চ্যাম্পিয়নস ট্রফি নয়, বিশ্বকাপে কী হবে ভাবুন! by রাজীব হাসান
বিশ্ব ক্রিকেটে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতেই নানা সমীকরণের সামনে পড়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ দল। ছবি: প্রথম আলো |
দক্ষিণ
আফ্রিকা দল এখন বাংলাদেশে। অথচ এ দেশের ক্রিকেটে এখনো আলোচিত হচ্ছে তিনটি
বিষয়: চ্যাম্পিয়নস ট্রফি, ত্রিদেশীয় সিরিজ আর র্যাঙ্কিং!
গত শুক্রবার সকালে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়: ‘বাংলাদেশকে ছিটকে ফেলতে ত্রিদেশীয় সিরিজের পরিকল্পনা’। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম ক্রিকেট পোর্টাল ‘ক্রিকেট ডটকম ডট এইউ’ আর পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক ডন-এর অনলাইন সংস্করণ ছিল খবরটির সূত্র। যে খবরে বলা হয়, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের খেলার সম্ভাবনা বাড়াতে জিম্বাবুয়ে-পাকিস্তান সিরিজে যোগ দিতে চাইছে ওয়েস্ট ইন্ডিজও। রোববার খবরটি নিশ্চিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রথমে কূটনৈতিক অবস্থানেই ছিল। বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস প্রথম আলো অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে আমরা ভাবছি না।’ কিন্তু গত সোমবার বিসিবি অসন্তোষ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। জালাল ইউনুসই কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে আনেন। বলেন, ‘যেদিন থেকে আইসিসি এফটিপি করা ছেড়ে দিয়েছে, ব্যাপারটি দ্বিপক্ষীয়ভাবে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেদিন থেকেই সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এটা সমর্থন করি না। এটা সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়।’ এও বলেছেন, ‘ব্যাপারটি যখন আইসিসি সদস্যদেশগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে অনেক কিছু নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।’
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন দুটি পক্ষ। একটি পক্ষ অবশ্যই এই ত্রিদেশীয় সিরিজের বিপক্ষে। অন্য পক্ষের বক্তব্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান তো নিয়মের বাইরে কিছু করছে না। তারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার সুযোগ হারাতে চাইবে কেন?
ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান আসলেই নিয়মের বাইরে কিছু করছে না। আইসিসি ঠিক করে দিয়েছে, এখন থেকে সিরিজগুলো দুই বোর্ডের আলোচনার ভিত্তিতেই হবে। ফলে যে কেউ চাইলে আলোচনার ভিত্তিতে সিরিজ করতেই পারে।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্য। ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ হওয়ার পরই কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাথায় এল, তাদের একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলা উচিত? এর আগে কেন তারা ভাবেনি? ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে তাদের কোনো ওয়ানডে নেই—এই তথ্য তারা ২২ জুন সকালে ঘুম থেকে উঠে আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেছে? বিশ্বকাপের পর অক্টোবরের আগে পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচ নির্ধারিত ছিল তাদের সূচিতে, পাঁচটিই টেস্ট। অথচ এই সময় দুটো দল সফর করে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ইংল্যান্ড তিনটা টেস্ট খেলে দেশে ফিরেছে, অস্ট্রেলিয়া দুটো টেস্ট খেলে। কেন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়ানডেও খেলল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ?
কারণ ইংল্যান্ড মে-তে দেশে ফিরেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো টেস্ট সিরিজ খেলবে বলে ঠিক করা ছিল। টেস্টের মেজাজেই তারা থাকতে চেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও জুনে দুটো টেস্ট খেলে দেশে ফিরেছে, কারণ জুলাই থেকেই শুরু অ্যাশেজ। মাঝখানে ওয়ানডে খেলার ঝামেলায় যেতে চায়নি তারা। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া নিজেদের লাভটা বুঝেছে। নিজেদের স্বার্থ দেখেছে। এখন যে স্বার্থটা দেখতে চাইছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পাকিস্তান এখনো এই ত্রিদেশীয় সিরিজের ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করছে না। পাকিস্তান হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে—হবে হবে। কিন্তু এও ভাবছে, শ্রীলঙ্কাকে যদি ৩-২-এ সিরিজ হারাতেই পারি, তাহলে আর ত্রিদেশীয় সিরিজে যাওয়ার ঝামেলায় কেন যাওয়া? ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদ পড়ে পড়ুক। আবার পাকিস্তান ঠিক আত্মবিশ্বাসীও নয়—বাংলাওয়াশের টাটকা স্মৃতির পর শ্রীলঙ্কাকে তাদেরই মাটিতে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ হারানোর চ্যালেঞ্জটা তাদের তরুণ দল নিতে পারবে তো? তাই এখনো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন করছে পাকিস্তান এমনটা? কারণ তারা তাদের স্বার্থ দেখছে।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের স্বার্থ দেখবে। বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ দেখবে না! বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যেটা করতে পারে, এই সম্ভাব্য ত্রিদেশীয় সিরিজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। জালাল ইউনুস সেটাই করেছেন। এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থে আরও জোরালোভাবে সেটা করা দরকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান হয়তো মাঠের খেলাতে খেলেই বাংলাদেশকে ছিটকে ফেলতে চাইছে, টেবিলের খেলায় নয়। কিন্তু এই মাঠের খেলার ছকটা কষা হয়েছে টেবিলেই।
ত্রিদেশীয় সিরিজের পক্ষে বলতে গিয়ে যাঁরা আইসিসির এফটিপির নতুন নিয়মের দোহাই দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদেরই প্রশ্ন করুন, গত কয়েক বছরে কেবল ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে আইসিসি কতবার নিয়ম বদলেছে? মাত্র গত সপ্তাহেই বদলাল আরও একবার!
আইসিসি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অভিভাবক প্রতিষ্ঠান। আইসিসি নিয়ম করল, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে হলে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটে থাকতে হবে। ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে হলেও থাকতে হবে সেরা আটে। কিন্তু এই সেরা আট নির্ধারিত হবে যে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে, আর যে র্যাঙ্কিং প্রভাবিত করবে এফটিপি, সেটা নিয়ন্ত্রণের ভার নিজেদের হাতেই রাখছে না আইসিসি! এ কি পাড়াতো খেলার বিস্কুট দৌড়—যে যেভাবে পার, মেরেকেটে হোক, কিংবা ল্যাং মেরে, সবার আগে ফিনিশিং লাইন যে ছোঁবে সে-ই ফার্স্ট!
আসলে ছয় মাস আগেও কেউ কল্পনা করেনি, র্যাঙ্কিংয়ের ছবিটা এভাবে বদলে যাবে। ২০১৯ বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব কোথায় হবে জানেন? বাংলাদেশে। কারণ, বাছাই পর্ব যেহেতু বাংলাদেশকে খেলতেই হচ্ছে, ওদেরকে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার দাও। নিজেদের মাঠে খেলে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে আসুক।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা আপাতত ভুলে যান। বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবুন। বাছাই পর্ব ছাড়াই সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার যে সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হলে, ভবিষ্যতেও যে এ রকম অনির্ধারিত এক বা একাধিক সিরিজের আয়োজন হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? বাকি দলগুলোর কথা বাদ দিন, বাংলাদেশও যে ‘বিপদে পড়লে’ নির্ধারিত সূচির বাইরে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনেক হিসেব কষে একাধিক সিরিজ আয়োজন করতে চাইবে না, সেটাও বা জোর দিয়ে কে বলতে পারে?
আইসিসির নিয়মটাতেই তাই গলদ আছে। যেখানে ‘ফেয়ার প্লে’র সুযোগ নেই। জালাল ইউনুস ঠিকই বলেছেন। বর্তমান এফটিপি প্রক্রিয়ায় অনেক ‘লুপহোল’ বা ‘ত্রুটি’ আছে। এটা এখন যেকোনো দল নিজ স্বার্থে ‘ম্যানিপুলেট’ বা ‘নিজ স্বার্থে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার’ করতে পারে। তাঁর সবচেয়ে বড় সত্যি কথাটা হলো, এটা একটা ‘অস্বাস্থ্যকর’ প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। সেই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার ছক কষা হবে টেবিলেই। যে যার কূটনৈতিক ক্ষমতাবলে আয়োজন করবে সিরিজ। এবং একজন বাংলাদেশি সমর্থক হিসেবে আপনি আশঙ্কা প্রকাশ করতেই পারেন, আইসিসি সভাপতি এখন যেহেতু একজন পাকিস্তানি, আইসিসির টাকা খরচা করেই তিনি বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানের পক্ষে দূতিয়ালি করে বেড়াতে পারেন। জহির আব্বাস এরই মধ্যে তাঁর দেশের মিডিয়াকে ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন, পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
জহির আব্বাস সেই চেষ্টা যদি নাও করেন, তবুও পাকিস্তান সুযোগ বেশি বই কম পাচ্ছে না। বর্তমান এফটিপি অনুযায়ীই, জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলবে ২০টি ওয়ানডে। পাকিস্তান কমপক্ষে ৪২টি ওয়ানডে খেলবে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় সিরিজ, সেই ওয়ানডের সংখ্যা বেড়ে হতে পারে ৪৭। ২০১৭-র জুনের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা পেলে মিলবে আরও সর্বোচ্চ ৫টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ২৪টি ওয়ানডে খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আছে তাদের। সেই সঙ্গে আছে আগস্টের এই বহুল আলোচিত ত্রিদেশীয় সিরিজ। এই দুই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতে পারে দশটি ওয়ানডে। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা পেলে মিলবে আরও সর্বোচ্চ ৫টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৯টি ওয়ানডে খেলার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে, পাকিস্তান ৫২টি, আর বাংলাদেশ ২৫টি (চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলে ফাইনাল পর্যন্ত গেলে)।
সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে না। পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এর মধ্যে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র লাইসেন্স দিয়ে রাখা হয়েছে নতুন সিরিজ আয়োজনে। পরিস্থিতি কতটা জটিল হয়ে ওঠে, সেটাই এখন দেখার। অনির্ধারিত বাড়তি সিরিজ আয়োজনের প্রয়োজন পড়লে বাংলাদেশকে র্যাঙ্কিংয়ের নিচু সারির দলগুলো ছাড়া কেউ তেমন সাড়া দেবে বলে মনেও হয় না। আর জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তানদের সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের আসলে তেমন একটা লাভ নেই, বরং হেরে গেলে বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা।
আইসিসির জন্য সবচেয়ে আদর্শ ছিল, বিশ্বকাপে খেলতে চাওয়া ১৪টি দলের মধ্যে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুটি করে ম্যাচের আয়োজন করে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব করা। সরাসরি আট দল কেন সুযোগ পাবে বিশ্বকাপে—এই প্রশ্ন মাইকেল হোল্ডিং অনেক আগেই করে রেখেছেন। কিন্তু আইসিসি তা বোঝে না? বোঝে, কিন্তু তারা সবচেয়ে বেশি বোঝে ব্যবসা। যে ব্যবসার কারণেই প্রতিবার বদলে যায় বিশ্বকাপের ফরম্যাট।
আইসিসি-র অনেক বিদ্রূপাত্মক পূর্ণ অর্থ চালু হয়ে গেছে। বিশ্বকাপে জায়গা পেতে ইঁদুর-লড়াইটা শুরু হয়ে গেলে নতুন আরেকটা নাম এখনই ঠিক করে রাখতে পারেন—‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটিং সার্কাস’!
গত শুক্রবার সকালে প্রথম আলো অনলাইনে প্রকাশিত হয়: ‘বাংলাদেশকে ছিটকে ফেলতে ত্রিদেশীয় সিরিজের পরিকল্পনা’। অস্ট্রেলিয়ার অন্যতম ক্রিকেট পোর্টাল ‘ক্রিকেট ডটকম ডট এইউ’ আর পাকিস্তানের শীর্ষ দৈনিক ডন-এর অনলাইন সংস্করণ ছিল খবরটির সূত্র। যে খবরে বলা হয়, চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে নিজেদের খেলার সম্ভাবনা বাড়াতে জিম্বাবুয়ে-পাকিস্তান সিরিজে যোগ দিতে চাইছে ওয়েস্ট ইন্ডিজও। রোববার খবরটি নিশ্চিত করে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড।
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড প্রথমে কূটনৈতিক অবস্থানেই ছিল। বিসিবির মিডিয়া কমিটির প্রধান জালাল ইউনুস প্রথম আলো অনলাইনকে বলেছিলেন, ‘এ নিয়ে আমরা ভাবছি না।’ কিন্তু গত সোমবার বিসিবি অসন্তোষ লুকিয়ে রাখতে পারেনি। জালাল ইউনুসই কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গ তুলে আনেন। বলেন, ‘যেদিন থেকে আইসিসি এফটিপি করা ছেড়ে দিয়েছে, ব্যাপারটি দ্বিপক্ষীয়ভাবে ঠিক করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সেদিন থেকেই সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। আমি এটা সমর্থন করি না। এটা সুস্থ প্রতিযোগিতা নয়।’ এও বলেছেন, ‘ব্যাপারটি যখন আইসিসি সদস্যদেশগুলোর হাতে ছেড়ে দিয়েছে, সেখানে অনেক কিছু নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করার সুযোগ আছে।’
বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটে এখন দুটি পক্ষ। একটি পক্ষ অবশ্যই এই ত্রিদেশীয় সিরিজের বিপক্ষে। অন্য পক্ষের বক্তব্য, ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান তো নিয়মের বাইরে কিছু করছে না। তারা চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলার সুযোগ হারাতে চাইবে কেন?
ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান আসলেই নিয়মের বাইরে কিছু করছে না। আইসিসি ঠিক করে দিয়েছে, এখন থেকে সিরিজগুলো দুই বোর্ডের আলোচনার ভিত্তিতেই হবে। ফলে যে কেউ চাইলে আলোচনার ভিত্তিতে সিরিজ করতেই পারে।
কিন্তু প্রশ্নটা অন্য। ভারত-বাংলাদেশ সিরিজ হওয়ার পরই কেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাথায় এল, তাদের একটা ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলা উচিত? এর আগে কেন তারা ভাবেনি? ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে তাদের কোনো ওয়ানডে নেই—এই তথ্য তারা ২২ জুন সকালে ঘুম থেকে উঠে আকস্মিকভাবে আবিষ্কার করেছে? বিশ্বকাপের পর অক্টোবরের আগে পর্যন্ত পাঁচটি ম্যাচ নির্ধারিত ছিল তাদের সূচিতে, পাঁচটিই টেস্ট। অথচ এই সময় দুটো দল সফর করে গেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজে। ইংল্যান্ড তিনটা টেস্ট খেলে দেশে ফিরেছে, অস্ট্রেলিয়া দুটো টেস্ট খেলে। কেন ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ওয়ানডেও খেলল না ওয়েস্ট ইন্ডিজ?
কারণ ইংল্যান্ড মে-তে দেশে ফিরেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে দুটো টেস্ট সিরিজ খেলবে বলে ঠিক করা ছিল। টেস্টের মেজাজেই তারা থাকতে চেয়েছে। অস্ট্রেলিয়াও জুনে দুটো টেস্ট খেলে দেশে ফিরেছে, কারণ জুলাই থেকেই শুরু অ্যাশেজ। মাঝখানে ওয়ানডে খেলার ঝামেলায় যেতে চায়নি তারা। ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া নিজেদের লাভটা বুঝেছে। নিজেদের স্বার্থ দেখেছে। এখন যে স্বার্থটা দেখতে চাইছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ।
পাকিস্তান এখনো এই ত্রিদেশীয় সিরিজের ব্যাপারে টুঁ শব্দটি করছে না। পাকিস্তান হয়তো ওয়েস্ট ইন্ডিজকে আশ্বাস দিয়ে যাচ্ছে—হবে হবে। কিন্তু এও ভাবছে, শ্রীলঙ্কাকে যদি ৩-২-এ সিরিজ হারাতেই পারি, তাহলে আর ত্রিদেশীয় সিরিজে যাওয়ার ঝামেলায় কেন যাওয়া? ওয়েস্ট ইন্ডিজ বাদ পড়ে পড়ুক। আবার পাকিস্তান ঠিক আত্মবিশ্বাসীও নয়—বাংলাওয়াশের টাটকা স্মৃতির পর শ্রীলঙ্কাকে তাদেরই মাটিতে ৩-২ ব্যবধানে সিরিজ হারানোর চ্যালেঞ্জটা তাদের তরুণ দল নিতে পারবে তো? তাই এখনো ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। কেন করছে পাকিস্তান এমনটা? কারণ তারা তাদের স্বার্থ দেখছে।
ইংল্যান্ড-অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান-ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিজেদের স্বার্থ দেখবে। বাংলাদেশ নিজের স্বার্থ দেখবে না! বাংলাদেশ এই মুহূর্তে যেটা করতে পারে, এই সম্ভাব্য ত্রিদেশীয় সিরিজ নিয়ে প্রশ্ন তোলা। জালাল ইউনুস সেটাই করেছেন। এবং বাংলাদেশের ক্রিকেটের স্বার্থে আরও জোরালোভাবে সেটা করা দরকার। ওয়েস্ট ইন্ডিজ-পাকিস্তান হয়তো মাঠের খেলাতে খেলেই বাংলাদেশকে ছিটকে ফেলতে চাইছে, টেবিলের খেলায় নয়। কিন্তু এই মাঠের খেলার ছকটা কষা হয়েছে টেবিলেই।
ত্রিদেশীয় সিরিজের পক্ষে বলতে গিয়ে যাঁরা আইসিসির এফটিপির নতুন নিয়মের দোহাই দিচ্ছেন, তাঁরা নিজেদেরই প্রশ্ন করুন, গত কয়েক বছরে কেবল ওয়ানডে ক্রিকেট নিয়ে আইসিসি কতবার নিয়ম বদলেছে? মাত্র গত সপ্তাহেই বদলাল আরও একবার!
আইসিসি সম্ভবত পৃথিবীর সবচেয়ে হাস্যকর ক্রীড়া সংশ্লিষ্ট অভিভাবক প্রতিষ্ঠান। আইসিসি নিয়ম করল, ২০১৭ চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে খেলতে হলে র্যাঙ্কিংয়ের সেরা আটে থাকতে হবে। ২০১৯ বিশ্বকাপে সরাসরি খেলতে হলেও থাকতে হবে সেরা আটে। কিন্তু এই সেরা আট নির্ধারিত হবে যে র্যাঙ্কিংয়ের ভিত্তিতে, আর যে র্যাঙ্কিং প্রভাবিত করবে এফটিপি, সেটা নিয়ন্ত্রণের ভার নিজেদের হাতেই রাখছে না আইসিসি! এ কি পাড়াতো খেলার বিস্কুট দৌড়—যে যেভাবে পার, মেরেকেটে হোক, কিংবা ল্যাং মেরে, সবার আগে ফিনিশিং লাইন যে ছোঁবে সে-ই ফার্স্ট!
আসলে ছয় মাস আগেও কেউ কল্পনা করেনি, র্যাঙ্কিংয়ের ছবিটা এভাবে বদলে যাবে। ২০১৯ বিশ্বকাপের বাছাই পর্ব কোথায় হবে জানেন? বাংলাদেশে। কারণ, বাছাই পর্ব যেহেতু বাংলাদেশকে খেলতেই হচ্ছে, ওদেরকে একটা সান্ত্বনা পুরস্কার দাও। নিজেদের মাঠে খেলে বিশ্বকাপ নিশ্চিত করে আসুক।
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির কথা আপাতত ভুলে যান। বিশ্বকাপ নিয়ে ভাবুন। বাছাই পর্ব ছাড়াই সরাসরি বিশ্বকাপ খেলার যে সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে বাংলাদেশ, সেই সম্ভাবনা উজ্জ্বল থেকে আরও উজ্জ্বলতর হলে, ভবিষ্যতেও যে এ রকম অনির্ধারিত এক বা একাধিক সিরিজের আয়োজন হবে না, তার নিশ্চয়তা কী? বাকি দলগুলোর কথা বাদ দিন, বাংলাদেশও যে ‘বিপদে পড়লে’ নির্ধারিত সূচির বাইরে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে অনেক হিসেব কষে একাধিক সিরিজ আয়োজন করতে চাইবে না, সেটাও বা জোর দিয়ে কে বলতে পারে?
আইসিসির নিয়মটাতেই তাই গলদ আছে। যেখানে ‘ফেয়ার প্লে’র সুযোগ নেই। জালাল ইউনুস ঠিকই বলেছেন। বর্তমান এফটিপি প্রক্রিয়ায় অনেক ‘লুপহোল’ বা ‘ত্রুটি’ আছে। এটা এখন যেকোনো দল নিজ স্বার্থে ‘ম্যানিপুলেট’ বা ‘নিজ স্বার্থে সুবিধাজনকভাবে ব্যবহার’ করতে পারে। তাঁর সবচেয়ে বড় সত্যি কথাটা হলো, এটা একটা ‘অস্বাস্থ্যকর’ প্রতিযোগিতা শুরু করে দেবে। সেই অস্বাস্থ্যকর প্রতিযোগিতার ছক কষা হবে টেবিলেই। যে যার কূটনৈতিক ক্ষমতাবলে আয়োজন করবে সিরিজ। এবং একজন বাংলাদেশি সমর্থক হিসেবে আপনি আশঙ্কা প্রকাশ করতেই পারেন, আইসিসি সভাপতি এখন যেহেতু একজন পাকিস্তানি, আইসিসির টাকা খরচা করেই তিনি বিশ্বজুড়ে পাকিস্তানের পক্ষে দূতিয়ালি করে বেড়াতে পারেন। জহির আব্বাস এরই মধ্যে তাঁর দেশের মিডিয়াকে ‘আশ্বাস’ দিয়েছেন, পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফেরাতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করবেন।
জহির আব্বাস সেই চেষ্টা যদি নাও করেন, তবুও পাকিস্তান সুযোগ বেশি বই কম পাচ্ছে না। বর্তমান এফটিপি অনুযায়ীই, জুলাই থেকে ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ খেলবে ২০টি ওয়ানডে। পাকিস্তান কমপক্ষে ৪২টি ওয়ানডে খেলবে। এর সঙ্গে যদি যুক্ত হয় প্রস্তাবিত ত্রিদেশীয় সিরিজ, সেই ওয়ানডের সংখ্যা বেড়ে হতে পারে ৪৭। ২০১৭-র জুনের চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা পেলে মিলবে আরও সর্বোচ্চ ৫টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ।
২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দ্বিপক্ষীয় সিরিজে ২৪টি ওয়ানডে খেলবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। এ ছাড়া অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে একটি ত্রিদেশীয় সিরিজ আছে তাদের। সেই সঙ্গে আছে আগস্টের এই বহুল আলোচিত ত্রিদেশীয় সিরিজ। এই দুই সিরিজে ওয়েস্ট ইন্ডিজ খেলতে পারে দশটি ওয়ানডে। আর চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে জায়গা পেলে মিলবে আরও সর্বোচ্চ ৫টি ওয়ানডে খেলার সুযোগ। সব মিলিয়ে এখন পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৩৯টি ওয়ানডে খেলার সম্ভাবনার সামনে দাঁড়িয়ে, পাকিস্তান ৫২টি, আর বাংলাদেশ ২৫টি (চ্যাম্পিয়নস ট্রফি খেলে ফাইনাল পর্যন্ত গেলে)।
সবাই সমান সুযোগ পাচ্ছে না। পাওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এর মধ্যে ‘যেমন খুশি তেমন সাজো’র লাইসেন্স দিয়ে রাখা হয়েছে নতুন সিরিজ আয়োজনে। পরিস্থিতি কতটা জটিল হয়ে ওঠে, সেটাই এখন দেখার। অনির্ধারিত বাড়তি সিরিজ আয়োজনের প্রয়োজন পড়লে বাংলাদেশকে র্যাঙ্কিংয়ের নিচু সারির দলগুলো ছাড়া কেউ তেমন সাড়া দেবে বলে মনেও হয় না। আর জিম্বাবুয়ে-আফগানিস্তানদের সঙ্গে খেলে বাংলাদেশের আসলে তেমন একটা লাভ নেই, বরং হেরে গেলে বেশি ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা।
আইসিসির জন্য সবচেয়ে আদর্শ ছিল, বিশ্বকাপে খেলতে চাওয়া ১৪টি দলের মধ্যে হোম-অ্যাওয়ে ভিত্তিতে দুটি করে ম্যাচের আয়োজন করে বিশ্বকাপ বাছাই পর্ব করা। সরাসরি আট দল কেন সুযোগ পাবে বিশ্বকাপে—এই প্রশ্ন মাইকেল হোল্ডিং অনেক আগেই করে রেখেছেন। কিন্তু আইসিসি তা বোঝে না? বোঝে, কিন্তু তারা সবচেয়ে বেশি বোঝে ব্যবসা। যে ব্যবসার কারণেই প্রতিবার বদলে যায় বিশ্বকাপের ফরম্যাট।
আইসিসি-র অনেক বিদ্রূপাত্মক পূর্ণ অর্থ চালু হয়ে গেছে। বিশ্বকাপে জায়গা পেতে ইঁদুর-লড়াইটা শুরু হয়ে গেলে নতুন আরেকটা নাম এখনই ঠিক করে রাখতে পারেন—‘ইন্টারন্যাশনাল ক্রিকেটিং সার্কাস’!
No comments