ক্রেতাদের সফর বাতিল বিদেশে যাওয়ার প্রস্তাব নিরাপত্তা শঙ্কা by এম এম মাসুদ
দুই
বিদেশী নাগরিক হত্যার পর বাংলাদেশে চলাফেরার ব্যাপারে নাগরিকদের সতর্ক
করেছে বেশ কয়েকটি দেশ। এ পরিস্থিতিতে পোশাকের বিদেশী ক্রেতাদের একটি বড় অংশ
তাদের বাংলাদেশ সফর বাতিল করেছেন। বাংলাদেশে না এসে তাদের নিজ নিজ দেশে
বৈঠক করতে ডাকছেন উদ্যোক্তা ও পোশাক কারখানার মালিকদের। ফলে নানা শঙ্কায়
পড়ছেন দেশের শীর্ষস্থানীয় পোশাক কারখানার মালিকেরা। বিজিএমইএ ও সংশ্লিষ্ট
সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে। এদিকে বাংলাদেশে অবস্থানরত ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের
সব কর্মকর্তাকে তাদের প্রধান কার্যালয় থেকে সতর্ক বার্তা পাঠানো হয়েছে।
সব বার্তারই একই বক্তব্য, কোন প্রতিনিধি গাড়ি ছাড়া বের হবেন না এবং
সন্ধ্যার পর বাসার বাইরে অবস্থান করবেন না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইংল্যান্ড থেকে ‘টেসকো’ ও ফ্রান্স থেকে ‘সিলিও’ নামের দুটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। এ দুটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই দেশ দুটির নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ড। কিন্তু সাম্প্রতিক দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা হওয়ায় তারা তাদের সফর স্থগিত করে। একজন ব্যবসায়ী জানান, ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে ‘সিলিও’ থেকে প্রায় ২১ জন সদস্য আসার কথা ছিল। এই প্রতিনিধি দলটি আসলে বিশাল পরিমাণ অর্ডার পেতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু তারা না আসায় সেটা আর হচ্ছে না। ওই ব্যবসায়ী আরও জানান, শুধু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৬০টি কারখানা থেকে তৈরী পোশাক কেনে। কিন্তু তারা বাংলাদেশে না এসে তাদের নিজ নিজ দেশে এসে বৈঠক করতে বলছেন। যা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১-২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক কেনে, এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, ইন্ডিটেক্স, লিডল ও লি অ্যান্ড ফাং। ১ বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য কেনে টার্গেট, বেস্ট সেলার, ভিএফ করপোরেশন, সিয়ার্স, ক্যারিফোর, জেসি পেনি, গ্যাপ, লিভাইসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এ তথ্য থেকে দেখা যায়, বড় সব ক্রেতাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা বলছেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা নিয়মিতই বাংলাদেশ সফর করেন। বড় ক্রেতাদের মধ্যে অনেকেরই এখন বাংলাদেশে কার্যালয়ও রয়েছে। এ কার্যালয়গুলোর মাধ্যমে কারখানার উৎপাদনের মান পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশগুলোর পরিকল্পনা করে থাকেন তারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দিক থেকেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। তবে বিকল্প পন্থায় তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আগেও রাজনৈতিক অস্থিরতা চলাকালে বিকল্প পন্থায় কার্যক্রম চালু রেখেছিলেন ক্রেতারা। বিকল্প পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো- ভিডিও কনফারেন্স। এছাড়া রয়েছে হংকং, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যবর্তী কোন স্থানে সভা করা। তবে ভিডিও কনফারেন্স বা কারখানা মালিকদের দেশের বাইরে যাওয়া বেশিদিন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া, বিদেশ সফর কারখানা মালিকদের জন্য ব্যয়বহুলও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কিন দূতাবাসের ট্রাভেল অ্যালার্টের কারণে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াল-মার্ট ও টার্গেটের মতো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও চলতি মাসের সফরসূচি স্থগিত করেছে। এ ছাড়া জাপানি ব্র্যান্ড ইউনিক্লোর প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফরের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চেরোকি গ্লোবাল ব্র্যান্ডের ক্রেতা প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরের নির্ধারিত তারিখ ছিল ১২ই অক্টোবর। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কারখানা মালিকদের দুবাই যাওয়ার অনুরোধ করেছেন চেরোকি গ্লোবালের প্রতিনিধি। কিন্তু দুবাই যাওয়া সম্ভব হবে না জেনে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এবারের বৈঠক বাতিল করতে হচ্ছে কারখানা মালিকদের।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড লিভাইস। এ ব্র্যান্ডের দুই ক্রেতা প্রতিনিধির বাংলাদেশে আসার কথা ছিল ৫ই অক্টোবর। এর মধ্যে একজনের আসার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ও অন্যজনের নয়াদিল্লি থেকে। দুবাই পর্যন্ত এসে ফিরে গেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রতিনিধি। নয়াদিল্লি থেকে আসার কথা ছিল যে প্রতিনিধির, সফর বাতিল করেছেন তিনিও।
যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান গ্যাপ ইনকরপোরেশনের ৪ প্রতিনিধির আসার কথা ছিল চলতি সপ্তাহে। চার জনই নির্ধারিত সফর বাতিল করেছেন। একইভাবে সফর বাতিল করেছেন নেক্সট, টেসকো, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ও সেইন্সবারির প্রতিনিধিরাও। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে এভাবেই একের পর এক সফর বাতিল করছেন বাংলাদেশী পোশাকের বিদেশী ক্রেতা প্রতিনিধিরা।
বিজিএমইএ সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত সপ্তাহে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে বিজিএমইএ’র একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর বায়াররা বৈঠকটি বাতিল করেন। তিনি বলেন, বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে দেশের পোশাকখাত হুমকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে বড় বড় ক্রেতাদের বুঝানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ক্রেতারা জানিয়েছেন তাদের নিজ দেশ থেকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সফর করা নিষেধ। তাই ক্রেতারা আমাদের তাদের দেশে বা অন্য কোন দেশে বসে বৈঠক করতে বলছেন। তবে নতুন করে কেউ সফর স্থগিত করেছে কি-না তা জানা নেই বলে বলেন তিনি।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মানবজমিনকে বলেন, আমার নিজের কারখানার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে দুটি পার্টি আসার কথা ছিল। তারা শুধু আমার কারখানার জন্য নয় তারা দেশের অন্য কারখানার কাছ থেকেও পোশাক কেনে। তিনি বলেন, তারা হোটেলও বুকিং দিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিদেশী হত্যাকাণ্ডে তারা তাদের সফর স্থগিত করে। এখন তারা তাদের দেশে বৈঠক করার জন্য ডাকছে। ফলে আমরা পড়ে গেছি বিপদে। কিন্তু ব্যবসার স্বার্থে তো যেতেই হবে। তবে একটু আমাদের খরচ বাড়বে।
ক্ল্যাসিক গ্রুপে ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলতে ১২ই অক্টোবর আমেরিকার এক ক্রেতার বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। সফরটি স্থগিত করেছেন ওই ক্রেতা। এমন তথ্য দিয়ে বিজিএমইএ সাবেক সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্রেতা ও ব্র্যান্ডদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খারাপ। তিনি বলেন, বিদেশী নাগরিক হত্যায় ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরমধ্যে বায়ার্স ফোরামের বৈঠক স্থগিত একটা অশনি সংকেত। এ অবস্থা চলতে থাকলে আবারও পোশাক শিল্প সংকটের দিকে যাবে; যা পোশাক শিল্পের নতুন চ্যালেঞ্জ। পোশাক খাতের এ উদ্যোক্তা বলেন, বায়ারদের অর্ডার দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কিন্তু এ সময়ই তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটা আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য ভাল লক্ষণ নয়। আর এমন পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধিও কমবে।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব ঘটনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেখানে বিদেশী ক্রেতা বা বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, সেখানে ইতিবাচক কিছু ভাবা যায় না। জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ওই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশে যে জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, তা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হবে।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পরপর দুটি ঘটনা আমরা (বাংলাদেশীরা) ছোট করে দেখলেও এর বিশালতা আছে। বিদেশীরা গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের (ব্যবসায়ীদের) আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারী কিংবা তৈরী পোশাকখাতের ক্রেতারা দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। তাদের কাছে এটা নতুন কোন বিষয় নয়। তবে সামপ্রতিক ঘটনাগুলো তাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। একইসঙ্গে এসব ঘটনায় দেশ ইমেজ সংকটে পড়বে। এখন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সরকার কি পদক্ষেপ নিচ্ছে-সেদিকে তাকিয়ে আছেন বলে মনে করেন এই গবেষক।
এদিকে বিদেশী হত্যার ঘটনায় দেশে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং রপ্তানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, এ ধরনের ঘটনায় তৈরী পোশাকসহ অন্য খাতের অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশী হত্যার এ ঘটনা যাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ এবং রপ্তানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্য বিদেশী ক্রেতা ও নাগরিকদের দেশে অবস্থান, চলাচলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে সংগঠনটি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ইংল্যান্ড থেকে ‘টেসকো’ ও ফ্রান্স থেকে ‘সিলিও’ নামের দুটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। এ দুটি ক্রেতা প্রতিষ্ঠানই দেশ দুটির নাম্বার ওয়ান ব্র্যান্ড। কিন্তু সাম্প্রতিক দুই বিদেশী নাগরিক হত্যা হওয়ায় তারা তাদের সফর স্থগিত করে। একজন ব্যবসায়ী জানান, ওই ক্রেতা প্রতিষ্ঠান দুটির মধ্যে ‘সিলিও’ থেকে প্রায় ২১ জন সদস্য আসার কথা ছিল। এই প্রতিনিধি দলটি আসলে বিশাল পরিমাণ অর্ডার পেতে পারতো বাংলাদেশ। কিন্তু তারা না আসায় সেটা আর হচ্ছে না। ওই ব্যবসায়ী আরও জানান, শুধু এই দুটি প্রতিষ্ঠানই বাংলাদেশের ৪০ থেকে ৬০টি কারখানা থেকে তৈরী পোশাক কেনে। কিন্তু তারা বাংলাদেশে না এসে তাদের নিজ নিজ দেশে এসে বৈঠক করতে বলছেন। যা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীদের চিন্তার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।
পোশাক খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলো সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ থেকে বছরে ১-২ বিলিয়ন ডলারের পোশাক কেনে, এমন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে এইচঅ্যান্ডএম, ওয়ালমার্ট, ইন্ডিটেক্স, লিডল ও লি অ্যান্ড ফাং। ১ বিলিয়ন ডলারের কম পণ্য কেনে টার্গেট, বেস্ট সেলার, ভিএফ করপোরেশন, সিয়ার্স, ক্যারিফোর, জেসি পেনি, গ্যাপ, লিভাইসের মতো প্রতিষ্ঠানগুলো। এ তথ্য থেকে দেখা যায়, বড় সব ক্রেতাই বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছে।
খাতসংশ্লিষ্ট সংগঠনের নেতারা বলছেন, ক্রেতা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিরা নিয়মিতই বাংলাদেশ সফর করেন। বড় ক্রেতাদের মধ্যে অনেকেরই এখন বাংলাদেশে কার্যালয়ও রয়েছে। এ কার্যালয়গুলোর মাধ্যমে কারখানার উৎপাদনের মান পর্যবেক্ষণ ও ভবিষ্যৎ ক্রয়াদেশগুলোর পরিকল্পনা করে থাকেন তারা। বর্তমান পরিস্থিতিতে দুই দিক থেকেই সমস্যার সম্মুখীন হতে হচ্ছে তাদের। তবে বিকল্প পন্থায় তারা কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। আগেও রাজনৈতিক অস্থিরতা চলাকালে বিকল্প পন্থায় কার্যক্রম চালু রেখেছিলেন ক্রেতারা। বিকল্প পন্থার মধ্যে অন্যতম হলো- ভিডিও কনফারেন্স। এছাড়া রয়েছে হংকং, দুবাই, সিঙ্গাপুরসহ মধ্যবর্তী কোন স্থানে সভা করা। তবে ভিডিও কনফারেন্স বা কারখানা মালিকদের দেশের বাইরে যাওয়া বেশিদিন অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। তাছাড়া, বিদেশ সফর কারখানা মালিকদের জন্য ব্যয়বহুলও।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মার্কিন দূতাবাসের ট্রাভেল অ্যালার্টের কারণে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াল-মার্ট ও টার্গেটের মতো ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানও চলতি মাসের সফরসূচি স্থগিত করেছে। এ ছাড়া জাপানি ব্র্যান্ড ইউনিক্লোর প্রতিনিধির বাংলাদেশ সফরের কথা থাকলেও তা হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক চেরোকি গ্লোবাল ব্র্যান্ডের ক্রেতা প্রতিনিধিদের বাংলাদেশ সফরের নির্ধারিত তারিখ ছিল ১২ই অক্টোবর। নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে কারখানা মালিকদের দুবাই যাওয়ার অনুরোধ করেছেন চেরোকি গ্লোবালের প্রতিনিধি। কিন্তু দুবাই যাওয়া সম্ভব হবে না জেনে ক্রেতা প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে এবারের বৈঠক বাতিল করতে হচ্ছে কারখানা মালিকদের।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড লিভাইস। এ ব্র্যান্ডের দুই ক্রেতা প্রতিনিধির বাংলাদেশে আসার কথা ছিল ৫ই অক্টোবর। এর মধ্যে একজনের আসার কথা ছিল যুক্তরাষ্ট্র থেকে ও অন্যজনের নয়াদিল্লি থেকে। দুবাই পর্যন্ত এসে ফিরে গেছেন যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা প্রতিনিধি। নয়াদিল্লি থেকে আসার কথা ছিল যে প্রতিনিধির, সফর বাতিল করেছেন তিনিও।
যুক্তরাষ্ট্রেরই আরেক ক্রেতাপ্রতিষ্ঠান গ্যাপ ইনকরপোরেশনের ৪ প্রতিনিধির আসার কথা ছিল চলতি সপ্তাহে। চার জনই নির্ধারিত সফর বাতিল করেছেন। একইভাবে সফর বাতিল করেছেন নেক্সট, টেসকো, মার্কস অ্যান্ড স্পেনসার ও সেইন্সবারির প্রতিনিধিরাও। নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগের কথা জানিয়ে এভাবেই একের পর এক সফর বাতিল করছেন বাংলাদেশী পোশাকের বিদেশী ক্রেতা প্রতিনিধিরা।
বিজিএমইএ সিনিয়র সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, গত সপ্তাহে বিদেশী ক্রেতাদের সঙ্গে বিজিএমইএ’র একটি বৈঠক হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ডের পর বায়াররা বৈঠকটি বাতিল করেন। তিনি বলেন, বিদেশী নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য সরকার যথাযথ ব্যবস্থা না নিলে দেশের পোশাকখাত হুমকির মুখে পড়বে। অন্যদিকে বড় বড় ক্রেতাদের বুঝানোর জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। সরকারও বেশকিছু উদ্যোগ নিয়েছে। তিনি বলেন, ক্রেতারা জানিয়েছেন তাদের নিজ দেশ থেকে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে সফর করা নিষেধ। তাই ক্রেতারা আমাদের তাদের দেশে বা অন্য কোন দেশে বসে বৈঠক করতে বলছেন। তবে নতুন করে কেউ সফর স্থগিত করেছে কি-না তা জানা নেই বলে বলেন তিনি।
বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ মানবজমিনকে বলেন, আমার নিজের কারখানার জন্য ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স থেকে দুটি পার্টি আসার কথা ছিল। তারা শুধু আমার কারখানার জন্য নয় তারা দেশের অন্য কারখানার কাছ থেকেও পোশাক কেনে। তিনি বলেন, তারা হোটেলও বুকিং দিয়েছিল। কিন্তু সাম্প্রতিক বিদেশী হত্যাকাণ্ডে তারা তাদের সফর স্থগিত করে। এখন তারা তাদের দেশে বৈঠক করার জন্য ডাকছে। ফলে আমরা পড়ে গেছি বিপদে। কিন্তু ব্যবসার স্বার্থে তো যেতেই হবে। তবে একটু আমাদের খরচ বাড়বে।
ক্ল্যাসিক গ্রুপে ক্রয়াদেশ দেয়ার বিষয় নিয়ে কথা বলতে ১২ই অক্টোবর আমেরিকার এক ক্রেতার বাংলাদেশে আসার কথা ছিল। সফরটি স্থগিত করেছেন ওই ক্রেতা। এমন তথ্য দিয়ে বিজিএমইএ সাবেক সহ-সভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম বলেন, দুই বিদেশী হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ক্রেতা ও ব্র্যান্ডদের কাছে ভুল বার্তা যাচ্ছে। এটা আমাদের জন্য খারাপ। তিনি বলেন, বিদেশী নাগরিক হত্যায় ক্রেতাদের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। এরমধ্যে বায়ার্স ফোরামের বৈঠক স্থগিত একটা অশনি সংকেত। এ অবস্থা চলতে থাকলে আবারও পোশাক শিল্প সংকটের দিকে যাবে; যা পোশাক শিল্পের নতুন চ্যালেঞ্জ। পোশাক খাতের এ উদ্যোক্তা বলেন, বায়ারদের অর্ডার দেয়ার এখনই উপযুক্ত সময়। কিন্তু এ সময়ই তারা দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এটা আমাদের পোশাক শিল্পের জন্য ভাল লক্ষণ নয়। আর এমন পরিস্থিতিতে প্রবৃদ্ধিও কমবে।
এফবিসিসিআই’র সাবেক সভাপতি মীর নাসির হোসেন চলমান পরিস্থিতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, এসব ঘটনায় ব্যবসা-বাণিজ্যে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। যেখানে বিদেশী ক্রেতা বা বিনিয়োগকারীরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন, সেখানে ইতিবাচক কিছু ভাবা যায় না। জাপানি নাগরিক হত্যাকাণ্ড প্রসঙ্গে ওই ব্যবসায়ী নেতা বলেন, এ ঘটনায় বাংলাদেশে যে জাপানি বিনিয়োগের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছিল, তা কিছুটা হলেও বিঘ্নিত হবে।
এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ইএবি) সভাপতি ও বিজিএমইএ’র সাবেক সভাপতি আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, পরপর দুটি ঘটনা আমরা (বাংলাদেশীরা) ছোট করে দেখলেও এর বিশালতা আছে। বিদেশীরা গভীরভাবে বিষয়টি নিয়ে চিন্তা করছেন। রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও রাজনৈতিক অস্থিরতার নেতিবাচক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই বিদেশী নাগরিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা আমাদের (ব্যবসায়ীদের) আরও চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।
এ প্রসঙ্গে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতির সঙ্গে বিদেশী বিনিয়োগকারী কিংবা তৈরী পোশাকখাতের ক্রেতারা দীর্ঘদিন ধরে পরিচিত। তাদের কাছে এটা নতুন কোন বিষয় নয়। তবে সামপ্রতিক ঘটনাগুলো তাদের গভীরভাবে ভাবিয়ে তুলছে। একইসঙ্গে এসব ঘটনায় দেশ ইমেজ সংকটে পড়বে। এখন বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ সরকার কি পদক্ষেপ নিচ্ছে-সেদিকে তাকিয়ে আছেন বলে মনে করেন এই গবেষক।
এদিকে বিদেশী হত্যার ঘটনায় দেশে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এবং রপ্তানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করছে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই)। এক বিবৃতিতে সংগঠনটি জানায়, এ ধরনের ঘটনায় তৈরী পোশাকসহ অন্য খাতের অর্ডার পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে চলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশী হত্যার এ ঘটনা যাতে দেশে বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) আকর্ষণ এবং রপ্তানি প্রবাহ বাধাগ্রস্ত করতে না পারে, সেজন্য বিদেশী ক্রেতা ও নাগরিকদের দেশে অবস্থান, চলাচলের ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সর্বোচ্চ ব্যবস্থা গ্রহণে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছে সংগঠনটি।
No comments