মেঘলার আকাশ কালো মেঘে ঢাকা
সাভারে রানা প্লাজা ধসের দুঃসহ স্মৃতি এখনও যারা বয়ে বেড়াচ্ছেন তাদের একজন মেঘলা আকতার। বাড়ি রংপুরের মিঠাপুকুরে। রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে তার স্বামী আবদুল বাতেন মারা গেছেন। নিজেও পঙ্গু হয়েছিলেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর কিছুটা সুস্থ হলেও মেঘলার জীবন এখনও কালো মেঘে ঢাকা। স্বামী ও সংসার হারানো জীবন সংগ্রামে সুই-সুতাই এখন তার অবলম্বন। ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সাভার বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন নয়তলা ভবনটি ধসে পড়ে। এতে ভবনের পাঁচ পোশাক কারখানার শ্রমিকসহ সহস্রাধিক লোকের প্রাণহানি ঘটে। ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে মেঘলার স্বামী আবদুল বাতেন মারা যান। মেঘলাও পঙ্গুত্ব বরণ করেন। দীর্ঘ চিকিৎসার পর শারীরিকভাবে কিছুটা সুস্থ হলেও মানসিকভাবে এখনও বিপর্যস্ত মেঘলা। এর মধ্যেও স্বাভাবিক জীবনে ফেরার সংগ্রাম করে যাচ্ছেন। সে সময় সরকারি-বেসরকারি সংস্থার দেয়া টাকায় খড়ের ঘর পাকা করেছেন মেঘলা। বাড়িতে ছোট্ট একটি গরুর খামার করেছেন। লিজ নিয়ে জমি চাষাবাদ করছেন সংগ্রামী মেঘলা।
তবে পরে আর কেউ তার সঙ্গে যোগাযোগ করেনি। উপজেলা সদরের কৃষি ব্যাংক মোড় থেকে সোজা পূর্বদিকে পাকা রাস্তার শেষ মোড়ে হাতের ডান পাশের বাড়িটি মেঘলার বাবা চাঁন মিয়ার। তিনি ছোট মেয়ে মেঘলাকে ২০১২ সালের শেষদিকে বিয়ে দেন মাঝগ্রাম মাঠেরহাট গ্রামের রফিক উদ্দিনের ছেলে আবদুল বাতেনের সঙ্গে। বিয়ের তিন মাসের মাথায় মেঘলা-বাতেন দম্পতি পাড়ি জমান ঢাকার সাভার এলাকায়। রানা প্লাজায় একই ফ্লোরে কাজ নেন মেঘলা ও বাতেন। বছরখানেক সেখানে কাজ করার পর হঠাৎ রানা প্লাজা ধসে মেঘলার জীবনে নেমে আসে কালো মেঘ। মেঘলা জানান, ঘটনার দিন তিনি বেশ অসুস্থ ছিলেন। মাসের শেষদিকে অফিসে না গেলে বেতন পাবেন না- এ ভয়ে সকাল সাড়ে আটটার দিকে কাজে যান। সকাল পৌনে ৯টার দিকে স্বামীকে ওষুধ এনে দিতে বলেন মেঘলা। হাতের কাজ সেরে ক্যান্টিনে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসার কথা বলেন বাতেন। কিছুক্ষণ পর একটি শব্দ শুনতে পান তারা। সবাই ছোটাছুটি শুরু করে দেয়। নিভে যায় সব আলো। গার্মেন্টের ভেতরে শুধু চিৎকার-চেঁচামেচি। এতে অজ্ঞান হয়ে পড়েন মেঘলা। যখন জ্ঞান ফিরে আসে, তখন তিনি কোথায় আছেন বুঝতে পারছিলেন না। শুধু বুঝতে পারছিলেন তার দু’পায়ের উপর ভারি কী যেন পড়ে আছে। উদ্ধারকর্মীরা যখন ফ্লোরে টর্চলাইট ও অক্সিজেন দেন তখন মেঘলা দেখতে পান, তিনি পড়ে আছেন কয়েকটি লাশের উপর। আবারও অজ্ঞান হয়ে যান মেঘলা। ৩৪ ঘণ্টা পর মেঘলাকে উদ্ধার করা হয়। নিয়ে যাওয়া হয় এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালে। হাসপাতালে জ্ঞান ফেরার পর খোঁজ করতে থাকেন স্বামীর। স্বজনরা মেঘলাকে জানান,
বাতেন সুস্থ আছেন। গুরুতর অবস্থায় মেঘলাকে রংপুরে নিয়ে আসা হয় একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে। ওই অ্যাম্বুলেন্সে মেঘলার পাশে একটি কফিনে রাখা হয় স্বামীর লাশ। তবে সেটি যে বাতেনের তা জানানো হয়নি মেঘলাকে। বাড়িতে এসে কফিন খোলার পর দেখতে পান জীবনসঙ্গীর নিথর দেহ। আকাশ ভেঙে পড়ে মাথার উপর। জীবনের সব আলো যেন নিভে যায় মেঘলার। তখন থেকেই স্বামী হারানোর দুঃস্মৃতিগুলো এখনও হাতড়ে ফিরছেন মেঘলা। দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মেঘলা পঙ্গুত্ব বরণ করেন। টানা এক বছর চিকিৎসার পর ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে উঠেন মেঘলা। শুরু হয় নতুন করে জীবনযুদ্ধ। মেঘলা জানান, ‘অনুদানের টাকায় জমি লিজ নিয়ে চাষাবাদ করছি। সুই-সুতাই এখন আমার জীবন সংগ্রামের অবলম্বন। গ্রামে দর্জির কাজ করে যা আয় করি তা দিয়ে কোনোরকমে দিন পার করি। স্বামীর স্মৃতিগুলো আমাকে কাঁদায়।’ বাবা চাঁন মিয়া বলেন, শারীরিকভাবে মেঘলা কিছুটা সুস্থ হলেও মানসিকভাবে সে এখনও বিপর্যস্ত। বিয়ের কথা বলেছি, কিন্তু মেঘলা কিছুতেই রাজি হচ্ছে না। স্বামীর স্মৃতি নিয়েই বেঁচে থাকতে চায় সে। বাড়িতে বসে দর্জির কাজ করে যা আয় করে তা দিয়ে জীবন-জীবিকা চালিয়ে যাচ্ছে মেঘলা।
No comments