বাঁধ ভেঙে ডুবল শনির হাওর
প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধে জয় হল না। টানা ২৪ দিন তাহিরপুরসহ তিন উপজেলার ৪০ গ্রামের হাজার হাজার মানুষ এ যুদ্ধে হেরে গেছেন। শনিবার মধ্য রাতে সুনামগঞ্জের শনির হাওরের বাঁধ ভাঙার মধ্য দিয়েই যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। রোববার সূর্য ওঠার আগেই অতিবৃষ্টি আর পাহাড়ি ঢল গ্রাস করে শনির হাওর। এলাকার সর্বশেষ হাওরটির সঙ্গে তলিয়ে যায় ২২ হাজার একর জমির আধাপাকা ধান। বাঁধ ভাঙার খবরে এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। সব হারানো কৃষককের হাহাকারে হাওর পাড়ে সৃষ্টি হয় হৃদয়বিদারক দৃশ্যের। ফলে ভারি হয়ে উঠে এলাকার পরিবেশ। এ অবস্থায়ও কৃষকরা তাদের ক্ষতির জন্য দায়ী করছেন পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা এবং ঠিকাদারদের। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত ঘেঁষেই জাদুকাটা নদী। টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে পাটলাই নদের সংযোগ নদ তাহিরপুরের বৌলাই। পাহাড়ি ঢল নামলে এ নদী উপচে বিভিন্ন হাওরে পানি ঢুকে। শনির হাওরের ফসল রক্ষায় উত্তর দিকের বৌলাই নদীর তীর ঘেঁষা অংশ ফসল রক্ষা বাঁধ। এ বৌলাই নদীর তীর ভেঙেই শনিবার মধ্যরাতে লালুর গোয়ালার বাঁধ আর ভোরের দিকে সাহেব নগর বাঁধ ভেঙে প্রবল বেগে পানি ঢুকে শনির হাওরে। পানির স্রোত বেশি থাকায় তা সামাল দেয়ার সাহসও করেননি কৃষকরা। পানি ঢুকে রোববার সন্ধ্যায় ডোবে হাওরের প্রায় ৬০ শতাংশ। স্থানীয় কৃষকদের মতে, আজ বিকালের মধ্যেই শতভাগ ধান ডুবে যাবে। সেই বাঁধ রক্ষায় সুনামগঞ্জের তাহিরপুরসহ তিন উপজেলার সহস্রাধিক কৃষক ২৯ মার্চ থেকে দিন-রাত কাজ শুরু করেন। তারা শনির হাওরের বাঁধ সংস্কারের পাশাপাশি মাটি ও বাঁশ দিয়ে কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী তৈরি করেছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। শনিবার মধ্য রাতে তীব্র বেগে পানি ঢুকে চোখের পলকে সব ভেঙে নিয়ে যায়। তলিয়ে যায় জেলার সর্বশেষ হাওরটি। সেই সঙ্গে ডুবে যায় পুরো সুনামগঞ্জবাসীর স্বপ্নও। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর পেয়ে শত শত কৃষক ভোর রাতেই কাঁচা-পাকা ধান কাটা শুরু করেন। এ সময় কৃষকের চোখের পানি আর হাওরের জলরাশি একাকার হয়ে যায়। জেলার সর্বশেষ এ হাওরটি ডুবে যাওয়ার কথা শুনে চোখের পানি ফেলেছেন সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলাম। আবেগতাড়িত কণ্ঠে রোববার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘শনির হাওর রক্ষায় প্রাণান্তকর চেষ্টা করেছি। বাঁধ নির্মাণে মানুষের কষ্ট প্রত্যক্ষ করেছি। ফসল হারা কৃষকের ব্যথায় আমিও ব্যথিত। আমি সর্বশক্তি প্রয়োগ করেছিলাম। কিন্তু কয়েকদিন ধরে টানা বৃষ্টিতে পানি বাড়তে থাকায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।’ তিনি বলেন, ‘একদিকে বাঁধ নির্মাণ করলে আবার অন্যদিকে চোরাই গর্ত তৈরি হয়। এভাবে রাত-দিন বাঁধ নির্মাণে স্থানীয় মানুষ রীতিমতো যুদ্ধ করেছেন।’ ডিসি বলেন, ‘সম্পূর্ণ হাওর ডুবতে ২-৩ দিন সময় লাগবে। এর মধ্যে হয়তো কিছু ফসল কাটা যাবে। কিন্তু সর্বশেষ হাওরটিও রক্ষা হল না এটা অত্যন্ত কষ্টের। দীর্ঘদিন এ কষ্ট আমাকে পীড়া দেবে।’ স্থানীয় জনগণ বলেন শনির হাওরে আগে কখনও শনি লাগেনি। ১৯৭৭, ১৯৯৩ ও ২০১০ সালে সারা জেলায় ফসলহানি ঘটলেও শনির হাওর ছিল অক্ষত। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদাসীনতার কারণে টানা ২ বছর ফসল তলিয়ে যাওয়ার মতো মর্মান্তিক ঘটনা ঘটল। বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার রাজিনপুর গ্রামের কৃষক জালাল উদ্দিন বলেন, আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছিলাম হাওর বাঁচানোর জন্য। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ডের দুর্নীতির কারণে সময়মতো বাঁধে কাজ না হওয়ায় আমরা ব্যর্থ হয়েছি। গত বোরো মৌসুমেও শনির হাওরের ফসলরক্ষা বাঁধ ভেঙে আধাপাকা ধান তলিয়ে যায়। টানা দুই বছর ফসলহানির কারণে দিশেহারা কৃষক। আহাজারিতে হাওরপারের গ্রামগুলোর বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বিগত বছরের ক্ষতি ও চলতি বছরের জীবিকার তাগিদে নতুন উদ্যম নিয়ে হাওরে ধান বুনেছিলেন কৃষকরা। কিন্তু শনির হাওরের শনির দশা না কাটায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছে হাজার হাজার কৃষক পরিবার। প্রায় ১৩ হাজার হেক্টর আয়তনের এ শনির হাওর। তাহিরপুর ছাড়াও জামালগঞ্জ ও বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার কৃষকদেরও জমি রয়েছে এখানে। আয়তনের দিক থেকে জেলার ৪২টি বড় হাওরের মধ্যে এটি দ্বিতীয়। হাওরটিতে ২২ হাজার একর জমিতে আবাদ হয়েছে বোরো ধান। তিন উপজেলার ৪৮টি গ্রামের মানুষ বছরের একটি মাত্র ফসল বোরো ধান আবাদ করেন এ হাওরে। ২ কোটি ২৯ লাখ টাকায় ৪ ঠিকাদার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কাজ পেয়েছিল হাওরটি রক্ষায়। কিন্তু তারা কোনো কাজই করেনি। পাহাড়ি ঢলের পানি বাড়তে থাকলে স্থানীয় তাহিরপুর উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুলের নেতৃত্বে এলাকার অন্তত সহস্রাধিক কৃষক বাঁধ নির্মাণে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ভাটি তাহিরপুর গ্রামের আবদুর রাজ্জাক বলেন, গত কয়েক দিন ধরেই এলাকার মানুষ হাওরটি রক্ষায় যুদ্ধ করেছে। কয়েক স্থান থেকে বাঁধ ভেঙে যাওয়ার খবর আসতে থাকে। খবর পেয়ে এলাকার হাজার হাজার মানুষ যার যা কিছু আছে তা নিয়েই ঝাঁপিয়ে পড়ে। ভাটি তাহিরপুর গ্রামের সালাম মিয়া বলেন, ‘শনিবার রাতে ১০টার দিকে লালু গোয়ালা বাঁধের ওপর দিয়ে হেঁটেছেন অনেকেই। তখন কোনো ভাঙার আলামত দেখা যায়নি।
এর আধা ঘণ্টা পরই হঠাৎ করেই শুনতে পাই যে বাঁধটি ভেঙে গেছে।’ স্থানীয় সূত্র জানায়, নদীতে ঢলের পানি বাড়ার পরপরই এ হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধে যখন পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদার কিংবা প্রকৌশলীর দেখা পাওয়া যাচ্ছিল না, ঠিক তখন থেকে এ হাওরের ৪ থেকে ৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ স্বেচ্ছাশ্রমে উঁচু করতে শুরু করেন স্থানীয় মানুষ। যে কাজটি পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারের করার কথা, সেটার দায়িত্ব নেন তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল। তরুণ এই উপজেলা চেয়ারম্যানের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন স্থানীয় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীসহ প্রশাসনের কর্মকর্তারা। এগিয়ে আসেন তিন উপজেলার হাজারও সাধারণ মানুষ। বাঁধ ভাঙার আগমুহূর্ত পর্যন্ত স্বেচ্ছাশ্রমে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করেন টানা প্রায় ২৪ দিন। কিন্তু হাজারও কৃষকের অক্লান্ত পরিশ্রমকে পণ্ড করে দিয়ে শনিবার মধ্যরাতে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকতে শুরু করে। শনির হাওরপারের কৃষক উজান তাহিরপুর গ্রামের নূরুল হক জানান, ওই হাওরে তার প্রায় দেড় হাল জমিন ছিল। সম্পূর্ণ জমি পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে। ধান কাটার উপযুক্ত না হওয়ায় এক ছটাক জমির ধানও ঘরে তুলতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘এই ধানের ওপর আমাদের সারা বছরের জীবন-জীবিকা নির্ভর করে। এখন সারা বছর কেমনে কাটাব, তা ভেবে কূল পাচ্ছি না।’ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘বাপের আমল থেকে শুনে আসছি শনির হাওর ধানের ভাণ্ডার। এ ধানের ভাণ্ডার আজ তলিয়ে গেল ঠিকাদার ও পিআইসিদের গাফিলতির কারণে। এখন আমরা কী নিয়ে বাঁচব, তা উপরওয়ালাই ভালো জানেন।’ বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার অনন্তপুর গ্রামের সেলিম মিয়া বলেন, হাওরে পানি ঢুকছে। ধান যে অবস্থায় তাতে কাটার উপযুক্ত হয়নি। এখন গরুর খাদ্য বানানোর জন্য কাঁচা ধান কাটছি। দেখি কত সময় কাটতে পারি। যেভাবে পানি ঢুকছে তাতে মনে হচ্ছে বেশি সময় ধান কাটা সম্ভব হবে না। তাহিরপুর উপজেলার উজ্জ্বলপুর গ্রামের তৌহিদ মিয়া জানান, ‘প্রায় ৩৩ একর জমি আবাদ করছিলাম। ৩০ একরের মতো পাশের হালির হাওরে ছিল। সেগুলো আগেই পানিতে তলিয়ে গেছে। এখন শনির হাওরে তিন একরের মতো আছে। বাঁধ উপচে পানি হাওরে ঢুকার উপক্রম হওয়ার পর থেকে কাঁচা ধান কাটতে শুরু করে দিয়েছি। এখান থেকে সামান্য যা ধান পাই না কেন গোখাদ্যের কিছুটা জোগান তো হবে।’ স্থানীয় নোয়ানগর গ্রামের কৃষক মুসলিম মিয়া কাঁদতে কাঁদতে ডুবে যাওয়া জমির কাঁচা ধান চিবিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করেন। এ সময় তিনি বিলাপের সুরে বলেন, ‘আল্লায় আমারে কেনে পাইন্নে ভাসাইয়া নেয় না, বাড়িত গিয়া বাচ্ছা কাচ্ছারে (ছেলেমেয়েদের) কিতা খানি দিতাম।’ এ কান্না শুধু মুসলিম মিয়ার নয়, শনির হাওরপাড়ের সমস্ত গ্রামবাসীর। তাহিরপুর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল জানান, সাহেবনগরের পূর্বপাশের বাঁধ ও জালখালি বাঁধটি মূল বাঁধ হতে তিন ফুট উঁচু করে দিলে এই সমস্যা হতো না। তিনি বলেন, ‘হাওরপাড়ের কৃষকদের নিয়ে স্বেচ্ছাশ্রমে আমি ২৫ দিন ধরে কাজ করেছি। এ হাওরটি তলিয়ে যাওয়ার দায়ও পাউবো এড়াতে পারে না।’ তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বললেন, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের সহায়তা করতে প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগই গ্রহণ করবে উপজেলা প্রশাসন। বাঁধ নির্মাণে ঠিকাদার যারা : এ সংক্রান্ত নথিপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, তাহিরপুরের শনির হাওর রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ড ৫টি প্যাকেজে বাঁধ নির্মাণের দরপত্র আহ্বান করে। এতে টাঙ্গাইলের গুডম্যান এন্টারপ্রাইজ ৪৫ লাখ ৭৬ হাজার টাকায় একটি কাজ পায়। পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর কাজের অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, সংশ্লিষ্ট বাঁধে এই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ করে মাত্র ১০ পার্সেন্ট। গত বছরও এই প্রতিষ্ঠান কাজ করেছে অর্ধেকেরও কম। আর বিল নিয়েছেন ১০ লাখ ৬১ হাজার টাকা। রাজেন কন্সট্রাকশন নামে আরেকটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ৩৬ লাখ টাকায় শনির হাওরে একটি কাজ পায়। এই প্রতিষ্ঠানটির কাজের অগ্রগতি উল্লেখ করা হয় ১০ পার্সেন্ট। গত বছর একই বাঁধে প্রতিষ্ঠানটি সামান্য কাজ করে তুলে নিয়েছে ১৪ লাখ টাকা। সুনামগঞ্জের পার্থ’র মালিকানাধীন এলএন কন্সট্রাকশন নামের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান এক কোটি ১২ লাখ ৪৪ হাজার টাকায় সর্বনিন্ম দরদাতা হিসেবে দুটি বাঁধের কাজ দেয়া হয়। অগ্রগতি প্রতিবেদনে দেখা গেছে, প্রতিষ্ঠানটি একটিতে ১৫ পার্সেন্ট এবং অপরটিতে ১৫ পার্সেন্ট কাজ করে। গত বছর এই দুটি বাঁধে নামকাওয়াস্তে কাজ করে তুলে নিয়েছে ৩৩ লাখ ৫৬ হাজার টাকা। এ প্রসঙ্গে পার্থ পুরকায়স্থ বলেন, তাদের কার্যাদেশ দেয়া হয়েছে দেরি করে। ফলে কাজ শুরু করতে দেরি হয়েছে। এদিকে শনির হাওর রক্ষায় পিআইসি’রও (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) একটি তালিকা পাওয়া যায়। এতে দেখা গেছে, ১১ লাখ ২৮ হাজার ৮৭৭ টাকা নিয়ে একটি প্রকল্প চেয়ারম্যান ছিলেন তাহিরপুর সদর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান বোরহান উদ্দিন। ৮ লাখ ৫৪ হাজার ২২৯ টাকায় আরেকটি প্রকল্পের চেয়ারম্যান ছিলেন ইউপি সদস্য হোসেন মিয়া। ১০ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮৯ টাকায় আরেকটি প্রকল্পের চেয়ারম্যান ছিলেন ইউপি সদস্য বুলবুল মিয়া। পিআইসি চেয়ারম্যানরা কাজ করেছেন কিনা জানতে চাইলে উপজেলা চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল বলেন, প্রথমে তারা কাজ না করলেও পরে তারা বাঁধ নির্মাণে সম্পৃক্ত হয়েছেন। তবে ঠিকাদারদের ব্যাপারে অভিযোগ রয়েছে।
No comments