সতর্কবার্তা নিয়ে রহস্য by মাসুদ করিম ও সৈয়দ আতিক
বাংলাদেশে বিদেশীদের ওপর ‘নির্বিচারে হামলার হুমকি’ সম্পর্কিত যুক্তরাজ্যের সতর্কবার্তা নিয়ে রহস্য বাড়ছে। এবারের সতর্কবার্তা আমলে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাড সতর্কবার্তা আপডেট করেনি। নতুন হুমকির বিষয়ে বাংলাদেশকে কোনো তথ্য দেয়নি যুক্তরাজ্য। এ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করে কিছু বলা হচ্ছে না। দুই বিদেশী হত্যায় আইএসের দাবির যথার্থতা যাচাইয়ের পর যুক্তরাষ্ট্র এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য বাংলাদেশকে দেবে না বলে জানা গেছে।
মঙ্গল ও বুধবার প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন। প্রথম দিনের বৈঠক শেষে কূটনৈতিক কোরের ডিন ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা কৃতজ্ঞ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চমাত্রার সন্তোষ প্রকাশের একদিন পর শুক্রবার ব্রিটিশ ফরেন কমনওয়েলথ অফিসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার উচ্চ ঝুঁকি আছে। ওইদিনই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ছোট আকারে হামলার আশংকা আছে। একই দিনে একটি দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে দুই ধরনের তথ্য প্রচার করছে। দুই ধরনের তথ্য দেয়াসহ আরও বেশ কিছু কারণে রহস্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, যারা বিদেশী নাগরিক হত্যা করেছে এবং বিদেশ থেকে সতর্কবার্তা জারি করছে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকরা ভালো আছেন। তারা যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেন এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নতুন করে হুমকির বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো তথ্য দেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো ঝুঁকি নেই। এ দেশ নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা বেশিদূর আগাতে পারবে না। অতীতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতেও তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না।’
উচ্চ পর্যায়ের সরকারি সূত্র মতে, বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর উদ্দেশ্যে বিদেশী নাগরিক হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে সূত্রটি আশংকা প্রকাশ করেছেন। তার মতে, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর করা, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি চলমান নিরাপত্তা সংকটের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। দুটি খুনের ঘটনার পরই আইএস হত্যার দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’। ইতালির নাগরিক খুনের পর প্রথম এই সাইটে আইএস সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার একদিন পর তারা প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া টুইটারসহ যেসব সাইবার মাধ্যমে আইএস হত্যার দায় স্বীকার করেছে, সেগুলো সঠিক কিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যথার্থতা যাচাইয়ের ফল বাংলাদেশকে জানাবে না বলে জানা গেছে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস অবশ্য দুই বিদেশী হত্যার ঘটনায় আইএসের সম্পৃক্ততার ঘটনা যাচাই না করে উড়িয়ে দিতে চায় না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটা অসম্ভব নয় বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। তিনি বলেন, বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখানোর জন্য দুই বিদেশীকে হত্যা করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়াকে জঙ্গি হামলার হুমকির তথ্য দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। হুমকির ওই তথ্যে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে।’ ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়া সাবধান হয়ে যায়। এই সতর্কতার পর ঢাকার গুলশানে ইতালির এক নাগরিক খুন হন। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে তাদের নাগরিকদের চলাচলের ওপর বাংলাদেশে সতর্কবার্তা জারি করে। কিন্তু যুক্তরাজ্য শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় সতর্কবার্তা জারির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা কেউ সিকিউরিটি এলার্ট আপডেট করেনি। তারা আগের সতর্কবার্তা বহাল রেখেছে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মনে করছে সরকারের পূর্ব-ঘেঁষা নীতির কারণে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। সরকারের বড় বড় প্রকল্প পূর্বের কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পশ্চিমারা সরকারকে চাপে রাখতে চাচ্ছে। এ কারণে নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুমকির তথ্য বেশি প্রচার করছে। যুক্তরাজ্যের কাছ থেকেই এ সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সরকার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়ার পরও ক্রিকেট দলের সফর অনুষ্ঠিত হয়নি। তারপর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো শোয়ারের বাংলাদেশ সফরও স্থগিত করা হয়। অথচ সফর বাতিলের মতো তেমন পরিস্থিতি হয়নি। কারণ একই সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দল, জার্মানির উন্নয়ন মন্ত্রী নিরাপদে বাংলাদেশ সফর করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বুধবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে বাংলাদেশে হামলার হুমকি, তদন্তের ফলাফল এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী কড়া নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কূটনৈতিক এলাকায় নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সব ইউনিট সর্বত্র নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছে। আমরা কোনো ধরনের আশংকা দেখছি না। সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর শুক্রবার বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের লক্ষ্য করে আরও হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, দেশটিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। সম্প্রতি দু’জন বিদেশীকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, আইএসআইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ সফরকারীদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে ওয়েবসাইটে বলা হয়, বিশেষ করে যেসব অনুষ্ঠানে পশ্চিমা দেশের নাগরিকরা সমবেত হন, সেগুলোতে যোগদানের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। উল্লেখ্য, ঢাকায় একজন ইতালিয়ান এবং রংপুরে এক জাপানি নাগরিক অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীরা হত্যা করার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কানাডাসহ অনেক পশ্চিমা দেশই তাদের নাগরিকদের গতিবিধি সীমিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে এসব দেশের উদ্বেগ কাটেনি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, দুই বিদেশী হত্যার ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আইন-শৃংখলা বাহিনী সজাগ আছে। এই ঘটনার শিগগিরই নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করি। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক খুনের পর বাংলাদেশে আইন-শৃংখলা বাহিনী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছে। যেহেতু আর কোনো ঘটনা ঘটেনি তাতে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে যে আশংকার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে সে ধরনের কোনো আশংকা নেই।
তিনি বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী যেভাবে তৎপর হয়েছে, সেভাবে দুই বিদেশী খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। বিদেশীদের বোঝাতে হবে বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী দুটি ঘটনা সুরাহা করতে সক্ষম হয়েছে। তখন বিদেশীরা আশ্বস্ত হবেন, সতর্কতা থেকে তারা স্বাভাবিক হবেন।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, যেভাবে বাইরে থেকে আশংকা ব্যক্ত করা হচ্ছে আমরা সে ধরনের আর কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর যে সক্ষমতা আছে তা দিয়ে যে কোনো নাশকতাই মোকাবেলা করা সম্ভব। কাজেই হতাশ বা আতংকিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী পেশাদারিত্বের সঙ্গে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। যে কোনো নাশকতা বা বিশৃংখলা মোকাবেলায় আইন-শৃংখলা সতর্ক অবস্থানে আছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, যা ঘটছে তা সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র। অতীতেও আইন-শৃংখলা বাহিনী সাংবিধানিকভাবে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে। বর্তমান সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র রুখতে আইন-শৃংখলা বাহিনী, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারিও বাড়িয়েছে। পাশাপাশি আমাদের দেশে যেসব বিদেশী নাগরিক আছে, তারা যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে সে ব্যাপারে আইন-শৃংখলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, যে আশংকার কথা ব্যক্ত করা হচ্ছে আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো আশংকা নেই।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো ধরনের থ্রেট আমরা দেখছি না। দুই বিদেশী নাগরিক খুনের পর বোঝা গেছে, এটা সরকারবিরোধীদের ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি ও অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছেÑ তা প্রতিরোধে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে।
তিনি বলেন, যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে আসলে সে ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই। তবে আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে।
মঙ্গল ও বুধবার প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকরা সরকারের সঙ্গে ধারাবাহিক বৈঠক করেন। প্রথম দিনের বৈঠক শেষে কূটনৈতিক কোরের ডিন ও ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন সাংবাদিকদের বলেন, সরকারের গৃহীত নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তারা কৃতজ্ঞ। নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়ে উচ্চমাত্রার সন্তোষ প্রকাশের একদিন পর শুক্রবার ব্রিটিশ ফরেন কমনওয়েলথ অফিসের ওয়েবসাইটে বলা হয়, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার উচ্চ ঝুঁকি আছে। ওইদিনই ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশে ছোট আকারে হামলার আশংকা আছে। একই দিনে একটি দেশ বাংলাদেশ সম্পর্কে দুই ধরনের তথ্য প্রচার করছে। দুই ধরনের তথ্য দেয়াসহ আরও বেশ কিছু কারণে রহস্য তৈরি হয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল শনিবার যুগান্তরকে বলেন, যারা বিদেশী নাগরিক হত্যা করেছে এবং বিদেশ থেকে সতর্কবার্তা জারি করছে তারা বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে বিদেশী নাগরিকরা ভালো আছেন। তারা যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাচল করতে পারেন এজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। নতুন করে হুমকির বিষয়ে যুক্তরাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে তাদের কোনো তথ্য দেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন। মন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশে কোনো ঝুঁকি নেই। এ দেশ নিয়ে যারা ষড়যন্ত্র করছে তারা বেশিদূর আগাতে পারবে না। অতীতেও তারা ব্যর্থ হয়েছে। ভবিষ্যতেও তারা সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে পারবে না।’
উচ্চ পর্যায়ের সরকারি সূত্র মতে, বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্র বানানোর উদ্দেশ্যে বিদেশী নাগরিক হত্যা করা হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে বলে সূত্রটি আশংকা প্রকাশ করেছেন। তার মতে, কূটনীতিক ও নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের ধারণা, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ভঙ্গুর রাজনৈতিক পরিস্থিতি, যুদ্ধাপরাধের বিচার কার্যকর করা, ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট ইস্যু, আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি চলমান নিরাপত্তা সংকটের সঙ্গে এর সম্পর্ক থাকতে পারে। দুটি খুনের ঘটনার পরই আইএস হত্যার দায় স্বীকার করে বলে খবর দেয় জঙ্গি তৎপরতা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা ‘সাইট ইন্টিলিজেন্স গ্রুপ’। ইতালির নাগরিক খুনের পর প্রথম এই সাইটে আইএস সংক্রান্ত তথ্য দেয়ার একদিন পর তারা প্রত্যাহার করে নেয়। এছাড়া টুইটারসহ যেসব সাইবার মাধ্যমে আইএস হত্যার দায় স্বীকার করেছে, সেগুলো সঠিক কিনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই যথার্থতা যাচাইয়ের ফল বাংলাদেশকে জানাবে না বলে জানা গেছে।
ঢাকায় মার্কিন দূতাবাস অবশ্য দুই বিদেশী হত্যার ঘটনায় আইএসের সম্পৃক্ততার ঘটনা যাচাই না করে উড়িয়ে দিতে চায় না। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৬ কোটি জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান ঘটা অসম্ভব নয় বলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মনে করে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেন, দেশে আইএসের অস্তিত্ব নেই। তিনি বলেন, বিদেশীদের কাছে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল দেখানোর জন্য দুই বিদেশীকে হত্যা করা হয়েছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, অস্ট্রেলিয়াকে জঙ্গি হামলার হুমকির তথ্য দিয়েছিল যুক্তরাজ্য। হুমকির ওই তথ্যে বলা হয়েছিল, ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসীগোষ্ঠী অস্ট্রেলিয়া ও পশ্চিমা স্বার্থের ওপর হামলার পরিকল্পনা করছে।’ ২৫ সেপ্টেম্বরের আগে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়ার পরই অস্ট্রেলিয়া সাবধান হয়ে যায়। এই সতর্কতার পর ঢাকার গুলশানে ইতালির এক নাগরিক খুন হন। এরপরই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে তাদের নাগরিকদের চলাচলের ওপর বাংলাদেশে সতর্কবার্তা জারি করে। কিন্তু যুক্তরাজ্য শুক্রবার দ্বিতীয় দফায় সতর্কবার্তা জারির পর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া এবং কানাডা কেউ সিকিউরিটি এলার্ট আপডেট করেনি। তারা আগের সতর্কবার্তা বহাল রেখেছে।
একাধিক কূটনৈতিক সূত্র মনে করছে সরকারের পূর্ব-ঘেঁষা নীতির কারণে পশ্চিমা কয়েকটি দেশ অতিরিক্ত প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। সরকারের বড় বড় প্রকল্প পূর্বের কিংবা প্রতিবেশী দেশগুলোর নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে পশ্চিমারা সরকারকে চাপে রাখতে চাচ্ছে। এ কারণে নিরাপত্তা সংক্রান্ত হুমকির তথ্য বেশি প্রচার করছে। যুক্তরাজ্যের কাছ থেকেই এ সংক্রান্ত তথ্য পেয়েছে অস্ট্রেলিয়া। সরকার পর্যাপ্ত নিরাপত্তা দেয়ার নিশ্চয়তা দেয়ার পরও ক্রিকেট দলের সফর অনুষ্ঠিত হয়নি। তারপর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হুগো শোয়ারের বাংলাদেশ সফরও স্থগিত করা হয়। অথচ সফর বাতিলের মতো তেমন পরিস্থিতি হয়নি। কারণ একই সময়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দল, জার্মানির উন্নয়ন মন্ত্রী নিরাপদে বাংলাদেশ সফর করেন। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় বুধবার অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় বৈঠকে বাংলাদেশে হামলার হুমকি, তদন্তের ফলাফল এবং এ সংক্রান্ত অন্যান্য ইস্যুতে আলোচনা হয়েছে বলে জানা গেছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমাদের দেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী কড়া নিরাপত্তা জোরদার করেছে। কূটনৈতিক এলাকায় নেয়া হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। আইন-শৃংখলা বাহিনীর সব ইউনিট সর্বত্র নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছে। আমরা কোনো ধরনের আশংকা দেখছি না। সবকিছু স্বাভাবিক আছে।
ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতর শুক্রবার বাংলাদেশে পশ্চিমা দেশের নাগরিকদের লক্ষ্য করে আরও হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করে দিয়েছে। ব্রিটিশ ফরেন অ্যান্ড কমনওয়েলথ অফিসের ওয়েবসাইটে বাংলাদেশ সম্পর্কে সর্বশেষ সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, দেশটিতে সন্ত্রাসবাদী হামলার উচ্চ ঝুঁকি রয়েছে। সম্প্রতি দু’জন বিদেশীকে হত্যার ঘটনা উল্লেখ করে এতে বলা হয়, আইএসআইএস এই হামলার দায়িত্ব স্বীকার করেছে। বাংলাদেশ সফরকারীদের বিশেষ সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ দিয়ে ওয়েবসাইটে বলা হয়, বিশেষ করে যেসব অনুষ্ঠানে পশ্চিমা দেশের নাগরিকরা সমবেত হন, সেগুলোতে যোগদানের সময় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। উল্লেখ্য, ঢাকায় একজন ইতালিয়ান এবং রংপুরে এক জাপানি নাগরিক অজ্ঞাতনামা বন্দুকধারীরা হত্যা করার পর বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে আন্তর্জাতিকভাবে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং কানাডাসহ অনেক পশ্চিমা দেশই তাদের নাগরিকদের গতিবিধি সীমিত রাখার পরামর্শ দিচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার কয়েক দফায় কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করে নিরাপত্তার ব্যাপারে আশ্বাস দিয়েছে। কিন্তু তারপরও নিরাপত্তা নিয়ে এসব দেশের উদ্বেগ কাটেনি।
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম শনিবার যুগান্তরকে বলেন, দুই বিদেশী হত্যার ব্যাপারে তদন্ত হচ্ছে। আইন-শৃংখলা বাহিনী সজাগ আছে। এই ঘটনার শিগগিরই নিষ্পত্তি হবে বলে আশা করি। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে আর বেশি কিছু বলতে রাজি হননি তিনি।
নিরাপত্তা বিশ্লেষক সাবেক এয়ার কমোডর ইশফাক ইলাহী চৌধুরী যুগান্তরকে বলেন, দুই বিদেশী নাগরিক খুনের পর বাংলাদেশে আইন-শৃংখলা বাহিনী নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়িয়েছে। যেহেতু আর কোনো ঘটনা ঘটেনি তাতে মনে হচ্ছে আন্তর্জাতিকভাবে যে আশংকার কথা ব্যক্ত করা হয়েছে সে ধরনের কোনো আশংকা নেই।
তিনি বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী যেভাবে তৎপর হয়েছে, সেভাবে দুই বিদেশী খুনের রহস্য উদ্ঘাটন করতে হবে। বিদেশীদের বোঝাতে হবে বাংলাদেশের আইন-শৃংখলা বাহিনী দুটি ঘটনা সুরাহা করতে সক্ষম হয়েছে। তখন বিদেশীরা আশ্বস্ত হবেন, সতর্কতা থেকে তারা স্বাভাবিক হবেন।
ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, যেভাবে বাইরে থেকে আশংকা ব্যক্ত করা হচ্ছে আমরা সে ধরনের আর কোনো লক্ষণ দেখছি না। আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনীর যে সক্ষমতা আছে তা দিয়ে যে কোনো নাশকতাই মোকাবেলা করা সম্ভব। কাজেই হতাশ বা আতংকিত হওয়ার মতো কিছু দেখছি না।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মুখপাত্র যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, আইন-শৃংখলা বাহিনী পেশাদারিত্বের সঙ্গে সর্বশক্তি নিয়োগ করেছে। যে কোনো নাশকতা বা বিশৃংখলা মোকাবেলায় আইন-শৃংখলা সতর্ক অবস্থানে আছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তা মনিরুল ইসলাম বলেন, যা ঘটছে তা সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্র। অতীতেও আইন-শৃংখলা বাহিনী সাংবিধানিকভাবে এবং পেশাদারিত্বের সঙ্গে সব ষড়যন্ত্র মোকাবেলা করেছে। বর্তমান সরকার বিরোধী ষড়যন্ত্র রুখতে আইন-শৃংখলা বাহিনী, গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর পাশাপাশি নজরদারিও বাড়িয়েছে। পাশাপাশি আমাদের দেশে যেসব বিদেশী নাগরিক আছে, তারা যাতে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে সে ব্যাপারে আইন-শৃংখলা বাহিনী যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। তিনি বলেন, যে আশংকার কথা ব্যক্ত করা হচ্ছে আমাদের দেশে এ ধরনের কোনো আশংকা নেই।
র্যাবের গোয়েন্দা বিভাগের প্রধান লে. কর্নেল আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, কোনো ধরনের থ্রেট আমরা দেখছি না। দুই বিদেশী নাগরিক খুনের পর বোঝা গেছে, এটা সরকারবিরোধীদের ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, আমাদের গোয়েন্দা নজরদারি ও অনুসন্ধান অব্যাহত আছে। অতীতেও ষড়যন্ত্র হয়েছে, বর্তমানেও হচ্ছেÑ তা প্রতিরোধে আইন-শৃংখলা বাহিনীর পূর্ণ সক্ষমতা রয়েছে।
তিনি বলেন, যে ঝুঁকির কথা বলা হচ্ছে আসলে সে ধরনের কোনো ঝুঁকি নেই। তবে আমাদের আইন-শৃংখলা বাহিনী সতর্ক রয়েছে।
No comments