থানার পাশেই মাদকের আখড়া
ভাষানটেক
থানা থেকে পিআরপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দূরত্ব বড়জোর এক শ গজ। এই
বিদ্যালয়ের ঠিক পেছনেই একটি পুকুর, পাশে নতুন একটি ভবন উঠছে। নির্মাণাধীন
সেই ভবনের ছাদে বিকেলের পর বসছে গাঁজার আসর। আর রাতে পুকুরপাড়ে চলে ইয়াবা
সেবন ও কেনাবেচা। থানা থেকে ঢিল ছোড়া দূরত্বে এভাবে মাদক কেনাবেচা হলেও
পুলিশ কিছুই করে না। এলাকাবাসীর অভিযোগ, থানা-পুলিশ বরং মাদকের কারবারে
সহায়তা করে। সে জন্য অভিযোগ দিলেও তারা গা করে না। ভাষানটেক থানার
ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সি ছাব্বীর আহম্মদ অবশ্য মাদক কেনাবেচায়
সহায়তা করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, ‘যে স্থানের
কথা বলছেন, সেটা তো মাদকের স্পট নয়, তবে আড্ডা সেখানে হতে পারে।’ কারা
আড্ডা দেয়, জানতে চাইলে ওসি বলেন, ‘স্থানীয় পোলাপান আর কিছু বহিরাগত আড্ডা
মারে।’ এলাকাবাসীর অভিযোগ, শুধু ভাষানটেক ও কাফরুল থানা এলাকাতেই এ রকম
মাদকের স্পট আছে ১১টি। যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও শ্রমিক লীগের
নেতা-কর্মীরা এসব স্পট নিয়ন্ত্রণ করেন। তবে পুলিশের সঙ্গে রফাদফার কাজটি
করেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের এক নেতা। জানতে চাইলে পুলিশের মিরপুর বিভাগের
উপকমিশনার মাসুদ আহাম্মদ অবশ্য এ অভিযোগ উড়িয়ে দেননি। তিনি প্রথম আলোকে
বলেন, থানা-পুলিশের কোনো না কোনো সদস্যের সঙ্গে মাদক ব্যবসায়ীদের সম্পর্ক
থাকলেও থাকতে পারে। তবে মাদক ব্যবসায় কেউ জড়িত থাকলে তিনি মাদক ব্যবসায়ীই,
তার আর কোনো পরিচয় বড় কথা নয়। গত বুধবার ভাষানটেক পুনর্বাসন প্রকল্পে গেলে
পিআরপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির দুজন সদস্য প্রথম আলোকে
বলেন, ভাষানটেক থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মিনহাজুল
আবেদিন ও তাঁর সহযোগীরা এলাকার মাদক ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি বলেন,
সন্ধ্যার পর পিআরপি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পেছনের পুকুরপাড়ে ইয়াবা বেচাকেনার
বাজার বসে। থানার সামনে দিয়েই মাদক ক্রেতারা আসা-যাওয়া করে। প্রতিদিন রাত
১১-১২টা পর্যন্ত লোকজন পুকুরপাড়ে অবস্থান করে মাদক সেবন করে। স্বেচ্ছাসেবক
লীগ নেতা মিনহাজুল আবেদিন নিজেও স্কুলের পেছনে গাঁজা ও ইয়াবা বেচাকেনার কথা
জানান। তবে তিনি বলেন, স্থানটি উন্মুক্ত থাকার কারণে মাদক বেচাকেনা হচ্ছে।
তবে তিনি নিজে মাদক ব্যবসায় জড়িত নন। তিনি দাবি করেন, যাঁরা তাঁর বিরুদ্ধে
অভিযোগ করছেন, তাঁরাই এলাকায় মাদক ব্যবসা করেন। স্থানীয় বাসিন্দাদের
অভিযোগ, ভাষানটেক কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির সাধারণ সম্পাদক নুর হোসেন খান
গণপূর্তের জমি দখল করে বেশ কিছু বস্তিঘর ও দোকানপাট গড়ে তুলেছেন। বস্তির
সামনে আগে সাগরিকা নামে একটি সিনেমা হল ছিল। এখন তা নেই।
বস্তির নামই হয়ে
গেছে সাগরিকা বস্তি। এই বস্তিতে ইয়াবা ও ফেনসিডিল কেনাবেচা হয়। নুর হোসেন
খান কমিউনিটি পুলিশিং কমিটির প্রভাব খাটিয়ে এবং ভাষানটেক থানা-পুলিশকে
ম্যানেজ করে মাদক ব্যবসা করেন বলে এলাকাবাসী জানান। বস্তির পাশেই মসজিদুল
আকস জামে মসজিদ। মসজিদ কমিটির একজন সদস্য প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিদিন
সন্ধ্যার পর ফেনসিডিলের খালি বোতলে মসজিদের শৌচাগার ভরে যেত। এখন লোহার ফটক
লাগিয়ে তা বন্ধ করা হয়েছে। মসজিদের ইমাম জুমার নামাজে মাদকের কুফল
সম্পর্কে বয়ানও করেন। ওই সদস্য বলেন, কিছুদিন আগে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা
আবদুল মজিদ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও ভাষানটেক থানায় লিখিত অভিযোগে
বলেছেন, নুর হোসেন যুবলীগের নেতা না হলেও তিনি নিজেকে নেতা বলে পরিচয় দেন।
তাঁর কারণে মানুষ আতঙ্কে আছে। প্রথম আলোর কাছে নুর হোসেন খান নিজেকে
যুবলীগের সদস্য বলে দাবি করেন। তাঁর বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের ব্যাপারে বলেন,
তিনি মাদক ব্যবসা করেন না। তিনি স্থানীয় দুই ব্যক্তির নাম উল্লেখ করে বলেন,
মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় আসিফুল হক ও আবদুল মজিদ তাঁর বিরুদ্ধে এসব
অপবাদ দিচ্ছেন। মসজিদের পাশে অবস্থিত সিবি-২৬০ পুরোনো কচুক্ষেত বস্তি।
বস্তির পাশের দুই দোকানি বলেন, সন্ধ্যার পর পুরোনো কচুক্ষেত বস্তিতে ইয়াবা
বেচাকেনা হয়। শ্রমিক লীগের নেতা আজিজুল হক ওরফে কালা বাবুল, তাঁর বোন
হেলেনা আক্তার, ভগ্নিপতি হাবিবুর রহমান তাঁর সহযোগীদের দিয়ে ইয়াবা ব্যবসা
নিয়ন্ত্রণ করেন। ইয়াবা বেচাকেনার অভিযোগে কালা বাবুলকে একাধিকবার গ্রেপ্তার
করা হয়েছে। জামিনে বেরিয়ে এসে তিনি আবার ইয়াবা ব্যবসা শুরু করেন। ভাষানটেক
থানার পুলিশ জানায়, কালা বাবুল ভাষানটেক থানার তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী।
তিনি পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতা। থানায় তাঁর বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ
আইনে ছয়টি মামলা রয়েছে। তাঁর বোন হেলেনা ও ভগ্নিপতি বাচ্চুর বিরুদ্ধেও
মাদকদ্রব্য আইনে ছয়টি করে মামলা আছে। ভাষানটেকের বাগানবাড়ি পকেট গেট এলাকায়
ইয়াবা বেচাকেনা নিয়ন্ত্রণ করেন ভাষানটেক থানা জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ
সম্পাদক শেখ লিটন ও কালু ব্যাপারী। তিন মাস আগে র্যাব-১-এর একটি দল
গাজীপুর এলাকা থেকে বিপুল পরিমাণ ইয়াবাসহ শেখ লিটনকে গ্রেপ্তার করে।
ভাষানটেক থানার পুলিশ জানায়, কালু ব্যাপারীকে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার করা
হয়েছিল। তাঁর বিরুদ্ধে ভাষানটেক থানায় মাদকদ্রব্য আইনে একটি মামলা রয়েছে।
সম্প্রতি তিনি জামিনে বেরিয়ে এসেছেন। মিরপুর ১৪ নম্বর মোড়সংলগ্ন খালের দুই
পাড়ে গড়ে ওঠা বাগানবাড়ি বস্তিতে গাঁজা ও ইয়াবা ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ করেন
তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ী বাচ্চু মিয়া। বাচ্চু বাগানবাড়ি ইউনিট
স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। জানতে চাইলে বাচ্চু মিয়া মাদক ব্যবসায় জড়িত
থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, রাজনীতি করেন বলেই তাঁর নামে কেউ অভিযোগ করতে
পারেন। অনুসন্ধানে জানা যায়, ধর্ষণ মামলার আসামি আলমগীর হোসেন, মামুন
হোসেন ও মাসুদ রানা ভাষানটেক টেকপাড়ায় টিনশেড এলাকার ইয়াবা ব্যবসা চালান।
তাঁদের সঙ্গে আছেন ফরহাদ শিকদার। তাঁরা স্বেচ্ছাসেবক লীগের নেতা। আলমগীর
ভাষানটেক থানা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি। ফরহাদ শিকদারের বিরুদ্ধেও কাফরুল
থানায় ধর্ষণের মামলা রয়েছে। যোগাযোগ করা হলে আলমগীর টেকপাড়ায় মাদক ব্যবসা
চলার সত্যতা স্বীকার করে প্রথম আলোকে বলেন, এই ব্যবসায় কারা জড়িত, তা তিনি
জানেন না। তবে তিনি নিজে মাদক ব্যবসা করেন না বলে জানান। তাঁদের বিরুদ্ধে
হওয়া ধর্ষণের মামলাটিও মিথ্যা বলে তিনি দাবি করেন। কাফরুল থানার
ইব্রাহিমপুরের সৃজনী সড়কের বাসায় অভিযান চালিয়ে সুলতানা বেগম, তাঁর ছেলে
নিশাত ও দেবর বিপ্লবকে ১০ হাজার ইয়াবা বড়িসহ গ্রেপ্তার করে র্যাব।
সম্প্রতি তাঁরা জামিন পান। সুলতানা ক্ষমতাসীন দলের এক সাংসদের ঘনিষ্ঠ বলে
পরিচিত। গতকাল বুধবার বিকেলে সৃজনী সড়কে গেলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে
একটি বাড়ির মালিক প্রথম আলোকে বলেন, সুলতানা ও তাঁর দুই ছেলে এখনো
নির্বিঘ্নে ইয়াবা ব্যবসা করছেন। তাঁরা এক সাংসদের লোক বলে পরিচিত। এ কারণে
স্থানীয় বাসিন্দারা ভয়ে মুখ খোলেন না। র্যাব-৪-এর কোম্পানি কমান্ডার
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আনোয়ার হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, সুলতানাকে তাঁর ছেলে,
দেবরসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। দক্ষিণ কাফরুলের ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ
করেন চামাইরা বাবু ও নিক্সন। দক্ষিণ কাফরুলে গেলে স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন,
চামাইরা বাবু ও তাঁর লোকজন পোশাক কারখানার কিছু কিশোরী কর্মীকে দিয়ে ইয়াবা
আনা-নেওয়ার কাজ করান। এ জন্য এসব মেয়েকে বেতন দেওয়া হয়। ইব্রাহিমপুরের আশি
দাগ এলাকায় রুম্মান ইয়াবা ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। পুলিশ বিপুল পরিমাণ
ইয়াবা বড়িসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তাঁর বিরুদ্ধে কাফরুল থানায় মামলাও আছে।
কাফরুল থানার ওসি শিকদার মো. শামীম হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর এলাকায়
কোনো মাদকের আখড়া নেই। তবে মুঠোফোনে ইয়াবা বড়ি বিক্রি হচ্ছে বলে প্রায়ই
শুনে থাকেন।
No comments