বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে বিএনপি -প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী
শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে বিএনপি। এই গুম
খুনের কালচার তো শুরু করেছিল জিয়াউর রহমান এই দেশে। আমাদের নারায়ণগঞ্জের
ছাত্রনেতা মাহফুজ বাবু, তাকে যে তুলে নিয়ে গেল তার পরিবার তো আর তার লাশ
পায়নি। শুধু আমাদের রাজনৈতিক দলের উপর এই জুলুম অত্যাচার তা নয়,
সেনাবাহিনীতে যারা মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছিল। যারা একদিন জাতির পিতার ডাকে
সাড়া দিয়ে অস্ত্র হাতে তুলে যুদ্ধ করেছিল সেরকম বহু অফিসারকে নির্মমভাবে
একের পর এক হত্যা করেছে। রাজধানীর আগারগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক
সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত জাতীয় শোক
দিবসের এক আলোচনা সভায় তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কারবালায়
যেভাবে নির্মম হত্যাকাণ্ড চালানো হয়েছিল। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট যেন
কারবালার ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো ৩২ নম্বরে।
১৫ দিন আগে আমরা বিদেশে যাই। আমরা দুইবোন ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যাই। বাংলাদেশের মানুষ এমন একটি মানুষকে হত্যা করল যে মানুষ তাদের দেশ দিলো, স্বাধীনতা দিলো। সভায় এ নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বক্তব্যে বারবার শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদতে এবং চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।
অতীতেও বিভিন্ন সময় ১৫ই আগস্টের নিষ্ঠুরতা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কাঁদতে দেখা গেছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করলো। ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করল। মন্ত্রিসভা যখন গঠন করলো, সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিলো। বিএনপির একটা কথা জানা উচিত, জিয়ার ক্ষমতা দখলকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। এজন্য বিএনপির সৃষ্টিটাও অবৈধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে তারা। আদর্শের রাজনীতি ধ্বংস করে খুনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ই আগস্টে শুধু একটা পরিবারকে হত্যা নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাসকে একবারে মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান তা মুছে দেয়া হয়েছিল। একমাত্র বিটিভি ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। একেবারে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অবিনশ্বর। তিনি আজ জীবন্ত ইতিহাস। তিনি বেঁচে আছেন বাঙালির হৃদয়ে, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতারা নতুন সাফাই গাইতে শুরু করেছে।
বিএনপি নেতারা বলছে, ৭৫ সালে তো বিএনপি গঠনই হয়নি তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিএনপি কীভাবে জড়িত হলো? কিন্তু বিএনপির যে প্রতিষ্ঠাতা, সেই জিয়াউর রহমান নিজেই খুনি। জিয়াউর রহমান শুধু খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এই হত্যার বিচার হবে না সেই ব্যবস্থাও জিয়াউর রহমান করেছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল তাদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। ডালিমসহ অন্যদের যখন বিদেশে পাঠানো হলো অনেক দেশ তাদের গ্রহণ করেনি। যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সপক্ষে ছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কূটনীতিক হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তারাও পরবর্তীতে জিয়ার সঙ্গে গেছে। অনেকে এখনো বেঁচে আছে, বড় বড় কথাও বলে। কিন্তু তারা যে এই চক্রান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না এবং আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে। এ সময় শেখ হাসিনা ১৫ই আগস্টের ঘটনায় বিদেশে অবস্থানের কারণে দুই বোনকে তৎকালীন সেনা সরকার দেশে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছিল তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কারণ এই মিলিটারি ডিটেকটররা যখন ক্ষমতা নেয় তখন তাদের মনের ভেতর একটা সুপ্ত বাসনা থাকে, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার। যদিও তারা রাজনৈতিক নেতাদেরই গালি দেয়। কারণ মোশতাক বেইমানি করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। আড়াই মাসও কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক যেভাবে মীরজাফর বেইমানি করে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করেছিল, মীরজাফরও কিন্তু ওই দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
ঠিক মোশতাকের ভাগ্যেও তাই ঘটলো, সেও থাকতে পারলো না। এই মোশতাকই কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন দেশে ফিরতে পারলাম না। ১৯৭৯ সালে প্রথম রেহানা সুইডেনে যান। কারণ সুইডেনের যিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. রাজ্জাক। তিনি মোশতাক সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেননি এবং বলেছিলেন আমি খুনিদের চাকরি করবো না। তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই না, তিনি সেখানে একটা সভার আয়োজন করেন। তখন রেহানা ১৯৭৯ সালে সেখানে যায় এবং ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে প্রথম রেহানাই সুইডেনে প্রতিবাদ করেছিল এবং বক্তব্য দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই এবং রেহানার পাসপোর্টের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশের দূতাবাস সেই পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেয়নি। কারণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমি দিল্লিতে ছিলাম। দিল্লিতে আমাদের যিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব, তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামি ছিলেন। তিনি কোনো কিছু না বলে চুপচাপ আমাদের পাসপোর্টটা রিনিউ করে দিয়েছিলেন। লন্ডনের দূতাবাস রেহানার পাসপোর্ট দেয়নি। কারণ উদ্দেশ্য একটিই ছিল কোনোমতে যেন দেশে আসতে না পারে।
তবে বৃটিশ সরকার পরে তাকে অ্যাসাইলাম দেয় এবং তাকে সেখানেই নাগরিকত্ব দিয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, আমি ১৯৮০ সালে লন্ডনে গেলাম। এই ব্যাপারে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এরপর লন্ডনে গিয়ে প্রতিবাদ সভা করি এবং সেখানে একটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যিনি জাতির পিতাকে সমর্থন করতে এসেছিলেন, স্যার টমাস উইলিয়ামস (কুইস কাউন্সিলের তিনি সদস্য)। তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপি ছিলেন। তিনি এবং শন ম্যাকব্রাইড আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নোবেল লরিয়েট, তাকেসহ বৃটিশ অন্যান্য দলের এমপিদের নিয়ে আমরা একটা ইনকোয়ারি কমিটি করি এবং এই ইনকোয়ারি কমিটিতে প্রবাসী বাঙালিরা তারা সেখানে ডোনেশন দেয় এবং ইনকোয়ারি কমিটির পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসবেন, এই ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবার জন্য এবং স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে আমরা ঠিক করি তিনি আসবেন এবং ওনাকে একটি সলিসিটারও নিয়োগ দেয়া হয় যার কাছে ফান্ড থাকতো এবং সমস্ত কাজগুলো হবে। তিনি যখন ভিসা চাইলেন, জিয়াউর রহমান তখন প্রেসিডেন্ট। জিয়া কিন্তু স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে ভিসা দেয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি যখন এসেছিলেন, তখন কিন্তু পাকিস্তানি সরকারও ভিসা দিয়েছিল।
কিন্তু ১৫ই আগস্টের পরে যখন ১৯৮০ সালে স্যার টমাস উইলিয়ামস আসতে চাইলেন, জিয়াউর রহমান তাকে ভিসা দিলেন না। শেখ হাসিনা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, প্রশ্ন এখানে, বিএনপি নেতাদের এটা আমি বলতে চাই এবং জিজ্ঞাসা করি, জিয়া যদি খুনি না হবেন আর তার হাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এই বিএনপি, এরা যদি খুনিদের দল না হবে আর খুনির দল না হয়, তাহলে স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে কেন বাংলাদেশে তদন্ত করতে আসতে দেয়নি? তার দুর্বলতাটা কি ছিল? সে কিন্তু ভিসা দেয়নি। অর্থাৎ এই ঘটনার কোনো তদন্ত হোক, হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, সেটা তো আইন করে আগেই বিচার বন্ধ, খুনিদের পুরস্কৃত করা এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সাধারণত মিলিটারি ডিটেকটর যখন ক্ষমতায় আসে আগে রাজনীতিবিদদের গালি দেয়। আর এরপরে নিজেরাই উর্দি খুলে তারপরে রাজনীতিবিদ সাজতে চায়। প্রথমে হ্যাঁ-না ভোট তারপরে প্রেসিডেন্ট ভোট অনেক নাটক করে এরপরে সে রাজনৈতিক দল করলো এবং সেটাও কয়েক দফা দলের নাম পরিবর্তন করে এই বিএনপির সৃষ্টি। আর সেই দলে যোগ দিলো কে? আওয়ামী লীগের যে সকল নেতাকর্মী বেইমান-মুনাফেক তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তারা ছাড়া সব নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং কারাগারে ছিল। আবার ৩রা নভেম্বর কারাগারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো। ১৯৭৫ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত আমাদের সব নেতাকর্মী কিন্তু কারাগারে বন্দি ছিল। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। বহু নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে। তার পরিবার লাশটাও পায়নি। আজকে তারা গুম-খুনের কথা বলে। শেখ হাসিনা বলেন, শোনা যায়, জিয়াউর রহমান টেবিলে বসে খেতে খেতেই এই ধরনের মৃত্যুদণ্ডের ফাইলে সই করত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যারা ছিল, তারা বলতে পারবে, এমন এমন রাত আটজন, দশজন করে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি দিয়েছে এবং তাদের চিৎকার তাদের কান্নায় ওই কারাগারের আকাশ ভারী হয়েছে। চরিত্রটাই তো এই ধরনের খুনের।
যেটা আপনারা দেখতে পারেন ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায়। কীভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হলো। আইভী রহমানসহ আমাদের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত। তাদের লাশও তো দিতে চায়নি। ২০০১ সালে এসে ঠিক ’৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যা চালিয়েছে, বিএনপি কিন্তু সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করলো। জঙ্গিবাদ সৃষ্টি এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মদত দেয়া, চোরাকারবারি, মানি লন্ডারিং এমন কোনো অপকর্ম নেই, সমাজটাকে তারা ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় ৭৫’র ১৫ই আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর, আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। এই দেশের মানুষ কি পেয়েছিল? মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তো কেউ কাজ করেনি। তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। এসব কাজে তাদের মনোযোগেই ছিল না। আলোচনা সভায় মহানগর নেতারা ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার দাবি জানানোর পাশাপাশি ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাস্টারমাইন্ডদের সাজা কার্যকর করার দাবি জানান। ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- দক্ষিণের সহ-সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী, উত্তরের সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, জাহানারা বেগম, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও কামাল চৌধুরী।
১৫ দিন আগে আমরা বিদেশে যাই। আমরা দুইবোন ভাগ্যক্রমে সেদিন বেঁচে যাই। বাংলাদেশের মানুষ এমন একটি মানুষকে হত্যা করল যে মানুষ তাদের দেশ দিলো, স্বাধীনতা দিলো। সভায় এ নির্মম হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন আওয়ামী লীগ সভাপতি। বক্তব্যে বারবার শেখ হাসিনাকে আবেগাপ্লুত হয়ে কাঁদতে এবং চোখের পানি মুছতে দেখা যায়।
অতীতেও বিভিন্ন সময় ১৫ই আগস্টের নিষ্ঠুরতা বলতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনাকে কাঁদতে দেখা গেছে। অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীর বিচার বন্ধ করলো। ট্রাইব্যুনাল বন্ধ করল। মন্ত্রিসভা যখন গঠন করলো, সেখানে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের পুরস্কৃত করলো, স্বাধীনতা বিরোধীদের মন্ত্রিসভায় স্থান দিলো। বিএনপির একটা কথা জানা উচিত, জিয়ার ক্ষমতা দখলকে হাইকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেছে। এজন্য বিএনপির সৃষ্টিটাও অবৈধ হয়ে যায়। বাংলাদেশের রাজনীতিকে কলুষিত করেছে তারা। আদর্শের রাজনীতি ধ্বংস করে খুনের রাজত্ব কায়েম করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, ১৫ই আগস্টে শুধু একটা পরিবারকে হত্যা নয়। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের ইতিহাসকে একবারে মুছে দেয়ার অপচেষ্টা করা হয়। ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে যত আন্দোলন সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর যে অবদান তা মুছে দেয়া হয়েছিল। একমাত্র বিটিভি ছিল। সেখানে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা যেত না। একেবারে ইতিহাস থেকেই মুছে ফেলার অপচেষ্টা করা হয়। কিন্তু বঙ্গবন্ধু অবিনশ্বর। তিনি আজ জীবন্ত ইতিহাস। তিনি বেঁচে আছেন বাঙালির হৃদয়ে, বিশ্বের শান্তিকামী মানুষের মনে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যা নিয়ে বিএনপি নেতারা নতুন সাফাই গাইতে শুরু করেছে।
বিএনপি নেতারা বলছে, ৭৫ সালে তো বিএনপি গঠনই হয়নি তাহলে বঙ্গবন্ধু হত্যায় বিএনপি কীভাবে জড়িত হলো? কিন্তু বিএনপির যে প্রতিষ্ঠাতা, সেই জিয়াউর রহমান নিজেই খুনি। জিয়াউর রহমান শুধু খুনের সঙ্গে জড়িত ছিল না, এই হত্যার বিচার হবে না সেই ব্যবস্থাও জিয়াউর রহমান করেছিল। বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডে যারা জড়িত ছিল তাদের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করা হয়েছিল। ডালিমসহ অন্যদের যখন বিদেশে পাঠানো হলো অনেক দেশ তাদের গ্রহণ করেনি। যেসব দেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের সপক্ষে ছিল, তারা বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের কূটনীতিক হিসেবে মেনে নিতে পারেনি। তিনি আরো বলেন, দেশের ভেতরে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী যারা বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল, তারাও পরবর্তীতে জিয়ার সঙ্গে গেছে। অনেকে এখনো বেঁচে আছে, বড় বড় কথাও বলে। কিন্তু তারা যে এই চক্রান্তের সঙ্গে সম্পূর্ণ জড়িত তাতে কোনো সন্দেহ ছিল না এবং আজকে তা প্রমাণিত হয়েছে। এ সময় শেখ হাসিনা ১৫ই আগস্টের ঘটনায় বিদেশে অবস্থানের কারণে দুই বোনকে তৎকালীন সেনা সরকার দেশে ফিরে আসতে বাধা দিয়েছিল তার বিভিন্ন দিক তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কারণ এই মিলিটারি ডিটেকটররা যখন ক্ষমতা নেয় তখন তাদের মনের ভেতর একটা সুপ্ত বাসনা থাকে, রাজনৈতিক নেতা হওয়ার। যদিও তারা রাজনৈতিক নেতাদেরই গালি দেয়। কারণ মোশতাক বেইমানি করে ক্ষমতায় গিয়েছিল। আড়াই মাসও কিন্তু ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ঠিক যেভাবে মীরজাফর বেইমানি করে সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত করেছিল, মীরজাফরও কিন্তু ওই দুই মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি।
ঠিক মোশতাকের ভাগ্যেও তাই ঘটলো, সেও থাকতে পারলো না। এই মোশতাকই কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিল। শেখ হাসিনা বলেন, আমি যখন দেশে ফিরতে পারলাম না। ১৯৭৯ সালে প্রথম রেহানা সুইডেনে যান। কারণ সুইডেনের যিনি আমাদের রাষ্ট্রদূত ছিলেন ড. রাজ্জাক। তিনি মোশতাক সরকারের কাছে আনুগত্য প্রকাশ করেননি এবং বলেছিলেন আমি খুনিদের চাকরি করবো না। তিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন। সেই পদ থেকে তিনি পদত্যাগ করেছিলেন এবং প্রতিবাদ করেছিলেন। শুধু তাই না, তিনি সেখানে একটা সভার আয়োজন করেন। তখন রেহানা ১৯৭৯ সালে সেখানে যায় এবং ১৫ই আগস্টের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করে প্রথম রেহানাই সুইডেনে প্রতিবাদ করেছিল এবং বক্তব্য দিয়েছিল। ১৯৮০ সালে আমি যখন লন্ডনে যাই এবং রেহানার পাসপোর্টের সময় শেষ হয়ে গিয়েছিল, বাংলাদেশের দূতাবাস সেই পাসপোর্টের মেয়াদ বৃদ্ধি করে দেয়নি। কারণ সরকারের নিষেধাজ্ঞা ছিল। আমি দিল্লিতে ছিলাম। দিল্লিতে আমাদের যিনি রাষ্ট্রদূত ছিলেন শামসুর রহমান সাহেব, তিনি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আসামি ছিলেন। তিনি কোনো কিছু না বলে চুপচাপ আমাদের পাসপোর্টটা রিনিউ করে দিয়েছিলেন। লন্ডনের দূতাবাস রেহানার পাসপোর্ট দেয়নি। কারণ উদ্দেশ্য একটিই ছিল কোনোমতে যেন দেশে আসতে না পারে।
তবে বৃটিশ সরকার পরে তাকে অ্যাসাইলাম দেয় এবং তাকে সেখানেই নাগরিকত্ব দিয়েছিল। শেখ হাসিনা বলেন, আমি ১৯৮০ সালে লন্ডনে গেলাম। এই ব্যাপারে তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন এবং ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। এরপর লন্ডনে গিয়ে প্রতিবাদ সভা করি এবং সেখানে একটি ইনকোয়ারি কমিশন গঠন করি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় যিনি জাতির পিতাকে সমর্থন করতে এসেছিলেন, স্যার টমাস উইলিয়ামস (কুইস কাউন্সিলের তিনি সদস্য)। তিনি বৃটিশ পার্লামেন্টের এমপি ছিলেন। তিনি এবং শন ম্যাকব্রাইড আয়ারল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং নোবেল লরিয়েট, তাকেসহ বৃটিশ অন্যান্য দলের এমপিদের নিয়ে আমরা একটা ইনকোয়ারি কমিটি করি এবং এই ইনকোয়ারি কমিটিতে প্রবাসী বাঙালিরা তারা সেখানে ডোনেশন দেয় এবং ইনকোয়ারি কমিটির পক্ষ থেকে একজন প্রতিনিধি বাংলাদেশে আসবেন, এই ১৫ই আগস্ট হত্যাকাণ্ডের তদন্ত করবার জন্য এবং স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে আমরা ঠিক করি তিনি আসবেন এবং ওনাকে একটি সলিসিটারও নিয়োগ দেয়া হয় যার কাছে ফান্ড থাকতো এবং সমস্ত কাজগুলো হবে। তিনি যখন ভিসা চাইলেন, জিয়াউর রহমান তখন প্রেসিডেন্ট। জিয়া কিন্তু স্যার টমাস উইলিয়াম এমপিকে ভিসা দেয়নি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার সময় তিনি যখন এসেছিলেন, তখন কিন্তু পাকিস্তানি সরকারও ভিসা দিয়েছিল।
কিন্তু ১৫ই আগস্টের পরে যখন ১৯৮০ সালে স্যার টমাস উইলিয়ামস আসতে চাইলেন, জিয়াউর রহমান তাকে ভিসা দিলেন না। শেখ হাসিনা বিএনপি নেতাদের উদ্দেশে বলেন, প্রশ্ন এখানে, বিএনপি নেতাদের এটা আমি বলতে চাই এবং জিজ্ঞাসা করি, জিয়া যদি খুনি না হবেন আর তার হাতে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল এই বিএনপি, এরা যদি খুনিদের দল না হবে আর খুনির দল না হয়, তাহলে স্যার টমাস উইলিয়াম কিউসি এমপিকে কেন বাংলাদেশে তদন্ত করতে আসতে দেয়নি? তার দুর্বলতাটা কি ছিল? সে কিন্তু ভিসা দেয়নি। অর্থাৎ এই ঘটনার কোনো তদন্ত হোক, হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক, সেটা তো আইন করে আগেই বিচার বন্ধ, খুনিদের পুরস্কৃত করা এবং জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসার পর সাধারণত মিলিটারি ডিটেকটর যখন ক্ষমতায় আসে আগে রাজনীতিবিদদের গালি দেয়। আর এরপরে নিজেরাই উর্দি খুলে তারপরে রাজনীতিবিদ সাজতে চায়। প্রথমে হ্যাঁ-না ভোট তারপরে প্রেসিডেন্ট ভোট অনেক নাটক করে এরপরে সে রাজনৈতিক দল করলো এবং সেটাও কয়েক দফা দলের নাম পরিবর্তন করে এই বিএনপির সৃষ্টি। আর সেই দলে যোগ দিলো কে? আওয়ামী লীগের যে সকল নেতাকর্মী বেইমান-মুনাফেক তার সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। তারা ছাড়া সব নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল এবং কারাগারে ছিল। আবার ৩রা নভেম্বর কারাগারে হত্যাকাণ্ড ঘটানো হলো। ১৯৭৫ থেকে ’৭৯ সাল পর্যন্ত আমাদের সব নেতাকর্মী কিন্তু কারাগারে বন্দি ছিল। বিভিন্ন জায়গায় আমাদের নেতাকর্মীদের ওপর অকথ্য অত্যাচার হয়েছে। বহু নেতাকর্মীকে ধরে নিয়ে গেছে। দিনের পর দিন অত্যাচার করেছে। তার পরিবার লাশটাও পায়নি। আজকে তারা গুম-খুনের কথা বলে। শেখ হাসিনা বলেন, শোনা যায়, জিয়াউর রহমান টেবিলে বসে খেতে খেতেই এই ধরনের মৃত্যুদণ্ডের ফাইলে সই করত। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে যারা ছিল, তারা বলতে পারবে, এমন এমন রাত আটজন, দশজন করে জোড়ায় জোড়ায় ফাঁসি দিয়েছে এবং তাদের চিৎকার তাদের কান্নায় ওই কারাগারের আকাশ ভারী হয়েছে। চরিত্রটাই তো এই ধরনের খুনের।
যেটা আপনারা দেখতে পারেন ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলায়। কীভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে গ্রেনেড হামলা হলো। আইভী রহমানসহ আমাদের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত। তাদের লাশও তো দিতে চায়নি। ২০০১ সালে এসে ঠিক ’৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেভাবে যে প্রক্রিয়ায় হত্যাকাণ্ড এবং গণহত্যা চালিয়েছে, বিএনপি কিন্তু সেই প্রক্রিয়াই অনুসরণ করলো। জঙ্গিবাদ সৃষ্টি এবং সন্ত্রাস সৃষ্টি করে মদত দেয়া, চোরাকারবারি, মানি লন্ডারিং এমন কোনো অপকর্ম নেই, সমাজটাকে তারা ধ্বংসের পথে ঠেলে দিয়েছিল। এই ধারাবাহিকতায় ৭৫’র ১৫ই আগস্টের পর থেকে ১৯৯৬ পর্যন্ত ২১ বছর, আবার ২০০১ থেকে ২০০৮ পর্যন্ত। এই দেশের মানুষ কি পেয়েছিল? মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য তো কেউ কাজ করেনি। তাদের নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তন ঘটেছিল। কিন্তু মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। এসব কাজে তাদের মনোযোগেই ছিল না। আলোচনা সভায় মহানগর নেতারা ১৫ই আগস্ট জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাকাণ্ডে দণ্ডপ্রাপ্ত পলাতক খুনিদের দ্রুত দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা কার্যকর করার দাবি জানানোর পাশাপাশি ২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনার মাস্টারমাইন্ডদের সাজা কার্যকর করার দাবি জানান। ঢাকা মহানগর উত্তরের সভাপতি একেএম রহমতউল্লাহর সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় ঢাকা মহানগর নেতাদের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- দক্ষিণের সহ-সভাপতি আবু আহম্মেদ মান্নাফী, উত্তরের সহ-সভাপতি শেখ বজলুর রহমান, জাহানারা বেগম, সাধারণ সম্পাদক শাহে আলম মুরাদ, উত্তরের সাধারণ সম্পাদক সাদেক খান, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এসএম মান্নান কচি ও কামাল চৌধুরী।
No comments