নির্বাচন নিয়ে বিএনপির উভয় সংকট by মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর
বিএনপির
নেতা মওদুদ আহমদ সহকর্মীর সঙ্গে ফোনালাপে বলেছিলেন, ‘এই বিএনপি দিয়ে হবে
না।’ লাখ কথার এক কথা। তিনি ঠিকই বলেছেন। এখন বিএনপির নেতা, কর্মী, খালেদা
জিয়া, তারেক রহমান—তাঁদের আলাপ-আলোচনা ও বিতর্ক করে ঠিক করতে হবে এই
বিএনপিকে কীভাবে মেরামত করা যাবে। এই গাড়ির পুরো ইঞ্জিন পাল্টাতে হবে।
শুধু চাকা বদলালে হবে না।
আমরা চাই দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা, সুষ্ঠু নির্বাচন, সুষ্ঠু সংসদ। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে তার কিছুই পাচ্ছি না। এটা দেশের জন্য ভালো নয়। অনেকের মতে, এটা ছদ্মবেশী ‘বাকশাল’। ‘বাকশাল’কে সেদিনও মানুষ মন থেকে সমর্থন করেনি। এখন যে অবস্থা দেশে চলছে, তা-ও মানুষ মন থেকে সমর্থন করছে বলে মনে হয় না। সামাজিক মিডিয়া ও আড্ডার আলাপচারিতায় সেসবই শোনা যায়। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকার যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিএনপিও। বিএনপি গণতান্ত্রিকভাবে খেলতে পারেনি। সেই যোগ্যতা বা দক্ষতা তারা দেখাতে পারেনি। যদিও সরকারের দমননীতি এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু সরকার তো তা করবেই। বিএনপি যেন কখনো ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সরকার এগোচ্ছে। সরকারকে যারা নানাভাবে দেশে-বিদেশে সহায়তা করছে, তারাও বেশ শক্তিশালী।
প্রথম আলোয় খবর বেরিয়েছে, ‘আগাম নির্বাচনের অঙ্ক কষছে সরকার’। (২৪ জুন ২০১৫) রাজনীতির অঙ্গনে এ রকম খবর বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। আরও শোনা যাচ্ছে: মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে সরকার কয়েকটি কাজ করতে চায়। ১) যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দুর্নীতির মামলার শুনানি শেষ করে শাস্তি দিয়ে তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। ২) নানা ফন্দিফিকির করে, লোভ দেখিয়ে ও ভয় দেখিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে নতুন বিএনপি গঠনে মদদ দেওয়া। ৩) জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কচ্ছেদ করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা। ৪) ২০-দলীয় জোটের কয়েকটি ছোট দলকে নানা টোপ দিয়ে জোট থেকে বের করে আনা ইত্যাদি। প্রথম আলোর খবরে মোটামুটি এসব ধারণারই প্রতিফলন রয়েছে। এ ধরনের খবর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারা তো চাইবেই নানা কৌশলে বিএনপিকে দুর্বল করতে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলে বিএনপি যদি এর প্রতিবাদে ও অন্যান্য দাবিতে আবার ‘নির্বাচন বর্জন’ করে, তখনই আওয়ামী লীগের এই ছক বাস্তবায়ন করার সুযোগ হবে। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপিতে তখন ভাঙন ধরানো সহজ হবে। তবে বিএনপি যদি খালেদা ও তারেক ছাড়াও নির্বাচন করতে চায়, তখন আওয়ামী লীগ হতাশ হয়ে পড়বে। তাদের ব্লুপ্রিন্ট তখন আর কাজে আসবে না।
লক্ষ করার বিষয়, আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার জন্য যত চাপ দিচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ করার জন্য তারা তত তৎপর নয়। অথচ সরকার আইনানুগভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে পারে, কিন্তু করছে না। সরকার চায় বিএনপি আগে জামায়াত ছাড়ুক। এখানে আওয়ামী লীগের অন্য একটা কৌশল কাজ করছে বলে সন্দেহ হয়। বিএনপির উচিত হবে জামায়াত না ছাড়া, বরং সরকার যেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, সে ব্যাপারে সরকারকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা। আওয়ামী লীগ ও তাদের নানা ধরনের সমর্থকগোষ্ঠী সবাই কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবিতে সমানভাবে সোচ্চার নয়। মনে হয় জামায়াত নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশলটা দলের অনেকে জানেন।
আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের গণতন্ত্রের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজয় মানতে পারবে না। কেন পারবে না, তা নিশ্চয় বিএনপি জানে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের একটা মডেল তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার একটা রিহার্সেল দিয়েছে এবং তাতে পাসও করেছে। অনেকের আশঙ্কা, মেয়র নির্বাচনের মতো সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিজিবি, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এক বড় অংশ সরকারের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। নির্বাচনী মাঠে বিএনপি থাকবে একা। ভোটাররা বিএনপির শক্তি হতে পারেন, কিন্তু সাধারণ ভোটাররা সন্ত্রাস প্রতিহত করতে পারেন না। কাজেই সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র নির্বাচনের এই মডেল প্রয়োগ করতে পারে, তা বিএনপিকে বুঝতে হবে।
এই পরিস্থিতি কল্পনা করে বিএনপিকে ঠিক করতে হবে যে তারা আগামী সংসদ নির্বাচন করবে কি করবে না। বিএনপির সামনে এখন উভয় সংকট। ১. সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভোট প্রহসন মেনে নেওয়া, ২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। না নিলে দলের অস্তিত্ব আরও দুর্বল হয়ে যাবে। অনেক নেতা ও কর্মী ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। নেতা ও কর্মীরা খুবই হতাশ হয়ে পড়বেন। দল টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে। কাজেই উভয় সংকট।
অনেকে বলতে পারেন, ‘সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সরকার ভোট-সন্ত্রাস করবেই, তার নিশ্চয়তা কী?’ না, কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে এটা আমাদের ধারণা। নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগকে ভোট-সন্ত্রাসে যেতেই হবে। সাধারণ মত হচ্ছে, সুষ্ঠু ভোটে আওয়ামী লীগ জিতবে না। না জেতা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। কী বিপদ, সেটা আওয়ামী লীগ জানে। আওয়ামী লীগ কীভাবে সরকার পরিচালনা করেছে, বিরোধী দলের ওপর কীভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন করেছে, তা কি তারা জানে না? জানে। সে জন্যই সংসদ নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। যেভাবেই হোক, আওয়ামী লীগকে জিততে হবে। এই সরকারের যারা (সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি) অন্যায়ভাবে বেনিফিশিয়ারি, তারা সবাই চাইবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জেতাতে। ২৮ এপ্রিলের মেয়র নির্বাচনই তার প্রমাণ।
বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলকে এটা বুঝতে হবে। নাগরিক সমাজকেও এটা বুঝতে হবে। বক্তৃতা, বিবৃতি ও গোলটেবিল দিয়ে ভোট-সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে না।
দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে বিএনপিকে তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। নির্বাচনে না গেলে দলের কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা-ও তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে।
দুর্ভাগ্য, আমাদের নাগরিক সমাজও খুব দুর্বল। নানা লোভ, প্রলোভন, ভীরুতা, হুমকি ইত্যাদিতে তারা বিপর্যস্ত। নইলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, সবার ভোট দেওয়ার অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধের দাবিতে নাগরিক সমাজও আন্দোলন করতে পারত। কিন্তু দুর্বল নাগরিক সমাজের পক্ষে এই আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
দেশে গণতন্ত্রের এমনই অবস্থা, উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বিরোধী ছাত্রসংগঠন’ বলে কিছু নেই। যে কয়েকটি ছোট সংগঠন রয়েছে, তারা দুর্বল হলেও কিছু করার চেষ্টা করছে। বিএনপির ছাত্রসংগঠন বলে এখন ক্যাম্পাসে কিছু নেই। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করবে কে?
এই পরিস্থিতির পুরো সুযোগ নিচ্ছে সরকার। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সব দল নিষিদ্ধ করে ‘বাকশাল’ গঠন করেছিল। শেখ হাসিনাকে কোনো গণতান্ত্রিক দল নিষিদ্ধ করতে হয়নি। তিনি এমন সব কৌশল ব্যবহার করেছেন, যাতে বড় বিরোধী দল বিএনপি নিজে নিজেই দুর্বল হয়ে গেছে। বেশির ভাগ নেতা জেলে বা গ্রেপ্তারের ভয়ে ফেরারি। আর অদৃশ্য শক্তির হাতে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। জীবনের মায়া কার নেই?
ছোট দলগুলো নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। কারণ সিএনজি অটোরিকশার মতো তারাও বলছে, ‘আমি ছোট, আমাকে ধাক্কা দেবেন না।’ শেখ হাসিনা এতটা নির্দয় নন। ছোট দলকে ধাক্কা দিতে তিনি আগ্রহী নন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি কী ভাবছে, এখন এটাই বিএনপির ইস্যু হওয়া উচিত। এটা জরুরি কাজ। কারণ বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার হঠাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে দিতে পারে। তখন বিএনপি চিন্তা করারও সময় পাবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
আমরা চাই দেশে সুষ্ঠু রাজনীতি, সুষ্ঠু গণতন্ত্রের চর্চা, সুষ্ঠু নির্বাচন, সুষ্ঠু সংসদ। বর্তমান সরকারের নেতৃত্বে তার কিছুই পাচ্ছি না। এটা দেশের জন্য ভালো নয়। অনেকের মতে, এটা ছদ্মবেশী ‘বাকশাল’। ‘বাকশাল’কে সেদিনও মানুষ মন থেকে সমর্থন করেনি। এখন যে অবস্থা দেশে চলছে, তা-ও মানুষ মন থেকে সমর্থন করছে বলে মনে হয় না। সামাজিক মিডিয়া ও আড্ডার আলাপচারিতায় সেসবই শোনা যায়। বর্তমান পরিস্থিতির জন্য সরকার যেমন দায়ী, তেমনি দায়ী বিএনপিও। বিএনপি গণতান্ত্রিকভাবে খেলতে পারেনি। সেই যোগ্যতা বা দক্ষতা তারা দেখাতে পারেনি। যদিও সরকারের দমননীতি এ জন্য অনেকাংশে দায়ী। কিন্তু সরকার তো তা করবেই। বিএনপি যেন কখনো ক্ষমতায় আসতে না পারে, সেই লক্ষ্যে সরকার এগোচ্ছে। সরকারকে যারা নানাভাবে দেশে-বিদেশে সহায়তা করছে, তারাও বেশ শক্তিশালী।
প্রথম আলোয় খবর বেরিয়েছে, ‘আগাম নির্বাচনের অঙ্ক কষছে সরকার’। (২৪ জুন ২০১৫) রাজনীতির অঙ্গনে এ রকম খবর বেশ কিছুদিন থেকেই শোনা যাচ্ছিল। আরও শোনা যাচ্ছে: মধ্যবর্তী নির্বাচনের আগে সরকার কয়েকটি কাজ করতে চায়। ১) যত দ্রুত সম্ভব খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দুর্নীতির মামলার শুনানি শেষ করে শাস্তি দিয়ে তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা। ২) নানা ফন্দিফিকির করে, লোভ দেখিয়ে ও ভয় দেখিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের দুই গ্রুপে ভাগ করে নতুন বিএনপি গঠনে মদদ দেওয়া। ৩) জামায়াতের সঙ্গে বিএনপির সম্পর্কচ্ছেদ করানোর সর্বাত্মক চেষ্টা। ৪) ২০-দলীয় জোটের কয়েকটি ছোট দলকে নানা টোপ দিয়ে জোট থেকে বের করে আনা ইত্যাদি। প্রথম আলোর খবরে মোটামুটি এসব ধারণারই প্রতিফলন রয়েছে। এ ধরনের খবর ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেওয়ার মতো নয়। আওয়ামী লীগের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখলে এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। তারা তো চাইবেই নানা কৌশলে বিএনপিকে দুর্বল করতে। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষিত হলে বিএনপি যদি এর প্রতিবাদে ও অন্যান্য দাবিতে আবার ‘নির্বাচন বর্জন’ করে, তখনই আওয়ামী লীগের এই ছক বাস্তবায়ন করার সুযোগ হবে। নির্বাচন প্রশ্নে বিএনপিতে তখন ভাঙন ধরানো সহজ হবে। তবে বিএনপি যদি খালেদা ও তারেক ছাড়াও নির্বাচন করতে চায়, তখন আওয়ামী লীগ হতাশ হয়ে পড়বে। তাদের ব্লুপ্রিন্ট তখন আর কাজে আসবে না।
লক্ষ করার বিষয়, আওয়ামী লীগ ও তার দোসররা বিএনপিকে জামায়াত ছাড়ার জন্য যত চাপ দিচ্ছে, জামায়াত নিষিদ্ধ করার জন্য তারা তত তৎপর নয়। অথচ সরকার আইনানুগভাবে জামায়াত নিষিদ্ধ করতে পারে, কিন্তু করছে না। সরকার চায় বিএনপি আগে জামায়াত ছাড়ুক। এখানে আওয়ামী লীগের অন্য একটা কৌশল কাজ করছে বলে সন্দেহ হয়। বিএনপির উচিত হবে জামায়াত না ছাড়া, বরং সরকার যেন জামায়াতকে নিষিদ্ধ করে, সে ব্যাপারে সরকারকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা। আওয়ামী লীগ ও তাদের নানা ধরনের সমর্থকগোষ্ঠী সবাই কিন্তু জামায়াত নিষিদ্ধ করার দাবিতে সমানভাবে সোচ্চার নয়। মনে হয় জামায়াত নিয়ে আওয়ামী লীগের কৌশলটা দলের অনেকে জানেন।
আগামী সংসদ নির্বাচন বিএনপির জন্য একটা বড় চ্যালেঞ্জ। দেশের গণতন্ত্রের জন্যও বড় চ্যালেঞ্জ। বিএনপিকে মনে রাখতে হবে, আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পরাজয় মানতে পারবে না। কেন পারবে না, তা নিশ্চয় বিএনপি জানে। আওয়ামী লীগ নির্বাচনের একটা মডেল তৈরি করেছে। ইতিমধ্যে ঢাকা-চট্টগ্রামের মেয়র নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার একটা রিহার্সেল দিয়েছে এবং তাতে পাসও করেছে। অনেকের আশঙ্কা, মেয়র নির্বাচনের মতো সংসদ নির্বাচনেও নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, বিজিবি, নির্বাচনী কর্মকর্তাদের এক বড় অংশ সরকারের ব্লুপ্রিন্ট বাস্তবায়নে সহায়তা করবে। নির্বাচনী মাঠে বিএনপি থাকবে একা। ভোটাররা বিএনপির শক্তি হতে পারেন, কিন্তু সাধারণ ভোটাররা সন্ত্রাস প্রতিহত করতে পারেন না। কাজেই সরকার পরিবর্তনের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মেয়র নির্বাচনের এই মডেল প্রয়োগ করতে পারে, তা বিএনপিকে বুঝতে হবে।
এই পরিস্থিতি কল্পনা করে বিএনপিকে ঠিক করতে হবে যে তারা আগামী সংসদ নির্বাচন করবে কি করবে না। বিএনপির সামনে এখন উভয় সংকট। ১. সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের ভোট প্রহসন মেনে নেওয়া, ২. তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া নির্বাচনে অংশ না নেওয়া। না নিলে দলের অস্তিত্ব আরও দুর্বল হয়ে যাবে। অনেক নেতা ও কর্মী ব্যক্তিগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবেন। নেতা ও কর্মীরা খুবই হতাশ হয়ে পড়বেন। দল টিকিয়ে রাখাই মুশকিল হবে। কাজেই উভয় সংকট।
অনেকে বলতে পারেন, ‘সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও সরকার ভোট-সন্ত্রাস করবেই, তার নিশ্চয়তা কী?’ না, কোনো নিশ্চয়তা নেই। তবে এটা আমাদের ধারণা। নির্বাচনে জিততে হলে আওয়ামী লীগকে ভোট-সন্ত্রাসে যেতেই হবে। সাধারণ মত হচ্ছে, সুষ্ঠু ভোটে আওয়ামী লীগ জিতবে না। না জেতা মানে নিজের বিপদ ডেকে আনা। কী বিপদ, সেটা আওয়ামী লীগ জানে। আওয়ামী লীগ কীভাবে সরকার পরিচালনা করেছে, বিরোধী দলের ওপর কীভাবে নির্যাতন, নিপীড়ন করেছে, তা কি তারা জানে না? জানে। সে জন্যই সংসদ নির্বাচনে পরাজয় মেনে নেওয়া তাদের পক্ষে অসম্ভব। যেভাবেই হোক, আওয়ামী লীগকে জিততে হবে। এই সরকারের যারা (সরকারি প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তি) অন্যায়ভাবে বেনিফিশিয়ারি, তারা সবাই চাইবে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে জেতাতে। ২৮ এপ্রিলের মেয়র নির্বাচনই তার প্রমাণ।
বিএনপি ও অন্যান্য বিরোধী দলকে এটা বুঝতে হবে। নাগরিক সমাজকেও এটা বুঝতে হবে। বক্তৃতা, বিবৃতি ও গোলটেবিল দিয়ে ভোট-সন্ত্রাস বন্ধ করা যাবে না।
দলীয় সরকারের অধীনে বিএনপি নির্বাচনে যাবে কি যাবে না, তা নিয়ে বিএনপিকে তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা করে ঠিক করতে হবে। নির্বাচনে না গেলে দলের কী কী ক্ষতি হতে পারে, তা-ও তৃণমূল পর্যায়ে আলোচনা করতে হবে।
দুর্ভাগ্য, আমাদের নাগরিক সমাজও খুব দুর্বল। নানা লোভ, প্রলোভন, ভীরুতা, হুমকি ইত্যাদিতে তারা বিপর্যস্ত। নইলে স্বাধীন নির্বাচন কমিশন, সবার ভোট দেওয়ার অধিকার, সুষ্ঠু নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বন্ধের দাবিতে নাগরিক সমাজও আন্দোলন করতে পারত। কিন্তু দুর্বল নাগরিক সমাজের পক্ষে এই আন্দোলন গড়ে তোলা সম্ভব হবে না।
দেশে গণতন্ত্রের এমনই অবস্থা, উচ্চশিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ‘বিরোধী ছাত্রসংগঠন’ বলে কিছু নেই। যে কয়েকটি ছোট সংগঠন রয়েছে, তারা দুর্বল হলেও কিছু করার চেষ্টা করছে। বিএনপির ছাত্রসংগঠন বলে এখন ক্যাম্পাসে কিছু নেই। কাজেই সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করবে কে?
এই পরিস্থিতির পুরো সুযোগ নিচ্ছে সরকার। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার সব দল নিষিদ্ধ করে ‘বাকশাল’ গঠন করেছিল। শেখ হাসিনাকে কোনো গণতান্ত্রিক দল নিষিদ্ধ করতে হয়নি। তিনি এমন সব কৌশল ব্যবহার করেছেন, যাতে বড় বিরোধী দল বিএনপি নিজে নিজেই দুর্বল হয়ে গেছে। বেশির ভাগ নেতা জেলে বা গ্রেপ্তারের ভয়ে ফেরারি। আর অদৃশ্য শক্তির হাতে ‘গুম’ হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্তও রয়েছে। জীবনের মায়া কার নেই?
ছোট দলগুলো নিয়ে সরকারের মাথাব্যথা নেই। কারণ সিএনজি অটোরিকশার মতো তারাও বলছে, ‘আমি ছোট, আমাকে ধাক্কা দেবেন না।’ শেখ হাসিনা এতটা নির্দয় নন। ছোট দলকে ধাক্কা দিতে তিনি আগ্রহী নন।
আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি কী ভাবছে, এখন এটাই বিএনপির ইস্যু হওয়া উচিত। এটা জরুরি কাজ। কারণ বিএনপিকে অপ্রস্তুত রেখে সরকার হঠাৎ মধ্যবর্তী নির্বাচন দিয়ে দিতে পারে। তখন বিএনপি চিন্তা করারও সময় পাবে না।
মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর: মিডিয়া ও উন্নয়নকর্মী।
No comments