ভারতে সন্ত্রাস আয়ত্তে এসেছে, নির্মূল হয় নি by অজিত কুমার সিং
এ
বছর ২৫ শে মার্চ বিহার এন্টি টেরোরিজম স্কোয়াডের (এটিএস) কর্মকর্তারা
খাইরুল মন্ডল ও আবু সুলতান নামে দু’সন্ত্রাসীকে সনাক্ত করে রাজ্যের রাজধানী
পাটনা থেকে। পুলিশি বিবৃতিতে বলা হয়, গ্রেপ্তার করা এই দু’ব্যক্তির কাছ
থেকে পুলওয়ামা হামলার পরে জম্মুতে নিযুক্ত নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী
সম্পর্কে অনেক সন্দেহজনক ডকুমেন্ট উদ্ধার করা হয়েছে। বাংলাদেশে নিষিদ্ধ
ঘোষিত জমিয়তুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি) এবং ইসলামিক স্টেট বাংলাদেশ
গ্রুপের সক্রিয় সদস্য এরা।
একই দিনে দিল্লি থেকে মোহাম্মদ পারভেজ (৪২) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে রাজস্থান পুলিশ। অভিযোগ, সে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করছিল। জিজ্ঞাসাবাদে পারভেজ বলেছে, আইএসআইয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। গত ১৮ বছরে সে ১৭ বার পাকিস্তান সফরে গিয়েছে। এ বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি জৈশ ই মোহাম্মদের ( জেইএম) দু’সন্ত্রাসীতে উত্তর প্রদেশের শাহারান জেলার দেওবন্দ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তারা হলো শাহনাওয়াজ তেলি এবং আকিব আহমেদ মালিক।
সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের (এসটিএপি) আংশিক ডাটা অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ২৬/১১ মুম্বইতে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ইসলামপন্থি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কমপক্ষে ২৬৮৮ জনকে। এর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী ক্যাডার, পাকিস্তানি আইএসআইয়ের এজেন্ট। আছে বাংলাদেশী, নেপালি ও পাকিস্তানি নাগরিকও। এ তথ্য ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত। ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩১২ জনকে। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৪৯ জনকে। ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ডাটা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯১ জনকে। অতীতের মতো ২০১৮ সালে যেসব মানুষকে দেশজুড়ে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে, তার অনেকগুলো ঘটেছে সন্ত্রাসীদের গুপ্ত সেলকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার জন্য।
এক্ষেত্রে খুব জোর দিয়ে উল্লেখ করা যায় ২০১৮ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর সকালের কথা। এদিন ইসলামিক স্টেটের আদর্শে গড়ে উঠা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের ১৭টি স্থানে তল্লাশি চালায় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। এমন সংগঠনের মধ্যে আছে হরকাতুল হার্বে ইসলাম। এনআইএর এই অভিযানে সক্রিয় সমর্থন দেয় দিল্লি পুলিশ, উত্তর প্রদেশ পুলিশ/উত্তর প্রদেশ সন্ত্রাস বিরোধী স্কোয়াড (এটিএস)। এ অভিযানে এ সংগঠনের কমপক্ষে ১০ জন ক্যাডেটকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিষ্ক্রিয় করা হয় দায়েশের সেল।
অতি সম্প্রতি দায়েশের (বা আইএস) আদর্শে উদ্বুদ্ধ একটি সন্ত্রাসী চক্রকে সনাক্ত করে ন্যাশনাল ফোর্স এবং তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে। ২০১৯ সালের ২১-২২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের থানে এবং আওরঙ্গবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নিজস্ব স্টাইলে গড়ে উঠা উম্মতে মোহাম্মদিয়ার ৯ সদস্যকে।
বিশেষ করে এসএটিপি’র ডাটাবেজ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে দায়েশের প্রতি সহানুভূতিশীল/সদস্য সংগ্রহকারীদের ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে আরো ৭৩ জনকে। তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে গিয়ে আইএসের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য আরো ৯৮ জন ভারত ত্যাগ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা আণুবীক্ষণিক। যে ৯৮ জন দায়েশে যোগ দেয়ার জন্য বিদেশে গিয়েছে তার মধ্যে ৩৩ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
উপরন্তু স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (সিমি)/ ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) ২০০৮ সালে বড় রকমের পরাজয়ের শিকার হয়। এরপরের বছরও তা অব্যাহত ছিল। এসএটিপির ডাটা অনুযায়ী, ২০০০ সালের ১১ই মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৫টি ঘটনায় সিমি/আইএমের কমপক্ষে ৭১৬ জন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬ জনকে।
সফল অপারেশনের ফলে পাকিস্তান সমর্থিত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠন যেমন দায়েশ এবং আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট-এর মতো সংগঠন ২০১৪ সাল থেকে ভারতে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা তাদের উচ্চাকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ভারতে মাত্র একটি ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাবের জালান্ধার শহরে মাকসুদান পুলিশ স্টেশনে একটি বিস্ফোরণ হয়। সেখানে অল্প আহত হন এক পুলিশ সদস্য। এ মামলাটি এখনও তদন্ত করছে এনআইএ।
২০১৭ সালেও একটিমাত্র ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময়ে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ মধ্যপ্রদেশের শাজাপুর জেলার জাবদি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি ট্রেনে বিস্ফোরণ হয়। এতে আহত হন ৯ জন। পরের দিন উত্তর প্রদেশের লক্ষেèৗতে সিকিউরিটি ফোর্স ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের বাইরে সংগঠিত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা ২০০৮ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ভারতে ১০টি সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এতে নিহত হন ৩৫২ জন। ২০০০ সালের পর এটাই হলো এক বছরের নিহতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এসব হামলায় নিহতদের মধ্যে ৩১০ জন বেসামরিক। ৩০ জন সিকিউরিটি ফোর্সের এবং ১২ জন সন্ত্রাসী। জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা সর্বশেষ যে বড় হামলা চালায় তা ঘটে ২০১৩ সালের ২৭শে অক্টোবর। ওই সময় সন্ত্রাসীরা পাটনায় বোমা হামলা করেছিল। এতে ৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। এতে হামলাকারীদের একজনও নিহত হয়েছে।
ইসলামপন্থি সন্ত্রাস মোকাবিলায় ভারতকে সহযোগিতা করেছে বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০০২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার কমপক্ষে ৭১ জন পলাতক ব্যক্তিকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এর মধ্যে ২১ জনকে ফেরত দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৯ জনকে ফেরত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ৬ জনকে ফেরত দিয়েছে কানাডা। চার জনকে ফেরত দিয়েছে থাইল্যান্ড। তিন জন করে ফেরত দিয়েছে জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। দুইজন করে ফেরত দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতিয়াস, পর্তুগাল ও সিঙ্গাপুর। এ ছাড়া একজন করে ফেরত দিয়েছে বাহরাইন, বুলগেরিয়া, হংকং, মরক্কো, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, ওমান, পেরু, সৌদি আরব, তাঞ্জানিয়া ও বৃটেন। ৭১ জনের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে চালানো বেশির ভাগ হামলার সঙ্গে জড়িত এমন কমপক্ষে ১৯ জন। বাকি ৫২ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন রকম ফৌজদারি অপরাধে জড়িত। এর মধ্যে ১৫ জন রয়েছে খুনের দায়ে অভিযুক্ত।
উপরন্তু, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে চেক দেয়ার জন্য সরকার কার্যকর কি পদক্ষেপ নিয়েছেÑ এর জবাবে ২০১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টকে সরকার জানিয়েছে যে, তারা সন্ত্রাস দমনে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, অবজার্ভেশন পোস্ট স্থাপন, সীমান্তে বেড়া নির্মাণ, ফ্লাড লাইটিং স্থাপন, আধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন নজরদারিকারী সরঞ্জাম মোতায়েন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে আধুনিকায়ন, উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তা শক্তিশালী করা।
তা সত্ত্বেও অনেকেই এখনও উদ্বেগে।
২০১৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিফিকেশনে জানিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে সিমি’কে আরো ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতার পর পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। এ কারণে, ২০০০এর দশকে ইসলামাবাদ সিমি/আইএম’কে সরিয়ে দেয়। বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ভারতে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বা হচ্ছে তার বড় একটি অংশের সঙ্গে সিমি/আইএমের সংশ্লিষ্টটা লুক্কায়িত আছে। পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে রয়েছে তাদের সখ্য।
বিশ্বজুড়ে আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একাকি হামলা চালাচ্ছে এর সদস্যরা। তারা যদিও এখন পর্যন্ত ভারতে উল্লেখ করার মতো কোনো বড় ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়েছে, তবুও তারা হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের যোগসূত্র রয়েছে আইএসের সঙ্গে। এটাই ভারতের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয়। এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো, ২০১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার সন্দেহে পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে ঝাড়খন্ড সরকার। এ বিষয়ে রাজ্য সরকার একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, ঝাড়খন্ডে সক্রিয় পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’কে ১৯০৮ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে নিষিদ্ধ করছে রাজ্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই নিষেধাজ্ঞায় সুপারিশ করেছে। পাকুর জেলায় খুব বেশি সক্রিয় এই পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া। কেরালায় গড়ে উঠেছে এই সংগঠনটি। এর সদস্যরা আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার কিছু সদস্য দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে সিরিয়া গিয়েছে এবং সেখানে তারা আইএসের পক্ষে কাজ করছে।
এটা সুস্পষ্ট যে, যদিও সিকিউরিটি ফোর্স এত লম্বা সময় ভারতকে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের হুমকি থেকে চেক দিয়েছেন, তবে তাতে আত্মতুষ্টিতে মজে থাকা উচিত হবে না। দুঃখজনক হলো, অতীতে বার বার এসএআইআর নোট দিয়েছে। বলেছে, সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সক্ষমতা বাড়াতে খুব সামান্যই করা হয়েছে।
>>>(অজিত কুমার সিংয়ের এই লেখাটি ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত। তিনি ইন্সটিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের রিসার্স ফেলো। তার লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো)
একই দিনে দিল্লি থেকে মোহাম্মদ পারভেজ (৪২) নামে এক যুবককে গ্রেপ্তার করে রাজস্থান পুলিশ। অভিযোগ, সে পাকিস্তানের ইন্টার-সার্ভিসেস ইন্টেলিজেন্সের (আইএসআই) পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করছিল। জিজ্ঞাসাবাদে পারভেজ বলেছে, আইএসআইয়ের সঙ্গে যুক্ত এমন ব্যক্তিদের সঙ্গে তার যোগাযোগ আছে। গত ১৮ বছরে সে ১৭ বার পাকিস্তান সফরে গিয়েছে। এ বছর ২১ শে ফেব্রুয়ারি জৈশ ই মোহাম্মদের ( জেইএম) দু’সন্ত্রাসীতে উত্তর প্রদেশের শাহারান জেলার দেওবন্দ থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
তারা হলো শাহনাওয়াজ তেলি এবং আকিব আহমেদ মালিক।
সাউথ এশিয়া টেরোরিজম পোর্টালের (এসটিএপি) আংশিক ডাটা অনুযায়ী, ২০০৮ সালের ২৬/১১ মুম্বইতে সন্ত্রাসী হামলার পর থেকে ইসলামপন্থি উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কমপক্ষে ২৬৮৮ জনকে। এর মধ্যে রয়েছে সন্ত্রাসী ক্যাডার, পাকিস্তানি আইএসআইয়ের এজেন্ট। আছে বাংলাদেশী, নেপালি ও পাকিস্তানি নাগরিকও। এ তথ্য ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত। ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৩১২ জনকে। ২০১৭ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ২৪৯ জনকে। ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ডাটা অনুযায়ী গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৯১ জনকে। অতীতের মতো ২০১৮ সালে যেসব মানুষকে দেশজুড়ে ভারতের নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে, তার অনেকগুলো ঘটেছে সন্ত্রাসীদের গুপ্ত সেলকে নিষ্ক্রিয় করে দেয়ার জন্য।
এক্ষেত্রে খুব জোর দিয়ে উল্লেখ করা যায় ২০১৮ সালের ২৬ শে ডিসেম্বর সকালের কথা। এদিন ইসলামিক স্টেটের আদর্শে গড়ে উঠা সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে দিল্লি ও উত্তর প্রদেশের ১৭টি স্থানে তল্লাশি চালায় ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)। এমন সংগঠনের মধ্যে আছে হরকাতুল হার্বে ইসলাম। এনআইএর এই অভিযানে সক্রিয় সমর্থন দেয় দিল্লি পুলিশ, উত্তর প্রদেশ পুলিশ/উত্তর প্রদেশ সন্ত্রাস বিরোধী স্কোয়াড (এটিএস)। এ অভিযানে এ সংগঠনের কমপক্ষে ১০ জন ক্যাডেটকে গ্রেপ্তার করা হয়। নিষ্ক্রিয় করা হয় দায়েশের সেল।
অতি সম্প্রতি দায়েশের (বা আইএস) আদর্শে উদ্বুদ্ধ একটি সন্ত্রাসী চক্রকে সনাক্ত করে ন্যাশনাল ফোর্স এবং তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে। ২০১৯ সালের ২১-২২ জানুয়ারি মহারাষ্ট্রের থানে এবং আওরঙ্গবাদ থেকে গ্রেপ্তার করা হয় নিজস্ব স্টাইলে গড়ে উঠা উম্মতে মোহাম্মদিয়ার ৯ সদস্যকে।
বিশেষ করে এসএটিপি’র ডাটাবেজ অনুযায়ী, ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ভারতে দায়েশের প্রতি সহানুভূতিশীল/সদস্য সংগ্রহকারীদের ১৬৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আটক করা হয়েছে আরো ৭৩ জনকে। তাদেরকে পরামর্শ দেয়া হয়েছে এবং ছেড়ে দেয়া হয়েছে। সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানে গিয়ে আইএসের সঙ্গে যোগ দেয়ার জন্য আরো ৯৮ জন ভারত ত্যাগ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়। ভারতের মুসলিম জনসংখ্যার তুলনায় এই সংখ্যা আণুবীক্ষণিক। যে ৯৮ জন দায়েশে যোগ দেয়ার জন্য বিদেশে গিয়েছে তার মধ্যে ৩৩ জন নিহত হয়েছে বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে।
উপরন্তু স্টুডেন্টস ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (সিমি)/ ইন্ডিয়ান মুজাহিদিন (আইএম) ২০০৮ সালে বড় রকমের পরাজয়ের শিকার হয়। এরপরের বছরও তা অব্যাহত ছিল। এসএটিপির ডাটা অনুযায়ী, ২০০০ সালের ১১ই মার্চ থেকে ২০১৯ সালের ৭ই এপ্রিল পর্যন্ত ১৩৫টি ঘটনায় সিমি/আইএমের কমপক্ষে ৭১৬ জন ক্যাডারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৮ সালে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৬ জনকে।
সফল অপারেশনের ফলে পাকিস্তান সমর্থিত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী সংগঠন যেমন দায়েশ এবং আল কায়েদা ইন ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট-এর মতো সংগঠন ২০১৪ সাল থেকে ভারতে পথ করে নেয়ার চেষ্টা করেছে। কিন্তু তারা তাদের উচ্চাকাঙ্খা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে। পুরো ২০১৮ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ভারতে মাত্র একটি ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। ২০১৮ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বরে পাঞ্জাবের জালান্ধার শহরে মাকসুদান পুলিশ স্টেশনে একটি বিস্ফোরণ হয়। সেখানে অল্প আহত হন এক পুলিশ সদস্য। এ মামলাটি এখনও তদন্ত করছে এনআইএ।
২০১৭ সালেও একটিমাত্র ইসলামপন্থি সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এ সময়ে অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৭ই মার্চ মধ্যপ্রদেশের শাজাপুর জেলার জাবদি রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি ট্রেনে বিস্ফোরণ হয়। এতে আহত হন ৯ জন। পরের দিন উত্তর প্রদেশের লক্ষেèৗতে সিকিউরিটি ফোর্স ওই বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িত এক সন্ত্রাসীকে হত্যা করেছে। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, পাকিস্তানের বাইরে সংগঠিত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা ২০০৮ সালে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ভারতে ১০টি সন্ত্রাসী হামলা চালায়। এতে নিহত হন ৩৫২ জন। ২০০০ সালের পর এটাই হলো এক বছরের নিহতের সর্বোচ্চ সংখ্যা। এসব হামলায় নিহতদের মধ্যে ৩১০ জন বেসামরিক। ৩০ জন সিকিউরিটি ফোর্সের এবং ১২ জন সন্ত্রাসী। জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীরা সর্বশেষ যে বড় হামলা চালায় তা ঘটে ২০১৩ সালের ২৭শে অক্টোবর। ওই সময় সন্ত্রাসীরা পাটনায় বোমা হামলা করেছিল। এতে ৭ জন বেসামরিক ব্যক্তি নিহত হন। এতে হামলাকারীদের একজনও নিহত হয়েছে।
ইসলামপন্থি সন্ত্রাস মোকাবিলায় ভারতকে সহযোগিতা করেছে বন্ধুপ্রতীম দেশগুলো। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট অনুযায়ী, ২০০২ সালের ২০ শে ফেব্রুয়ারি থেকে বিভিন্ন দেশের সরকার কমপক্ষে ৭১ জন পলাতক ব্যক্তিকে ভারতের হাতে তুলে দিয়েছে। এর মধ্যে ২১ জনকে ফেরত দিয়েছে সংযুক্ত আরব আমিরাত। ৯ জনকে ফেরত দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। ৬ জনকে ফেরত দিয়েছে কানাডা। চার জনকে ফেরত দিয়েছে থাইল্যান্ড। তিন জন করে ফেরত দিয়েছে জার্মানি ও দক্ষিণ আফ্রিকা। দুইজন করে ফেরত দিয়েছে অস্ট্রেলিয়া, বাংলাদেশ, বেলজিয়াম, ইন্দোনেশিয়া, মৌরিতিয়াস, পর্তুগাল ও সিঙ্গাপুর। এ ছাড়া একজন করে ফেরত দিয়েছে বাহরাইন, বুলগেরিয়া, হংকং, মরক্কো, নিকারাগুয়া, নাইজেরিয়া, ওমান, পেরু, সৌদি আরব, তাঞ্জানিয়া ও বৃটেন। ৭১ জনের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মিরের বাইরে চালানো বেশির ভাগ হামলার সঙ্গে জড়িত এমন কমপক্ষে ১৯ জন। বাকি ৫২ জনকে ফেরত দেয়া হয়েছে। তারা বিভিন্ন রকম ফৌজদারি অপরাধে জড়িত। এর মধ্যে ১৫ জন রয়েছে খুনের দায়ে অভিযুক্ত।
উপরন্তু, কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারগুলো ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট ও কার্যকর পদক্ষেপ নিয়েছে। উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, যখন প্রশ্ন করা হয়েছে, ক্রমবর্ধমান সন্ত্রাসী কর্মকান্ডকে চেক দেয়ার জন্য সরকার কার্যকর কি পদক্ষেপ নিয়েছেÑ এর জবাবে ২০১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টকে সরকার জানিয়েছে যে, তারা সন্ত্রাস দমনে নানা রকম পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, অবজার্ভেশন পোস্ট স্থাপন, সীমান্তে বেড়া নির্মাণ, ফ্লাড লাইটিং স্থাপন, আধুনিক ও উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন নজরদারিকারী সরঞ্জাম মোতায়েন, গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহে আধুনিকায়ন, উপকূলীয় এলাকায় নিরাপত্তা শক্তিশালী করা।
তা সত্ত্বেও অনেকেই এখনও উদ্বেগে।
২০১৯ সালের ৩১ শে জানুয়ারি কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নোটিফিকেশনে জানিয়েছে, রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডের কারণে সিমি’কে আরো ৫ বছরের জন্য নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রে ২০০১ সালের ১১ই সেপ্টেম্বরে সন্ত্রাসী হামলার ভয়াবহতার পর পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়তে থাকে। এ কারণে, ২০০০এর দশকে ইসলামাবাদ সিমি/আইএম’কে সরিয়ে দেয়। বিস্ময়ের কিছু নেই যে, ভারতে যেসব সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে বা হচ্ছে তার বড় একটি অংশের সঙ্গে সিমি/আইএমের সংশ্লিষ্টটা লুক্কায়িত আছে। পাকিস্তানভিত্তিক বিভিন্ন সন্ত্রাসী সংগঠনের সঙ্গে রয়েছে তাদের সখ্য।
বিশ্বজুড়ে আইএসের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে একাকি হামলা চালাচ্ছে এর সদস্যরা। তারা যদিও এখন পর্যন্ত ভারতে উল্লেখ করার মতো কোনো বড় ক্ষতি করতে ব্যর্থ হয়েছে, তবুও তারা হুমকি হিসেবে রয়ে গেছে। বিভিন্ন দেশের ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের যোগসূত্র রয়েছে আইএসের সঙ্গে। এটাই ভারতের কাছে একটি উদ্বেগের বিষয়। এখানে উল্লেখ করার বিষয় হলো, ২০১৯ সালের ১২ই ফেব্রুয়ারি আইএসের সঙ্গে সম্পর্ক থাকার সন্দেহে পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়াকে নিষিদ্ধ করেছে ঝাড়খন্ড সরকার। এ বিষয়ে রাজ্য সরকার একটি বিবৃতি দেয়। তাতে বলা হয়, ঝাড়খন্ডে সক্রিয় পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া’কে ১৯০৮ সালের ক্রিমিনাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্টের অধীনে নিষিদ্ধ করছে রাজ্য। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই নিষেধাজ্ঞায় সুপারিশ করেছে। পাকুর জেলায় খুব বেশি সক্রিয় এই পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়া। কেরালায় গড়ে উঠেছে এই সংগঠনটি। এর সদস্যরা আইএসের আদর্শে উদ্বুদ্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রিপোর্ট অনুযায়ী, পপুলার ফ্রন্ট অব ইন্ডিয়ার কিছু সদস্য দক্ষিণের রাজ্যগুলো থেকে সিরিয়া গিয়েছে এবং সেখানে তারা আইএসের পক্ষে কাজ করছে।
এটা সুস্পষ্ট যে, যদিও সিকিউরিটি ফোর্স এত লম্বা সময় ভারতকে ইসলামপন্থি সন্ত্রাসীদের হুমকি থেকে চেক দিয়েছেন, তবে তাতে আত্মতুষ্টিতে মজে থাকা উচিত হবে না। দুঃখজনক হলো, অতীতে বার বার এসএআইআর নোট দিয়েছে। বলেছে, সারাদেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের সক্ষমতা বাড়াতে খুব সামান্যই করা হয়েছে।
>>>(অজিত কুমার সিংয়ের এই লেখাটি ইউরেশিয়া রিভিউয়ে প্রকাশিত। তিনি ইন্সটিটিউট ফর কনফ্লিক্ট ম্যানেজমেন্টের রিসার্স ফেলো। তার লেখাটির অনুবাদ প্রকাশ করা হলো)
No comments