‘আমরা সবাই মায়েদের কান্না শুনছি’
‘আমার
বয়স যখন মাত্র ৮ বছর তখন আমার বাবা গুম হন। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। এখন
আমি ক্লাস নাইনে পড়ি। দীর্ঘ ৫ বছর আমি বাবাকে দেখি না। বাবাকে ছাড়াই কী আমি
বেঁচে থাকবো? আমি আমার বাবাকে ফেরত পেতে চাই। বাবার সঙ্গে বেড়াতে যেতে
চাই। আমি আমার বাবার বুকে ঘুমাতে চাই। আমি যখন স্কুলে যাই আমি দেখি আমার
বন্ধুদের অনেকের বাবা তাদের স্কুল ছুটির পর নিতে আসেন।
কিন্তু, আমি একা একা বাসায় আসি। আমি আমার বাবার অনুপস্থিতি প্রতিটি পদে পদে অনুভব করি।’ কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল গুম হওয়া তেজগাঁও থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে রাইসা। রাইসা বাবা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্না উপস্থিত আলোচক ও শ্রোতাদেরও আপ্লুত করে। অনেকেই চোখ মুছতে থাকেন। গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে স্বজন হারানোদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক- Mother’s Call’ এর উদ্যোগে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস ২০১৯ উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল ‘মায়ের ডাক’-এর সভানেত্রী ও ২০১৩ সালে গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগমের। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় সুমনের বড়বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী সভাপতিত্ব করেন।
অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মা ও তাদের স্বজনেরা গুম হওয়া সদস্যদের জন্য ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মঞ্চের সামনে আগত ছোট ছোট শিশুরা তাদের বাবার ছবি তুলে ধরে। এতে লেখা ছিল ‘শুধু বাবাকে ফিরে পেতে চাই।’ মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে যায় প্রেস ক্লাবের হলরুম। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতির পরিবর্তে মায়েদের কান্নার রোল পড়ে যায় হলরুমে। অনুষ্ঠানে দেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান করতে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের উদ্যোগের দাবি জানান বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ২০১৩ সালের ২৬শে এপ্রিল গুম হওয়া রনি হোসেনের মা আঞ্জুমান আরা বেগম, ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট গুম হওয়া সাজ্জাদ হোসেনের মা সাজেদা বেগম, ২০১৯ সালের ১৯শে জুন গুম হওয়া ইসমাঈল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার ও সাতক্ষীরা এলাকার গুম হওয়া মোখলেসুরের পিতা আব্দুর রশিদ ও বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস, সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি, নিখোঁজ তপুর মা সালেহা বেগম, পিন্টুর বোন মুন্নী, পারভেজ হোসেনের শিশু কন্যা হৃদী, নিখোঁজ গাড়িচালক কাউসারের মেয়ে লামিয়া, যশোরের মোহন মিয়ার বাবা জামশেদ ও সুজনের ভাই শাকিলসহ অন্যরা।
অনুষ্ঠানে গুম হওয়া পল্লী চিকিৎসক মোখলেসুরের পিতা আব্দুর রশিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ২০১৬ সালের ৪ঠা আগস্ট সন্দেহবশত থানা পুলিশ আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন থানায় ছিল। থানায় পুলিশের মাধ্যমে খাবারও দিয়েছি। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে আকুতি করে বলেছিল, সে কোনো দল করে না। কোনো উগ্রবাদেও বিশ্বাস করে না। পুলিশ আমাকে চাপ দিতে থাকে যে, তার ছেলে যাতে পুলিশের কাছে স্বীকার করে সে সরকার বিরোধী কাজে জড়িত। স্বীকার না করলে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। আমাকে গালিগালাজ করা হয়। কিন্তু, আমার ছেলে অন্যায় স্বীকারোক্তি দেয়নি। তিনদিন পর থানার ওসি আলতাফ জানায় যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্যস্থানে পাঠানো হয়েছে। সেই যে পাঠানো হলো আর ফিরে আসেনি আমার ছেলে। কথাগুলো বলতে বলতে একপর্যায়ে মূর্ছা যান সত্তরোর্ধ্ব আব্দুর রশীদ। তখন তার মাথায় পানি ঢালা হয়।
রাজধানীর রামপুরা থেকে নিখোঁজ ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম বলেন, আমার ছেলে তিন বছর ৭ মাস ধরে নিখোঁজ। যুবলীগের স্থানীয় নেতারা প্রশাসনকে দিয়ে আমার ছেলেকে গুম করে। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে হাজারও মানুষের দুয়ারে গেছি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজও আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। আর কতদিন আমি ছেলের অপেক্ষায় থাকবো, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সালেহা বেগম।
ফেনীর মাহবুবুর রহমান রিপনের মা রওশন আরা বলেন, আমার ছেলেকে ২০১৪ সালের মার্চের ২০ তারিখে রাতের আঁধারে আমার বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে কালো পোশাকধারীরা চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। যখন রিপনকে নিয়ে যায়, তখন তার একটি শিশু বাচ্চা রেখে যায়। মামলা করতে গিয়েছি। তারা মামলাও নেয়নি। আজও আমি ছেলেকে ফেরত পাইনি। কোনো বিচারও পাইনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউনাইটেড ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমার বোন সুভদ্রা চাকমা বলেন, গত ৯ই এপ্রিল আমার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরনা দিয়েছি। প্রথমে তারা আটকের বিষয়টি স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করে।
সুভদ্রা বলেন, আমাদের দাবি আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাকে আইনের মাধ্যমে বিচার করুন। নইলে আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন। এ পর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখনো সময় আছে অতীতের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চান। গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের যদি তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে পারেন তাহলে পরিবারগুলো আপনাদের ক্ষমা করবে। আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবে। অন্যথায় কারও কাছেই আপনারা ক্ষমা পাবেন না। তিনি আরো বলেন, দেশে প্রকৃত অর্থে কোনো আইনের শাসন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, দেশের প্রতিটি গুমের সঙ্গে সরকার জড়িত। পরিবারগুলোর বর্ণনা মতে প্রতিটি গুমের সময়ে সরকারি গাড়ি কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে বা তাদের গাড়ি ব্যবহার হলো কিভাবে? এ ছাড়া প্রতিটি ঘটনার পরে থানায়ই বা সাধারণ ডায়েরি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে কেন? সরকার যদি গুমের সঙ্গে জড়িত নাই থাকে তাহলে স্বাধীন কমিশন গঠন করে এতগুলো গুমের ঘটনা তদন্ত করছে না কেন ?
ড. নজরুল বলেন, গুম একটি অপরাধ যা, হত্যা বা খুনের চেয়েও নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ। কেননা গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার সারা জীবনই অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে চলেন। পরিবার গুম হওয়া স্বামী কিংবা সন্তানের কোনো খোঁজ পায় না। অনেক পরিবার আছে যারা কারো কাছে কোনো অভিযোগ করবে না, শুধু লাশটি ফেরত চায় অথবা নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান শুধু চায়।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমান সরকারকে হৃদয়হীন উল্লেখ করে বলেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কান্নায় এই সরকারের হৃদয় নড়েও না, গলেও না। তিনি আরো বলেন, যে সরকার দেশের ১০ কোটি ভোটারের ভোট রাতের অন্ধকারে লুট করতে পারে সেই সরকারের কাছে কোনো কাকুতি মিনতি করেও কোনো লাভ হবে না। এই সরকারের জনগণের সরকার নয়। তাই এই সরকার জনগণের কথা শুনে না। জনগণের কথা এই সরকারের কানে প্রবেশ করবে না।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, নারায়ণগঞ্জের যে ৭ খুন হয়েছিল তাদের আগে সড়ক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের লাশ যদি নদীতে ভেসে না উঠতো তাহলে তারাও গুম অবস্থায় থেকে যেত। জানি না, যারা গুম হয়েছে তাদের ভ্যাগে কী জুটেছে। আমরা পরিবারের কাছে জেনেছি যে, প্রত্যেকটি গুমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। গুম ব্যক্তিদের অবশ্যই পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং এইসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যাতে কেউ এইসব অপরাধ না করতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড সাইফুল হক বলেন, এখানে মায়েদের, স্ত্রীদের, শিশুদের যে আর্তনাদ তাতে কারও সুস্থ থাকা সত্যিই কঠিন। এখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা যদি আজকের এ কর্মসূচি রেকর্ড করে থাকেন, ভিডিও করে থাকেন, তাহলে দয়া করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবেন। কারণ তিনি প্রায়শই বলে থাকেন, স্বজন হারানোর বেদনা তিনি বোঝেন। আজকের এই যে আহাজারি তা প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাশালীরা দেখলে কিছুটা হলেও আপ্লুত হবেন। তাহলে স্বজন হারানোরা বিচার পেতে পারেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, পাহাড়ে সমতলে আজ স্বজন হারানোদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আছে কি না, তা আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আক্তার বলেন, আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে গুমের শিকার হওয়া স্বজনদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। গুমের শিকার হওয়া স্বজনরা যেভাবে কথা বলছেন, এটা অত্যন্ত শক্তিশালী। অত্যন্ত সাহসী কাজ। আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, আজকে এখানে আমরা সবাই কান্না শুনছি। মায়েদের কান্না শুনছি। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার, নির্যাতক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এর বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা না আসলে এ কান্না থামবে না।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই এ অনুষ্ঠানে আসি। কিন্তু আজকে অনেককেই দেখতে পাই না। কারণ তারা স্বজনদের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পরপারে চলে গেছেন। অথচ বিচার দেখে যেতে পারেন নি।
অনুষ্ঠানে এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও মানবাধিকার কর্মী নাসির উদ্দিন এলানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
কিন্তু, আমি একা একা বাসায় আসি। আমি আমার বাবার অনুপস্থিতি প্রতিটি পদে পদে অনুভব করি।’ কথাগুলো কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলছিল গুম হওয়া তেজগাঁও থানা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম সুমনের মেয়ে রাইসা। রাইসা বাবা সম্পর্কে বক্তব্য রাখতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। তার কান্না উপস্থিত আলোচক ও শ্রোতাদেরও আপ্লুত করে। অনেকেই চোখ মুছতে থাকেন। গতকাল বিকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবের মিলনায়তনে স্বজন হারানোদের সংগঠন ‘মায়ের ডাক- Mother’s Call’ এর উদ্যোগে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে আন্তর্জাতিক দিবস ২০১৯ উপলক্ষে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। এতে সভাপতিত্ব করার কথা ছিল ‘মায়ের ডাক’-এর সভানেত্রী ও ২০১৩ সালে গুম হওয়া সাজেদুল ইসলাম সুমনের মা হাজেরা বেগমের। কিন্তু তিনি অসুস্থ থাকায় সুমনের বড়বোন মারুফা ইসলাম ফেরদৌসী সভাপতিত্ব করেন।
অনুষ্ঠানে প্রত্যেক মা ও তাদের স্বজনেরা গুম হওয়া সদস্যদের জন্য ফিরে পাওয়ার আকুতি জানিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। মঞ্চের সামনে আগত ছোট ছোট শিশুরা তাদের বাবার ছবি তুলে ধরে। এতে লেখা ছিল ‘শুধু বাবাকে ফিরে পেতে চাই।’ মায়েদের বুকফাটা আর্তনাদে ভারি হয়ে যায় প্রেস ক্লাবের হলরুম। সন্তানকে ফিরে পাওয়ার আকুতির পরিবর্তে মায়েদের কান্নার রোল পড়ে যায় হলরুমে। অনুষ্ঠানে দেশে বিভিন্ন সময়ে গুমের শিকার ব্যক্তিদের সন্ধান করতে একটি স্বাধীন নিরপেক্ষ কমিশন গঠনের উদ্যোগের দাবি জানান বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনসহ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা।
অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন ২০১৩ সালের ২৬শে এপ্রিল গুম হওয়া রনি হোসেনের মা আঞ্জুমান আরা বেগম, ২০১৫ সালের ২১শে আগস্ট গুম হওয়া সাজ্জাদ হোসেনের মা সাজেদা বেগম, ২০১৯ সালের ১৯শে জুন গুম হওয়া ইসমাঈল হোসেনের স্ত্রী নাসরিন আক্তার ও সাতক্ষীরা এলাকার গুম হওয়া মোখলেসুরের পিতা আব্দুর রশিদ ও বিএনপির নিখোঁজ নেতা ইলিয়াস আলীর ছেলে আবরার ইলিয়াস, সাজেদুল ইসলাম সুমনের বোন আফরোজা ইসলাম আঁখি, নিখোঁজ তপুর মা সালেহা বেগম, পিন্টুর বোন মুন্নী, পারভেজ হোসেনের শিশু কন্যা হৃদী, নিখোঁজ গাড়িচালক কাউসারের মেয়ে লামিয়া, যশোরের মোহন মিয়ার বাবা জামশেদ ও সুজনের ভাই শাকিলসহ অন্যরা।
অনুষ্ঠানে গুম হওয়া পল্লী চিকিৎসক মোখলেসুরের পিতা আব্দুর রশিদ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ২০১৬ সালের ৪ঠা আগস্ট সন্দেহবশত থানা পুলিশ আমার ছেলেকে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়। তিনদিন থানায় ছিল। থানায় পুলিশের মাধ্যমে খাবারও দিয়েছি। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে আকুতি করে বলেছিল, সে কোনো দল করে না। কোনো উগ্রবাদেও বিশ্বাস করে না। পুলিশ আমাকে চাপ দিতে থাকে যে, তার ছেলে যাতে পুলিশের কাছে স্বীকার করে সে সরকার বিরোধী কাজে জড়িত। স্বীকার না করলে করুণ পরিণতি বরণ করতে হবে। আমাকে গালিগালাজ করা হয়। কিন্তু, আমার ছেলে অন্যায় স্বীকারোক্তি দেয়নি। তিনদিন পর থানার ওসি আলতাফ জানায় যে, ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য অন্যস্থানে পাঠানো হয়েছে। সেই যে পাঠানো হলো আর ফিরে আসেনি আমার ছেলে। কথাগুলো বলতে বলতে একপর্যায়ে মূর্ছা যান সত্তরোর্ধ্ব আব্দুর রশীদ। তখন তার মাথায় পানি ঢালা হয়।
রাজধানীর রামপুরা থেকে নিখোঁজ ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম হোসেন তপুর মা সালেহা বেগম বলেন, আমার ছেলে তিন বছর ৭ মাস ধরে নিখোঁজ। যুবলীগের স্থানীয় নেতারা প্রশাসনকে দিয়ে আমার ছেলেকে গুম করে। আমি আমার ছেলেকে ফিরে পেতে হাজারও মানুষের দুয়ারে গেছি। সবাই শুধু আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু আজও আমি আমার ছেলেকে ফিরে পাইনি। আর কতদিন আমি ছেলের অপেক্ষায় থাকবো, বলে কান্নায় ভেঙে পড়েন সালেহা বেগম।
ফেনীর মাহবুবুর রহমান রিপনের মা রওশন আরা বলেন, আমার ছেলেকে ২০১৪ সালের মার্চের ২০ তারিখে রাতের আঁধারে আমার বাড়ি থেকে ঘরের দরজা ভেঙে কালো পোশাকধারীরা চোখ বেঁধে নিয়ে যায়। যখন রিপনকে নিয়ে যায়, তখন তার একটি শিশু বাচ্চা রেখে যায়। মামলা করতে গিয়েছি। তারা মামলাও নেয়নি। আজও আমি ছেলেকে ফেরত পাইনি। কোনো বিচারও পাইনি।
পার্বত্য চট্টগ্রামের ইউনাইটেড ফ্রন্টের সাধারণ সম্পাদক মাইকেল চাকমার বোন সুভদ্রা চাকমা বলেন, গত ৯ই এপ্রিল আমার ভাইকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তুলে নিয়ে যায়। আমরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরনা দিয়েছি। প্রথমে তারা আটকের বিষয়টি স্বীকার করলেও পরে তা অস্বীকার করে।
সুভদ্রা বলেন, আমাদের দাবি আমার ভাই যদি অপরাধ করে থাকে, তাহলে তাকে আইনের মাধ্যমে বিচার করুন। নইলে আমার ভাইকে ফিরিয়ে দিন। এ পর্যায়ে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন।
অনুষ্ঠানে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী সরকারকে উদ্দেশ্য করে বলেন, এখনো সময় আছে অতীতের ভুলের জন্য জাতির কাছে ক্ষমা চান। গুম হওয়া ব্যক্তিদের তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিন। গুম হওয়া ব্যক্তিদের যদি তাদের পরিবারের কাছে ফেরত দিতে পারেন তাহলে পরিবারগুলো আপনাদের ক্ষমা করবে। আল্লাহ আপনাদের ক্ষমা করবে। অন্যথায় কারও কাছেই আপনারা ক্ষমা পাবেন না। তিনি আরো বলেন, দেশে প্রকৃত অর্থে কোনো আইনের শাসন নেই।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, দেশের প্রতিটি গুমের সঙ্গে সরকার জড়িত। পরিবারগুলোর বর্ণনা মতে প্রতিটি গুমের সময়ে সরকারি গাড়ি কিংবা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাকে বা তাদের গাড়ি ব্যবহার হলো কিভাবে? এ ছাড়া প্রতিটি ঘটনার পরে থানায়ই বা সাধারণ ডায়েরি নিতে অপারগতা প্রকাশ করে কেন? সরকার যদি গুমের সঙ্গে জড়িত নাই থাকে তাহলে স্বাধীন কমিশন গঠন করে এতগুলো গুমের ঘটনা তদন্ত করছে না কেন ?
ড. নজরুল বলেন, গুম একটি অপরাধ যা, হত্যা বা খুনের চেয়েও নিষ্ঠুর ও ভয়াবহ। কেননা গুম হওয়া ব্যক্তির পরিবার সারা জীবনই অবর্ণনীয় কষ্ট নিয়ে চলেন। পরিবার গুম হওয়া স্বামী কিংবা সন্তানের কোনো খোঁজ পায় না। অনেক পরিবার আছে যারা কারো কাছে কোনো অভিযোগ করবে না, শুধু লাশটি ফেরত চায় অথবা নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান শুধু চায়।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বর্তমান সরকারকে হৃদয়হীন উল্লেখ করে বলেন, গুম হওয়া ব্যক্তিদের পরিবারের কান্নায় এই সরকারের হৃদয় নড়েও না, গলেও না। তিনি আরো বলেন, যে সরকার দেশের ১০ কোটি ভোটারের ভোট রাতের অন্ধকারে লুট করতে পারে সেই সরকারের কাছে কোনো কাকুতি মিনতি করেও কোনো লাভ হবে না। এই সরকারের জনগণের সরকার নয়। তাই এই সরকার জনগণের কথা শুনে না। জনগণের কথা এই সরকারের কানে প্রবেশ করবে না।
মানবাধিকার কর্মী নূর খান লিটন বলেন, নারায়ণগঞ্জের যে ৭ খুন হয়েছিল তাদের আগে সড়ক থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। তাদের লাশ যদি নদীতে ভেসে না উঠতো তাহলে তারাও গুম অবস্থায় থেকে যেত। জানি না, যারা গুম হয়েছে তাদের ভ্যাগে কী জুটেছে। আমরা পরিবারের কাছে জেনেছি যে, প্রত্যেকটি গুমের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী জড়িত। গুম ব্যক্তিদের অবশ্যই পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিতে হবে এবং এইসব অপরাধ কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যাতে কেউ এইসব অপরাধ না করতে পারে।
বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি কমরেড সাইফুল হক বলেন, এখানে মায়েদের, স্ত্রীদের, শিশুদের যে আর্তনাদ তাতে কারও সুস্থ থাকা সত্যিই কঠিন। এখানে গোয়েন্দা সংস্থার লোকেরা যদি আজকের এ কর্মসূচি রেকর্ড করে থাকেন, ভিডিও করে থাকেন, তাহলে দয়া করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেবেন। কারণ তিনি প্রায়শই বলে থাকেন, স্বজন হারানোর বেদনা তিনি বোঝেন। আজকের এই যে আহাজারি তা প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাশালীরা দেখলে কিছুটা হলেও আপ্লুত হবেন। তাহলে স্বজন হারানোরা বিচার পেতে পারেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকী বলেন, পাহাড়ে সমতলে আজ স্বজন হারানোদের আহাজারিতে আকাশ-বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব আছে কি না, তা আমাদের প্রশ্ন রয়েছে।
মানবাধিকার কর্মী ফরিদা আক্তার বলেন, আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবসে গুমের শিকার হওয়া স্বজনদের প্রতি সংহতি জানাচ্ছি। গুমের শিকার হওয়া স্বজনরা যেভাবে কথা বলছেন, এটা অত্যন্ত শক্তিশালী। অত্যন্ত সাহসী কাজ। আমি আপনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাই।
ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক ঢাবি শিক্ষক অধ্যাপক আকমল হোসেন বলেন, আজকে এখানে আমরা সবাই কান্না শুনছি। মায়েদের কান্না শুনছি। একটা ফ্যাসিস্ট সরকার, নির্যাতক রাষ্ট্র ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে আমরা যাচ্ছি। এর বিকল্প রাজনৈতিক ব্যবস্থা না আসলে এ কান্না থামবে না।
জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফয়জুল হাকিম বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই এ অনুষ্ঠানে আসি। কিন্তু আজকে অনেককেই দেখতে পাই না। কারণ তারা স্বজনদের অপেক্ষায় থাকতে থাকতে পরপারে চলে গেছেন। অথচ বিচার দেখে যেতে পারেন নি।
অনুষ্ঠানে এ সময় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া ও মানবাধিকার কর্মী নাসির উদ্দিন এলানসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ।
No comments