বেনারসির তাঁতিরা বেকার হয়ে যাচ্ছে
চোখ ধাঁধানো মিরপুরের বেনারসি পল্লী। আড়ালে তাঁতিদের দুঃখগাথা। কেউ শোনে না তাদের বোবাকান্না। এ হচ্ছে বেনারসি পল্লীর বাস্তবতা। ভারতীয় শাড়ি অবাধ প্রবেশে হুমকির মুখে পড়েছে ঐতিহ্যবাহী বেনারসি শাড়ি। আর সেই সঙ্গে বেনারসি শাড়ির তাঁতিদের জীবনে নেমে এসেছে অসীম দুর্ভোগ। সরেজমিন দেখা যায়, রাজধানীর মিরপুর ১১ নম্বরে বিহারি ক্যাম্প। ছোট ছোট তাঁত কারখানাগুলো বন্ধের উপক্রম হয়েছে। কিছু ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। যেগুলো আছে সেগুলোর অবস্থাও ভালো নয়। নানা কারণে বন্ধ হওয়ার উপক্রম। তাঁতি মহাজন মো. কাসিম যুগান্তরকে বলেন, ‘বুঝ হওয়ার পর থেকেই এ ব্যবসা করছি। আমার বাপ-দাদাও এ ব্যবসা করতেন। এখন এ ব্যবসার অবস্থা খুব খারাপ। বর্তমানে শাড়ির কাঁচামালের দাম চড়া। একটা শাড়ি বুনতে সময় লাগে এক সপ্তাহ। কাঁচামালের খরচ পড়ে ১ হাজার ২০০ থেকে ১ হাজার ৪০০ টাকা। শোরুম মজুরি দেয় ১ হাজার ৭০০ থেকে ২ হাজার টাকা। এ আয় দিয়ে বৌ-বাচ্চা নিয়ে চলা খুবই কঠিন।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমার আগে ৮টি তাঁত ছিল, আর এখন আছে চারটি। তাও তাঁতি আছে (আমিসহ) দু’জন। এভাবে চলতে থাকলে ব্যবসা কীভাবে চলবে আমি জানি না। আজ থেকে ১০-১৫ বছর আগেও এ মহল্লায় ২৫ থেকে ৩০টি তাঁতের কারখানা ছিল।’ আরেক তাঁতি মহাজন আবদুল সামাদ বলেন, ‘দুই বছর আগে তাঁতিদের সমিতি করার উদ্যোগ নেয়া হলেও আজও তা কার্যকর হয়নি। আরও শোরুম মালিকদের কাছ থেকে কাজ নিয়ে আসি। কোনো কোনো শোরুম দাদন দেয়। সপ্তাহ শেষে টাকা নিয়ে আসি।’ তাঁতশিল্পী আনোয়ার হোসেন ১০ বছর ধরে এ পেশায় আছেন। তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘এক সপ্তাহে একটি শাড়ি তৈরি করা যায়। নকশা ভেদে মজুরি পাই ২ হাজার ৫০০ টাকা। কিন্তু শোরুমের মাালিক এ শাড়ি বিক্রি করে ১০ হাজার টাকা। শাড়ির দাম আছে, কারিগরের দাম নাই।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেকেই এ পেশা ছেড়ে গার্মেন্টে চলে যাচ্ছেন। আবার কেউ চায়ের দোকান দিয়েছেন, কেউ হকারি করছেন। এ কারখানায় ১০টি তাঁত থাকলেও এখন মাত্র ৪টি তাঁত চালু আছে।’ তাঁতিদের এ সমস্যা নিয়ে কথা হয় বেনারসি পল্লীর বিগ বাজার শোরুমের স্বত্বাধিকারী মো. জাহাঙ্গীর আলমের সঙ্গে। তিনি যুগান্তরকে বলেন, এ ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। মহাজনরা কাজ নেয়। কাজ শেষে শাড়ি জমা দিয়ে টাকা নিয়ে যায়। তাঁতিদের সঙ্গে আমাদের সরাসরি কোনো যোগাযোগ নেই। বেনারসি পল্লীর পরিচয় দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও ছড়িয়ে পড়ে। অথচ এই পল্লীর গড়ে উঠা দোকানে ৭০ শতাংশ শাড়িই ভারতীয়। বৈধ-অবৈধ নানা উপায়ে কম মূল্যে এনে চড়া দামে বিক্রি করছে দোকান মালিকরা। ভারতীয় শাড়ির অবাধ বিক্রি প্রসঙ্গে কথা বলতে বোনারসি পল্লীর দোকান মালিক সমিতির সভাপতি মো. কলিম উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মো. কাশেমকে কয়েকবার তাদের দোকানে গিয়ে পাওয়া যায়নি। তাদের মুঠোফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তা বন্ধ পাওয়া যায়। ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারত থেকে বেনারসি শাড়ির তাঁতিরা এ দেশে চলে আসেন। মিরপুরে বিহারিদের একটা বড় অংশ তাঁত পেশায় জড়িত থাকলেও কালের বিবর্তনে তা সঙ্কুচিত হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন লাখ লাখ টাকার ব্যবসা হয় বেনারসি পল্লীতে। মৌসুম ভেদে দোকান প্রতি দৈনিক প্রায় ২ লাখ থেকে ২৫ লাখ টাকার শাড়ি বিক্রি হয়। বছরে প্রায় ৪০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এখানে। অথচ বেনারসি পল্লীর অন্তরালের কুশিলব সেই তাঁতিদের আজ বেহালদশা। ভারতীয় শাড়ির অবাধ প্রবেশ অব্যাহত থাকলে বেনারসি শাড়ি হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁতি ও মহাজনরা।
No comments