বিদেশে নির্যাতনে ৩০০০ নারী শ্রমিকের স্বপ্নভঙ্গ
বিদেশে
বিভিন্ন নির্যাতনের শিকার হয়ে নারী শ্রমিকদের একটি অংশ দেশে ফিরতে বাধ্য
হচ্ছে। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এবং মন্ত্রণালয়ের
অধীনে থাকা অন্যান্য সংস্থার দেওয়া তথ্যমতে, গত দুই বছরে প্রায় তিন হাজার
নারী নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, যা অভিবাসী মোট নারী শ্রমিকের ২ শতাংশের কম।
চলতি বছরেও নির্যাতন থেমে নেই। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিরা বলছেন,
নির্যাতনের শিকার হওয়া বা ফেরত আসা নারীদের সংখ্যা খুব নগণ্য। তবে অভিবাসী
শ্রমিকদের নিয়ে কর্মরত ব্যক্তি এবং মানবাধিকারকর্মীরা বলছেন, বিদেশে কাজের
জন্য গিয়ে একজন নারীও যদি নির্যাতনের শিকার হন, তার দায় নিতে হবে সরকারকে।
জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) দেওয়া তথ্য বলছে, গত
দুই বছরে প্রায় আড়াই লাখ নারী শ্রমিক বিভিন্ন দেশে গেছেন।
চলতি বছরের
অক্টোবর মাস পর্যন্ত ১ লাখ ১৩৬ জন নারী ১৮টি দেশে কাজের জন্য গেছেন। এর
মধ্যে শুধু সৌদি আরবে যাওয়া নারীর সংখ্যা ৬৬ হাজারের বেশি। এর বাইরে
সংযুক্ত আরব আমিরাত, জর্ডান, লেবাননসহ বিভিন্ন দেশে যাচ্ছেন নারী
শ্রমিকেরা। বিদেশ যাওয়ার পর কোন দেশে কত নারী নির্যাতনের শিকার, এর
পুরোপুরি তথ্য বিএমইটির কাছে নেই। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বিএমইটি, এনজিওসহ বিভিন্ন জায়গায় নারী
শ্রমিক ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন। বিএমইটির তথ্য বলছে, গত দুই
বছরে প্রায় তিন হাজার নারী বিভিন্ন দেশে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন বলে
অভিযোগ করেছেন। মে মাস থেকে রাজধানীর কাকরাইলে বিএমইটি কার্যালয়ে বেসরকারি
সংস্থা ওয়্যারবি একটি অভিযোগ কেন্দ্র চালু করেছে। চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে
অক্টোবর মাস পর্যন্ত এ কেন্দ্রে ৬১টি অভিযোগ জমা হয়েছে (ওয়্যারবির কাছে
আসা অভিযোগসহ)। এর মধ্যে ৩০টি অভিযোগ করেন নারী শ্রমিকেরা। এ সময়ের মধ্যে
নির্যাতনের শিকার ১৫ জন নারীকে বিদেশ থেকে ফেরত আনা হয়েছে, এঁদের মধ্যে ১৩
জনকেই আনা হয় সৌদি আরব থেকে। সরকারের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের দেওয়া
তথ্য অনুযায়ী, গত বছর সৌদি আরবের রিয়াদ ও জেদ্দা এবং ওমানের সেফহোমে আশ্রয়
নেওয়া ১ হাজার ৩৬২ জন নারীকে দেশে ফেরত আনা হয়। আর চলতি বছরের অক্টোবর মাস
পর্যন্ত এই হোমগুলোয় ২ হাজার ৪২৭ জন নারীকে আশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এঁদের মধ্যে
ফেরত আনা হয়েছে ২ হাজার ১৬০ জনকে। বাংলাদেশ অভিবাসী মহিলা শ্রমিক
অ্যাসোসিয়েশনের (বমসা) পরিচালক সুমাইয়া ইসলাম জানান, তাঁদের সংগঠন মাসে ৮
থেকে ১০টি অভিযোগ পাচ্ছে নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে। বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা
আইনজীবী সমিতির সাবেক নির্বাহী পরিচালক সালমা আলীর মতে, মধ্যপ্রাচ্যে
অভিবাসী নারী শ্রমিকদের মধ্যে ৯৯ শতাংশই শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের
শিকার। কেউ প্রকাশ করেন, কেউ প্রকাশ করেন না। ময়মনসিংহের নান্দাইলের এক
নারী মারধরসহ বিভিন্ন নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে টেলিফোনে প্রথম আলোকে
বলেন, ‘আফা, বুইঝা লন, আর কোন ধরনের নির্যাতনের শিকার হইছি। দেশে ফিরছি কয়
মাস হইলো, কিন্তু এখন পর্যন্ত স্বামীর কাছে ওই নির্যাতনের কথা বলতে পারি
নাই। সৌদি আরবে প্রায় প্রতি রাইতেই বাপ, ছেলে কেউ না কেউ নির্যাতন করত।
জমি
বেচার টাকা দিয়া স্বামী আমারে ফেরত আনলেও এহন নানা কথা শুনাইতাছে।’
হবিগঞ্জের এক বাবা সৌদি আরব থেকে তিন মাসের মাথায় মেয়েকে ফেরত আনার জন্য
দালালের বিরুদ্ধে মামলা করেন। এই বাবা টেলিফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর
সান্ত্বনা একটাই যে অবিবাহিত মেয়েটাকে জীবিত ফেরত পেয়েছেন। চলতি বছরের
শুরুর দিকে ফেরার পর থেকে চিকিৎসকের পেছনেই খরচ করতে হয়েছে ২০ থেকে ৩০
হাজার টাকা। আশপাশের মানুষের কাছ থেকে বাজে মন্তব্য শোনার পাশাপাশি
অবিবাহিত আরেক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে। সব থেকে ভয় হলো,
মেয়ের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দিয়েছে। তবে সামাজিক বাস্তবতায় মেয়েকে
ফেরত পাওয়ার পর আসামিপক্ষের সঙ্গে আপস করে ফেলেন এ বাবা। যৌন নির্যাতনসহ
বিভিন্ন নির্যাতনের অভিযোগে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইনসহ কয়েকটি দেশ
মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিক পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। অন্যদিকে, ২০১৫ সালের
ফেব্রুয়ারি মাসে গৃহ খাতে কর্মী নিতে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করে সৌদি
আরব। তখন থেকেই নারীদের নিরাপত্তার প্রশ্নটি সামনে আসে। সম্প্রতি
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে ওয়ান বিলিয়ন রাইজিং (উদ্যমে উত্তরণে শতকোটি) আয়োজিত
‘কেমন আছেন অভিবাসী নারী শ্রমিকেরা?’ শীর্ষক গণশুনানিতে কয়েকজন নারী তাঁদের
অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরেন। বিভিন্ন সময় নারী শ্রমিকদের কাছ থেকে পাওয়া
অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত ২২ থেকে ২৭ এপ্রিল প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক
কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব আজহারুল হকের নেতৃত্বে
উচ্চপর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল সৌদি আরবে যায় নারী শ্রমিকদের সার্বিক
অবস্থা দেখার জন্য। আজহারুল হকের মতে, নারী শ্রমিকেরা যত না নির্যাতনের
শিকার, তার চেয়েও গণমাধ্যমে প্রচার বেশি হচ্ছে। যে নারীদের পাঠানো হচ্ছে,
তাঁরা বিদেশ যাওয়ার জন্য মানসিক ও শারীরিকভাবে প্রস্তুত কি না, তা ভাবছে না
রিক্রুটিং এজেন্সিগুলো। আজহারুল হক বলেন, সৌদি আরবে সেফহোমে গিয়ে দেখা
গেল, এক নারীর মাথায় টিউমার, অথচ তিনি বিদেশে কাজ করতে চলে গেছেন। বাংলাদেশ
থেকেই গর্ভবতী হয়ে যাওয়া নারীদেরও দেখা মিলল। অথচ এঁদের অনেকেই অভিযোগ
করেন, সেখানে যাওয়ার পর তাঁরা ধর্ষণের ফলে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছেন। যৌন
নির্যাতন যে হচ্ছে না তা নয়, তবে নারীরা যৌন নির্যাতনের যে অভিযোগ করেন,
তার প্রায় ৮০ ভাগই মিথ্যা অভিযোগ। বিএমইটির পরিচালক (প্রশিক্ষণ) নুরুল
ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘৩৬টি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে গৃহকর্মী হিসেবে যেতে
ইচ্ছুক নারীদের এক মাসের প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। সেখানে আরবি ভাষা শেখানো
হলেও বিদেশ যাওয়ার আগে তাঁরা চর্চা করছেন না। বিদেশ যাওয়ার আগের দিন
পর্যন্ত নারীরা পেট ভরে ভাত খাচ্ছেন।
বিদেশ যাওয়ার পর যখন রুটি খেতে দেওয়া
হচ্ছে, তখন বলছেন, মালিক খাবার দেয় না। আর এখন পর্যন্ত নির্যাতনের যে
অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে, তা মোট নারী শ্রমিকের তুলনায় খুব কম। তবে সরকার
অভিযোগ পাওয়ার পরই দ্রুত নারীদের ফেরত আনার উদ্যোগ নিচ্ছে।’সরকারের
প্রস্তুতি ও উদ্যোগ প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের
অতিরিক্ত সচিব আজহারুল হকের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের প্রতিনিধিদল দেশে ফিরে
সরকারের কাছে একটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনের সুপারিশে বিদেশে
পাঠানোর আগে নারীদের কমপক্ষে এক মাস প্রায়োগিক প্রশিক্ষণ দেওয়া, চুক্তির
শর্ত সম্পর্কে বাস্তব ধারণা দেওয়া, বিএমইটি থেকে ইস্যু করা স্মার্টকার্ডে
বাংলাদেশি ও সৌদি রিক্রুটিং এজেন্সি এবং সৌদি নিয়োগকর্তার বিস্তারিত ঠিকানা
ও যোগাযোগ নম্বর রাখা, নারী গৃহকর্মীদের পাঠানোর আগে সব তথ্য সম্পর্কে
দূতাবাস/কনস্যুলেটকে অবহিত করা এবং গৃহকর্মীদের যেকোনো সমস্যায় দেশে ফেরত
পাঠানোর ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বাংলাদেশি রিক্রুটিং এজেন্সিকে দায়বদ্ধ করার
কথা বলা হয়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রিক্রুটিং এজেন্সির প্রতিনিধিরা
বিভিন্ন সময় এক মাস প্রশিক্ষণের সনদ জাল করে প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনেক নারীকে
বিদেশ পাঠিয়ে দিতেন। এক মাস ধরে এ বিষয়ে কড়াকড়ি এবং সনদ যাতে জাল করতে না
পারে, এর কিছু উদ্যোগ নিয়েছে বিএমইটি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, দূতাবাসে
কর্মরত ব্যক্তিরা চাইলেই সৌদি আরবে কোনো বাড়িতে ঢুকে সেখানে কর্মরত নারী
শ্রমিক কেমন আছেন, তা জানতে পারেন না। নারীরা বিপদে পড়ে কোনোভাবে তথ্য
জানাতে পারলেই দূতাবাসের পক্ষে কিছু করা সম্ভব। এই গৃহকর্মীদের দেশে বা
দূতাবাসের সঙ্গে যোগাযোগের সুযোগ প্রায় নেই বললেই চলে। তাই পালিয়ে দূতাবাসে
আশ্রয় নেওয়া ছাড়া গতি থাকে না। তবে প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান
মন্ত্রণালয়ের সচিব নমিতা হালদার প্রথম আলোকে বলেন, সৌদি আরবের সঙ্গে
চুক্তিতেই বলা আছে, নির্যাতনের শিকার হলে আইনি পদক্ষেপ নেওয়া যাবে। কিন্তু
বিপদে পড়লে নারীরা দূতাবাসের সাহায্য নেন না। তাঁরা পালিয়ে সেফহোম বা
আশ্রয়কেন্দ্রে চলে আসেন। তখন মালিকপক্ষ উল্টো ওই নারীর বিরুদ্ধে মামলা করে
দেয়। ফলে ওই নারীকে দেশে ফেরত পাঠানোর পুরো প্রক্রিয়া কঠিন হয়ে যায়। এ ছাড়া
বাংলাদেশ এবং যে দেশে নারী শ্রমিকেরা যাচ্ছেন, সেখানকার কিছু অসাধু
রিক্রুটিং এজেন্সির খপ্পরে পড়ে এই নারীরা বিমানবন্দর থেকেই বিক্রি হতে
থাকেন।
সচিব জানালেন, রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোকে জবাবদিহির আওতায় আনার চেষ্টা
চালানো হচ্ছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিফিউজি অ্যান্ড
মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন
তাসনিম সিদ্দিকী নারী শ্রমিকদের বিদেশ পাঠানোর আগে চুক্তির শর্ত, বিদেশ
গিয়ে কোন ধরনের পরিবেশে থাকতে হবে, তিন মাসের মধ্যে ফেরত আসতে চাইলে তার
খরচ নিজেকেই বহন করতে হবে—এ ধরনের তথ্য জানিয়ে পাঠানোর জন্য সরকারের যে
প্রচার তা যথাযথ নয়। নারী শ্রমিকেরা কোনো তথ্য না জেনেই বিদেশ চলে যাচ্ছেন।
তাসনিম সিদ্দিকীর মতে, বিদেশে নারী শ্রমিকেরা বিপদে পড়লে তা দূতাবাসকে
জানাবেন বলে সরকার যা দাবি করছে, কাজটি কিন্তু খুব একটা সহজ কাজ নয়।
অন্যদিকে, দূতাবাসের পক্ষেও কোনো বাড়িতে ঢুকে শ্রমিকদের দেখভাল করা সম্ভব
নয়। বিদেশে স্থায়ী বাংলাদেশিরা স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে মাসে একবার নারী
শ্রমিকদের সঙ্গে যোগাযোগের কাজটা করতে পারেন। ভারত বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা
চালু করেছে। অভিবাসী নারী শ্রমিকদের যথাযথ সুরক্ষা দিতে হলে সেফহোমের
সংখ্যা বাড়ানো, দূতাবাসের জনবল বাড়ানোসহ সরকারকে এ খাতে বিনিয়োগ বাড়ানোর
পরামর্শ দেন তিনি। গত বছরের প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান নীতিতে
নারীদের নিরাপত্তা প্রশিক্ষণসহ বিশেষ ধরনের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা
বলা হয়েছে, যাতে তাঁরা বিদেশে নিজেদের শারীরিক বা মানসিক সম্ভাব্য বিপদ
সম্পর্কে জেনে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় যথাযথ প্রস্তুতি নিতে পারেন। এ
ধরনের প্রশিক্ষণ কার্যক্রম এখনো শুরু হয়নি।
No comments