মুক্তিযুদ্ধের সেসব প্রতিশ্রুতি কে ভোলাল?
ডিসেম্বর
এলেই টেলিভিশনে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে নানান আলোচনা শুনি আর ভাবি,
‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ নিয়ে এসব গৎবাঁধা কথা জাতির কী কাজে আসবে?
মুক্তিযুদ্ধের আকাঙ্ক্ষার মধ্যে তো এসব গৎ না, তার মূলে ছিল বহু স্পষ্ট
দাবিদাওয়া ও গণমুখী রূপরেখা। ছোটবেলায় যখন ৬ দফা পড়েছি, ১১ দফা পড়েছি, তখন
তেমন কিছু বুঝিনি। বড়বেলায় যখনই ওসব চোখে পড়ে, রক্ত টগবগ করে।
মানুষের
মুক্তিসংগ্রামের কী অভূতপূর্ব এক দলিল। অথচ মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে শক্তিশালী
স্তম্ভগুলো ‘চেতনা’র আলোচনা থেকে হারিয়ে গিয়েছে। একাত্তরে রণাঙ্গনের
গল্পগুলোর বাইরে নিপীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়াই-সংগ্রামের যে
অবিস্মরণীয় ২৪ বছর, সেটা যেন স্রেফ নাই হয়ে গেছে। ১১ দফার ১ নম্বরে ছিল
শিক্ষাসমস্যার আশু সমাধান। বাংলাদেশ নামের স্বাধীন ভূখণ্ডে শিক্ষার মান
নামতে নামতে এখন তলানিতে ঠেকেছে? প্রশ্নপত্র কিনতে কিনতে ছেলেমেয়েদের
নীতি-নৈতিকতাহীন করে তোলার এক সর্বাত্মক আয়োজন চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের
শিক্ষক নিয়োগে ঢুকে পড়ছে লেজুড়বৃত্তির মানদণ্ড? একদিকে হাজার হাজার গ্রামে
কোনো স্কুলই নেই, আরেক দিকে মাধ্যমিক পর্যায়ের স্কুলে ১ হাজার ১১৬ কোটি
টাকার চলন্ত সিঁড়ি বানানোর আজগুবি প্রকল্প অনুমোদন হয়ে গেছে। ১১ দফার ২
নম্বরে ছিল পত্রিকার স্বাধীনতা। হায় বাক্স্বাধীনতা! ৫৭ ধারার ভয়ে ঠকঠক
করতে করতে এ সময়ের তীব্র লেখাগুলোকে নখদন্তহীন সরকারি প্রেসনোট বানিয়ে
দেওয়া হয়। আমাদের কোনো কোনো সাংবাদিক বন্ধু একটা সাহসী প্রতিবেদন করলে
পরবর্তী মাস খানেকের জন্য ‘চুপ’ হয়ে যান। ছাত্রলীগ-যুবলীগ কর্মীর অপকর্ম
নিয়ে প্রতিবেদন করালে কেমন হেনস্তা হতে হয়, তার বিস্তর উদাহরণ আছে। আর
চ্যানেলগুলোয় শক্ত কথা বলা মানুষগুলো ক্রমে কমে যাচ্ছে। ১১ দফার ৫ নম্বরে
ছিল ব্যাংক, বিমা, পাটকলসহ বৃহৎ শিল্পের জাতীয়করণ। কেমন আছে স্বাধীন
বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত পাটকল, চিনিকল, আর সার কারখানাগুলো? একে একে সব
কটি প্রতিষ্ঠানকে পরিকল্পিতভাবে ধ্বংস করিনি আমরা? রাজনৈতিক বিবেচনায় কোটি
কোটি টাকা ঋণ দিয়ে রাষ্ট্রীয় আট ব্যাংককে ফোকলা বানিয়ে ফেলিনি? নয় বছরে
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলো থেকে লুট হয়ে যায়নি ৪৫ হাজার কোটি টাকা? ১১ দফা দাবির
৬ নম্বরে ছিল কৃষকের ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা। অথচ স্বাধীনতার পর থেকে আজ
পর্যন্ত কৃষকের হাড়ভাঙা খাটুনির মূল্য কি দিতে পেরেছে এই দেশ? কৃষকের কাছ
থেকে ন্যায্যমূল্যে ধান কেনার সরকারি কার্যক্রম এখন আগাগোড়া অকার্যকর একটি
ব্যবস্থা। স্বাধীন বাংলাদেশে সাড়ে ৫০০ টাকায় ধান উৎপাদন করে বেচতে হয় ৪০০
টাকায়। চালকলগুলো ঠকায়।
ফড়িয়া নিয়ে যায় ৩৭ শতাংশ। আমরা নির্লিপ্ত শহুরে
মধ্যবিত্ত। রুগ্ণ, ভগ্ন, ঋণে জর্জরিত কৃষকের ভর্তুকি দেওয়া খাটুনির
‘ফিনিশড প্রোডাক্ট’ খাই। আর দেশের ৬০ শতাংশ মানুষকে অদৃশ্য রেখে সরকার
উন্নয়ন করে। ১১ দফার ৭ নম্বরে ছিল শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি আর আন্দোলনের
অধিকারের দাবি! এই স্বাধীন বাংলাদেশে পোশাকশ্রমিকের বেতন কত? আর মালিকের
মুনাফাই-বা কত? লজ্জাজনক হলেও সত্যি, এ দেশের শ্রমিক এখনো গোটা পৃথিবীতে
সবচেয়ে সস্তা (ভারতে ন্যূনতম মজুরি ১০,৯০০ টাকা, পাকিস্তানে ৯,২০০ টাকা আর
বাংলাদেশে ৫,৪০০ টাকা)। ৬০ টাকা দামের চাল, ১২০ টাকার পেঁয়াজ। দফায় দফায়
বাড়তে থাকা বিদ্যুতের বিল, গাড়িভাড়া, বাসাভাড়ায় এই মানবেতর মজুরিতে কোনো
রকমে খেয়ে-পরে বেঁচে থাকা যায় আজাবের এ রাজধানীতে। অধিকার দূরে থাক, উল্টো এ
দেশে মালিকের অনুদানে তৈরি হয় শিল্প পুলিশ। পিটিয়ে ছাতু বানিয়ে দেওয়া হয়
শ্রমিকের ন্যায্য মজুরির আন্দোলনকে। এই দেশে তাজরীন ফ্যাশনসে ১১৭ জন নারী
শ্রমিককে পুড়িয়ে মারলে বিচারের নামে প্রহসন চলে। রাষ্ট্রপক্ষ দিনের পর দিন
ইচ্ছাকৃতভাবে সাক্ষী হাজির করে না। ১১ দফার ৮ নম্বরে দেশের বন্যা
নিয়ন্ত্রণ! স্বাধীন বাংলাদেশে বাঁধ আর বন্যা নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে লুটপাটের এক
বিরাট আস্তানা। ইঁদুরে বাঁধ খেয়ে ফেলে, কৃষক বাঁধ কেটে ফেলেন—এসব
দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করা কর্মকর্তা ব্যক্তিরা কয়েক বছরে শত কোটি টাকা
লোপাট করে বসে আছেন। একের পর এক ত্রুটিপূর্ণ বাঁধ তৈরি হয়। পরের বছরই
বন্যায় ডুবে যায় মেহনতের ফসল। আবার নতুন উদ্যমে লুটপাট চলে। এভাবে এক বাঁধ
বারবার বানানো হয় এই দেশে। ১১ দফার ১০ নম্বরে শক্তিশালী পররাষ্ট্রনীতি।
আমাদের আত্মসম্মান বিকিয়ে দেওয়া পররাষ্ট্রনীতির কথা কি নতুন করে বলতে হবে?
একসময় শুনেছিলাম, ভারতকে ট্রানজিট দিলে দেশ সিঙ্গাপুর হয়ে যাবে। পরে অবশ্য
ট্রানজিট দেওয়া হলো, টনপ্রতি ১৯২ টাকা মাশুলে। আফসোস, দেশটা এখনো সিঙ্গাপুর
হলো না। সুন্দরবন আমরা ছেড়ে দিয়েছি এনটিপিসির হাতে, যা কিনা ভারতের অন্যতম
শীর্ষ পরিবেশদূষণকারী প্রতিষ্ঠান। কোটি কোটি টাকা খরচ করে রূপপুর ছেড়ে
দিয়েছি রাশিয়ান কোম্পানি রোসাটমের হাতে, যাদের আছে জালিয়াতির সুদীর্ঘ
ইতিহাস। চীনা কোম্পানির হাতে ছেড়ে দিয়েছি বাঁশখালীর আবাদি জমি। ভিটেমাটি
বাঁচাতে এরই মধ্যে সেখানকার পাঁচজন গুলি খেয়ে মরেছে। স্বাধীন বাংলাদেশের
সবচেয়ে গর্বের প্রতিষ্ঠান বাপেক্স। দক্ষ, নির্ভরযোগ্য ও সাফল্যের হার
ঈর্ষণীয়। সেই বাপেক্সকে বাদ দিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা লোকসান দিয়ে দ্বিগুণ
খরচে দেশের ১১০টি গ্যাসকূপ তুলে দেওয়া হয়েছে রুশ প্রতিষ্ঠান গাজপ্রমের
হাতে। চুক্তিতে আবার বলা হয়েছে, দুর্ঘটনার কোনো দায় তারা নেবে না। উল্টো
কোনো দুর্ঘটনা নিজেরা সামলাতে না পারলে বাপেক্সের প্রকৌশলী ডেকে কাজ করানো
হয়। লুটপাট থেকে দেশের গ্যাসসম্পদ বাঁচাতে বাপেক্সকে ঢেলে সাজানোর চেষ্টা
ব্যর্থ হয়েছে।
এ মুহূর্তে দেশের নীতি একটাই: ‘এলোমেলো করে দে মা, লুটেপুটে
খাক বিদেশি কোম্পানি’। এই যে উনসত্তরে একটা গণ-অভ্যুত্থান হয়েছিল, ১৯৭১
সালে হয়েছিল অতুলনীয় এক মুক্তিযুদ্ধ হয়েছিল; সেসব আন্দোলন ও লড়াই হয়েছিল
পাকিস্তানের ‘ফ্যাসিবাদী’ সরকারগুলোর দীর্ঘ ২৪ বছরের শোষণ আর লুটপাটের
বিরুদ্ধে। অথচ সেই শোষণ, লুটপাট আর জুলুমের বিরুদ্ধে ২৪ বছর ধরে ধাপে ধাপে
সংগ্রামের গল্পটা আর শোনা যায় না। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটটা
পুরোপুরি বুঝে ফেললে হীরক রাজার সব জারিজুরি ফাঁস হতে আর কতক্ষণ?
মুক্তিযোদ্ধা বা শহীদ বুদ্ধিজীবীরা গণভবনে গিয়ে সেলফি তোলেননি;
ক্ষমতাকেন্দ্রের আশপাশে ঘুরঘুর করেননি। তাঁদের একটা জিনিস ছিল, যাকে বলে
শিরদাঁড়া। তাঁদের কলমের ছিল মেরুদণ্ড। তাই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে গৎবাঁধা আলাপ
আর বিজ্ঞাপনের তোতাপাখি প্রচার থেকে বের হওয়া জরুরি। মুক্তিযুদ্ধকে বুঝতে
হবে তার প্রেক্ষাপটে। আপনি তাই ধাক্কা মারুন, প্রশ্ন করুন, তর্জনী ওঠান,
চিৎকার করুন। মুক্তির সংগ্রাম যুগ যুগ ধরে চলতে থাকা এক প্রক্রিয়া। আমাদের
অঘ্রানের ধানের খেত, আমাদের ফাল্গুনের আমের বাগান, আমাদের নদীর কূল আর বটের
মূল, আমাদের খাল-বিল-বন-পাহাড়, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাক্স্বাধীনতা—সবকিছু
হারিয়ে যাচ্ছে, দখল হয়ে যাচ্ছে। একাত্তরের আসল চেতনা একটাই: শাসকের
অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানো। মুক্তিযুদ্ধ এ কথাই
শিখিয়ে গেছে, ‘ডিসেন্ট ইজ দ্য হাইয়েস্ট ফর্ম অব প্যাট্রিওটিজম’। স্তুতিতে
দেশপ্রেম হয় না, প্রতিবাদ ও ভিন্নমতে হয়।
মাহা মির্জা: গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট।
মাহা মির্জা: গবেষক ও অ্যাক্টিভিস্ট।
No comments