অর্থনীতি- ইউরোপের শেষ কাজ by জোসেফ ই স্টিগলিৎজ
গ্রিস
সরকারের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ইউরোপীয় সরকারগুলো বিপজ্জনক নীতি
অনুসরণ করেই চলেছে। গ্রিস তার ঋণদাতাদের দাবির অর্ধেকের বেশি মিটিয়েছে।
তারপরও জার্মানি ও গ্রিসের অন্য ঋণদাতারা দাবি করেই চলেছেন যে দেশটি এমন
নীতি গ্রহণ করুক, যা ইতিমধ্যে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। আর খুব কম
অর্থনীতিবিদই ভেবেছেন, এটা কখনো বাস্তবায়িত হতে পারে, হওয়া উচিত বা হবে।
গ্রিস তার রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন এনে প্রাথমিক ঘাটতি থেকে যে বিশাল উদ্বৃত্ত তৈরি করেছে, তা নজিরবিহীন। কিন্তু দেশটি মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৫ ভাগ উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করুক, এই দাবি একেবারেই অবিবেচকের মতো। কিন্তু ‘ট্রয়কা’ অর্থাৎ ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গ্রিসের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক কর্মসূচি প্রণয়নের সময় এই দায়িত্বজ্ঞানহীন দাবি তুলেছিল। তখন অবশ্য দেশটির তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এই নীতিতে অটল থাকাটা ভুল ছিল, গ্রিস এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ফলে সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রিসের মোট দেশজ উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। ট্রয়কা যে কর্মসূচি গ্রিসের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, সামষ্টিক অর্থনীতিতে তার কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা ভুল ছিল। প্রকাশিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তারা বিশ্বাস করত, মজুরি কমিয়ে দিয়ে ও অন্যান্য কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করলে গ্রিসের রপ্তানি বাড়বে, আর দেশটি শিগগিরই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারবে। তারা আরও বিশ্বাস করত, প্রথম ঋণ পুনঃকাঠামো কর্মসূচি ঋণকে আরও টেকসই করবে।
ট্রয়কার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে, শুধু একবার না, বারবারই তা ভুল প্রমাণিত হয়েছ। আবার সেই ভুলের ব্যাপ্তি ছোট হবে না, অনেক বড়ই হবে। গ্রিসের ভোটাররা সঠিকভাবেই এর পরিবর্তন চেয়েছেন, আবার সরকারও সঠিক। কারণ, তারা একটি মারাত্মকভাবে ভুল নীতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ কথা বললে এটাও স্বীকার করতে হয় যে চুক্তি করার সুযোগ আছে। গ্রিস তার লক্ষ্য সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার করেছে, তারা ধারাবাহিকভাবে সংস্কার করতেই চায়। আর কিছু ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করতে দেশটি ইউরোপের সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে। গ্রিসের ঋণদাতারা একটু বাস্তবানুগ হলে তা পুরো ইউরোপের জন্যই ভালো হয় এমন মতৈক্যের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারত: কী অর্জন করা যায়, আর সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন রাজস্ব ও কাঠামোগত সংস্কারের কী প্রভাব পড়বে।
ইউরোপের কেউ কেউ বিশেষ করে জার্মানি গ্রিসের ইউরোজোন ত্যাগের ব্যাপারে উদাসীন। তাঁরা দাবি করেন, বাজার ইতিমধ্যে সেই সম্ভাব্য বিচ্ছেদের মূল্য পরিমাপ করেছে। অনেকে আবার এ-ও বলেন, এটা মুদ্রা একীভূতকরণের পক্ষে ভালো।
আমি মনে করি, এমন দৃষ্টিভঙ্গি খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকির অবমূল্যায়ন করে। ২০০৮ সালে লেহম্যান ব্রাদার্সের পতনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই রকম আত্মসন্তুষ্টি দেখা গেছে। মার্কিন ব্যাংকের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে মানুষ বহুদিন আগে থেকেই অবগত, অন্তত গত মার্চে বিয়ার স্টার্নস দেউলিয়া হওয়ার পর থেকে এটা স্পষ্ট। তারপরও স্বচ্ছতার অভাবে (এর আংশিক কারণ হচ্ছে আইনের দুর্বলতা) বাজার ও নীতিপ্রণেতা উভয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
হ্যাঁ, বটেই দুনিয়ার আর্থিক খাত লেহম্যান পতনের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর ব্যাংকগুলো এখনো অস্বচ্ছ, ফলে সেগুলো ঝুঁকির মুখে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আদতে কী সম্পর্ক বিরাজ করে, তার আদ্যপান্ত এখনো আমরা জানি না। এর মধ্যে অস্বচ্ছ ডেরিভেটিভ ও ঋণ বদলা বদলিজনিত যে সম্পর্ক তাদের মধ্যে আছে, সে ব্যাপারেও আমরা অন্ধকারে।
ইউরোপে আমরা ইতিমধ্যে অপর্যাপ্ত বিধিবিধানের ফলাফল কী হতে পারে, তা দেখেছি। ইউরোজোনের ভুল নকশা সম্পর্কেও আমরা জেনেছি। আমরা জানি, ইউরোজোনের কাঠামো বিচ্যুতিকে উৎসাহিত করে, সমকেন্দ্রাভিমুখতাকে নয়। পুঁজি ও মেধাবী মানুষেরা সংকট-আক্রান্ত অর্থনীতি ত্যাগ করার কারণে এসব দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যায়। বাজার যখন বুঝতে পারে, ইউরোর মানের সর্পিল পতনের ব্যাপারটি এর কাঠামোর মধ্যেই নিহিত আছে, তখন পরবর্তী সংকটের ক্ষেত্রে পরিণতি খুবই গভীর হয়ে ওঠে। আর আরেকটি সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে, এটা পুঁজিবাদের প্রকৃতিতেই আছে।
ইসিবির প্রেসিডেন্ট মারিও দ্রাঘির আত্মবিশ্বাসের চালাকি আজ পর্যন্ত কাজেই দিয়েছে। তিনি ২০১২ সালের ঘোষণায় বলেছিলেন, মুদ্রা কর্তৃপক্ষ ইউরো রক্ষা করতে যা যা করা দরকার, তা করবে। কিন্তু ইউরো যে এর সদস্যদের ক্ষেত্রে বাধ্যকরী নয়, এটা জানাজানি হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে এর কার্যকারিতা কমবে। বন্ডের সুদের হার বাড়তে পারে। আর ইউরোপ ও ইসিবির নেতারা যতই নিশ্চয়তা দেন না কেন, কোনোভাবেই এই সুদের হার আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনা যাবে না। কারণ, দুনিয়া এখন জেনে গেছে, ‘প্রয়োজনীয় কাজগুলো’ তারা আর করবে না। গ্রিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ভোটের রাজনৈতিক দাবিতে যা উঠে আসবে, তারা শুধু সেটাই করবে।
আমার ভয় হচ্ছে, এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হিসেবে ইউরোপের সংহতি দুর্বল হতে দেখব। ধারণা ছিল, ইউরো সেই ঐক্যকে সংহত করবে। বাস্তবে এর ফলাফল উল্টোই হলো।
ইউরোপের প্রান্তে একটি দেশ তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে, এটা ইউরোপ বা দুনিয়ার কারও স্বার্থের জন্যই ভালো নয়। বিশেষ করে, এ মুহূর্তে যখন ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একদম দৃশ্যমান। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যেও নানা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে ইউরোপ নব্য আগ্রাসী শক্তি রাশিয়ার গলায় লাগাম দেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার চীন এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্য, সঞ্চয় ও সার্বিকভাবে (ক্রয়ক্ষমতার সমতা) তারা এখন দুনিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে তারা পশ্চিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ফলে এ সময় ইউরোপের সংহতিতে চিড় ধরার অবকাশ নেই।
ইউরোপীয় নেতারা যখন ইউরো সৃষ্টি করেন, তখন তাঁরা নিজেদের স্বপ্নদ্রষ্টা ভাবতেন। নেতারা ভেবেছিলেন, রাজনীতিকদের মতো স্বল্পমেয়াদি দাবির ভিত্তিতে তাঁরা কাজ করছেন না।
দুর্ভাগ্যবশত, অর্থনীতিবিষয়ক বোঝাপড়া তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আর সে সময়ের রাজনীতির কারণে তাঁদের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যেটা হলে ইউরো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাজ করত। যদিও একক মুদ্রার নজিরবিহীন সমৃদ্ধি আনার কথা কথা ছিল, সংকটের আগে পুরো ইউরোজোনের জন্য এটা তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে, এমনটা দেখা যায়নি। যদিও সংকটের পর থেকে প্রতিকূল ফলাফলের ভূরি ভূরি নজির দেখা গেছে।
গ্রিস তার রাজস্ব নীতিতে পরিবর্তন এনে প্রাথমিক ঘাটতি থেকে যে বিশাল উদ্বৃত্ত তৈরি করেছে, তা নজিরবিহীন। কিন্তু দেশটি মোট দেশজ উৎপাদনের ৪ দশমিক ৫ ভাগ উদ্বৃত্ত সৃষ্টি করুক, এই দাবি একেবারেই অবিবেচকের মতো। কিন্তু ‘ট্রয়কা’ অর্থাৎ ইউরোপীয় কমিশন, ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল গ্রিসের জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক কর্মসূচি প্রণয়নের সময় এই দায়িত্বজ্ঞানহীন দাবি তুলেছিল। তখন অবশ্য দেশটির তা মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় ছিল না।
এই নীতিতে অটল থাকাটা ভুল ছিল, গ্রিস এখন তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। ফলে সংকট শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত গ্রিসের মোট দেশজ উৎপাদন ২৫ শতাংশ কমে গেছে। ট্রয়কা যে কর্মসূচি গ্রিসের ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, সামষ্টিক অর্থনীতিতে তার কী প্রভাব পড়বে, সে বিষয়ে তাদের ধারণা ভুল ছিল। প্রকাশিত ভবিষ্যদ্বাণী অনুসারে তারা বিশ্বাস করত, মজুরি কমিয়ে দিয়ে ও অন্যান্য কৃচ্ছ্রসাধনের নীতি গ্রহণ করলে গ্রিসের রপ্তানি বাড়বে, আর দেশটি শিগগিরই প্রবৃদ্ধির ধারায় ফিরতে পারবে। তারা আরও বিশ্বাস করত, প্রথম ঋণ পুনঃকাঠামো কর্মসূচি ঋণকে আরও টেকসই করবে।
ট্রয়কার ভবিষ্যদ্বাণী ভুল প্রমাণিত হয়েছে, শুধু একবার না, বারবারই তা ভুল প্রমাণিত হয়েছ। আবার সেই ভুলের ব্যাপ্তি ছোট হবে না, অনেক বড়ই হবে। গ্রিসের ভোটাররা সঠিকভাবেই এর পরিবর্তন চেয়েছেন, আবার সরকারও সঠিক। কারণ, তারা একটি মারাত্মকভাবে ভুল নীতি গ্রহণে অস্বীকৃতি জানিয়েছে।
এ কথা বললে এটাও স্বীকার করতে হয় যে চুক্তি করার সুযোগ আছে। গ্রিস তার লক্ষ্য সম্পর্কে আমাদের পরিষ্কার করেছে, তারা ধারাবাহিকভাবে সংস্কার করতেই চায়। আর কিছু ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়ন করতে দেশটি ইউরোপের সহায়তাকে স্বাগত জানিয়েছে। গ্রিসের ঋণদাতারা একটু বাস্তবানুগ হলে তা পুরো ইউরোপের জন্যই ভালো হয় এমন মতৈক্যের ভিত্তি নির্মাণ করতে পারত: কী অর্জন করা যায়, আর সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিভিন্ন রাজস্ব ও কাঠামোগত সংস্কারের কী প্রভাব পড়বে।
ইউরোপের কেউ কেউ বিশেষ করে জার্মানি গ্রিসের ইউরোজোন ত্যাগের ব্যাপারে উদাসীন। তাঁরা দাবি করেন, বাজার ইতিমধ্যে সেই সম্ভাব্য বিচ্ছেদের মূল্য পরিমাপ করেছে। অনেকে আবার এ-ও বলেন, এটা মুদ্রা একীভূতকরণের পক্ষে ভালো।
আমি মনে করি, এমন দৃষ্টিভঙ্গি খুবই তাৎপর্যপূর্ণভাবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ঝুঁকির অবমূল্যায়ন করে। ২০০৮ সালে লেহম্যান ব্রাদার্সের পতনের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একই রকম আত্মসন্তুষ্টি দেখা গেছে। মার্কিন ব্যাংকের ভঙ্গুরতা সম্পর্কে মানুষ বহুদিন আগে থেকেই অবগত, অন্তত গত মার্চে বিয়ার স্টার্নস দেউলিয়া হওয়ার পর থেকে এটা স্পষ্ট। তারপরও স্বচ্ছতার অভাবে (এর আংশিক কারণ হচ্ছে আইনের দুর্বলতা) বাজার ও নীতিপ্রণেতা উভয়েই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যকার সম্পর্ক সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে পারেনি।
হ্যাঁ, বটেই দুনিয়ার আর্থিক খাত লেহম্যান পতনের ধাক্কা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি। আর ব্যাংকগুলো এখনো অস্বচ্ছ, ফলে সেগুলো ঝুঁকির মুখে আছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আদতে কী সম্পর্ক বিরাজ করে, তার আদ্যপান্ত এখনো আমরা জানি না। এর মধ্যে অস্বচ্ছ ডেরিভেটিভ ও ঋণ বদলা বদলিজনিত যে সম্পর্ক তাদের মধ্যে আছে, সে ব্যাপারেও আমরা অন্ধকারে।
ইউরোপে আমরা ইতিমধ্যে অপর্যাপ্ত বিধিবিধানের ফলাফল কী হতে পারে, তা দেখেছি। ইউরোজোনের ভুল নকশা সম্পর্কেও আমরা জেনেছি। আমরা জানি, ইউরোজোনের কাঠামো বিচ্যুতিকে উৎসাহিত করে, সমকেন্দ্রাভিমুখতাকে নয়। পুঁজি ও মেধাবী মানুষেরা সংকট-আক্রান্ত অর্থনীতি ত্যাগ করার কারণে এসব দেশগুলোর ঋণ পরিশোধের ক্ষমতা কমে যায়। বাজার যখন বুঝতে পারে, ইউরোর মানের সর্পিল পতনের ব্যাপারটি এর কাঠামোর মধ্যেই নিহিত আছে, তখন পরবর্তী সংকটের ক্ষেত্রে পরিণতি খুবই গভীর হয়ে ওঠে। আর আরেকটি সংকট অনিবার্য হয়ে ওঠে, এটা পুঁজিবাদের প্রকৃতিতেই আছে।
ইসিবির প্রেসিডেন্ট মারিও দ্রাঘির আত্মবিশ্বাসের চালাকি আজ পর্যন্ত কাজেই দিয়েছে। তিনি ২০১২ সালের ঘোষণায় বলেছিলেন, মুদ্রা কর্তৃপক্ষ ইউরো রক্ষা করতে যা যা করা দরকার, তা করবে। কিন্তু ইউরো যে এর সদস্যদের ক্ষেত্রে বাধ্যকরী নয়, এটা জানাজানি হয়ে গেলে পরবর্তী সময়ে এর কার্যকারিতা কমবে। বন্ডের সুদের হার বাড়তে পারে। আর ইউরোপ ও ইসিবির নেতারা যতই নিশ্চয়তা দেন না কেন, কোনোভাবেই এই সুদের হার আকাশ থেকে মাটিতে নামিয়ে আনা যাবে না। কারণ, দুনিয়া এখন জেনে গেছে, ‘প্রয়োজনীয় কাজগুলো’ তারা আর করবে না। গ্রিসের ক্ষেত্রে দেখা যায়, ক্ষীণদৃষ্টিসম্পন্ন ভোটের রাজনৈতিক দাবিতে যা উঠে আসবে, তারা শুধু সেটাই করবে।
আমার ভয় হচ্ছে, এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরিণতি হিসেবে ইউরোপের সংহতি দুর্বল হতে দেখব। ধারণা ছিল, ইউরো সেই ঐক্যকে সংহত করবে। বাস্তবে এর ফলাফল উল্টোই হলো।
ইউরোপের প্রান্তে একটি দেশ তার প্রতিবেশীদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন থাকবে, এটা ইউরোপ বা দুনিয়ার কারও স্বার্থের জন্যই ভালো নয়। বিশেষ করে, এ মুহূর্তে যখন ভূরাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা একদম দৃশ্যমান। প্রতিবেশী মধ্যপ্রাচ্যেও নানা অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে। ওদিকে ইউরোপ নব্য আগ্রাসী শক্তি রাশিয়ার গলায় লাগাম দেওয়ার চেষ্টা করছে। আবার চীন এখন দুনিয়ার সবচেয়ে বড় অর্থনীতিতে পরিণত হয়েছে। বাণিজ্য, সঞ্চয় ও সার্বিকভাবে (ক্রয়ক্ষমতার সমতা) তারা এখন দুনিয়ার বৃহত্তম অর্থনীতি। অর্থনৈতিক ও কৌশলগত ক্ষেত্রে নতুন বাস্তবতা তৈরি করে তারা পশ্চিমের মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। ফলে এ সময় ইউরোপের সংহতিতে চিড় ধরার অবকাশ নেই।
ইউরোপীয় নেতারা যখন ইউরো সৃষ্টি করেন, তখন তাঁরা নিজেদের স্বপ্নদ্রষ্টা ভাবতেন। নেতারা ভেবেছিলেন, রাজনীতিকদের মতো স্বল্পমেয়াদি দাবির ভিত্তিতে তাঁরা কাজ করছেন না।
দুর্ভাগ্যবশত, অর্থনীতিবিষয়ক বোঝাপড়া তাঁদের উচ্চাকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল না। আর সে সময়ের রাজনীতির কারণে তাঁদের পক্ষে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি, যেটা হলে ইউরো কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় কাজ করত। যদিও একক মুদ্রার নজিরবিহীন সমৃদ্ধি আনার কথা কথা ছিল, সংকটের আগে পুরো ইউরোজোনের জন্য এটা তাৎপর্যপূর্ণ ইতিবাচক ফলাফল বয়ে এনেছে, এমনটা দেখা যায়নি। যদিও সংকটের পর থেকে প্রতিকূল ফলাফলের ভূরি ভূরি নজির দেখা গেছে।
ইউরোজোনের
রাজনৈতিক নেতারা অর্থনীতিবিষয়ক কিঞ্চিত বোঝাপড়ার সঙ্গে তাঁদের ইউরোপীয়
সংহতির ধারণা ও এ–বিষয়ক উদ্বেগের মিলন ঘটাতে পারবেন কি না, তার ওপরই নির্ভর
করছে ইউরোপ ও ইউরোর ভবিষ্যৎ। হয়তো আগামী কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই এই
অস্তিত্ববাদী প্রশ্নের উত্তর আমরা পেতে শুরু করব।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
জোসেফ ই স্টিগলিৎজ: নোবেলজয়ী মার্কিন অর্থনীতিবিদ।
No comments