দখলে রাখা জলাশয় দেয়া হচ্ছে আল্লামা শফীকেই
চট্টগ্রামের হাটহাজারীতে রেলওয়ের মূল্যবান ৮১ শতক জলাশয় (পুকুর) দীর্ঘদিন ধরে দখলে নিয়ে ভোগ করছেন হেফাজতে ইসলামের আমীর ও হাটহাজারী দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার মহাপরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এবার এ জায়গা বরাদ্দ পেতে রেলওয়ের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তার কাছে আবেদন করেছেন তিনি। সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নেক নজরে তার নামে ওই জলাশয় বরাদ্দ দিতে ফাইল চালাচালিও শুরু হয়েছে। অবশ্য এর আগেই সেই পুকুরের পাড়ে উঠে গেছে দোকানপাট। লেগেছে সাইন বোর্ড। গত বছরের ২৮ মার্চ ওই জলাশয় তার নামে বরাদ্দের জন্য আবেদন করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের সঙ্গে হেফাজতে ইসলামের সম্পর্ক বেশ উষ্ণ। এ সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে এখন জলাশয়টি বরাদ্দ পাওয়ার চেষ্টা করছেন তিনি। অবশ্য মাদ্রাসা সূত্র বলছে, আল্লামা শফী নয়, জলাশয়টি দখলে রয়েছে দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসার। একই মাদ্রাসার দখলে রয়েছে আরও ১ দশমিক ৩১ একর কৃষিজমি। তবে রেলের এ জমিটিও বরাদ্দ পান আল্লামা শফী। ১৯৯২ সালে। ওই সূত্রের দাবি, মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে আল্লামা শফী আবেদনকারীমাত্র। রেলওয়ের কয়েক কোটি টাকার জমি এভাবে একজন ব্যক্তিকে বরাদ্দ দেয়াকে স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারছেন না অনেকেই। এটাকে হেফাজতের সঙ্গে সরকারের সাম্প্রতিক আপসকামিতার আরেকটি উদাহরণ বলছেন তারা। তারা সরকারের নীতিনির্ধারকদের উদ্দেশে বলেছেন, শাপলা চত্বরের ২০১৩ সালের ৫ মের ঘটনা ভুলে যাওয়া সরকারের জন্য ক্ষতি ডেকে আনবে। রেলের ভূমি বছরভিত্তিক বরাদ্দ দেয়া হলে বিষয়টিকে এস্টেট বিভাগ ‘লাইসেন্স ইস্যু’ বলে থাকে। শর্ত পূরণসাপেক্ষে প্রতি বছর তা নবায়ন করতে হয়।
১৯৯২ সালে বরাদ্দ দেয়া ভূমিটি চাষাবাদযোগ্য জমি বলে তা ‘কৃষি লাইসেন্স’ নিয়ে ভোগ করছেন আল্লামা শফী। জলাশয় বলে এবারের ভূমিটির জন্য তিনি আবেদন করেছেন ‘মৎস্য লাইসেন্স’। রেলওয়ের ভূ-সম্পত্তি বিভাগ সূত্র জানায়, গত বছরের ২৮ মার্চ হাটহাজারী উপজেলার আলীপুর মৌজায় অবস্থিত ৮১ শতক পুকুর/জলাশয়ের {বিএস খতিয়ান নম্বর ৪, দাগ নম্বর ১৪৫৫ ও ১৪৫৬ (আংশিক)} জন্য মৎস্য লাইসেন্স ইস্যুর আবেদন করেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম মাদ্রাসা, হাটহাজারীর প্যাডে তিনি এ আবেদন করেন। ‘হাটাহাজারী রেলস্টেশনের পূর্ব পাশে দশমিক ৮১ একর মৎস্য পুকুরের লাইসেন্সের আবেদন’-এ আল্লামা শফী লিখেছেন, ‘উক্ত জমি দীর্ঘদিন যাবৎ আমরা ভোগ দখলে আছি। রেলওয়ে নীতিমালার ৫, ৩ ও ৬ ধারা অনুযায়ী উক্ত মৎস্য পুকুরটি আমি লাইসেন্স পাওয়ার উপযোগী। সরকারি রাজস্ব আদায়ের স্বার্থে উক্ত পুকুর আমার নামে দেয়ার উপযোগী।’ রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি বরাবর করা এ আবেদনে আল্লামা শফী তার নামে এই মৎস্য পুকুরের লাইসেন্স দেয়ার বিষয়টি বিবেচনা করার অনুরোধ জানান। রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের প্রধান ভূ-সম্পত্তি কর্মকর্তা মো. জসিম উদ্দিন রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘হাটহাজারীতে ৮১ শতক পুকুর-জলাশয়ের জন্য গত বছরের ২৮ মার্চ আবেদন করেছিলেন আল্লামা শাহ আহমদ শফী। এই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই জায়গা তাকে দেয়া যায় কিনা বা তার নামে লাইসেন্স ইস্যু করা যায় কিনা সে বিষয়ে প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। আবেদনটি প্রক্রিয়াধীন আছে।’ এর বেশি কিছু বলতে চাননি তিনি। এর আগে ১৯৯২ সালের ১৯ অক্টোবর আল্লামা আহমদ শফীর নামে হাটহাজারী উপজেলার একই মৌজায় রেলওয়ের মালিকানাধীন ১ দশমিক ৩১ একর কৃষিজমির লাইসেন্স দেয়া হয়। মাত্র পাঁচ হাজার ৬১৮ টাকা দিয়ে বিপুল পরিমাণ এই জমি পান আল্লামা শফী।
প্রতি একরে বছরে তিন হাজার টাকা রাজস্ব দিয়ে এ জমির লাইসেন্স নবায়ন করে চলেছেন তিনি। এ জমির ‘কৃষি লাইসেন্স’ বাংলা ১৪২৪ সন (এ বছর) পর্যন্ত নবায়ন করা আছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, রেলওয়ে তাদের মালিকানাধীন পুকুর-জলাশয় ও চাষাবাদযোগ্য জমির লাইসেন্স দিয়ে থাকে। লাইসেন্স দেয়ার ক্ষেত্রে যেমন কিছু শর্ত মানতে হয় তেমনি লাইসেন্স ইস্যুর পরও বিভিন্ন শর্ত পালন করতে হয়। জমির শ্রেণী পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ যেমন নেই, তেমনি লাইসেন্স পাওয়ার আগে তা দখল করারও কোনো সুযোগ নেই। কিন্তু হেফাজত আমীরের নামে দেয়া এসব কৃষি জমির শ্রেণী পরিবর্তনের অভিযোগ রয়েছে। আবার লাইসেন্স পাওয়ার আগেই রেলওয়ের ৮১ শতকের বিশাল পুকুরপাড় দখল করে রেখেছেন তিনি। এর আগে ২০১২ সালে আলোচ্য ওই পুকুর-জলাশয়ের বিপরীতে লাইসেন্স পাওয়ার আবেদন করা হয়েছিল। কিন্তু তখন রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে সাফ জানিয়ে দেয়া হয়, এ জমি দেয়া যাবে না। ওই বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি রেলপথ মন্ত্রণালয়ের ভূমি শাখার সিনিয়র সহকারী সচিব আশরাফুজ্জামান স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বাংলাদেশ রেলওয়ের জমিজমা ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী আল্লামা শাহ আহমদ শফীর আবেদনটি বিবেচনা করার কোনো সুযোগ নেই। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নির্দেশে বিষয়টি আপনাকে অবহিত করা হল। তবে সম্প্রতিক যে আবেদন করা হয়েছে, সে আবেদন নিয়ে বেশ তোড়জোড় চলছে। সরেজমিন হাটহাজারী মাদ্রাসার অদূরে স্টেশনের উত্তর ও দক্ষিণ পাশে গিয়ে দেখা যায়, রেলওয়ের মালিকানাধীন বিশাল এ পুকুরটিতে সাইনবোর্ড ঝুলানো আছে। সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘মাননীয় যোগাযোগমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে এ পুকুর ও স্টেশন এলাকার উত্তর-দক্ষিণ ও পূর্ব-পশ্চিম পাশের ২.৬৪ একর (১৬০ কাঠা) কৃষি জমি ও পুকুর দখলদার মালিক দারুল উলুম মঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদ্রাসা।’
স্থানীয় সূত্রমতে, এ স্থানের বর্তমান বাজারমূল্য ৩০ কোটি টাকার ওপরে। হেফাজতে ইসলামের সাংগঠনিক সম্পাদক মাওলানা আজিজুল হক ইসলামাবাদী এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, ‘হুজুর যদি রেলওয়ের বা সরকারি জায়গা প্রাপ্তির জন্য কোনো আবেদন করে থাকেন তা মাদ্রাসার জন্য করেছেন। ব্যক্তিগত লাভের জন্য নয়।’ হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ ও উপজেলা চেয়ারম্যানের বক্তব্য : দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসার এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে বলেন, মাদ্রাসার মহাপরিচালক হিসেবে আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নামে রেলওয়ের জায়গা বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। এসব জায়গা ব্যক্তিগতভাবে বা পারিবারিকভাবে ব্যবহার করেন না তিনি। মাদ্রাসার কাজেই ব্যবহার হয়। এছাড়া নতুন করে ওই পুকুরটিও মাদ্রাসার নামে নেয়ার জন্য আবেদন করা হয়েছে। ওই কর্মকর্তা বলেন, এটি মাদ্রাসা যদি দখল না করত হয়তো অন্য কোনো সন্ত্রাসী বা প্রভাবশালীরা দখল করে নিত। একটি দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জন্য সরকারি জমি বরাদ্দ পেলে আপনাদের অসুবিধা কী- এমন প্রশ্ন ছুড়েন তিনি। হাটহাজারী উপজেলা চেয়ারম্যান মাহবুবুল আলম এ প্রসঙ্গে রোববার যুগান্তরকে বলেন, রেলের বিপুল পরিমাণ জমি চাষাবাদের নামে অনেক আগে লিজ বা বরাদ্দ নেয়া হলেও মূলত অধিকাংশ জমির শ্রেণী পরিবর্তন করেছে হাটহাজারী মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ। অথচ আইন অনুযায়ী এটি করার সুযোগ নেই তাদের। রেলের আরও একটি পুকুর বরাদ্দ পাওয়ার আগেই সাইনবোর্ড তুলে দিয়ে মাদ্রাসার নামে দখল করা হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বরাদ্দ পাওয়ার আগে এভাবে কোনো ব্যক্তি বা মাদ্রাসা সরকারি জায়গা দখল বা ভোগ কীভাবে করে, সে প্রশ্নও রাখেন তিনি।
No comments