ২৫৪টি, ২০১৫ সালে ৩৫৮টি, ২০১৬ সালে ২৮৭টি, ২০১৭ সালে ৪০০টি, ২০১৮ সালে ৪৫৬টি ও ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত রেজিষ্ট্রেশন হয়েছে ১৪০টি। সব মিলিয়ে বিআরটিএ শুধুমাত্র ঢাকাতেই ৩ হাজার ৭১০টি এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছে। যা সারা বাংলাদেশে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের অর্ধেকের চেয়ে অনেক বেশি।
বিআরটিএ জানিয়েছে ২০১০ সাল পর্যন্ত সারা দেশে রেজিষ্ট্রেশনকৃত এম্বুলেন্সের সংখ্যা ছিল ২ হাজার ৭৯৩টি। আর ২০১১ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত সেটি গিয়ে দাড়িয়েছে ৫ হাজার ৮৭১টিতে। এর মধ্যে ২০১১ সালে হয়েছে ২১৯টি, ২০১২ সালে ১৮১টি, ২০১৩ সালে ২৪৩টি, ২০১৪ সালে ৩৩৮টি, ২০১৫ সালে ৪৮০টি, ২০১৬ সালে ৩৭৮টি, ২০১৭ সালে ৪৯৫টি, ২০১৮ সালে ৫৬৪টি ও ২০১৯ সালের মে মাস পর্যন্ত হয়েছে ১৮০ টি। সব মিলিয়ে সারা দেশে মোট ৫ হাজার ৮৭১টি এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন দিয়েছে বিআরটিএ।
ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতির সভাপতি মো. আলমগীর হোসেন মানবজমিনকে বলেন, এম্বুলেন্সের কোন নীতিমালা না থাকা ও হাসপাতাল ভিত্তিক সিন্ডিকেট গড়ে উঠার কারণে ভাড়া বেশি নেয় চালকরা। নীতিমালা হয়ে গেলে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয়া হবে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে এম্বুলেন্স মালিকদের টেক্স দিতে হচ্ছে। এই টেক্স মওকূপ হয়ে গেলে আরও কম টাকায় সেবা দেয়া যাবে।
তিনি বলেন, আমরা চাই একটা নীতিমালা হোক। এজন্য সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, সমাজসেবা মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও যোগাযোগ মন্ত্রণালয়ে নীতিমালা চেয়ে লিখিত আবেদন করেছি। এছাড়া হাইকোর্টে রিটও করেছি। নীতিমালা হয়ে গেলে কি কি সুবিধা মিলবে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমরা রোগীদের সঠিক সেবা দিকে চাই। একটি মানসম্মত এম্বুলেন্স যাতে অক্সিজেন, প্রাথমিক চিকিৎসার সরঞ্জাম, এসিসহ প্রয়োজনীয় সব কিছু থাকবে। কারণ অনেকেই পুরাতন গাড়িতে স্টিকার লাগিয়ে নিম্নমানের সুবিধা দিয়ে এম্বুলেন্স সার্ভিস দিচ্ছে। এসব এম্বুলেন্স থেকে রোগীরা ভালো সুবিধা পায় না।
দিন দিন এম্বুলেন্সের রেজিষ্ট্রেশন কেন বেড়ে যাচ্ছে এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এক সময় এই ব্যবসায় নানা ঝামেলা ছিল, গাড়ির দামও বেশি ছিল। কিন্তু এখন দাম অনেক কমেছে। এম্বুলেন্স আমদানিতে টেক্স অনেক কমে গেছে। একটি মাইক্রোবাস কিনতে ৩০ লাখ টাকা লাগলে এম্বুলেন্সে ২০ লাখ টাকা লাগছে। তাই অনেকেই এখন মাইক্রোবাস না কিনে এম্বুলেন্স কিনছে।
No comments