হাসিনা সরকারকে গাছে তুলে দিয়ে মই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা by আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী
সন্ত্রাসের
সমস্যা এখন একটি বিশ্ব সমস্যা। সন্ত্রাস নেই এমন একটি দেশ খুঁজে পাওয়া
যাবে না। এমন যে কমিউনিস্ট চীন এবং রাশিয়া তাও এখন সন্ত্রাসকবলিত। এ
সন্ত্রাস নানা ধরনের। তার সঙ্গে আবার যুক্ত হয়েছে তথাকথিত ইসলামী জঙ্গি
সমস্যা। এ সমস্যা উপমহাদেশেও ছায়া ফেলেছে। তবে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার
অনেকটা সাফল্যের সঙ্গেই এ সমস্যার মোকাবেলা করছে। পাকিস্তান ও
আফগানিস্তানের মতো তালেবান বা আল কায়দা বাংলাদেশে যুদ্ধ শুরু করতে পারেনি।
কিংবা আইএস বাংলাদেশে ঘাঁটি গাড়তে পারেনি। তবে জামায়াত বা অন্য কোনো উগ্র
মৌলবাদী দল আইএসের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে পারে কিংবা তাদের হয়ে বাংলাদেশে কাজ
করতে পারে। কিন্তু দেশের গোয়েন্দারা অনেক খোঁজখবর নিয়েও আইএসের ঘাঁটির
কোনো সন্ধান পায়নি।
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে দু’জন বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এ ঘটনা এমন কোনো বড় ঘটনা নয় যে তাতে প্রমাণ হয়ে গেছে, বাংলাদেশে আইএসের আবির্ভাব ঘটেছে কিংবা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা তিলকে তাল করে দেখাচ্ছে। এ দুটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশে ক্রিকেট টিম পাঠানো বাতিল করাসহ বাংলাদেশে বসবাসকারী তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ তাদের মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। আমেরিকা তো এ বিদেশী হত্যার হোতা কারা তা নির্ধারিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে কল্পিত আইএস-সন্ত্রাস দমনের জন্য সরকারকে সাহায্য দানের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাবের অর্থ জঙ্গি দমনে সাহায্যদানের নামে বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি কি?
একজন ইতালীয় এবং একজন জাপানি নাগরিক দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, এ হত্যাকারীদের অবিলম্বে ধরা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে। সামরিক ও অসামরিক গোয়েন্দারা সঙ্গে সঙ্গে তদন্তে নেমেছে এবং তদন্ত কার্যে যে অগ্রগতি ঘটেনি তাও নয়। ঢাকার কূটনীতিকপাড়াতেও বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আরও দু’চারদিন না গেলে বোঝা যাবে না, এ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ কতটা সাফল্য অর্জন করবে।
ওই বিদেশী হত্যার পরপরই প্রাথমিকভাবে সন্দেহ পতিত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের দিকে। এ সন্দেহ দেখা দেয়ার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কারও দণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের তৎপর হতে দেখা যায়। এবার যে দু’জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিল আদালত বহাল রেখেছেন তারা দু’জনেই বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা। তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকায় জামায়াত-শিবির তার হিংসাÍক প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা অনেকেই ধরে রেখেছিলেন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।
তবে বিএনপি-জামায়াতের আগের সন্ত্রাসের সঙ্গে এ সন্ত্রাসের পার্থক্য এই যে, আগে দেশের নিরীহ মানুষ এ সন্ত্রাসের শিকার হতো, এবার হয়েছেন দু’জন বিদেশী নাগরিক। তার কারণ হয়তো এই যে, দেশের মানুষ হত্যা করে বিদেশের বিশেষ করে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর টনক নড়ানো যায়নি। বিদেশী হত্যা দ্বারা তাদের টনক নড়ানো যাবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে হাসিনা সরকারকে চাপে রাখার জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এক রকম তৈরি হয়েই বসে আছে, এখন এটা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে।
অথচ এ পশ্চিমা দেশগুলো দু’দিন আগেও দেখেছে বাংলাদেশে নির্বাচন বানচাল এবং সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে যে পেট্রলবোমা সন্ত্রাস শুরু হয়েছিল, হাসিনা সরকার তা সাফল্যের সঙ্গে দমন করেছে। তার পাশাপাশি উগ্র মৌলবাদী তৎপরতা বন্ধ করা এবং তাদের গ্রেফতার অভিযানেও সফল হয়েছে এই সরকার। প্রশংসা করেছেন পশ্চিমা দেশগুলোই, বিশেষ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা। তারা জানেন, এই বিদেশী হত্যার সন্ত্রাসও বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব উদ্যোগেই (অবশ্যই পশ্চিমা দেশগুলোর নৈতিক সমর্থনসহ) বন্ধ করার কাজে সক্ষমতা দেখাতে পারবে।
তাহলে মাত্র দুটি হত্যাকাণ্ডের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোজুড়ে এত হইচই কেন? সৌদি আরবে সরকারি অব্যবস্থাপনায় হাজারের ওপর বিদেশী হাজী পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া নিয়ে যত হইচই করা হয়নি, তার চেয়ে বেশি হইচই করা হচ্ছে বাংলাদেশে দু’জন বিদেশীকে হত্যা করা নিয়ে। এটা কি কোনো পরিকল্পিত হইচই? এর চেয়ে বড় এবং বেশি হত্যাকাণ্ড কোনো পশ্চিমা দেশে ঘটলেও তা নিয়ে এত হইচই করা হয় না। অবশ্যই বাংলাদেশে বিদেশী হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত এবং বাংলাদেশ সরকার তা করেছেও। পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাস দমনে আন্তরিক হলে তাদের উচিত বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ভীতি না ছড়িয়ে এ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে দেশের সরকারকে নৈতিক সাহায্য ও সমর্থন দেয়া।
সে কাজটি তারা করছেন না। বরং বাংলাদেশে বিদেশীরা নিরাপদ নয় এই ধুয়া তুলে দেশটিকে আপাতত হলেও সামাজিক ও সমষ্টিগত বয়কটের ব্যবস্থা করে বর্তমান সরকারকে বিব্রত করছে এবং সম্ভবত কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমেরিকা তো দাবি করে বসেছে, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে বাংলাদেশে বিদেশীদের ওপর হামলা হতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। ওয়াশিংটনের গোয়েন্দারা যদি এই হামলার আগাম খবর পেয়ে থাকেন, তাহলে এই হামলাকারী কারা সে খবরও কি তারা পাননি? তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে ওয়াশিংটন তখনই সতর্ক করেনি কেন? নাকি তাদের উদ্দেশ্য, নিউইয়র্কের নাইন-ইলেভেনের হামলা চালানোর সুযোগ দিয়ে তারপর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার নামে ইরাক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করার মতো উপমহাদেশেও কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা?
সত্য অপ্রিয়। তবু আমার এই অনুমানটির কথা না লিখে পারলাম না। বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিদেশীদের ওপর হামলার ব্যাপারে তারা আগে কারও কাছ থেকে হুশিয়ারি পাননি। কিন্তু এটা যে আইএসের দ্বারা সংঘটিত হয়নি, সেটা তারা জানেন। বাংলাদেশে আইএসের কোনো ঘাঁটি নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আইএস এই দুই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল কেন? এখন জানা গেছে, আইএসের এই দায়িত্ব স্বীকারের প্রচারটিও সঠিক নয়। এক ইহুদি মহিলা আইএসের নাম ভাঙিয়ে এই দায় স্বীকারের বিবৃতিটি ছড়িয়েছেন। সুতরাং এখন এই প্রশ্নও তোলা যায় এই ইহুদি মহিলা কি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং সেই সূত্রে আমেরিকায় সিআইএ’র সঙ্গেও যুক্ত?
দু’জন বিদেশীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে আইএসের অস্তিত্ব আবিষ্কার (কোনো প্রকার তদন্ত হওয়ার আগেই) এবং তাদের দমনের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা দানে এগিয়ে আসার মার্কিন প্রস্তাব তাৎপর্যপূর্ণ। এভাবেই তারা সন্ত্রাস দমন ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সাহায্যদানের নামে কোনো দেশে ঢোকে এবং শেষ পর্যন্ত তা তাদের সামরিক উপস্থিতিতে পরিণত হয় এবং শান্তির বদলে অশান্তির আগুন জ্বলে দেশটিতে। দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন তাঁবেদার সরকার। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া তার প্রমাণ। সিরিয়ায় আইএস দমনের নামে আমেরিকা ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপ সারা বিশ্বে ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
অতীতে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণকার্যের নামে বাংলাদেশে ঢুকে আমেরিকা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন সামরিক ও ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ‘মিলিটারি জোন’ প্রতিষ্ঠার ছক এঁকেছিল বলে তখনই অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে, এ সময় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। এ বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার কার্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা দেখাতে পারছে না এই অজুহাতে সরকারের কোনো পূর্ব অনুমতি না নিয়েই মার্কিন মেরিন সেনা দল বাংলাদেশে ঢোকে এবং ত্রাণকার্যের দায়িত্ব সরাসরি নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ত্রাণকার্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সেনা দলকে তাদের খবরদারি মেনে নিতে হয়।
তারপর মিডিয়ায় এ নিয়ে কম লেখালেখিও হয়নি। অভিযোগ উঠেছিল, মার্কিন সেনারা ত্রাণকার্য চালিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের গোপন সামরিক উদ্দেশ্যও পূরণ করে গেছে। আর ত্রাণকার্যে আমাদের সেনা টিম দক্ষ ছিল না, এ অভিযোগটিও ছিল অসত্য। উদ্দেশ্যমূলক বিদেশী প্রচারণা। ত্রাণকার্যে বা দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সেনা টিম যে মোটেই অদক্ষ নয়, তার প্রমাণ মিলেছে হাসিনা সরকারের সময়ে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ অভিযান পরিচালনা এবং রানা প্লাজায় সংঘটিত ভয়াবহ ভবন ধসের সময় উদ্ধারকার্য এবং নিহতদের লাশ খোঁজার সময়। বাংলাদেশের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের বিস্ময়কর দক্ষতার তখন উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন ব্রিটেনসহ বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও।
ঢাকা এবং রংপুরে দু’জন বিদেশী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন এবং হত্যাকারীদের শনাক্তকরণ দ্বারা এই সন্ত্রাস দমনেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব উদ্যোগেই সফল হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর সফল না হলে বিদেশীরা সাহায্যদানের উছিলায় এসে পানি ঘোলা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পরতো মার্কিন এফবিআই বাংলাদেশে ছুটে এসেছিল তদন্ত চালানোর জন্য। তাতে রহস্যের কোনো কিনারা হয়েছে কি? বর্তমান বিদেশী হত্যাকাণ্ডেও সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকাকে বাংলাদেশে নাক গলানোর সুযোগ দেয়া বিপজ্জনক হতে পারে। তাতে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা হবে। সন্ত্রাস তখন পাকিস্তানি ও আফগানিস্তানের মতো ভয়াবহ অবস্থায় চলে যেতে পারে। উপমহাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের ধ্বংসযজ্ঞের সম্প্রসারণ ঘটতে পারে।
বর্তমানে হাসিনা সরকার পশ্চিমা শক্তিগুলোর কঠোর চাপের মধ্যে আছে। শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘে ডেকে নিয়ে নানারকম স্তুতি ও খেতাবের উচ্চ গাছের মাথায় তুলে দিয়ে এখন মই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে মনে হয়। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও মনোবলের ওপরই নির্ভর করে এবারের ক্রাইসিসও তিনি দক্ষতা ও ধৈর্যের সঙ্গে পার হতে পারবেন কিনা।
লন্ডন ১১ অক্টোবর, রবিবার, ২০১৫
সম্প্রতি বাংলাদেশে যে দু’জন বিদেশী নাগরিককে হত্যা করা হয়েছে, তা অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও এ ঘটনা এমন কোনো বড় ঘটনা নয় যে তাতে প্রমাণ হয়ে গেছে, বাংলাদেশে আইএসের আবির্ভাব ঘটেছে কিংবা সন্ত্রাস নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। কিন্তু পশ্চিমা দেশগুলো, বিশেষ করে আমেরিকা তিলকে তাল করে দেখাচ্ছে। এ দুটি হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কোনো কোনো দেশ বাংলাদেশে ক্রিকেট টিম পাঠানো বাতিল করাসহ বাংলাদেশে বসবাসকারী তাদের নাগরিকদের সতর্ক করে দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ তাদের মন্ত্রীর বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছে। আমেরিকা তো এ বিদেশী হত্যার হোতা কারা তা নির্ধারিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশে কল্পিত আইএস-সন্ত্রাস দমনের জন্য সরকারকে সাহায্য দানের প্রস্তাব দিয়েছে। এ প্রস্তাবের অর্থ জঙ্গি দমনে সাহায্যদানের নামে বাংলাদেশের মাটিতে আমেরিকার সামরিক উপস্থিতি কি?
একজন ইতালীয় এবং একজন জাপানি নাগরিক দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন, এ হত্যাকারীদের অবিলম্বে ধরা হবে এবং শাস্তি দেয়া হবে। সামরিক ও অসামরিক গোয়েন্দারা সঙ্গে সঙ্গে তদন্তে নেমেছে এবং তদন্ত কার্যে যে অগ্রগতি ঘটেনি তাও নয়। ঢাকার কূটনীতিকপাড়াতেও বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আরও দু’চারদিন না গেলে বোঝা যাবে না, এ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে পুলিশ কতটা সাফল্য অর্জন করবে।
ওই বিদেশী হত্যার পরপরই প্রাথমিকভাবে সন্দেহ পতিত হয়েছে বিএনপি-জামায়াতের দিকে। এ সন্দেহ দেখা দেয়ার সঙ্গত কারণও রয়েছে। ’৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের কারও দণ্ডাদেশ ঘোষিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের সন্ত্রাসীদের তৎপর হতে দেখা যায়। এবার যে দু’জন যুদ্ধাপরাধীর মৃত্যুদণ্ডাদেশ আপিল আদালত বহাল রেখেছেন তারা দু’জনেই বিএনপি ও জামায়াতের প্রভাবশালী নেতা। তাদের মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল থাকায় জামায়াত-শিবির তার হিংসাÍক প্রতিক্রিয়া দেখাবে এটা অনেকেই ধরে রেখেছিলেন। বাস্তবে ঘটেছেও তাই।
তবে বিএনপি-জামায়াতের আগের সন্ত্রাসের সঙ্গে এ সন্ত্রাসের পার্থক্য এই যে, আগে দেশের নিরীহ মানুষ এ সন্ত্রাসের শিকার হতো, এবার হয়েছেন দু’জন বিদেশী নাগরিক। তার কারণ হয়তো এই যে, দেশের মানুষ হত্যা করে বিদেশের বিশেষ করে প্রভাবশালী পশ্চিমা দেশগুলোর টনক নড়ানো যায়নি। বিদেশী হত্যা দ্বারা তাদের টনক নড়ানো যাবে। বাংলাদেশের ব্যাপারে হাসিনা সরকারকে চাপে রাখার জন্য আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলো এক রকম তৈরি হয়েই বসে আছে, এখন এটা তাদের উদ্দেশ্য পূরণের সুযোগ এনে দিয়েছে।
অথচ এ পশ্চিমা দেশগুলো দু’দিন আগেও দেখেছে বাংলাদেশে নির্বাচন বানচাল এবং সরকারের পতন ঘটানোর লক্ষ্যে বিএনপি-জামায়াতের দ্বারা পরিকল্পিতভাবে যে পেট্রলবোমা সন্ত্রাস শুরু হয়েছিল, হাসিনা সরকার তা সাফল্যের সঙ্গে দমন করেছে। তার পাশাপাশি উগ্র মৌলবাদী তৎপরতা বন্ধ করা এবং তাদের গ্রেফতার অভিযানেও সফল হয়েছে এই সরকার। প্রশংসা করেছেন পশ্চিমা দেশগুলোই, বিশেষ করে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ওবামা। তারা জানেন, এই বিদেশী হত্যার সন্ত্রাসও বাংলাদেশ সরকার নিজস্ব উদ্যোগেই (অবশ্যই পশ্চিমা দেশগুলোর নৈতিক সমর্থনসহ) বন্ধ করার কাজে সক্ষমতা দেখাতে পারবে।
তাহলে মাত্র দুটি হত্যাকাণ্ডের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোজুড়ে এত হইচই কেন? সৌদি আরবে সরকারি অব্যবস্থাপনায় হাজারের ওপর বিদেশী হাজী পদপিষ্ট হয়ে মারা যাওয়া নিয়ে যত হইচই করা হয়নি, তার চেয়ে বেশি হইচই করা হচ্ছে বাংলাদেশে দু’জন বিদেশীকে হত্যা করা নিয়ে। এটা কি কোনো পরিকল্পিত হইচই? এর চেয়ে বড় এবং বেশি হত্যাকাণ্ড কোনো পশ্চিমা দেশে ঘটলেও তা নিয়ে এত হইচই করা হয় না। অবশ্যই বাংলাদেশে বিদেশী হত্যাকাণ্ডের দুটি ঘটনাকে গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা উচিত এবং বাংলাদেশ সরকার তা করেছেও। পশ্চিমা দেশগুলো সন্ত্রাস দমনে আন্তরিক হলে তাদের উচিত বাংলাদেশে সন্ত্রাসের ভীতি না ছড়িয়ে এ হত্যা রহস্য উদ্ঘাটনে দেশের সরকারকে নৈতিক সাহায্য ও সমর্থন দেয়া।
সে কাজটি তারা করছেন না। বরং বাংলাদেশে বিদেশীরা নিরাপদ নয় এই ধুয়া তুলে দেশটিকে আপাতত হলেও সামাজিক ও সমষ্টিগত বয়কটের ব্যবস্থা করে বর্তমান সরকারকে বিব্রত করছে এবং সম্ভবত কোনো উদ্দেশ্য পূরণের জন্য চাপ সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমেরিকা তো দাবি করে বসেছে, এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার আগে বাংলাদেশে বিদেশীদের ওপর হামলা হতে পারে বলে সরকারকে সতর্ক করা হয়েছিল। ওয়াশিংটনের গোয়েন্দারা যদি এই হামলার আগাম খবর পেয়ে থাকেন, তাহলে এই হামলাকারী কারা সে খবরও কি তারা পাননি? তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারকে ওয়াশিংটন তখনই সতর্ক করেনি কেন? নাকি তাদের উদ্দেশ্য, নিউইয়র্কের নাইন-ইলেভেনের হামলা চালানোর সুযোগ দিয়ে তারপর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার নামে ইরাক যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করার মতো উপমহাদেশেও কোনো অঘটন ঘটানোর চেষ্টা?
সত্য অপ্রিয়। তবু আমার এই অনুমানটির কথা না লিখে পারলাম না। বাংলাদেশ সরকারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি প্রকাশ্যেই বলেছেন, বিদেশীদের ওপর হামলার ব্যাপারে তারা আগে কারও কাছ থেকে হুশিয়ারি পাননি। কিন্তু এটা যে আইএসের দ্বারা সংঘটিত হয়নি, সেটা তারা জানেন। বাংলাদেশে আইএসের কোনো ঘাঁটি নেই। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে আইএস এই দুই হত্যাকাণ্ডের দায়িত্ব সঙ্গে সঙ্গে স্বীকার করল কেন? এখন জানা গেছে, আইএসের এই দায়িত্ব স্বীকারের প্রচারটিও সঠিক নয়। এক ইহুদি মহিলা আইএসের নাম ভাঙিয়ে এই দায় স্বীকারের বিবৃতিটি ছড়িয়েছেন। সুতরাং এখন এই প্রশ্নও তোলা যায় এই ইহুদি মহিলা কি ইসরাইলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ এবং সেই সূত্রে আমেরিকায় সিআইএ’র সঙ্গেও যুক্ত?
দু’জন বিদেশীর হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে সঙ্গে দেশটিতে আইএসের অস্তিত্ব আবিষ্কার (কোনো প্রকার তদন্ত হওয়ার আগেই) এবং তাদের দমনের জন্য সাহায্য-সহযোগিতা দানে এগিয়ে আসার মার্কিন প্রস্তাব তাৎপর্যপূর্ণ। এভাবেই তারা সন্ত্রাস দমন ও গণতন্ত্র রক্ষার জন্য সাহায্যদানের নামে কোনো দেশে ঢোকে এবং শেষ পর্যন্ত তা তাদের সামরিক উপস্থিতিতে পরিণত হয় এবং শান্তির বদলে অশান্তির আগুন জ্বলে দেশটিতে। দেশটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে দেশটিতে প্রতিষ্ঠিত হয় মার্কিন তাঁবেদার সরকার। আফগানিস্তান, ইরাক, লিবিয়া তার প্রমাণ। সিরিয়ায় আইএস দমনের নামে আমেরিকা ও ন্যাটোর হস্তক্ষেপ সারা বিশ্বে ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টি করেছে।
অতীতে বন্যাদুর্গতদের ত্রাণকার্যের নামে বাংলাদেশে ঢুকে আমেরিকা দেশটির গুরুত্বপূর্ণ ও গোপন সামরিক ও ভৌগোলিক তথ্য সংগ্রহ করে দক্ষিণ এশিয়ায় তাদের ‘মিলিটারি জোন’ প্রতিষ্ঠার ছক এঁকেছিল বলে তখনই অভিযোগ উঠেছিল। সে সময় খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার ক্ষমতায় ছিল। পাঠকদের স্মরণ থাকতে পারে, এ সময় বাংলাদেশে ভয়াবহ বন্যা হয়। এ বন্যাদুর্গতদের উদ্ধার কার্যে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর দক্ষতা দেখাতে পারছে না এই অজুহাতে সরকারের কোনো পূর্ব অনুমতি না নিয়েই মার্কিন মেরিন সেনা দল বাংলাদেশে ঢোকে এবং ত্রাণকার্যের দায়িত্ব সরাসরি নিজেদের হাতে তুলে নেয়। ত্রাণকার্যে নিযুক্ত বাংলাদেশের সেনা দলকে তাদের খবরদারি মেনে নিতে হয়।
তারপর মিডিয়ায় এ নিয়ে কম লেখালেখিও হয়নি। অভিযোগ উঠেছিল, মার্কিন সেনারা ত্রাণকার্য চালিয়েছে বটে, কিন্তু তাদের গোপন সামরিক উদ্দেশ্যও পূরণ করে গেছে। আর ত্রাণকার্যে আমাদের সেনা টিম দক্ষ ছিল না, এ অভিযোগটিও ছিল অসত্য। উদ্দেশ্যমূলক বিদেশী প্রচারণা। ত্রাণকার্যে বা দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের সেনা টিম যে মোটেই অদক্ষ নয়, তার প্রমাণ মিলেছে হাসিনা সরকারের সময়ে বন্যাদুর্গতদের জন্য ত্রাণ অভিযান পরিচালনা এবং রানা প্লাজায় সংঘটিত ভয়াবহ ভবন ধসের সময় উদ্ধারকার্য এবং নিহতদের লাশ খোঁজার সময়। বাংলাদেশের মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং টিমের বিস্ময়কর দক্ষতার তখন উচ্চ প্রশংসা করেছিলেন ব্রিটেনসহ বিদেশী বিশেষজ্ঞরাও।
ঢাকা এবং রংপুরে দু’জন বিদেশী হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদ্ঘাটন এবং হত্যাকারীদের শনাক্তকরণ দ্বারা এই সন্ত্রাস দমনেও বাংলাদেশ তার নিজস্ব উদ্যোগেই সফল হবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। আর সফল না হলে বিদেশীরা সাহায্যদানের উছিলায় এসে পানি ঘোলা করা ছাড়া আর কিছুই করতে পারবেন না। কিবরিয়া হত্যাকাণ্ডের পরতো মার্কিন এফবিআই বাংলাদেশে ছুটে এসেছিল তদন্ত চালানোর জন্য। তাতে রহস্যের কোনো কিনারা হয়েছে কি? বর্তমান বিদেশী হত্যাকাণ্ডেও সন্ত্রাস দমনের নামে আমেরিকাকে বাংলাদেশে নাক গলানোর সুযোগ দেয়া বিপজ্জনক হতে পারে। তাতে খাল কেটে কুমির ডেকে আনা হবে। সন্ত্রাস তখন পাকিস্তানি ও আফগানিস্তানের মতো ভয়াবহ অবস্থায় চলে যেতে পারে। উপমহাদেশে মধ্যপ্রাচ্যের ধ্বংসযজ্ঞের সম্প্রসারণ ঘটতে পারে।
বর্তমানে হাসিনা সরকার পশ্চিমা শক্তিগুলোর কঠোর চাপের মধ্যে আছে। শেখ হাসিনাকে জাতিসংঘে ডেকে নিয়ে নানারকম স্তুতি ও খেতাবের উচ্চ গাছের মাথায় তুলে দিয়ে এখন মই কেড়ে নেয়ার চেষ্টা হচ্ছে মনে হয়। শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও মনোবলের ওপরই নির্ভর করে এবারের ক্রাইসিসও তিনি দক্ষতা ও ধৈর্যের সঙ্গে পার হতে পারবেন কিনা।
লন্ডন ১১ অক্টোবর, রবিবার, ২০১৫
No comments