দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব নেই -সাক্ষাৎকারে : এমাজউদ্দীন আহমদ by এ কে এম জাকারিয়া
এমাজউদ্দীন আহমদ |
দুই
বিদেশি হত্যায় দেশে উদ্বেগজনক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। এর সঙ্গে জঙ্গিদের
যোগসূত্র থাকার বিষয়টি সামনে এসেছে। এই প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ড. এমাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হলো
প্রথম আলো: দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত জড়িত থাকতে পারে বলে সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তা জাতির জন্য লজ্জাজনক। আমরা নিজেরা যতই ঝগড়াঝাঁটি করি না কেন, এ ধরনের ঘটনার কোনো নজির আমাদের দেশে নেই। এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত করা আমাদের রাজনীতির বহু পুরোনো ব্লেম গেম সংস্কৃতিরই অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যা বলেছেন তা অপ্রত্যাশিত। বিষয়টি নিয়ে যেহেতু তদন্ত চলছে, তাই এর আগে এ নিয়ে কথা বলা উচিত হয়নি।
প্রথম আলো: বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: ঘটনাটি আমাদের দেশে বা জাতীয় পর্যায়ে হয়তো ঘটেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকেও আমাদের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। আইএসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার চলমান অভিযান সিরিয়া বিষয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন অবস্থার তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে ইরানের ভূমিকা বা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবস্থান—এসব বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়। আমি মনে করি, আমাদের দেশে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা পর্যালোচনার সময় এই আন্তর্জাতিক বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: আমাদের দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ বিস্তারের আশঙ্কা কতটুকু?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি মনে করি আমাদের দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ কখনো বিস্তার লাভ করতে পারেনি। এর অস্তিত্ব নেই, থাকার কারণও নেই। আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ পছন্দ করে না। এখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রকৃতি ও জনগণের মানসিকতা এর সহায়ক নয়। তবে কোনো কারণে বা কোনোভাবেই জঙ্গিবাদ যাতে এ দেশে বিস্তারের সুযোগ না পায়, সে জন্য জাতীয় স্বার্থে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো উচিত। আমি বলি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে না লাগিয়ে বরং বিদেশিদের নিরাপত্তার কাজে লাগান।
প্রথম আলো: কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা নিয়মিতই উদ্ঘাটন করছে। অনেক সহিংসতায় যে তারা জড়িত, সেটি তদন্তে বের হয়ে আসছে। জঙ্গিরা ধরাও পড়ছে। আর বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আমরা আবদুর রহমান বা বাংলা ভাইদের কর্মকাণ্ড দেখেছি।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ওটা ছিল, কিন্তু এখন আর অস্তিত্ব নেই। নানা পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে তারা নির্মূল হয়েছে। তবে এ ধরনের কিছু যাতে আর কখনো মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা জঙ্গিবাদ ঘৃণা করে।
প্রথম আলো: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোটের কারণেই কি তখন জঙ্গি তৎপরতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জামায়াতের সঙ্গে জোট শুধু বিএনপি করেনি। সব দলই কোনো না কোনো সময়ে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক রেখে চলেছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি—সবাই। আসলে আমাদের কারও হাতই পরিষ্কার নয়। সমস্যা হয়েছে যে কিছু একটা হলেই বিএনপি আর জামায়াতকে এক ব্রাকেটে বন্দী করে ফেলা হয়। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পরও আমরা দেখলাম কোনো তদন্ত ছাড়াই বিএনপি-জামায়াতকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
প্রথম আলো: কোনো দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্পর্ক রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: একটি সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের জন্য সহায়ক হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখুন, রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল বা এ ধরনের কিছু করার সুযোগ নেই। একটা মুক্ত পরিবেশ বজায় থাকলে, প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকলে অনেক কিছু লাঘব হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে দেশে একটা বদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ, এরপর বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ঢালাওভাবে। এগুলো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয় দূর করতে হলে সুস্থ, স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার।
প্রথম আলো: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপির ভুল বলে মনে করেন কি? বা এর পরে বিএনপি আন্দোলনের যে কৌশল নিয়েছিল?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি তো মনে করি ৫ জানুয়ারি এভাবে নির্বাচন করাটা সরকারের ভুল ছিল। নির্বাচনটি যাতে সবার অংশগ্রহণে হয়, সেই চেষ্টা তাদের থাকা উচিত ছিল। সরকারের উচিত ছিল এমন পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে সবাই নির্বাচনে অংশ নেয়। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে সেই নির্বাচনের কোনো গুরুত্ব থাকে না। এরপরও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনটি করতে হচ্ছে। এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু তা আর পরে দেখা গেল না; বরং সরকারি দলের জেদই স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখলাম। বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল, সেটা ব্যর্থ বা সার্থক হয়েছে কি না, সেটা জরুরি নয়। আসল কথা হচ্ছে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে আলাপ-আলোচনা করতে হবে, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এসব ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।
প্রথম আলো: বিএনপি কি জামায়াত ছাড়বে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে রয়েছে। সেখান থেকে দলটিকে বের করা হবে কোন অজুহাতে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতও এই অপরাধে অভিযুক্ত বলে বলা হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, তা হলে দল হিসেবে সরকার জামায়াতকে আগে নিষিদ্ধ করুক। এর আগে বা তেমন কিছু না করে জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দায়টা বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। সরকারই তো জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রথম আলো: আপনি দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বললেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিক সমাজ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা শুনতে পাই যে সরকারের সমালোচনা করেন এমন ব্যক্তিদের টিভি টক শোতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বয়স, সম্মান, ভয়-ভীতি- এসব নানা কিছু মিলিয়ে অনেকে কথা বলতে পারেন না। দিগন্ত টিভি ও আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো: নাগরিক সমাজ দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলেই কি এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আসলে আমাদের সব সামাজিক ও পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোই দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একক নাগরিক সমাজ বলে কিছু নেই। সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়া খুবই খারাপ লক্ষণ। দলমতধর্ম-নির্বিশেষে আমরা যখনই এক হতে পেরেছি তখনই আমরা কিছু অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের ভাষার অধিকার, আমাদের স্বাধীনতা—সবই আমরা এক হয়ে পেয়েছি। আর এখন আমরা বিভক্তির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।
প্রথম আলো: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন দেশের বাইরে আছেন। চিকিৎসা এবং পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সময় কাটানোই এই সফরের ঘোষিত লক্ষ্য বলে আমরা জানি। কিন্তু এর কি কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই? খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর বিএনপির রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখেন কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: দীর্ঘদিন পরে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ছেলে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সময় কাটাতে গেছেন। নানা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সময়গুলো পার করেছেন তিনি। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান মারা গেছেন। ব্যক্তিগত শান্তি ও স্বস্তির জন্য তাঁর এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সঙ্গে এই সময়টুকু কাটানো তাঁর জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। তবে এর নিশ্চয়ই রাজনৈতিক একটি দিকও রয়েছে। সেখানে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে। আমি ধারণা করি, এই সফরের মধ্য দিয়ে একধরনের উদ্দীপনা ও নতুন চিন্তাভাবনা নিয়েই খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন।
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রথম আলো: দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনায় বিএনপি ও জামায়াত জড়িত থাকতে পারে বলে সরকার ইঙ্গিত দিয়েছে। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, কোনো প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে এটা করা হয়েছে। আপনার মন্তব্য কী?
এমাজউদ্দীন আহমদ: যে দুটি ঘটনা ঘটেছে, তা জাতির জন্য লজ্জাজনক। আমরা নিজেরা যতই ঝগড়াঝাঁটি করি না কেন, এ ধরনের ঘটনার কোনো নজির আমাদের দেশে নেই। এর সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতকে জড়িত হিসেবে অভিযুক্ত করা আমাদের রাজনীতির বহু পুরোনো ব্লেম গেম সংস্কৃতিরই অংশ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে যা বলেছেন তা অপ্রত্যাশিত। বিষয়টি নিয়ে যেহেতু তদন্ত চলছে, তাই এর আগে এ নিয়ে কথা বলা উচিত হয়নি।
প্রথম আলো: বিদেশি নাগরিক খুনের ঘটনাটিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: ঘটনাটি আমাদের দেশে বা জাতীয় পর্যায়ে হয়তো ঘটেছে, কিন্তু আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটকেও আমাদের বিবেচনার মধ্যে রাখতে হবে। আইএসের বিরুদ্ধে রাশিয়ার চলমান অভিযান সিরিয়া বিষয়ে বিশ্ব রাজনীতিতে এক নতুন অবস্থার তৈরি করেছে। এ ব্যাপারে ইরানের ভূমিকা বা যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের অবস্থান—এসব বিবেচনায় নেওয়ার বিষয়। আমি মনে করি, আমাদের দেশে দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার ঘটনা পর্যালোচনার সময় এই আন্তর্জাতিক বাস্তবতাকেও বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
প্রথম আলো: আমাদের দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ বিস্তারের আশঙ্কা কতটুকু?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি মনে করি আমাদের দেশে ইসলামি জঙ্গিবাদ কখনো বিস্তার লাভ করতে পারেনি। এর অস্তিত্ব নেই, থাকার কারণও নেই। আমাদের দেশের মানুষ জঙ্গিবাদ পছন্দ করে না। এখানকার আবহাওয়া, পরিবেশ, প্রকৃতি ও জনগণের মানসিকতা এর সহায়ক নয়। তবে কোনো কারণে বা কোনোভাবেই জঙ্গিবাদ যাতে এ দেশে বিস্তারের সুযোগ না পায়, সে জন্য জাতীয় স্বার্থে গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো জরুরি। দুজন বিদেশি নাগরিক খুন হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতা আরও বাড়ানো উচিত। আমি বলি, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে না লাগিয়ে বরং বিদেশিদের নিরাপত্তার কাজে লাগান।
প্রথম আলো: কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দেশে জঙ্গিদের তৎপরতা নিয়মিতই উদ্ঘাটন করছে। অনেক সহিংসতায় যে তারা জড়িত, সেটি তদন্তে বের হয়ে আসছে। জঙ্গিরা ধরাও পড়ছে। আর বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে আমরা আবদুর রহমান বা বাংলা ভাইদের কর্মকাণ্ড দেখেছি।
এমাজউদ্দীন আহমদ: ওটা ছিল, কিন্তু এখন আর অস্তিত্ব নেই। নানা পদক্ষেপ ও ব্যবস্থা নেওয়ার ফলে তারা নির্মূল হয়েছে। তবে এ ধরনের কিছু যাতে আর কখনো মাথা তুলে না দাঁড়াতে পারে, সে ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। আমাদের দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তারা জঙ্গিবাদ ঘৃণা করে।
প্রথম আলো: বিএনপির সঙ্গে জামায়াতের জোটের কারণেই কি তখন জঙ্গি তৎপরতার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জামায়াতের সঙ্গে জোট শুধু বিএনপি করেনি। সব দলই কোনো না কোনো সময়ে জামায়াতের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক রেখে চলেছে। আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি—সবাই। আসলে আমাদের কারও হাতই পরিষ্কার নয়। সমস্যা হয়েছে যে কিছু একটা হলেই বিএনপি আর জামায়াতকে এক ব্রাকেটে বন্দী করে ফেলা হয়। দুই বিদেশি নাগরিক হত্যার পরও আমরা দেখলাম কোনো তদন্ত ছাড়াই বিএনপি-জামায়াতকে অভিযুক্ত করা হচ্ছে।
প্রথম আলো: কোনো দেশে জঙ্গিবাদের বিকাশ ও বিস্তারের সঙ্গে দেশটির রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির সম্পর্ক রয়েছে বলে ধরে নেওয়া হয়। বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আপনি কীভাবে দেখছেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: একটি সুস্থ ও স্বচ্ছ রাজনৈতিক পরিস্থিতি জঙ্গিবাদের জন্য সহায়ক হতে পারে না। কিন্তু আমাদের দেশের বর্তমান পরিস্থিতি দেখুন, রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশ, মিটিং-মিছিল বা এ ধরনের কিছু করার সুযোগ নেই। একটা মুক্ত পরিবেশ বজায় থাকলে, প্রতিবাদ করার সুযোগ থাকলে অনেক কিছু লাঘব হয়ে যায়। কিন্তু বর্তমানে দেশে একটা বদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। ৫ জানুয়ারি যে নির্বাচন হয়েছে তা প্রশ্নবিদ্ধ, এরপর বিরোধী রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে ঢালাওভাবে। এগুলো স্বাভাবিক পরিস্থিতি নয়। জঙ্গিবাদ বিস্তারের ভয় দূর করতে হলে সুস্থ, স্বাভাবিক ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিশ্চিত করা দরকার।
প্রথম আলো: ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিএনপির ভুল বলে মনে করেন কি? বা এর পরে বিএনপি আন্দোলনের যে কৌশল নিয়েছিল?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আমি তো মনে করি ৫ জানুয়ারি এভাবে নির্বাচন করাটা সরকারের ভুল ছিল। নির্বাচনটি যাতে সবার অংশগ্রহণে হয়, সেই চেষ্টা তাদের থাকা উচিত ছিল। সরকারের উচিত ছিল এমন পরিস্থিতি তৈরি করা, যাতে সবাই নির্বাচনে অংশ নেয়। অর্ধেকেরও বেশি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় প্রার্থীরা নির্বাচিত হলে সেই নির্বাচনের কোনো গুরুত্ব থাকে না। এরপরও প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন যে আইনগত বাধ্যবাধকতার কারণে নির্বাচনটি করতে হচ্ছে। এটা ধরে নেওয়া হয়েছিল যে এই বাধ্যবাধকতার নির্বাচনের পর আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। কিন্তু তা আর পরে দেখা গেল না; বরং সরকারি দলের জেদই স্পষ্ট হয়ে উঠতে দেখলাম। বিএনপি আন্দোলন শুরু করেছিল, সেটা ব্যর্থ বা সার্থক হয়েছে কি না, সেটা জরুরি নয়। আসল কথা হচ্ছে, গণতন্ত্রে বিশ্বাস করলে আলাপ-আলোচনা করতে হবে, সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন নিশ্চিত করতে হবে। এসব ছাড়া গণতন্ত্র হয় না।
প্রথম আলো: বিএনপি কি জামায়াত ছাড়বে?
এমাজউদ্দীন আহমদ: জামায়াত বিএনপির সঙ্গে ২০-দলীয় জোটে রয়েছে। সেখান থেকে দলটিকে বের করা হবে কোন অজুহাতে। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার-প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে সংগঠন হিসেবে জামায়াতও এই অপরাধে অভিযুক্ত বলে বলা হয়েছে। আমার কথা হচ্ছে, তা হলে দল হিসেবে সরকার জামায়াতকে আগে নিষিদ্ধ করুক। এর আগে বা তেমন কিছু না করে জামায়াতের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ার দায়টা বিএনপির ওপর চাপানোর চেষ্টা হচ্ছে। সরকারই তো জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারে।
প্রথম আলো: আপনি দেশের বর্তমান যে রাজনৈতিক পরিস্থিতির কথা বললেন, এমন পরিস্থিতিতে দেশের নাগরিক সমাজ কোনো ভূমিকা পালন করতে পারছে না কেন?
এমাজউদ্দীন আহমদ: বর্তমান পরিস্থিতিতে নাগরিক সমাজের ভূমিকা রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। আমরা শুনতে পাই যে সরকারের সমালোচনা করেন এমন ব্যক্তিদের টিভি টক শোতে অংশগ্রহণের ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। বয়স, সম্মান, ভয়-ভীতি- এসব নানা কিছু মিলিয়ে অনেকে কথা বলতে পারেন না। দিগন্ত টিভি ও আমার দেশ পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলো: নাগরিক সমাজ দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে পড়েছে বলেই কি এ ধরনের সমস্যায় পড়তে হচ্ছে না?
এমাজউদ্দীন আহমদ: আসলে আমাদের সব সামাজিক ও পেশাজীবীদের সংগঠনগুলোই দলীয়ভাবে বিভক্ত হয়ে গেছে। একক নাগরিক সমাজ বলে কিছু নেই। সমাজ এভাবে বিভক্ত হয়ে পড়া খুবই খারাপ লক্ষণ। দলমতধর্ম-নির্বিশেষে আমরা যখনই এক হতে পেরেছি তখনই আমরা কিছু অর্জন করতে পেরেছি। আমাদের ভাষার অধিকার, আমাদের স্বাধীনতা—সবই আমরা এক হয়ে পেয়েছি। আর এখন আমরা বিভক্তির মধ্যে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছি।
প্রথম আলো: বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন দেশের বাইরে আছেন। চিকিৎসা এবং পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সময় কাটানোই এই সফরের ঘোষিত লক্ষ্য বলে আমরা জানি। কিন্তু এর কি কোনো রাজনৈতিক তাৎপর্য নেই? খালেদা জিয়া দেশে ফেরার পর বিএনপির রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কোনো সম্ভাবনা দেখেন কি?
এমাজউদ্দীন আহমদ: দীর্ঘদিন পরে বেগম খালেদা জিয়া তাঁর ছেলে ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে সময় কাটাতে গেছেন। নানা কঠিন পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে সাম্প্রতিক সময়গুলো পার করেছেন তিনি। ছোট ছেলে আরাফাত রহমান মারা গেছেন। ব্যক্তিগত শান্তি ও স্বস্তির জন্য তাঁর এই সফর খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিবারের সঙ্গে এই সময়টুকু কাটানো তাঁর জন্য জরুরি হয়ে পড়েছিল। তবে এর নিশ্চয়ই রাজনৈতিক একটি দিকও রয়েছে। সেখানে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা হবে। আমি ধারণা করি, এই সফরের মধ্য দিয়ে একধরনের উদ্দীপনা ও নতুন চিন্তাভাবনা নিয়েই খালেদা জিয়া দেশে ফিরবেন।
এমাজউদ্দীন আহমদ: সাবেক উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
No comments