সামাজিক বনাম মূলধারার গণমাধ্যম কোন্টা বেশি শক্তিশালী? by মরিয়ম চম্পা
ইদানীং
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যাপক আলোচনায়। পান থেকে চুন খসলেও তা চলে আসছে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। বিশেষজ্ঞদের মতে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম কারো
কাছে দায়বদ্ধ নয়। তাই যার যা ইচ্ছা তা-ই লিখে দিতে পারছে। এতে কার ক্ষতি
হলো, কার লাভ হলো- এটা বিবেচ্য নয়। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যম একটি
নীতিমালার মধ্যে চলে। তাদের পাঠকের কাছে জববাদিহিতা আছে। ফলে ইচ্ছা করলেই
যা ইচ্ছা তা লিখে দিতে পারে না।
তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হাতে নিয়েই লিখতে হয়। প্রকাশ করতে হয়। তারপরও প্রশ্ন উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কি বিকল্প মিডিয়া? এ নিয়ে কথা বলেছেন শিক্ষাবিদ, যোগাযোগ গবেষক, সামাজিক বোদ্ধা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ ও তরুণ সংবাদকর্মীরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ.আ.ম.স. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া গণমাধ্যম হয়ে ওঠার সময় এখনও আসেনি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা বলা যায় না। তবে এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিক গণমাধ্যম হিসেবেই কাজ করছে। সামাজিক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের মধ্যে একটি মূল পার্থক্য হচ্ছে গণমাধ্যমে যে তথ্যটা দেয়া হয় সেটা সম্পাদনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অর্থাৎ একটি তথ্যকে সম্পাদনা, যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন করে নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্ট দিয়ে পত্রপত্রিকায় বা টেলিভিশনে প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়। এই পার্থক্যের কারণে যারা গণমাধ্যমের ভোক্তা, পাঠক এবং দর্শক তারা গণামাধ্যমকে বিশ্বাস করে যে, নিউজটি সম্পাদিত হয়ে এসেছে। অতএব এটার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। সামাজিক গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো বিষয় চলে আসে। মানুষ জানতে পারে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতার একটি মূল্যায়ন আছে। কিন্তু পাঠকের মনে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের যে একটি পার্থক্য সেটা কিন্তু থেকেই যায়। সম্পাদনা হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ। যেখানে সম্পাদনা নেই সেখানে আসলে সাংবাদিকতা হয় না। সম্পাদনা ছাড়া যে সামাজিক মাধ্যম চলে সেগুলো কোনো গণমাধ্যম হতে পারে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ফেসবুক মূলধারার মিডিয়ার বিকল্প হচ্ছে এ রকম আমার এখনো মনে হয় না। ফেসবুকে যে সকল নিউজ পাওয়া যায় সেগুলোর অথেনটিসিটি নিয়ে নানাধরনের প্রশ্ন থাকে। ফেসবুকের এ সকল খবরের উৎস অস্পষ্ট থাকে। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকে যে সব খবর আসে সেগুলোর পরবর্তী পর্যালোচনা করার মতো উপাত্ত থাকে না। মূলধারার মিডিয়াতে যতগুলো ইস্যু একত্রে পাওয়া যায় সেটা কিন্তু ফেসবুকে কভার করা সম্ভব হয় না। ফেসবুকের কারণে মূলধারার মিডিয়ার যে সংখ্যক দর্শক বা পাঠক হওয়ার কথা সেখানে হয়তো কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এটার একটা প্রভাব পড়তে পারে।
একটা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া যদি তাদের খবর পরিবেশনা বা কাঠামোর পরিবর্তন না আনে তাহলে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়বে। তার মানে এই নয় ফেসবুক রিপ্লেস করতে যাচ্ছে অন্য মিডিয়াকে। কারণ বিশ্বের অনেক দেশে ফেসবুকই ব্যবহার করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, এখন তো প্রযুক্তিভিক্তিক সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর প্রতি মানুষের মনোযোগ বেড়েছে। এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বিশাল। প্রায় ১২ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। চার থেকে পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী। এত বিশাল ব্যবহারকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা তো একরকম নয়। তাদের বড় একটি অংশ গুজবে বিশ্বাসী। অতএব সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক একটি বাজার তৈরি হয়েছে। যেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে বড় হচ্ছে এটা একটি মজা, ট্র্যাজেডি, দুঃখ সবকিছুই একটি পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। একটি বড় সংখ্যক ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে সিরিয়াস পাঠকের সংখ্যাটা কম। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া একটি বিশাল বাজার তৈরি করেছে। যেটা সত্যিকার অর্থেই মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য কিছুটা হলেও হুমকিস্বরূপ। এ অবস্থায় মূলধারার গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, বাজারমুখিতা কমে যাবে ধীরে ধীরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের জন্য একটি কোম্পানি যে টাকা খরচ করে সেটা মূলধারার গণমাধ্যমে করে না। আস্তে আস্তে মার্কেট মডেলটা যখন সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক হয়ে যাবে তখন মূলধারার মিডিয়াগুলো সাফার করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, হ্যাঁ ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে মূলধারার গণমাধ্যমের আবেদন কখনো শেষ হবে না। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে যে তথ্যগুলো আমরা পাই সে তথ্যগুলোর কোনো বৈধতা নেই। বস্তুনিষ্ঠতার জন্য লোকে এটা ব্যবহার করে না। তথ্য পাওয়ার জন্য এটা ভালো। বা কোনো মতামতকে সংগঠিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভালো। কিন্তু কোনো একটি নিউজের বস্তুনিষ্ঠতা বিচার করতে হলে তখন আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের কাছেই যেতে হবে। মানুষ যায়ও। গণমাধ্যম কিন্তু ফেসবুক থেকে অনেক তথ্য নেয়। কিন্তু তারা সেটা যাচাই করে। যাচাই করার পর পত্রিকায় সেটা ছাপে বা প্রকাশ করে। এই জায়গাটিই হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে মূলধারার গণমাধ্যমের পার্থক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তথ্যকে কে কতো আগে প্রকাশ করতে পারে সেটার প্রতিযোগিতায় নামে তারা। সেখানে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের এই জবাবদিহিতা আছে। ফলে সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমত গঠন করে। নানা ধরনের আদান প্রদান করে। কিন্তু কোনো একটি খবরের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করার জন্য তাদেরকে মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে ফিরতে হয়। এটাই হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমের শক্তির জায়গা। কাজেই প্রচলিত গণমাধ্যম যত বেশি বস্তুনিষ্ঠতা অর্জন করবে পাঠকের আস্থা তারা ততোটাই অর্জন করতে পারবে। এই আস্থা পাওয়ার কোনো দায় সামাজিক মাধ্যমের নেই।
তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও প্রিয়.কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকারিয়া স্বপন বলেছেন, ফেসবুক ইতিমধ্যে বিকল্প মিডিয়া হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই মূল ধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমরা যে সেন্সে মূলধারার মিডিয়ার কথা বলছি সেটার মূলধারাটা কিন্তু পৃথিবীব্যাপী ভেঙে গেছে ইতিমধ্যে। কারণ প্রতিটি সাধারণ মানুষ এখন ইনডিভিজুয়াল সাংবাদিক। তথ্য পাস করার যে টেনডেনসি সেটা চলে এসেছে তাদের মধ্যে। আমরা অনেক কিছু এখন ফেসবুকে পেয়ে যাই। যেটা একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক সময় বের করতে পারেন না। যে কারণে লাখ লাখ মানুষ এখন ফেসবুকের কাছে চলে গেছে। বর্তমানে আমরা মূলধারা বলতে যে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকাকে বুঝি এটাই হয় তো একসময় মূলধারা থাকবে না। ইনডিভিজুয়াল জার্নালিজম বা ইনফরমেশন পাসিং এটাই এক সময় মূলধারা হয়ে যাবে। এখনো সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমরা খুব আরলি স্টেজে আছি। ভবিষ্যতে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজের ক্ষেত্রে এডিটিং, ফিল্টার, গেটকিপিং অর্থাৎ কোন্টা যাবে বা যাবে না এই ফিল্টারিং মেশিনেই করে ফেলতে পারবে। কারণ মানুষের চেয়ে মেশিনের ব্রেইন অনেক শক্তিশালী।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দা আখতার জাহান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া বিকল্প মাধ্যম আসলে ওই অর্থে হতে পারছে না। কিন্তু আমরা প্রকাশ প্রিয় জাতি তো। আমরা প্রকাশ করতে পছন্দ করি। বৃষ্টি হচ্ছে...ভালো লাগছে। আজকে অনেক গরম.....। এই ধরনের প্রকাশ করে থাকি। ফেসবুকের প্রতি মানুষের ঝুকে পড়ার একটি কারণ হচ্ছে মানুষ তার বক্তব্যটা কমন গণ্ডির মধ্যেই জানাতে পারছে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর খুব কম লোক ফেসবুকে ইতিবাচক লিখেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বড় অংশ নিশ্চুপ ছিল। তারা হ্যাঁ বা না কোনোটিই বলেনি। কিন্তু যখন একটি গুজব হলো ছেলে ধরা এবং সেই গুজবে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। তখন কিন্তু কমবেশি সবাই এটাতে অংশ নিচ্ছে। এটা ফেসবুক ব্যবহারকারীরা জানে খারাপ। তারপরও মানুষ কিন্তু থেমে থাকছে না। আমার মতে, ফেসবুক একেবারেই একটি প্রকাশের জায়গা। এখানে আমরা ফিডব্যাক দিতে পছন্দ করি।
বিটিভি’র সাংবাদিক আফরিন জাহান বলেন, ফেসবুক মানুষ ব্যবহার করছে। কিন্তু এর সত্যতা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন আসে। অনেক সময় সত্য না জেনেই অনেক কিছু ভাইরাল করে ফেলি। ফেসবুক মানুষের বিশ্বস্ততার জায়গা অর্জন করতে পারেনি। মূলধারার নিউজের ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। অনেকের কাছে ফেসবুক হয়তো মূলধারার বিকল্প গণমাধ্যম। কিন্তু সেই বিশ্বাস যোগ্যতা এখনো ফেসবুক অর্জন করতে পারেনি।
তাদের প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট হাতে নিয়েই লিখতে হয়। প্রকাশ করতে হয়। তারপরও প্রশ্ন উঠেছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুক কি বিকল্প মিডিয়া? এ নিয়ে কথা বলেছেন শিক্ষাবিদ, যোগাযোগ গবেষক, সামাজিক বোদ্ধা এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমের জ্যেষ্ঠ ও তরুণ সংবাদকর্মীরা।
এ ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. আ.আ.ম.স. আরেফিন সিদ্দিক বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া গণমাধ্যম হয়ে ওঠার সময় এখনও আসেনি। ভবিষ্যতে কী হবে সেটা বলা যায় না। তবে এখন পর্যন্ত সোশ্যাল মিডিয়া সামাজিক গণমাধ্যম হিসেবেই কাজ করছে। সামাজিক গণমাধ্যম এবং গণমাধ্যমের মধ্যে একটি মূল পার্থক্য হচ্ছে গণমাধ্যমে যে তথ্যটা দেয়া হয় সেটা সম্পাদনার মাধ্যমে উপস্থাপিত হয়। অর্থাৎ একটি তথ্যকে সম্পাদনা, যাচাই-বাছাই, মূল্যায়ন করে নির্দিষ্ট ট্রিটমেন্ট দিয়ে পত্রপত্রিকায় বা টেলিভিশনে প্রচারিত এবং প্রকাশিত হয়। এই পার্থক্যের কারণে যারা গণমাধ্যমের ভোক্তা, পাঠক এবং দর্শক তারা গণামাধ্যমকে বিশ্বাস করে যে, নিউজটি সম্পাদিত হয়ে এসেছে। অতএব এটার ওপর বিশ্বাস রাখা যায়। সামাজিক গণমাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে যে কোনো বিষয় চলে আসে। মানুষ জানতে পারে। এক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকতার একটি মূল্যায়ন আছে। কিন্তু পাঠকের মনে গণমাধ্যম এবং সামাজিক মাধ্যমের যে একটি পার্থক্য সেটা কিন্তু থেকেই যায়। সম্পাদনা হচ্ছে সাংবাদিকতার প্রাণ। যেখানে সম্পাদনা নেই সেখানে আসলে সাংবাদিকতা হয় না। সম্পাদনা ছাড়া যে সামাজিক মাধ্যম চলে সেগুলো কোনো গণমাধ্যম হতে পারে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ফেসবুক মূলধারার মিডিয়ার বিকল্প হচ্ছে এ রকম আমার এখনো মনে হয় না। ফেসবুকে যে সকল নিউজ পাওয়া যায় সেগুলোর অথেনটিসিটি নিয়ে নানাধরনের প্রশ্ন থাকে। ফেসবুকের এ সকল খবরের উৎস অস্পষ্ট থাকে। দ্বিতীয়ত, ফেসবুকে যে সব খবর আসে সেগুলোর পরবর্তী পর্যালোচনা করার মতো উপাত্ত থাকে না। মূলধারার মিডিয়াতে যতগুলো ইস্যু একত্রে পাওয়া যায় সেটা কিন্তু ফেসবুকে কভার করা সম্ভব হয় না। ফেসবুকের কারণে মূলধারার মিডিয়ার যে সংখ্যক দর্শক বা পাঠক হওয়ার কথা সেখানে হয়তো কিছুটা কম-বেশি হতে পারে। এটার একটা প্রভাব পড়তে পারে।
একটা চ্যালেঞ্জ অবশ্যই আছে। প্রিন্ট এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়া যদি তাদের খবর পরিবেশনা বা কাঠামোর পরিবর্তন না আনে তাহলে হয়তো কিছুটা প্রভাব পড়বে। তার মানে এই নয় ফেসবুক রিপ্লেস করতে যাচ্ছে অন্য মিডিয়াকে। কারণ বিশ্বের অনেক দেশে ফেসবুকই ব্যবহার করে না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মফিজুর রহমান বলেন, এখন তো প্রযুক্তিভিক্তিক সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর প্রতি মানুষের মনোযোগ বেড়েছে। এখন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের সংখ্যা বিশাল। প্রায় ১২ কোটি মানুষের হাতে মোবাইল ফোন। চার থেকে পাঁচ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারী। এত বিশাল ব্যবহারকারীর শিক্ষাগত যোগ্যতা তো একরকম নয়। তাদের বড় একটি অংশ গুজবে বিশ্বাসী। অতএব সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক একটি বাজার তৈরি হয়েছে। যেখানে বিশ্বাসযোগ্যতার চেয়ে বড় হচ্ছে এটা একটি মজা, ট্র্যাজেডি, দুঃখ সবকিছুই একটি পণ্যে রূপান্তরিত হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া। একটি বড় সংখ্যক ব্যবহারকারী সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখতে অভ্যস্ত। এক্ষেত্রে সিরিয়াস পাঠকের সংখ্যাটা কম। তিনি বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া একটি বিশাল বাজার তৈরি করেছে। যেটা সত্যিকার অর্থেই মূলধারার গণমাধ্যমের জন্য কিছুটা হলেও হুমকিস্বরূপ। এ অবস্থায় মূলধারার গণমাধ্যমে বিজ্ঞাপন, বাজারমুখিতা কমে যাবে ধীরে ধীরে। সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজ্ঞাপনের জন্য একটি কোম্পানি যে টাকা খরচ করে সেটা মূলধারার গণমাধ্যমে করে না। আস্তে আস্তে মার্কেট মডেলটা যখন সোশ্যাল মিডিয়াকেন্দ্রিক হয়ে যাবে তখন মূলধারার মিডিয়াগুলো সাফার করবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক ড. কাবেরী গায়েন বলেন, হ্যাঁ ফেসবুক বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠছে। কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তাই বলে মূলধারার গণমাধ্যমের আবেদন কখনো শেষ হবে না। কারণ, সামাজিক মাধ্যমে যে তথ্যগুলো আমরা পাই সে তথ্যগুলোর কোনো বৈধতা নেই। বস্তুনিষ্ঠতার জন্য লোকে এটা ব্যবহার করে না। তথ্য পাওয়ার জন্য এটা ভালো। বা কোনো মতামতকে সংগঠিত করার জন্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ভালো। কিন্তু কোনো একটি নিউজের বস্তুনিষ্ঠতা বিচার করতে হলে তখন আমাদেরকে প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমের কাছেই যেতে হবে। মানুষ যায়ও। গণমাধ্যম কিন্তু ফেসবুক থেকে অনেক তথ্য নেয়। কিন্তু তারা সেটা যাচাই করে। যাচাই করার পর পত্রিকায় সেটা ছাপে বা প্রকাশ করে। এই জায়গাটিই হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমের সঙ্গে মূলধারার গণমাধ্যমের পার্থক্য। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি তথ্যকে কে কতো আগে প্রকাশ করতে পারে সেটার প্রতিযোগিতায় নামে তারা। সেখানে কোনো জবাবদিহিতা থাকে না। কিন্তু মূলধারার গণমাধ্যমে তাদের এই জবাবদিহিতা আছে। ফলে সাধারণ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনমত গঠন করে। নানা ধরনের আদান প্রদান করে। কিন্তু কোনো একটি খবরের বস্তুনিষ্ঠতা যাচাই করার জন্য তাদেরকে মূলধারার গণমাধ্যমের কাছে ফিরতে হয়। এটাই হচ্ছে মূলধারার গণমাধ্যমের শক্তির জায়গা। কাজেই প্রচলিত গণমাধ্যম যত বেশি বস্তুনিষ্ঠতা অর্জন করবে পাঠকের আস্থা তারা ততোটাই অর্জন করতে পারবে। এই আস্থা পাওয়ার কোনো দায় সামাজিক মাধ্যমের নেই।
তথ্য-প্রযুক্তিবিদ ও প্রিয়.কমের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) জাকারিয়া স্বপন বলেছেন, ফেসবুক ইতিমধ্যে বিকল্প মিডিয়া হয়ে গেছে। অনেক ক্ষেত্রেই মূল ধারার গণমাধ্যমকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দিয়েছে। আমরা যে সেন্সে মূলধারার মিডিয়ার কথা বলছি সেটার মূলধারাটা কিন্তু পৃথিবীব্যাপী ভেঙে গেছে ইতিমধ্যে। কারণ প্রতিটি সাধারণ মানুষ এখন ইনডিভিজুয়াল সাংবাদিক। তথ্য পাস করার যে টেনডেনসি সেটা চলে এসেছে তাদের মধ্যে। আমরা অনেক কিছু এখন ফেসবুকে পেয়ে যাই। যেটা একজন পেশাদার সাংবাদিক অনেক সময় বের করতে পারেন না। যে কারণে লাখ লাখ মানুষ এখন ফেসবুকের কাছে চলে গেছে। বর্তমানে আমরা মূলধারা বলতে যে রেডিও, টেলিভিশন, পত্রিকাকে বুঝি এটাই হয় তো একসময় মূলধারা থাকবে না। ইনডিভিজুয়াল জার্নালিজম বা ইনফরমেশন পাসিং এটাই এক সময় মূলধারা হয়ে যাবে। এখনো সোশ্যাল মিডিয়ার ক্ষেত্রে আমরা খুব আরলি স্টেজে আছি। ভবিষ্যতে সোশ্যাল মিডিয়ার নিউজের ক্ষেত্রে এডিটিং, ফিল্টার, গেটকিপিং অর্থাৎ কোন্টা যাবে বা যাবে না এই ফিল্টারিং মেশিনেই করে ফেলতে পারবে। কারণ মানুষের চেয়ে মেশিনের ব্রেইন অনেক শক্তিশালী।
স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা ও গণমাধ্যম বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সৈয়দা আখতার জাহান বলেন, সোশ্যাল মিডিয়া বিকল্প মাধ্যম আসলে ওই অর্থে হতে পারছে না। কিন্তু আমরা প্রকাশ প্রিয় জাতি তো। আমরা প্রকাশ করতে পছন্দ করি। বৃষ্টি হচ্ছে...ভালো লাগছে। আজকে অনেক গরম.....। এই ধরনের প্রকাশ করে থাকি। ফেসবুকের প্রতি মানুষের ঝুকে পড়ার একটি কারণ হচ্ছে মানুষ তার বক্তব্যটা কমন গণ্ডির মধ্যেই জানাতে পারছে। এরশাদ মারা যাওয়ার পর খুব কম লোক ফেসবুকে ইতিবাচক লিখেছে। আরেকটি উল্লেখযোগ্য বড় অংশ নিশ্চুপ ছিল। তারা হ্যাঁ বা না কোনোটিই বলেনি। কিন্তু যখন একটি গুজব হলো ছেলে ধরা এবং সেই গুজবে মানুষ পিটিয়ে মারা হচ্ছে। তখন কিন্তু কমবেশি সবাই এটাতে অংশ নিচ্ছে। এটা ফেসবুক ব্যবহারকারীরা জানে খারাপ। তারপরও মানুষ কিন্তু থেমে থাকছে না। আমার মতে, ফেসবুক একেবারেই একটি প্রকাশের জায়গা। এখানে আমরা ফিডব্যাক দিতে পছন্দ করি।
বিটিভি’র সাংবাদিক আফরিন জাহান বলেন, ফেসবুক মানুষ ব্যবহার করছে। কিন্তু এর সত্যতা নিয়ে অনেক সময় প্রশ্ন আসে। অনেক সময় সত্য না জেনেই অনেক কিছু ভাইরাল করে ফেলি। ফেসবুক মানুষের বিশ্বস্ততার জায়গা অর্জন করতে পারেনি। মূলধারার নিউজের ক্ষেত্রে অনেক যাচাই-বাছাই করে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। অনেকের কাছে ফেসবুক হয়তো মূলধারার বিকল্প গণমাধ্যম। কিন্তু সেই বিশ্বাস যোগ্যতা এখনো ফেসবুক অর্জন করতে পারেনি।
ডেইলি স্টারের সাংবাদিক ইমরান মাহফুজ বলেন, গত এক দশকে ফেসবুক বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এই জনপ্রিয়তার কারণ হচ্ছে প্রথমত, এটার সহজলভ্যতা। গণমাধ্যমকর্মীদের অনেক সীমাবদ্ধতার কারণে যা প্রকাশ করতে পারে না সে তথ্যটা কিন্তু মানুষ ফেসবুকে পায়। ফলে মানুষ তখন ফেসবুকের প্রতি আরো আগ্রহী হয়ে ওঠে। আমাদের সংবাদপত্রগুলোর নিজস্ব কিছু সংকট আছে। এক্ষেত্রে কারো কারো ব্যবসায়িক মনোভাব আছে। সকল সংবাদ ঠিক সময়ে যেমন দেয় না। এবং ঠিক ওই অ্যাঙ্গেলে নিউজ আসে না। ফলে ওই ব্যক্তি ফেসবুকে তার কথাগুলো উন্মুক্তভাবে লিখছে, পড়ছে এবং লাইভে শোনারও সুযোগ পাচ্ছে। এটা হচ্ছে অংশগ্রহণ। কোনো কিছু ভাইরাল হলে বা অনেক বেশি আলোড়ন তৈরি করলে সেটার প্রতি হয়তো মূলধারার গণমাধ্যমের নজর আসে।
অনেক সময় আলোচিত ঘটনার কারণে মিডিয়া তখন নিউজ করতে বাধ্য হয়। কিন্তু অধিকাংশ সময় আমরা দেখেছি ফেসবুকের খবরে তথ্যভিক্তিক যাচাই বাছাই না থাকার কারণে সেগুলো আমরা বিশ্বাস করতে পারি না। ফলে গুজব তৈরি হয়। যারা সাংবাদিকতার ইথিক্যাল বিষয় সম্পর্কে জানে না। আমাদের দেশে অনেক পত্রিকা গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জনপ্রিয় না। ঠিক একই ভাবে ফেসবুকও জনপ্রিয় কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ না। এটা উন্মুক্তভাবে ব্যবহার করা যায়। এখানে কোনো সেন্সর নেই।
দেশ রূপান্তর পত্রিকার সাংবাদিক পরাগ মাঝি বলেন, নিঃসন্দেহে ফেসবুক একটি জনপ্রিয় মাধ্যম হয়ে উঠছে। তবে নির্ভরশীলতার দিক থেকে মূলধারার সংবাদ মাধ্যমকে এখনো অতিক্রম করতে পারেনি। সাম্প্রতিক সময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় গুজব সংক্রান্ত ফেইক নিউজের একটি প্রবণতা দেখা গেছে। যেটা ফেসবুকে পাওয়া সংবাদ বা তথ্যকে নতুন করে পরীক্ষার সম্মুখীন করেছে। ফলে এখন ফেসবুকে পাওয়া খবরাখবর নিয়ে মানুষ দ্বিতীয়বার ভাবে। কোনো একটি খবর পেলেই চিন্তা ভাবনা করে এটা গুজব না কী সত্য ঘটনা। কিন্তু মূল ধারার সংবাদ পত্র পড়ে মানুষের মাঝে এমন ভাবনা আসে না। এক্ষেত্রে সোশ্যাল মিডিয়াকে সাধারণ মানুষের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য হতে হলে ফেক নিউজ নামে যে একটি টার্ম তৈরি হয়েছে সেটার পুরোপুরি নিষ্পত্তি হতে হবে।
No comments