এই স্মৃতিভ্রষ্টতা সহ্য করার মতো নয় by এ কে এম শাহনাওয়াজ

বিজয়ের মাস অতিক্রম করতে যাচ্ছি। নতুন বছর সমাগত। এভাবেই দিন, মাস, বছর, কাল অতিক্রান্ত হয়। হালখাতা খুলে হালের হিসাব রাখি। খেরোখাতা তুলে রাখি তাকের ওপর। কখনও কিছু স্মৃতি সামনে চলে আসে, আবার অনেক স্মৃতিতে ধুলো জমে তা ধূসর হয়ে যায়। আজকাল বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবসের কাগজগুলোয় মুক্তিযুদ্ধকালীন ২নং সেক্টরের কমান্ডার ক্যাপ্টেন (পরবর্তীকালে লে. কর্নেল) হায়দারকে নিয়ে কোনো লেখা চোখে পড়ে না। খেরোখাতায় নিশ্চয় অনেকটা ধ–লো জমে গেছে। ডিসেম্বর শেষ হওয়ার আগে আমার মঙ্গলবাসরীয় লেখার একটি দিন পেয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন হায়দারকে নিয়ে লেখার সুযোগটি নিয়ে নিলাম। এই লেখাটির পেছনে দুটো অনুঘটক ছিল। আমি নারায়ণগঞ্জে বেড়ে উঠেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ক্লাস সেভেনের ছাত্র। শীতলক্ষ্যার পূর্ব পাড় বন্দরের বাড়ি ছেড়ে ২ এপ্রিল আমরা পাকবাহিনীর গুলির মুখে জীবন নিয়ে পালিয়ে ছিলাম পৈতৃক ঠিকানা বিক্রমপুরে। আমাদের দেয়ালঘেরা সাজানো বাড়ির পুরোটা জ্বালিয়ে দেয় পাকসৈন্যরা বিহারিদের সহায়তায়। অক্টোবরে পরিবারের খণ্ডিত অংশ এসে বসবাস শুরু করি বন্দরে। পোড়া টিন দিয়ে মাথাগোঁজার ঠাঁই বানিয়ে শুরু হয় নতুন সংসারে বসবাস। এ সময় এলাকার মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কখনও কখনও যোগাযোগ হতো।
তখনই ক্যাপ্টেন হায়দার- মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে ‘হায়দার স্যারে’র নাম শুনতাম। বছর দুই আগে ‘মুক্তিযুদ্ধে বন্দর’ নামে একটি বই সম্পাদনা করে প্রকাশ করি। এখানে একটা বড় অংশজুড়ে সংশ্লিষ্ট বীর মুক্তিযোদ্ধারা স্মৃতিচারণ করে লিখেছেন তাদের ভয়ানক এবং উত্তেজনাকর অভিজ্ঞতা। এই বইটিতে মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান ঢালী এবং মুক্তিযোদ্ধা জি কে বাবুল মেজর হায়দারকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেছেন। তাদের লেখা পড়ে এই বীর কমান্ডারের প্রতি আমার মনে একটি আলাদা শ্রদ্ধা তৈরি হয়েছে। আর দ্বিতীয় অনুঘটক হচ্ছে প্রিয় কলাম লেখক মাহবুব কামাল ভাইয়ের আর্তনাদ। আমি আর্তনাদই বলব। উপলক্ষ গত সপ্তাহে প্রকাশিত আমার লেখা। আগের দিন লেখা পেস্টিং হয়ে যাওয়ার পর কামাল ভাই এ সপ্তাহের লেখার বিষয় জানতে চাইলেন। বিষয় জানার পর প্রশ্ন করলেন এই লেখায় আমি মেজর হায়দার সম্পর্কে কিছু লিখেছি কিনা। লিখিনি জেনে প্রায় আর্তনাদই করেছিলেন। আমি তখন কথা দিয়েছিলাম বিজয়ের মাসের শেষ লেখাটি মেজর হায়দারকে নিয়েই লিখব। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা ২নং সেক্টরে পরপর দু’জন সেক্টর কমান্ডার পাই। ২নং সেক্টর গঠিত হয়েছিল নোয়াখালী জেলা, আখাউড়া-ভৈরব রেললাইন পর্যন্ত কুমিল্লা জেলা, ঢাকা জেলা এবং ফরিদপুর জেলার কিছু অংশ নিয়ে। এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এ সেক্টরের দায়িত্ব ছিল মেজর খালেদ মোশাররফের ওপর। তিনি যুদ্ধে আহত হলে সেপ্টেম্বর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছিলেন ক্যাপ্টেন এটিএম হায়দার। এই অকুতোভয় তরুণ ক্যাপ্টেন হায়দার মুক্তিযুদ্ধের সূচনাপর্বে কুমিল্লা সেনানিবাসে কর্মরত ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরু করতেই প্রতিরোধ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তিনি মনস্থির করেন। তিনি লক্ষ্যস্থির করে ২৭ মার্চ সেনানিবাস ছেড়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চলে আসেন। এখানে মিলিত হন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সঙ্গে। এখান থেকে তিনি চলে যান তেলিয়াপাড়া। এখানে কিছুসংখ্যক সৈন্য সংগ্রহ করে অগ্রসর হন। মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করার সুযোগ পেয়ে যান তিনি। কিশোরগঞ্জের ছেলে হায়দার নিজ অঞ্চল থেকেই যুদ্ধযাত্রা শুরু করেন। তিনি ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ সড়কসহ মুসল্লি রেলওয়ে সেতু বিস্ফোরক দিয়ে উড়িয়ে দেন। বৃহত্তর সংগ্রামের প্রস্তুতির জন্য ক্যাপ্টেন হায়দার ভারতের মেলাঘর ক্যাম্পে চলে আসেন। এখানে তিনি সেক্টর কমান্ডার খালেদ মোশাররফের সেকেন্ড-ইন কমান্ডার নিযুক্ত হন। ক্যাপ্টেন হায়দার মেঘালয়ে একটি স্টুডেন্ট কোম্পানি গঠন করেন। তার বিশেষ দায়িত্ব ছিল গেরিলাদের কমান্ডো ও বিস্ফোরক বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেয়া। নারায়ণগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধা জি কে বাবুল তার অভিজ্ঞতা থেকে লিখেছেন, ‘ক্যাপ্টেন হায়দার ঢাকাকে অচল করে দেয়ার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যে ঢাকায় আক্রমণ চালানোর জন্য গেরিলা যোদ্ধাদের নিয়ে গঠন করেন ক্র্যাক প্লাটুন আর নারায়ণগঞ্জ মহকুমার জন্য গঠন করেন শহিদ কোম্পানি। এর দায়িত্ব দেন গিয়াস উদ্দিন বীরপ্রতীকের ওপর।
এই দুই গেরিলা বাহিনীর সদস্যরা চোরাগুপ্তা আক্রমণের মাধ্যমে ঢাকা নারায়ণগঞ্জের অফিস, আদালত, প্রশাসনিক কার্যক্রম ও যোগাযোগ ব্যবস্থায় প্রতিনিয়ত আঘাত হানেন। গেরিলা বাহিনী যোগাযোগ ও বিদ্যুৎ ব্যবস্থা অচল করার পাশাপাশি গেরিলা যুদ্ধের সঙ্গে সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধেও অংশ নেয়।’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ক্যাপ্টেন হায়দার কুমিল্লা সেনানিবাসে যুক্ত হন। সেখানে তিনি মেজর পদে উন্নীত হয়েছিলেন। এ সময়ের একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন মুক্তিযোদ্ধা মিজানুর রহমান ঢালী। এই বর্ণনায় ব্যক্তি মেজর হায়দারকে অনুভব করা যাবে। তিনি বর্ণনা করেন, ‘১৯৭১-এর যুদ্ধ বিজয়ের অল্প পরের কথা। হায়দার স্যার তখন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে চাকরিরত। কোরবানির ঈদের আগের দিন দুপুরে হঠাৎ মেজর হায়দার গাড়ি নিয়ে নারায়ণগঞ্জ তল্লায় গিয়াস ভাইয়ের বাসায় চলে এলেন (গিয়াস উদ্দিন বীর প্রতীক)। আমি তখন সেখানে ছিলাম। গিয়াস ভাই কয়েকদিন আগে বিয়ে করেছেন। স্যার আমাকে ও গিয়াস ভাইকে বললেন, চলো আমার বাড়িতে (কিশোরগঞ্জে) ঈদ করব। বললেন, গিয়াস তোমার বউকেও নিয়ে চলো, খুব মজা হবে। আমি তড়িঘড়ি করে বাসায় গিয়ে একটি ব্যাগে ২-৪টি কাপড় নিয়ে চলে এলাম। ‘একটু একটু শীত পড়ছে। স্যারের গাড়ি গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হল। আমরা নারায়ণগঞ্জ ‘পাট সমিতির’ ফিয়াট-১১০০ একটি গাড়ির ব্যবস্থা করে দুপুর ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জ থেকে রওনা দিলাম। সঙ্গে কোনো ড্রাইভার ছিল না। গিয়াস ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন। ঢাকার পথে স্যার বললেন, চলো রুমীর মাকে (শহীদ জননী জাহানারা ইমাম) একটু দেখে যাই। বীর মুক্তিযোদ্ধা রুমী পাক হানাদারদের হাতে শহীদ হয়েছিলেন। ঢাকার ইস্কাটনে জাহানারা ইমামের বাসা। জাহানারা ইমাম হায়দার স্যারকে তুমি করে বলতেন। নিজ হাতে চা বানিয়ে ট্রুলিতে করে নিয়ে এসে আমাদের পরিবেশন করলেন।
তখনও রুমীর আব্বা জীবিত, অসুস্থ। পাশে একটি সোফায় চুপচাপ বসে আছেন। যা হোক, ৪টা থেকে ৫টার মধ্যে ওনার বাসা থেকে আমরা কিশোরগঞ্জের উদ্দেশে রওনা দিই। টাঙ্গাইল পৌঁছতে আমাদের রাত প্রায় ৮টা বেজে গেল। কারণ বীর মুক্তিযোদ্ধা কাদের সিদ্দিকী ঢাকা-টাঙ্গাইল সড়কের বড় বড় সব কটা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের একটু পরপরই বিকল্প পথে যেতে হচ্ছিল। টাঙ্গাইল শহর পার হয়ে আর এগোতে পারছিলাম না। কারণ, কুয়াশা ও অন্ধকারে বিকল্প পথগুলো শনাক্ত করতে কষ্ট হচ্ছিল। স্যার বললেন, চলো টাঙ্গাইলে রাতটা হল্ট করি।... ‘মনে পড়ে সার্কিট হাউসের দোতলায় একটি রুমে হায়দার স্যার, এক রুমে গিয়াস ভাই সস্ত্রীক ও এক কক্ষে আমি একা। খুব ভোরে আজানের আগে আমার কক্ষে স্যার নক করেন। একই সঙ্গে গিয়াস ভাইয়ের কক্ষেও। আমি তাড়াহুড়া করে ২-৩ মিনিটে কেডস পরে তৈরি হয়ে নিচে গিয়ে দেখি স্যার দুই হাতে দুটি বড় সুটকেস নিয়ে গাড়ির পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। যা হোক মনে পড়ে ভোরে আজানের সময় রওনা দিলাম। গিয়াস ভাই গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে ভাবি। পেছনের সিটে স্যার ও আমি। শীতের কারণে স্যার তার নিজস্ব একটি কম্বল বের করে আমার ও তার ঊরুর উপর দিয়ে দিলেন। ময়মনসিংহ শহরে গিয়ে বেশ ফর্সা হল। শম্ভুগঞ্জ ফেরি পার হয়ে এবার স্যার নিজে স্টিয়ারিং ধরলেন। রাস্তা ভাঙা থাকায় কখনও কাঁচা রাস্তা কখনও জমির ওপর দিয়ে কখনও ইটের রাস্তা।... ঠিক প্রায় সকাল সোয়া আটটায় স্যারের নিজ বাড়ি কিশোরগঞ্জ শহরের খড়মপট্টিতে চলে এলাম। রাস্তার পাশে বড় একটি দীঘির ধারে বাড়ির আঙ্গিনার ভেতর গাড়ি নিয়ে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই এক দৃশ্যের অবতারণা। স্যারের বিশালদেহী আব্বা এবং স্যারের ছোট ভাই জিতু (বিশালদেহী) ঈদের জামাতে যাওয়ার জন্য ঘরের বারান্দায় বের হয়েছেন। স্যারকে গাড়ি থেকে নামতে দেখে এগিয়ে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে সেই ছোটবেলার মতো বারবার চুমু খেতে লাগলেন। স্যার সেই স্নেহের আলিঙ্গনে পিতার বুকে মিশে গেছেন। তার আব্বা বললেন, জলদি গোসল ও ওজু করে তৈরি হও, নামাজের সময় হয়ে গেছে।’ এটিএম হায়দার ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের (এসএসজি) কর্মকর্তা, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কমান্ডো ও প্যারাট্রুপার।
১৯৭৪ সালে তিনি লে. কর্নেল পদে উন্নীত হন। এই বীর মুক্তিযোদ্ধার জীবনের শেষ অঙ্কটা ছিল করুণ। ১৯৭৫-এর ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর ঢাকা সেনানিবাসে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছিল। ৩ নভেম্বর ঢাকায় এসে খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন এটিএম হায়দার। ৭ নভেম্বরে পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থানে খালেদ মোশাররফের সঙ্গে লে. কর্নেল হায়দারকেও হত্যা করা হয়। তার মৃতদেহ ১১ নভেম্বর উদ্ধার করে দাফন করা হয় গ্রামের বাড়িতে। আজকাল এ কথাটিও কম উচ্চারিত হয়, ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের অনুষ্ঠানে রেসকোর্স ময়দানে এটিএম হায়দারও উপস্থিত ছিলেন। এ স্মৃতিভ্রষ্টতা সহ্য করার মতো নয়। মুক্তিযুদ্ধে অবদান রাখার জন্য হায়দারকে বীর উত্তম উপাধি দেয়া হয়েছিল। আর তার বোন মুক্তিযোদ্ধা ডা. ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম পেয়েছিলেন বীর প্রতীক উপাধি। নতুন প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের ইতিহাস স্পষ্ট করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের এই বীর সেনানীদের কথা বারবার উচ্চারণ করতে হবে। এই বরেণ্য মানুষদের ভুলে যাওয়ার অর্থ হবে ইতিহাসের পাতায় মুক্তিযুদ্ধের গৌরবকে ফিকে করে ফেলা। এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য আমাদের সবাইকে সচেতন-সতর্ক থাকতে হবে।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
shahnaway7b@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.