নারী হলেও! by হাসান ফেরদৌস
ভারতের
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যে রকম নায়কোচিত সংবর্ধনা ঢাকায় পেয়েছেন, তা
দেখে খুব যে অবাক হয়েছি, তা বলব না। মোদি যেন এলেন, দেখলেন এবং জয় করলেন।
কিন্তু মাঝখানে এক ফোঁটা চনা পড়ে সব গুবলেট হয়ে গেল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানটি খুবই পরিকল্পিত ছিল। পুরো মঞ্চটি একা মোদির জন্য, আশপাশে অন্য কেউ নেই। অনুমান করি, অন্য কারও সঙ্গে সেই মঞ্চ তিনি ভাগাভাগি করবেন না, সফরকারী ভারতীয় দল তেমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছিল। কোনো কাগজপত্র ছাড়া একদম ‘এক্সটেম্পোর’ ভাষণ দেওয়াটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের ট্রেড মার্ক করে নিয়েছেন। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে তাঁকে লম্বা ভাষণ দিতে দেখেছি, সেই একই কায়দা। কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া ভাষণ দেওয়ার সমস্যা হলো মুখ ফসকে দু-চারটে কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। নিউইয়র্কে কোনো অঘটন ঘটেনি, সেখানে তিনি যথার্থই এলেন, ভাষণ দিলেন, জয় করে দেশে ফিরে গেলেন।
ঢাকায়ও তা-ই হতো, কিন্তু যত সমস্যা বাধল আট-দশ শব্দের ওই এক বাক্যে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে, মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ধরে তিনি বললেন, নারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়েছেন। তাঁর সেই কথা শুনে হলভর্তি মানুষের সে কী হাততালি। সামনের সারিতে দেশের সব বাঘা বাঘা মন্ত্রী, পরের সারিতে বুদ্ধিজীবী, ওপরতলায় কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। সবাই ধরে নিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে মস্ত একটা তারিফ করলেন। সম্ভবত মোদি সাহেব নিজেও ভেবেছিলেন, এ কথা বলে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর নিজস্ব কায়দায়—অর্থাৎ বড় ভাইয়ের মতো—কিঞ্চিৎ পিঠ চুলকে দিলেন।
এক দিন পর আমাদের ঠাহর হলো, কথাটা বলে মোদি সাহেব যে শুধু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নয়, বিশ্বের সব নারীকে খাটো করেছেন। সে কথা আমাদের জানতে হলো ভারতের নারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে, যাঁরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে এক প্রচারণা শুরু করে দেন।
ইউরোপ–আমেরিকায়ও নারীরা সেই প্রচারে অংশ নেন, নারী হয়েও কোন দেশের কে জগৎজোড়া কী অর্জন করেছেন, তার ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করেন। তিনি এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধে ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, সেই যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন একজন নারী।
বাংলাদেশে এ নিয়ে তখন পর্যন্ত কার্যত টুঁ শব্দটি শোনা যায়নি।
অনুমান করি, মোদি সাহেবের কল্পনাতেও ছিল না যে তারিফ হিসেবে যে কথা তিনি বলেছেন, তার এমন ব্যাখ্যা হবে। ভারতে কেন, উপমহাদেশের সর্বত্র পুরুষেরা ধরেই নেন নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা, তা ঘরের ভেতরে হোক বা বাইরে, আর নারীরা তাঁদের পিছু পিছু হাঁটবেন। যদি নারীরা নেতৃত্বের শীর্ষে উঠেই আসেন, তাঁর পেছনে অনিবার্যভাবে থাকবেন কোনো পুরুষ। হয় বাবা, অথবা স্বামী। মোদিই বা এই মানসিকতার ব্যতিক্রম কেন হবেন?
মনে রাখা ভালো, মোদি বিয়ের পর তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করে বিবাগি হন। নিজে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার পরেও নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন দেখেননি। এ নিয়ে কখনো কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেননি।
মানছি, এটি মোদির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ থেকে সব নারীর প্রতি তাঁর অবজ্ঞা বা ঘৃণা প্রকাশিত হয়, এমন কথা ভাবা অন্যায়। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নারীদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় তিনি একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ আন্দোলন কেবলই লোক দেখানো ব্যাপার নয়। ব্যাংকে অধিক সুদে ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি’ অ্যাকাউন্ট খোলার যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন, সেটিও শুধু কাগজের শিরোনাম হওয়ার জন্য নয়। ফলে, সেই প্রধানমন্ত্রী যখন প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে এমন অসম্মানজনক মন্তব্য করেন, তখন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করতেই হয়, ব্যাপারটা কি মুখ ফসকে বলা, নাকি এর পেছনে গভীরতর কোনো কারণ রয়েছে?
এক দিন পর আমাদের ঠাহর হলো, কথাটা বলে মোদি সাহেব যে শুধু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নয়, বিশ্বের সব নারীকে খাটো করেছেন। সে কথা আমাদের জানতে হলো ভারতের নারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে নারীদের প্রতি উপমহাদেশের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি যে বৈষম্যমূলক, তার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। রয়েছে ধর্মের অনুশাসন। সমাজের চোখে নারীরা সেখানে বোঝা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ভারতে এখনো অনেক জায়গায় কন্যাশিশু জন্মালে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। ভারতে এই সেদিন পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ভ্রূণ হত্যায় উৎসাহ জোগানো হতো। আইন করে সেই ব্যবস্থা বাতিল করেছে ভারত সরকার, কিন্তু ভ্রূণ হত্যা একদম বন্ধ হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। আর পুরুষদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে
মেয়েশিশু যদি জন্মগ্রহণ করত, তো তারা অনভিপ্রেত, এই ভর্ৎসনা আজন্ম বয়ে বেড়াতে হয় তাদের। বছর দুয়েক আগে এক ভারতীয় শ্বশুর তার পুত্রবধূর ঘরে মেয়ে আসছে জেনে সাত মাসের পোয়াতি মেয়েটির শরীরে এইচআইভি এইডসের দূষিত রক্ত ঢুকিয়ে দেন। তঁাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর মুখের ভাবখানা ছিল, কাজটা তো তিনি মা-মেয়ে উভয়ের ভালোর জন্যই করেছেন!
নারীদের সামনে ঘরের ভেতরে যেমন, তেমনি ঘরের বাইরেও পদে পদে বাধা ও বৈষম্য। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের উদাহরণ থেকেই বোঝা সম্ভব এই বৈষম্য কতটা গভীরে প্রথিত। সরকারিভাবে বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষার হার এখনো প্রায় অর্ধেক। স্কুল শুরুর ক্ষেত্রে অধিক সমতা থাকলেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
সেই তুলনায় বাংলাদেশ নারীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। গত পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ও অন্যান্য জায়গায় যে গভীর লজ্জার ঘটনা ঘটে গেল, তার জন্য দোষারোপ করা হয়েছিল নারীদেরই। অত রাতে তাদের বাইরে থাকার দরকার কী? আর অমন পোশাক পরেই বা তারা যায় কেন?—এ ধরনের নানা কথা বলা হয়। কয়েক বছর আগে সংখ্যালঘু নারীরা ধর্ষিত হয়েছেন, এ কথা শুনে আমাদের জাতীয় সংসদে এক সাংসদ মন্তব্য করেছিলেন, সুযোগ থাকলে তিনিও সে কাজে নেমে পড়তেন। তাঁর সেই কথা শুনে সারা হলঘরে হাসির রোল উঠেছিল।
আসলে শুধু কাগজে-কলমে আইন করে নারীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো যাবে না। দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারটা মনোগত, ফলে পরিবর্তনটা আসতে হবে আমাদের, বিশেষ করে পুরুষদের মনে। কিন্তু পুরুষেরা তাঁদের মনের দরজায় অনেক আগেই খিল দিয়েছেন, মনোজগতের পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছাই তাঁদের নেই। ফলে যা করার নারীদের নিজেদেরই করতে হবে। আর তার সেরা উপায় হাতে-কলমে এ কথা প্রমাণ করা যে পুরুষদের তুলনায় তারা কোথাও বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে সে কথার প্রমাণ। গত কয়েক বছরে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের পরীক্ষায় মেয়েদের ফলাফল থেকে স্পষ্ট, হাজারো বাধা সত্ত্বেও মেয়েরা ছেলেদের টপকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
গাড়ির চালকের আসনে যখন নারীই বসবেন, তখন যাত্রী হিসেবে পুরুষ কী ভাবল না–ভাবল, তাতে বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত অনুষ্ঠানটি খুবই পরিকল্পিত ছিল। পুরো মঞ্চটি একা মোদির জন্য, আশপাশে অন্য কেউ নেই। অনুমান করি, অন্য কারও সঙ্গে সেই মঞ্চ তিনি ভাগাভাগি করবেন না, সফরকারী ভারতীয় দল তেমন সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষকে আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছিল। কোনো কাগজপত্র ছাড়া একদম ‘এক্সটেম্পোর’ ভাষণ দেওয়াটা ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাঁর নিজের ট্রেড মার্ক করে নিয়েছেন। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে তাঁকে লম্বা ভাষণ দিতে দেখেছি, সেই একই কায়দা। কিন্তু কাগজপত্র ছাড়া ভাষণ দেওয়ার সমস্যা হলো মুখ ফসকে দু-চারটে কথা একবার বেরিয়ে গেলে তা আর ফিরিয়ে আনা অসম্ভব। নিউইয়র্কে কোনো অঘটন ঘটেনি, সেখানে তিনি যথার্থই এলেন, ভাষণ দিলেন, জয় করে দেশে ফিরে গেলেন।
ঢাকায়ও তা-ই হতো, কিন্তু যত সমস্যা বাধল আট-দশ শব্দের ওই এক বাক্যে। দর্শকদের দিকে তাকিয়ে, মুখে কিঞ্চিৎ হাসি ধরে তিনি বললেন, নারী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সন্ত্রাস দমনে ‘জিরো টলারেন্স’ দেখিয়েছেন। তাঁর সেই কথা শুনে হলভর্তি মানুষের সে কী হাততালি। সামনের সারিতে দেশের সব বাঘা বাঘা মন্ত্রী, পরের সারিতে বুদ্ধিজীবী, ওপরতলায় কয়েক শ ছাত্রছাত্রী। সবাই ধরে নিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে মস্ত একটা তারিফ করলেন। সম্ভবত মোদি সাহেব নিজেও ভেবেছিলেন, এ কথা বলে তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তাঁর নিজস্ব কায়দায়—অর্থাৎ বড় ভাইয়ের মতো—কিঞ্চিৎ পিঠ চুলকে দিলেন।
এক দিন পর আমাদের ঠাহর হলো, কথাটা বলে মোদি সাহেব যে শুধু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নয়, বিশ্বের সব নারীকে খাটো করেছেন। সে কথা আমাদের জানতে হলো ভারতের নারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে, যাঁরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিজেদের প্রধানমন্ত্রীকে ভর্ৎসনা করে এক প্রচারণা শুরু করে দেন।
ইউরোপ–আমেরিকায়ও নারীরা সেই প্রচারে অংশ নেন, নারী হয়েও কোন দেশের কে জগৎজোড়া কী অর্জন করেছেন, তার ফিরিস্তি দেওয়া শুরু করেন। তিনি এ কথাও মনে করিয়ে দিলেন, ১৯৭১ সালে যে যুদ্ধে ৯০ হাজার পাকিস্তানি সেনা আত্মসমর্পণ করে, সেই যুদ্ধের রাজনৈতিক নেতৃত্বে ছিলেন একজন নারী।
বাংলাদেশে এ নিয়ে তখন পর্যন্ত কার্যত টুঁ শব্দটি শোনা যায়নি।
অনুমান করি, মোদি সাহেবের কল্পনাতেও ছিল না যে তারিফ হিসেবে যে কথা তিনি বলেছেন, তার এমন ব্যাখ্যা হবে। ভারতে কেন, উপমহাদেশের সর্বত্র পুরুষেরা ধরেই নেন নেতৃত্ব দেবেন তাঁরা, তা ঘরের ভেতরে হোক বা বাইরে, আর নারীরা তাঁদের পিছু পিছু হাঁটবেন। যদি নারীরা নেতৃত্বের শীর্ষে উঠেই আসেন, তাঁর পেছনে অনিবার্যভাবে থাকবেন কোনো পুরুষ। হয় বাবা, অথবা স্বামী। মোদিই বা এই মানসিকতার ব্যতিক্রম কেন হবেন?
মনে রাখা ভালো, মোদি বিয়ের পর তাঁর স্ত্রীকে ত্যাগ করে বিবাগি হন। নিজে ক্ষমতার শীর্ষে ওঠার পরেও নিজের স্ত্রীর কাছে ফিরে যাওয়ার প্রয়োজন দেখেননি। এ নিয়ে কখনো কোনো ব্যাখ্যা দেওয়ার প্রয়োজনটুকুও বোধ করেননি।
মানছি, এটি মোদির একান্ত ব্যক্তিগত ব্যাপার, এ থেকে সব নারীর প্রতি তাঁর অবজ্ঞা বা ঘৃণা প্রকাশিত হয়, এমন কথা ভাবা অন্যায়। বস্তুত, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর নারীদের সামাজিক মর্যাদা রক্ষায় তিনি একটি সামাজিক আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁর ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও’ আন্দোলন কেবলই লোক দেখানো ব্যাপার নয়। ব্যাংকে অধিক সুদে ‘সুকন্যা সমৃদ্ধি’ অ্যাকাউন্ট খোলার যে উদ্যোগ তিনি নিয়েছেন, সেটিও শুধু কাগজের শিরোনাম হওয়ার জন্য নয়। ফলে, সেই প্রধানমন্ত্রী যখন প্রতিবেশী দেশের প্রধানমন্ত্রীকে লক্ষ্য করে এমন অসম্মানজনক মন্তব্য করেন, তখন বিস্মিত হয়ে প্রশ্ন করতেই হয়, ব্যাপারটা কি মুখ ফসকে বলা, নাকি এর পেছনে গভীরতর কোনো কারণ রয়েছে?
এক দিন পর আমাদের ঠাহর হলো, কথাটা বলে মোদি সাহেব যে শুধু আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে নয়, বিশ্বের সব নারীকে খাটো করেছেন। সে কথা আমাদের জানতে হলো ভারতের নারীদের প্রতিক্রিয়া দেখে নারীদের প্রতি উপমহাদেশের পুরুষদের দৃষ্টিভঙ্গি যে বৈষম্যমূলক, তার পেছনে রয়েছে হাজার বছরের ইতিহাস। রয়েছে ধর্মের অনুশাসন। সমাজের চোখে নারীরা সেখানে বোঝা ছাড়া অন্য কিছু নয়। ভারতে এখনো অনেক জায়গায় কন্যাশিশু জন্মালে তাকে গলা টিপে মেরে ফেলা হয়। ভারতে এই সেদিন পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে ভ্রূণ হত্যায় উৎসাহ জোগানো হতো। আইন করে সেই ব্যবস্থা বাতিল করেছে ভারত সরকার, কিন্তু ভ্রূণ হত্যা একদম বন্ধ হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। আর পুরুষদের রক্তচক্ষু এড়িয়ে
মেয়েশিশু যদি জন্মগ্রহণ করত, তো তারা অনভিপ্রেত, এই ভর্ৎসনা আজন্ম বয়ে বেড়াতে হয় তাদের। বছর দুয়েক আগে এক ভারতীয় শ্বশুর তার পুত্রবধূর ঘরে মেয়ে আসছে জেনে সাত মাসের পোয়াতি মেয়েটির শরীরে এইচআইভি এইডসের দূষিত রক্ত ঢুকিয়ে দেন। তঁাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তাঁর মুখের ভাবখানা ছিল, কাজটা তো তিনি মা-মেয়ে উভয়ের ভালোর জন্যই করেছেন!
নারীদের সামনে ঘরের ভেতরে যেমন, তেমনি ঘরের বাইরেও পদে পদে বাধা ও বৈষম্য। শুধু শিক্ষাক্ষেত্রের উদাহরণ থেকেই বোঝা সম্ভব এই বৈষম্য কতটা গভীরে প্রথিত। সরকারিভাবে বিস্তর চেষ্টা সত্ত্বেও ভারতে ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের শিক্ষার হার এখনো প্রায় অর্ধেক। স্কুল শুরুর ক্ষেত্রে অধিক সমতা থাকলেও ছেলেদের তুলনায় মেয়েদের স্কুল ছেড়ে যাওয়ার পরিমাণ প্রায় দ্বিগুণ।
সেই তুলনায় বাংলাদেশ নারীদের প্রতি সামাজিক বৈষম্য অনেকটাই কমিয়ে আনতে পেরেছে। শিক্ষা ও কর্মক্ষেত্রে তাদের অংশগ্রহণ লক্ষণীয়ভাবে বেড়েছে। কিন্তু নারীর প্রতি পুরুষের দৃষ্টিভঙ্গির বদল হয়েছে, এ কথা বলা যাবে না। গত পয়লা বৈশাখে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে ও অন্যান্য জায়গায় যে গভীর লজ্জার ঘটনা ঘটে গেল, তার জন্য দোষারোপ করা হয়েছিল নারীদেরই। অত রাতে তাদের বাইরে থাকার দরকার কী? আর অমন পোশাক পরেই বা তারা যায় কেন?—এ ধরনের নানা কথা বলা হয়। কয়েক বছর আগে সংখ্যালঘু নারীরা ধর্ষিত হয়েছেন, এ কথা শুনে আমাদের জাতীয় সংসদে এক সাংসদ মন্তব্য করেছিলেন, সুযোগ থাকলে তিনিও সে কাজে নেমে পড়তেন। তাঁর সেই কথা শুনে সারা হলঘরে হাসির রোল উঠেছিল।
আসলে শুধু কাগজে-কলমে আইন করে নারীদের প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলানো যাবে না। দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাপারটা মনোগত, ফলে পরিবর্তনটা আসতে হবে আমাদের, বিশেষ করে পুরুষদের মনে। কিন্তু পুরুষেরা তাঁদের মনের দরজায় অনেক আগেই খিল দিয়েছেন, মনোজগতের পরিবর্তনের কোনো ইচ্ছাই তাঁদের নেই। ফলে যা করার নারীদের নিজেদেরই করতে হবে। আর তার সেরা উপায় হাতে-কলমে এ কথা প্রমাণ করা যে পুরুষদের তুলনায় তারা কোথাও বিন্দুমাত্র পিছিয়ে নেই। আমাদের প্রধানমন্ত্রী নিজে সে কথার প্রমাণ। গত কয়েক বছরে স্কুল-কলেজ পর্যায়ের পরীক্ষায় মেয়েদের ফলাফল থেকে স্পষ্ট, হাজারো বাধা সত্ত্বেও মেয়েরা ছেলেদের টপকে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।
গাড়ির চালকের আসনে যখন নারীই বসবেন, তখন যাত্রী হিসেবে পুরুষ কী ভাবল না–ভাবল, তাতে বিন্দুমাত্র হেরফের হবে না।
হাসান ফেরদৌস: নিউইয়র্কে প্রথম আলোর বিশেষ প্রতিনিধি।
No comments