টেলিফোনে রাগের মাশুল by কাফি কামাল
ইতিহাসের
এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বাংলাদেশের রাজনীতিতে জিয়াউর রহমানের আবির্ভাব। তার
হাতেই ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর যাত্রা শুরু বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী
দল-বিএনপির। চারবার রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়া দলটি এখন এক অনিবার্য
ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে। বিএনপির জন্য এ এক অনিশ্চিত ঘোর অমানিশার সময়। কেন
এই বিপর্যয়? বিএনপির শেষ গন্তব্যইবা কোথায়। এমন সব প্রশ্নের উত্তর
অনুসন্ধান করেছেন আমাদের রাজনৈতিক সংবাদদাতা কাফি কামাল। তার লেখা ‘বিএনপির ময়নাতদন্ত’ শীর্ষক ধারাবাহিক প্রতিবেদনের আজ ছাপা হলো দ্বিতীয় পর্ব-
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিশ্চিতভাবেই প্রভাবশালী একটি দল বিএনপি। ৫ম থেকে ৯ম পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা এমনটাই নির্দেশ করে। কিন্তু এ শক্তি যতটা না সাংগঠনিক তার চেয়ে বেশি জনসমর্থনে। বিএনপির ব্যর্থতা হচ্ছে, মানুষের সমর্থনকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তর করতে না পারা। যার কারণে দেখা যায়, ভোটের মাঠে বিএনপি প্রার্থীদের বাক্স ভরলেও আন্দোলনের মাঠে দলটির অবস্থান সব সময়ই টলোমলো।
দেশের উন্নয়ন ও বহুমতের ঐক্যের প্রতি জোর দিয়ে ১৯ দফা প্রণয়ন করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যা দেশের বেশির ভাগ মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ দফার সঙ্গে সংগতি রেখে যুগোপযোগী কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারেনি বিএনপি। এই ১৯ দফা নিয়ে বিএনপির অনেক নেতারই আগ্রহ কম, এর কোন হালনাগাদ দফাও দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি তারা। দলটি ধরে রাখতে পারেনি বহুমতের ঐক্য, ত্যাগের মনোভাব, নির্লোভ আদর্শ ও স্বচ্ছ ইমেজের সমন্বয়ে গড়ে তোলা জিয়ার নীতি। জিয়াউর রহমান দল গঠনকালে ও সরকারের সর্বক্ষেত্রে সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন মেধাবী ও সাংগঠনিক লোকজনের। সে বিএনপিতে এখন ব্যবসায়ী ও আমলারাই প্রাধান্য পাচ্ছেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে যেখানে সুবিধাবাদীরা তটস্থ থাকতেন, এখন সেখানে তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ। রাজপথে মিছিলে মুখর কণ্ঠ, সংগঠনে সক্রিয় ঘর্মাক্ত কর্মীর বদলে কেতাদুরস্তরাই আদরণীয়। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী, ত্যাগীদের হটিয়ে দলটিতে সুবিধাবাদীদের অবস্থানই মজবুত। ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শ, জিয়াউর রহমানের অবদান এবং বিএনপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দেশের নতুন প্রজন্ম দূরে থাক, দলের কর্মী-সমর্থকদের হূদয়েই প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
অন্যদিকে সরকার পরিচালনা, দল পরিচালনা ও আন্দোলনে জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বহুবার নানামুখী জটিলতায়ও পড়েছেন তিনি। কখনও তার সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে কখনওবা ভুল। নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কারণে একসময় পরিচিতি পেয়েছিলেন আপসহীন নেত্রী হিসেবে। রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার কারণে খালেদা জিয়ার কাছে দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্তই আশা করেন দেশের মানুষ এবং দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার একটি রেওয়াজ তৈরি হয় বিএনপিতে। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে এ রেওয়াজটি রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। নির্বাচন থেকে আন্দোলন, দল গোছানো থেকে কূটনীতি, সবখানেই নেতিবাচক ছাপ পড়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলটির এ দীর্ঘসূত্রতার। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক বিএনপি দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে, সেটা এখন অনেকেই ভাবতে পানে না। বিশ্বাসও করে না। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পদে মির্জা ফখরুলকে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে রাখার মধ্যেও কোন গতিশীলতার ছাপ নেই।
রাজনৈতিক সংকট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ২০১৩ সালের ২৬শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপের প্রস্তাব ও ২৮শে অক্টোবর গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন। এ সময় তিনি সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। বিএনপির যুক্তি ছিল, হরতালটি যেহেতু ১৮ দলের কর্মসূচি, তাই শেষ মুহূর্তে জোটের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নেই। তাই হরতাল শেষে যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। কিন্তু অনেকেই একমত যে, প্রধানমন্ত্রীর ফোনের কারণে যদি তাৎক্ষণিক বিএনপি নেত্রী হরতাল তুলে নিতে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারতেন, তাহলে প্রচারণার পাল্লা তার দিকেই বেশি ঝুঁকতো। অবশ্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘোলাটে হয়ে যায় পরিস্থিতি। লিক হয়ে যায় কিংবা লিক করে দেয়া হয় দুনেত্রীর সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন দুপুরে লাল টেলিফোনে ফোন দিলেও খালেদা জিয়া ধরেননি। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তার লাল ফোন অনেক দিন ধরেই বিকল। এ নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কিছু ইস্যু এবং ৪০ মিনিটের বক্তব্যটি শেষ হয় রাগারাগির মধ্য দিয়েই। রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, সেদিন সহিষ্ণু আচরণের মধ্য দিয়ে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ রক্ষা করলে পরিস্থিতি ইতিবাচক মোড় নিতে পারতো। সেখানেই শেষ নয়, টেলিফোন সংলাপের পর ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর বিরোধী দলের প্রতি নির্বাচনীকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কোন মিনিস্ট্রি চান। আপনি আসেন, কোন কোন মন্ত্রণালয় চান- আলোচনা করে আমরা ঠিক করি।’ কিন্তু পরদিনই আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে দাবি করে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। রাজনৈতিক মহলের মতে, নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চাইতে পারতো বিএনপি। সেখানে তারা কাজ করতে না পারলে শেষ মুহূর্তে সরে আসারও সুযোগ ছিল। এতে তাদের ওপর একগুঁয়েমির অভিযোগটি প্রতিষ্ঠা পেতো না। দেশভাগের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে এরকম একটি কোয়ালিশন সরকার গড়তে রাজি হয়েছিলেন জিন্নাহ। লিয়াকত আলী খান (পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) পেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রণালয় এবং কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল যে, মুসলিম লীগ তাদের সিদ্ধান্ত আটকে দিচ্ছে। সুতরাং দৃষ্টান্ত যে ছিল না, তা নয়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। একইভাবে ভিন্নমত রয়েছে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় নির্বাচন নিয়েও। দলের নেতারা প্রকাশ্যে শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরলেও ঘরোয়া আলাপে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলেন। অনেকেই মনে করেন, ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারতো বিএনপি। এতে সরকারই চাপে পড়তো তাদের বিজয় নিয়ে এবং নতুন পথে হাঁটতো। নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর চাপ তৈরি করতে পারতো সরকারের ওপর। ওই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি বিদেশী অতিথিদেরও বিব্রত করেছেন। কারণ অফিসিয়াল অপোজিশন হিসেবে বিএনপির পরিবর্তে জাতীয় পার্টি ও তার নেত্রী রওশন এরশাদকেই তাদের গুরুত্ব দিতে হয়।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ যে কৌশলটি নিয়েছিল তার থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারেনি বিএনপি। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। নির্বাচনের ৫ দিন আগে বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বরাত দিয়ে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির এক তারবার্তায় দেখা যায়, বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, এ নির্বাচনে ভোটে নয়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের জয়ী করানো হবে। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টির চেয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিএনপিকে দুর্বল করেছিল। কারণ বিএনপি শেষ মুহূর্তে অপ্রস্তুত অবস্থায় সাড়া দিয়েছিল। এর ফলে নেতারা ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেননি নির্বাচনে অংশগ্রহণের।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের বৃহত্তর প্লাটফরম গড়ে তুলতে জোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। ২০১৩-১৪ সালে একের পর এক রাজনৈতিক দল যুক্ত হয় বিএনপি জোটে। চারদলীয় জোট ১৪, ১৮ ও ২০ দলে পরিণত হয়। কিন্তু জোটের বেশির ভাগ দলই ব্যক্তি ও নামসর্বস্ব। জোটের অর্ধেক দলেরই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। কর্মী-সমর্থন, সংগঠন ও জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বেশির ভাগ দলের উল্লেখযোগ্য কোন অবস্থান নেই। একপর্যায়ে জোটের শরিক দলের মধ্যেই তৈরি হয় মনকষাকষি। প্রগতিপন্থি ও ইসলামপন্থি পরস্পরবিরোধী দলগুলো বাস্তবিক অর্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এছাড়া জোটের নেতাদের সামনের আসনে বসাতে গিয়ে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ও বর্ষীয়ান নেতাদের পেছনে চলে যেতে হয়। সভা-সমাবেশসহ সবখানেই এটা নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তৈরি হয় অসন্তোষ। সাম্প্রতিক সময়ে এ অসন্তোষের বিষয়টি আরও সামনে চলে এসেছে।
অন্যদিকে মনোমালিন্য কমলেও দলে বা জোটে ফেরানো যায়নি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ অনেক প্রভাবশালী নেতাকে। জিয়ার জন্মদিনে অধ্যাপক চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করে বেগম খালেদা জিয়া মঞ্চে না বসে দর্শকের গ্যালারিতে বসেছিলেন। এটা ভাল নজির হয়েছে। কিন্তু তাঁকে দলে টেনে আনার সঙ্গে যে জটিলতা আছে তা দূর করতে যে ধরনের সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে, তার কোন লক্ষণ নেই।
এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত নেতাদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কৌশলও কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। সংস্কারপন্থি নেতাদের মধ্যে প্রভাবশালীরা অন্তর্কোন্দলের কারণে দলে ফিরতে পারেননি। ফলে বিএনপি সীমিত হলেও একটি শক্তিকে হাতছাড়া করেছে। আবার ২০ দলের আন্দোলন চলাকালে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক ইস্যুতে একাধিক বক্তৃতা-বিবৃতি দেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তার কিছু বক্তব্যও বিতর্ক তৈরি করে।
১৫ই আগস্ট ইস্যুটি বিএনপির রাজনীতিতে আরেকটি ভুল হিসেবে বিবেচনা করেছেন রাজনৈতিক ও কূটনীতিক মহল। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর কারণে দিনটি আওয়ামী লীগের কাছে যেখানে শোকের সেখানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে পালন করে বিএনপি। এ ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক ও সুধী সমাজের তরফে নানা অনুরোধও গ্রাহ্য করেনি বিএনপি। এক তারবার্তায় মরিয়ার্টি লিখেছেন, ‘১৫ই আগস্টই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভাজন রেখা, এটাই বিরোধের উৎস। ৩৪ বছর পরেও এটা বাংলাদেশকে বিভক্ত রেখেছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দুই দলের মধ্যকার তিক্ততাই গত দুদশকের বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আমরা আশা করি, এ ইস্যুতে উভয় পক্ষের বিতর্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজকে প্রত্যাহার করে নেবে।’ অথচ তারেক রহমানের বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত ও আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার এজাহার থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সম্পর্কে নতুন এক মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। ৫ম সংসদে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে সামাদ আজাদ-বি. চৌধুরী কিছুটা আলোচনা এগিয়েছিল। এমনকি তখন দেশের বহু স্থানে শিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একসঙ্গে লড়াই করেছে। বিএনপির এমপিরাও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন সংসদের ফ্লোরেই। রাজনীতির সেই ধারাটা বেগবান বা আর ফেরানোর সুযোগ জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল বলেও অনেকে মনে করেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলাকালে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। এ সময় তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিরোধের ভেতরেও শোক জানাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু খালেদা জিয়া অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বিএনপি নেতা ও চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অভ্যর্থনা জানাননি প্রধানমন্ত্রীকে। কার্যালয়ের সামনে কয়েক মিনিট অপেক্ষা শেষে ফিরে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের দেখা হওয়ার দৃশ্যটি দেখতে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন গোটা দেশের মানুষ। দুই নেত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎ হলে বা সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে অন্তত কার্যালয়ে অভ্যর্থনা জানালে পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের ওপর একটি নৈতিক চাপ তৈরি হতো। এ ঘটনাকে বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বুদ্ধিতা ও শিষ্টাচার লঙ্ঘনের একটি ক্ষতচিহ্ন হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক মহল।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে নিশ্চিতভাবেই প্রভাবশালী একটি দল বিএনপি। ৫ম থেকে ৯ম পাঁচটি জাতীয় নির্বাচনের ফলাফল পর্যালোচনা এমনটাই নির্দেশ করে। কিন্তু এ শক্তি যতটা না সাংগঠনিক তার চেয়ে বেশি জনসমর্থনে। বিএনপির ব্যর্থতা হচ্ছে, মানুষের সমর্থনকে সাংগঠনিক শক্তিতে রূপান্তর করতে না পারা। যার কারণে দেখা যায়, ভোটের মাঠে বিএনপি প্রার্থীদের বাক্স ভরলেও আন্দোলনের মাঠে দলটির অবস্থান সব সময়ই টলোমলো।
দেশের উন্নয়ন ও বহুমতের ঐক্যের প্রতি জোর দিয়ে ১৯ দফা প্রণয়ন করেছিলেন বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান। যা দেশের বেশির ভাগ মানুষের আস্থা অর্জনে সক্ষম হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তিত আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও বৈশ্বিক পরিপ্রেক্ষিতে ১৯ দফার সঙ্গে সংগতি রেখে যুগোপযোগী কর্মসূচি প্রণয়ন করতে পারেনি বিএনপি। এই ১৯ দফা নিয়ে বিএনপির অনেক নেতারই আগ্রহ কম, এর কোন হালনাগাদ দফাও দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি তারা। দলটি ধরে রাখতে পারেনি বহুমতের ঐক্য, ত্যাগের মনোভাব, নির্লোভ আদর্শ ও স্বচ্ছ ইমেজের সমন্বয়ে গড়ে তোলা জিয়ার নীতি। জিয়াউর রহমান দল গঠনকালে ও সরকারের সর্বক্ষেত্রে সমাবেশ ঘটিয়েছিলেন মেধাবী ও সাংগঠনিক লোকজনের। সে বিএনপিতে এখন ব্যবসায়ী ও আমলারাই প্রাধান্য পাচ্ছেন। জিয়াউর রহমানের সময়ে যেখানে সুবিধাবাদীরা তটস্থ থাকতেন, এখন সেখানে তাদের হাতেই নিয়ন্ত্রণ। রাজপথে মিছিলে মুখর কণ্ঠ, সংগঠনে সক্রিয় ঘর্মাক্ত কর্মীর বদলে কেতাদুরস্তরাই আদরণীয়। জাতীয়তাবাদী আদর্শের প্রতি বিশ্বাসী, ত্যাগীদের হটিয়ে দলটিতে সুবিধাবাদীদের অবস্থানই মজবুত। ফলে জাতীয়তাবাদী আদর্শ, জিয়াউর রহমানের অবদান এবং বিএনপির লক্ষ্য-উদ্দেশ্য দেশের নতুন প্রজন্ম দূরে থাক, দলের কর্মী-সমর্থকদের হূদয়েই প্রতিষ্ঠিত করতে পারেনি।
অন্যদিকে সরকার পরিচালনা, দল পরিচালনা ও আন্দোলনে জীবনে বহু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সিদ্ধান্ত গ্রহণে বহুবার নানামুখী জটিলতায়ও পড়েছেন তিনি। কখনও তার সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণিত হয়েছে কখনওবা ভুল। নিজ সিদ্ধান্তে অনড় থাকার কারণে একসময় পরিচিতি পেয়েছিলেন আপসহীন নেত্রী হিসেবে। রাজনীতি ও সরকার পরিচালনায় অভিজ্ঞতার কারণে খালেদা জিয়ার কাছে দ্রুত এবং কার্যকর সিদ্ধান্তই আশা করেন দেশের মানুষ এবং দলের নেতাকর্মীরা। কিন্তু ২০০১ সালে ক্ষমতায় আসার পর থেকে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতার একটি রেওয়াজ তৈরি হয় বিএনপিতে। ওয়ান-ইলেভেনের পর থেকে এ রেওয়াজটি রীতিমতো অভ্যাসে পরিণত করে নিয়েছে দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব। নির্বাচন থেকে আন্দোলন, দল গোছানো থেকে কূটনীতি, সবখানেই নেতিবাচক ছাপ পড়েছে সিদ্ধান্ত গ্রহণে দলটির এ দীর্ঘসূত্রতার। ভুল-শুদ্ধ যাই হোক বিএনপি দ্রুত সিদ্ধান্ত দিতে পারে, সেটা এখন অনেকেই ভাবতে পানে না। বিশ্বাসও করে না। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব পদে মির্জা ফখরুলকে এতটা দীর্ঘ সময় ধরে রাখার মধ্যেও কোন গতিশীলতার ছাপ নেই।
রাজনৈতিক সংকট নিয়ে টানটান উত্তেজনার মধ্যেই ২০১৩ সালের ২৬শে অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৎকালীন বিরোধী নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করে সংলাপের প্রস্তাব ও ২৮শে অক্টোবর গণভবনে নৈশভোজের দাওয়াত দেন। এ সময় তিনি সংলাপের প্রস্তাবকে স্বাগত জানালেও হরতাল প্রত্যাহারে প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। বিএনপির যুক্তি ছিল, হরতালটি যেহেতু ১৮ দলের কর্মসূচি, তাই শেষ মুহূর্তে জোটের নেতাদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়ার সময় নেই। তাই হরতাল শেষে যে কোন সময়, যে কোন জায়গায় তিনি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলতে প্রস্তুত। কিন্তু অনেকেই একমত যে, প্রধানমন্ত্রীর ফোনের কারণে যদি তাৎক্ষণিক বিএনপি নেত্রী হরতাল তুলে নিতে তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিতে পারতেন, তাহলে প্রচারণার পাল্লা তার দিকেই বেশি ঝুঁকতো। অবশ্য কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘোলাটে হয়ে যায় পরিস্থিতি। লিক হয়ে যায় কিংবা লিক করে দেয়া হয় দুনেত্রীর সংলাপ। প্রধানমন্ত্রী অভিযোগ করেন দুপুরে লাল টেলিফোনে ফোন দিলেও খালেদা জিয়া ধরেননি। জবাবে খালেদা জিয়া বলেন, তার লাল ফোন অনেক দিন ধরেই বিকল। এ নিয়ে শুরু হওয়া বিতর্কটির সঙ্গে যুক্ত হয় আরও কিছু ইস্যু এবং ৪০ মিনিটের বক্তব্যটি শেষ হয় রাগারাগির মধ্য দিয়েই। রাজনৈতিক নেতারা মনে করেন, সেদিন সহিষ্ণু আচরণের মধ্য দিয়ে হরতাল কর্মসূচি প্রত্যাহার করে প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ রক্ষা করলে পরিস্থিতি ইতিবাচক মোড় নিতে পারতো। সেখানেই শেষ নয়, টেলিফোন সংলাপের পর ২০১৩ সালের ৩রা নভেম্বর বিরোধী দলের প্রতি নির্বাচনীকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তাব দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেন, ‘কোন মিনিস্ট্রি চান। আপনি আসেন, কোন কোন মন্ত্রণালয় চান- আলোচনা করে আমরা ঠিক করি।’ কিন্তু পরদিনই আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনের দিকে এগোচ্ছে দাবি করে নির্বাচনকালীন সর্বদলীয় সরকারে অংশ নেয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে বিএনপি। রাজনৈতিক মহলের মতে, নির্বাচনকালীন সরকারে অংশ নিয়ে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয় চাইতে পারতো বিএনপি। সেখানে তারা কাজ করতে না পারলে শেষ মুহূর্তে সরে আসারও সুযোগ ছিল। এতে তাদের ওপর একগুঁয়েমির অভিযোগটি প্রতিষ্ঠা পেতো না। দেশভাগের আগে কংগ্রেসের সঙ্গে এরকম একটি কোয়ালিশন সরকার গড়তে রাজি হয়েছিলেন জিন্নাহ। লিয়াকত আলী খান (পরে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী) পেয়েছিলেন অর্থমন্ত্রণালয় এবং কংগ্রেস অভিযোগ করেছিল যে, মুসলিম লীগ তাদের সিদ্ধান্ত আটকে দিচ্ছে। সুতরাং দৃষ্টান্ত যে ছিল না, তা নয়।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা মত রয়েছে। একইভাবে ভিন্নমত রয়েছে ২০১৪ সালে অনুষ্ঠিত ১০ম জাতীয় নির্বাচন নিয়েও। দলের নেতারা প্রকাশ্যে শীর্ষ নেতৃত্বের সিদ্ধান্তের পক্ষে যুক্তিতর্ক তুলে ধরলেও ঘরোয়া আলাপে এ সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা নিয়ে কথা বলেন। অনেকেই মনে করেন, ২০১৪ সালে শেখ হাসিনার অধীনেই নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিতে পারতো বিএনপি। এতে সরকারই চাপে পড়তো তাদের বিজয় নিয়ে এবং নতুন পথে হাঁটতো। নির্বাচন হলে ক্ষমতায় যেতে না পারলেও বিপুলসংখ্যক আসনে বিজয়ের মাধ্যমে শক্তিশালী বিরোধী দল হিসেবে কার্যকর চাপ তৈরি করতে পারতো সরকারের ওপর। ওই নির্বাচন বয়কট করে বিএনপি বিদেশী অতিথিদেরও বিব্রত করেছেন। কারণ অফিসিয়াল অপোজিশন হিসেবে বিএনপির পরিবর্তে জাতীয় পার্টি ও তার নেত্রী রওশন এরশাদকেই তাদের গুরুত্ব দিতে হয়।
২০০৬ সালে আওয়ামী লীগ যে কৌশলটি নিয়েছিল তার থেকে কোন শিক্ষাই নিতে পারেনি বিএনপি। আবার ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ না নেয়ার ব্যাপারে কঠোর অবস্থান নিয়েছিলেন তৎকালীন মহাসচিব খোন্দকার দেলোয়ার হোসেন। নির্বাচনের ৫ দিন আগে বিএনপির আরেক নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বরাত দিয়ে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত জেমস এফ মরিয়ার্টির এক তারবার্তায় দেখা যায়, বিএনপি নেতারা অভিযোগ করছেন, এ নির্বাচনে ভোটে নয়, সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পছন্দের ব্যক্তিদের জয়ী করানো হবে। সে নির্বাচনে অংশগ্রহণের বিষয়টির চেয়েও সিদ্ধান্ত গ্রহণে দ্বিধাদ্বন্দ্ব বিএনপিকে দুর্বল করেছিল। কারণ বিএনপি শেষ মুহূর্তে অপ্রস্তুত অবস্থায় সাড়া দিয়েছিল। এর ফলে নেতারা ঠিকমতো প্রস্তুতি নিতে পারেননি নির্বাচনে অংশগ্রহণের।
নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলনের বৃহত্তর প্লাটফরম গড়ে তুলতে জোটের পরিধি বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। ২০১৩-১৪ সালে একের পর এক রাজনৈতিক দল যুক্ত হয় বিএনপি জোটে। চারদলীয় জোট ১৪, ১৮ ও ২০ দলে পরিণত হয়। কিন্তু জোটের বেশির ভাগ দলই ব্যক্তি ও নামসর্বস্ব। জোটের অর্ধেক দলেরই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। কর্মী-সমর্থন, সংগঠন ও জনপ্রিয়তার দিক থেকেও বেশির ভাগ দলের উল্লেখযোগ্য কোন অবস্থান নেই। একপর্যায়ে জোটের শরিক দলের মধ্যেই তৈরি হয় মনকষাকষি। প্রগতিপন্থি ও ইসলামপন্থি পরস্পরবিরোধী দলগুলো বাস্তবিক অর্থে ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। এছাড়া জোটের নেতাদের সামনের আসনে বসাতে গিয়ে বিএনপির গুরুত্বপূর্ণ ও বর্ষীয়ান নেতাদের পেছনে চলে যেতে হয়। সভা-সমাবেশসহ সবখানেই এটা নিয়ে বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মধ্যে তৈরি হয় অসন্তোষ। সাম্প্রতিক সময়ে এ অসন্তোষের বিষয়টি আরও সামনে চলে এসেছে।
অন্যদিকে মনোমালিন্য কমলেও দলে বা জোটে ফেরানো যায়নি বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা মহাসচিব প্রফেসর ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরীসহ অনেক প্রভাবশালী নেতাকে। জিয়ার জন্মদিনে অধ্যাপক চৌধুরীকে প্রধান অতিথি করে বেগম খালেদা জিয়া মঞ্চে না বসে দর্শকের গ্যালারিতে বসেছিলেন। এটা ভাল নজির হয়েছে। কিন্তু তাঁকে দলে টেনে আনার সঙ্গে যে জটিলতা আছে তা দূর করতে যে ধরনের সাহসী পদক্ষেপ নিতে হবে, তার কোন লক্ষণ নেই।
এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের সময় সংস্কার প্রক্রিয়ায় যুক্ত নেতাদের ব্যাপারে আওয়ামী লীগের কৌশলও কাজে লাগাতে পারেনি দলটি। সংস্কারপন্থি নেতাদের মধ্যে প্রভাবশালীরা অন্তর্কোন্দলের কারণে দলে ফিরতে পারেননি। ফলে বিএনপি সীমিত হলেও একটি শক্তিকে হাতছাড়া করেছে। আবার ২০ দলের আন্দোলন চলাকালে যুক্তরাজ্যে রাজনৈতিক ইস্যুতে একাধিক বক্তৃতা-বিবৃতি দেন বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে তার কিছু বক্তব্যও বিতর্ক তৈরি করে।
১৫ই আগস্ট ইস্যুটি বিএনপির রাজনীতিতে আরেকটি ভুল হিসেবে বিবেচনা করেছেন রাজনৈতিক ও কূটনীতিক মহল। শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুর কারণে দিনটি আওয়ামী লীগের কাছে যেখানে শোকের সেখানে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার জন্মদিন হিসেবে আনন্দের উপলক্ষ হিসেবে পালন করে বিএনপি। এ ব্যাপারে দেশের রাজনৈতিক ও সুধী সমাজের তরফে নানা অনুরোধও গ্রাহ্য করেনি বিএনপি। এক তারবার্তায় মরিয়ার্টি লিখেছেন, ‘১৫ই আগস্টই বিএনপি ও আওয়ামী লীগের বিভাজন রেখা, এটাই বিরোধের উৎস। ৩৪ বছর পরেও এটা বাংলাদেশকে বিভক্ত রেখেছে। এ নিয়ে শেখ হাসিনা ও খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন দুই দলের মধ্যকার তিক্ততাই গত দুদশকের বাংলাদেশের রাজনীতিকে সংজ্ঞায়িত করেছে। আমরা আশা করি, এ ইস্যুতে উভয় পক্ষের বিতর্ক থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকার নিজকে প্রত্যাহার করে নেবে।’ অথচ তারেক রহমানের বঙ্গবন্ধুর মাজার জিয়ারত ও আওয়ামী লীগ সরকার বঙ্গবন্ধু হত্যার এজাহার থেকে জিয়াউর রহমানের নাম বাদ দেয়ার মাধ্যমে বিএনপি-আওয়ামী লীগের সম্পর্কে নতুন এক মাত্রা যোগ হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, যা শেষ পর্যন্ত অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়েছে। ৫ম সংসদে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিলে সামাদ আজাদ-বি. চৌধুরী কিছুটা আলোচনা এগিয়েছিল। এমনকি তখন দেশের বহু স্থানে শিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্রদল ও ছাত্রলীগ একসঙ্গে লড়াই করেছে। বিএনপির এমপিরাও জামায়াত নিষিদ্ধের দাবি তুলেছেন সংসদের ফ্লোরেই। রাজনীতির সেই ধারাটা বেগবান বা আর ফেরানোর সুযোগ জামায়াত আওয়ামী লীগের সঙ্গে আন্দোলন করে নির্মূল করতে সক্ষম হয়েছিল বলেও অনেকে মনে করেন।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলের অনির্দিষ্টকালের অবরোধ চলাকালে নিজ কার্যালয়ে অবরুদ্ধ দিন কাটাচ্ছিলেন খালেদা জিয়া। এ সময় তার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক বিরোধের ভেতরেও শোক জানাতে খালেদা জিয়ার কার্যালয়ে ছুটে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কিন্তু খালেদা জিয়া অসুস্থতার দোহাই দিয়ে বিএনপি নেতা ও চেয়ারপারসন কার্যালয়ের কর্মকর্তারা অভ্যর্থনা জানাননি প্রধানমন্ত্রীকে। কার্যালয়ের সামনে কয়েক মিনিট অপেক্ষা শেষে ফিরে যান শেখ হাসিনা। কিন্তু সেদিন প্রধানমন্ত্রী ও বিএনপি চেয়ারপারসনের দেখা হওয়ার দৃশ্যটি দেখতে টেলিভিশনের সামনে অপেক্ষা করছিলেন গোটা দেশের মানুষ। দুই নেত্রীর মধ্যে সাক্ষাৎ হলে বা সেদিন প্রধানমন্ত্রীকে অন্তত কার্যালয়ে অভ্যর্থনা জানালে পরিস্থিতি উত্তরণে সরকারের ওপর একটি নৈতিক চাপ তৈরি হতো। এ ঘটনাকে বিএনপির রাজনৈতিক ইতিহাসে নির্বুদ্ধিতা ও শিষ্টাচার লঙ্ঘনের একটি ক্ষতচিহ্ন হিসেবে দেখছে রাজনৈতিক মহল।
No comments