সিভিল সোসাইটির একাল-সেকাল by উৎপল রায় ও সিরাজুস সালেকিন
দুই
শিবিরে বিভক্ত বাংলাদেশ। সিভিল সোসাইটিও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও হয়ে গেছেন
বিভক্ত। কমে যাচ্ছে নির্জলা সত্য বলার মানুষ। নেই তেমন কোন জাতীয় মুরব্বি।
ব্যতিক্রম যে নেই তাও নয়। তবুও বিভক্তির কবলে পড়েছে মানুষের বিশ্বাস। কী
ভাবছেন জাতির বিবেক বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সোসাইটির প্রতিনিধিরা?
ধারাবাহিকভাবে এ প্রশ্নের জবাব খুঁজছে মানবজমিন। আজ ছাপা হলো দ্বিতীয় পর্ব-
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সোসাইটি এক নয়। সিভিল সোসাইটিকে সমাজের একটি অংশ বলা হলেও আমি মনে করি সিভিল সোসাইটি বলে কিছু নেই। কাউকে দেখতেও পাই না। এর বদলে কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও এনজিও আছে। যারা বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য- বিবৃতি দেয়, আন্দোলন করে। সিভিল সোসাইটি বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর কোন ভিত্তি আদৌ দেখি না। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মতবাদ একটা জায়গা থেকে আসছে না। বিভিন্নভাবে বিভিন্নজন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে না। সুশীল সমাজের একীভূত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সবার দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, চেতনা আলাদা। রাজনীতিও সবক্ষেত্রেই থাকবে। কেউ এ দল করছে। কেউ ও দল করছে। তাই মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে বিক্ষিপ্ত মনোভাব থাকতেই পারে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোই একসঙ্গে থাকতে পারে না, তারা (সুশীল সমাজ) ঐক্যবদ্ধ থাকবে কিভাবে? আর যদি তারা একীভূত হয়েই যায় তাহলে তো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোন তফাৎ থাকে না। তারাও রাজনৈতিক দল হয়ে যায়।
গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এবিষয়ে বলেন, ‘সুশীল সমাজ’ কথাটি ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ নয়। এ জন্য যে, এই কথাটি কোন অর্থবহন করে না। যাকে ‘সিভিল সোসাইটি’ বলা হয় তার বাংলা প্রতিশব্দ সুশীল সমাজ হয় না। হয় নাগরিক সমাজ। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ সবক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নিরপেক্ষ। নাগরিক সমাজের নেতা বা সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন। তারা কারও কাছে দায়বদ্ধ নন। তবে মতপার্থক্য থাকতেই পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্য, ন্যায় ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটা উচিত নয়-যা বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমাদের নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি বলতে যা বুঝায় আর তাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য তা ব্যক্তিগত স্বার্থকে কেন্দ্র করে। আমাদের নাগরিক সমাজের অনেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেন না। এদের অনেকেই আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া বাংলাদেশে সরকার সমর্থক যে বিশাল কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, নাট্য কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আছেন তাদের সমর্থন পেয়ে সরকার অনেক সময় অগণতান্ত্রিক আচরণ করে। সেই জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের যারা কথা বলেন তাদের থামিয়ে দেন সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সরকারি নেতারা। তিনি আরও বলেন, ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকদের পক্ষে বাহুবলের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতি ক্যাডারনির্ভর। ক্যাডারদের সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিক সমাজের নেতারা লড়াই করতে পারে না। তাই সুবিধাবাদীদের সঙ্গে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে নাগরিক সমাজের মিল না হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং নাগরিক সমাজের সরকারপন্থি ও সরকারবিরোধী বিভক্তি থাকাটাই স্বাভাবিক।
মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, দেশের বিভিন্ন অর্জনে সুশীল সমাজের একটা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের সুশীল সমাজ এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কারণেই সুশীল সমাজ এমন হয়ে গেছে। তারা এত বেশি বিভক্ত হয়ে গেছে যে, বর্তমানে যে চিন্তাধারায় তারা বিশ্বাসী সেই চিন্তাধারা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে না। কিন্তু এটা কোনমতেই হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা মানুষ তাই আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে, চিন্তাধারা ভিন্ন হতে পারে। আমি যেটা চিন্তা করি সেটা অন্য কেউ চিন্তা নাও করতে পারে। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে জাতীয় ইস্যুতে আমাদের এক হতে হবে। সিগমা হুদা আরও বলেন, দেশে গুম খুন হচ্ছে কেন? ক্রসফায়ার কেন হচ্ছে? ট্রাফিক জ্যাম কেন কমানো যাচ্ছে না? সুশীল সমাজ যদি মুখপাত্র হয়ে থাকে তাহলে দেশবাসীর কাছে তারা তা তুলে ধরবে। কিন্তু কেন যেন এমনটি হচ্ছে না? সিগমা হুদা বলেন, কিছু ভাল কাজ করতে গেলে একপক্ষের ক্ষতি হবে। অন্যপক্ষ লাভবান হবে। কিন্তু দেশকে যদি রক্ষা করতেই হয়, দেশের ভালোর জন্য যে কাজটি সঠিক, সেই কাজটিই সিভিল সোসাইটিকে করতে হবে। তাদের বলতে হবে যে, আমরা যদি দেশকে রক্ষা করতে চাই তাহলে সঠিক কথা বলা ও এই ভাল কাজটি আমাদের করতেই হবে। না করলে দেশ ও জনগণের ক্ষতি হবে।
সুশীল সমাজের বিভাজনের জন্য রাজনৈতিক বিভাজনকে দায়ী করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন জনগণই তো দুইভাগে বিভক্ত। সেভাবেই নাগরিক সমাজের বিভক্তিটা হয়ে গেছে। সকল ক্ষেত্রে এই বিভাজনটা হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সিভিল সার্ভেন্ট সব ক্ষেত্রে। কিন্তু সবাই প্রকাশ করে না। কারণ তাদের প্রকাশ করলে সমস্যা আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা কয়েকজন মুষ্টিমেয় আছি। যারা কোন দলের বিরোধিতা করি না। কোন লেজুড়বৃত্তি করি না। কিন্তু আমাদের ভয়েস তো খুব কম। এটাই সমস্যা আর কি। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য গণমাধ্যমের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, আমাদের আরও চেষ্টা করতে হবে। আমরা যারা নিরপেক্ষ দেশের জন্য চিন্তা করি। কারও ক্ষমতায় আনার জন্য বা ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য নয়। দেশে যে বিভাজন হয়েছে সেটা যারা সমর্থন করে না তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে গণমাধ্যমকে ভূমিকা রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশে সুশীল সমাজের সংজ্ঞাতেই সমস্যা আছে। মূলত সুশীল সমাজকে সংজ্ঞায়িত করলে দেখা যাবে আসলে কোন বিভক্তি নেই। সুশীল সমাজের মধ্যে যারা এই সরকারের আমলে বা আগের সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন, অথবা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছে অথবা টেলিভিশনের লাইসেন্স পেয়েছেন, অথবা অর্থবিত্ত, ব্যবসা-বাণিজ্য বিভিন্ন সরকারের আমলে পেয়েছেন তারা সিভিল সোসাইটির ভান ধরে থাকেন। তারা আসলে পার্টি দলের রাজনীতিই বহন করেন। শত নাগরিক কমিটি ও সহস্র নাগরিক কমিটির বহুলোক আছেন যারা সিভিল সোসাইটির মধ্যে পড়েন না। তারা আসলে পলিটিক্যাল সোসাইটি। তারা রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে বিভক্তি আছে। যেটা আগেও ছিল। তিনি আরও বলেন, নিঃস্বার্থভাবে যারা সকল সরকারের অন্যায়ের সম্পর্কে কথা বলে তাদের মধ্যে কোন বিভক্তি আসেনি। তারা সকল সময় ইস্যুভিত্তিক সরকারের সমালোচনা করেন। কোন সরকার ক্ষমতায় এটা তাদের বিবেচনার বিষয় না। যেটা খাটি সুশীল সমাজ সেটা রাজনৈতিক সমাজের অংশ হয় না। এর মধ্যে কোন বিভক্তি আসেনি।
সরকারের দমন নীতির কারণে প্রকৃত সুশীল সমাজ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রকৃত সুশীল সমাজের মধ্যে বিভক্তি আসেনি। প্রকৃত সুশীল সমাজের একটা অংশ সরকারের দমন-নীতির কারণে, বিভিন্ন আইনের কারণে সরকারের বিভিন্ন হয়রানির কারণে নিষ্ক্রিয়, হতবুদ্ধি ও নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। এজন্য মনে হয় তাদের শক্তি কমে গেছে। আগে কখনই কোন গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ভিন্নমত পোষণের জন্য, বাক স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্য এই পরিমাণ দমন-নিপীড়ন বা ভোগান্তির শিকার হতে হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেন্দ্র করে সুশীল সমাজের বিভাজন হয়েছে বলে মনে করেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের এ বিভাজন সকল সময়ে ছিল। যে যার জায়গা থেকে চিন্তা করে। তবে এ বিভাজন মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। একটা সুশীল সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আবার কারও কারও অবস্থান ভিন্ন। এছাড়া এনজিও ও ননএনজিও সুশীল সমাজ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই বিভাজনের মাঝখানে নিরপেক্ষ কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমিরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, বুদ্ধিজীবী ও সিভিল সোসাইটি এক নয়। সিভিল সোসাইটিকে সমাজের একটি অংশ বলা হলেও আমি মনে করি সিভিল সোসাইটি বলে কিছু নেই। কাউকে দেখতেও পাই না। এর বদলে কিছু ব্যক্তি, সংগঠন ও এনজিও আছে। যারা বিভিন্ন ইস্যুতে বক্তব্য- বিবৃতি দেয়, আন্দোলন করে। সিভিল সোসাইটি বলে ধারণা তৈরি হয়েছে। কিন্তু এর কোন ভিত্তি আদৌ দেখি না। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের মতবাদ একটা জায়গা থেকে আসছে না। বিভিন্নভাবে বিভিন্নজন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করছে না। সুশীল সমাজের একীভূত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই উল্লেখ করে প্রবীণ এই শিক্ষাবিদ বলেন, তাদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার কোন সুযোগ নেই। সবার দৃষ্টিভঙ্গি, চিন্তা, চেতনা আলাদা। রাজনীতিও সবক্ষেত্রেই থাকবে। কেউ এ দল করছে। কেউ ও দল করছে। তাই মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে বিক্ষিপ্ত মনোভাব থাকতেই পারে। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী আরও বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোই একসঙ্গে থাকতে পারে না, তারা (সুশীল সমাজ) ঐক্যবদ্ধ থাকবে কিভাবে? আর যদি তারা একীভূত হয়েই যায় তাহলে তো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাদের কোন তফাৎ থাকে না। তারাও রাজনৈতিক দল হয়ে যায়।
গবেষক, প্রাবন্ধিক, কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ এবিষয়ে বলেন, ‘সুশীল সমাজ’ কথাটি ব্যক্তিগতভাবে আমার পছন্দ নয়। এ জন্য যে, এই কথাটি কোন অর্থবহন করে না। যাকে ‘সিভিল সোসাইটি’ বলা হয় তার বাংলা প্রতিশব্দ সুশীল সমাজ হয় না। হয় নাগরিক সমাজ। তিনি বলেন, নাগরিক সমাজ সবক্ষেত্রেই প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন নিরপেক্ষ। নাগরিক সমাজের নেতা বা সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীন। তারা কারও কাছে দায়বদ্ধ নন। তবে মতপার্থক্য থাকতেই পারে এবং থাকাটাই স্বাভাবিক। কিন্তু সত্য, ন্যায় ও জনগণের স্বার্থের প্রশ্নে তাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকাটা উচিত নয়-যা বাংলাদেশে লক্ষ্য করা যায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, আমাদের নাগরিক সমাজ বা সিভিল সোসাইটি বলতে যা বুঝায় আর তাদের মধ্যে যে মতপার্থক্য তা ব্যক্তিগত স্বার্থকে কেন্দ্র করে। আমাদের নাগরিক সমাজের অনেকেই ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে জাতীয় স্বার্থ ও জনগণের স্বার্থকে বড় করে দেখেন না। এদের অনেকেই আধা সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত। তাছাড়া বাংলাদেশে সরকার সমর্থক যে বিশাল কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, নাট্য কর্মী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আছেন তাদের সমর্থন পেয়ে সরকার অনেক সময় অগণতান্ত্রিক আচরণ করে। সেই জনবিরোধী কাজের বিরুদ্ধে নাগরিক সমাজের যারা কথা বলেন তাদের থামিয়ে দেন সরকারপন্থি বুদ্ধিজীবী ও সরকারি নেতারা। তিনি আরও বলেন, ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিকদের পক্ষে বাহুবলের সঙ্গে লড়াই করা সম্ভব নয়। কারণ আমাদের দেশের রাজনীতি ক্যাডারনির্ভর। ক্যাডারদের সঙ্গে ভিন্নমতাবলম্বী নাগরিক সমাজের নেতারা লড়াই করতে পারে না। তাই সুবিধাবাদীদের সঙ্গে ন্যায় ও সত্যের পক্ষে নাগরিক সমাজের মিল না হওয়াই স্বাভাবিক। সুতরাং নাগরিক সমাজের সরকারপন্থি ও সরকারবিরোধী বিভক্তি থাকাটাই স্বাভাবিক।
মানবাধিকার নেত্রী এডভোকেট সিগমা হুদা বলেন, দেশের বিভিন্ন অর্জনে সুশীল সমাজের একটা বড় ভূমিকা আছে। কিন্তু এটা অত্যন্ত দুঃখজনক যে আমাদের সুশীল সমাজ এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। রাজনৈতিক কারণেই সুশীল সমাজ এমন হয়ে গেছে। তারা এত বেশি বিভক্ত হয়ে গেছে যে, বর্তমানে যে চিন্তাধারায় তারা বিশ্বাসী সেই চিন্তাধারা থেকে তারা বেরিয়ে আসতে পারছে না। কিন্তু এটা কোনমতেই হওয়া উচিত নয়। তিনি বলেন, যেহেতু আমরা মানুষ তাই আমাদের মধ্যে মতপার্থক্য থাকতে পারে, চিন্তাধারা ভিন্ন হতে পারে। আমি যেটা চিন্তা করি সেটা অন্য কেউ চিন্তা নাও করতে পারে। কিন্তু দেশ ও জনগণের স্বার্থে জাতীয় ইস্যুতে আমাদের এক হতে হবে। সিগমা হুদা আরও বলেন, দেশে গুম খুন হচ্ছে কেন? ক্রসফায়ার কেন হচ্ছে? ট্রাফিক জ্যাম কেন কমানো যাচ্ছে না? সুশীল সমাজ যদি মুখপাত্র হয়ে থাকে তাহলে দেশবাসীর কাছে তারা তা তুলে ধরবে। কিন্তু কেন যেন এমনটি হচ্ছে না? সিগমা হুদা বলেন, কিছু ভাল কাজ করতে গেলে একপক্ষের ক্ষতি হবে। অন্যপক্ষ লাভবান হবে। কিন্তু দেশকে যদি রক্ষা করতেই হয়, দেশের ভালোর জন্য যে কাজটি সঠিক, সেই কাজটিই সিভিল সোসাইটিকে করতে হবে। তাদের বলতে হবে যে, আমরা যদি দেশকে রক্ষা করতে চাই তাহলে সঠিক কথা বলা ও এই ভাল কাজটি আমাদের করতেই হবে। না করলে দেশ ও জনগণের ক্ষতি হবে।
সুশীল সমাজের বিভাজনের জন্য রাজনৈতিক বিভাজনকে দায়ী করেছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা এম হাফিজ উদ্দিন খান। তিনি বলেন, আমরা রাজনৈতিক বিভাজনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। এখন জনগণই তো দুইভাগে বিভক্ত। সেভাবেই নাগরিক সমাজের বিভক্তিটা হয়ে গেছে। সকল ক্ষেত্রে এই বিভাজনটা হয়েছে। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, সিভিল সার্ভেন্ট সব ক্ষেত্রে। কিন্তু সবাই প্রকাশ করে না। কারণ তাদের প্রকাশ করলে সমস্যা আছে। তিনি আরও বলেন, আমরা কয়েকজন মুষ্টিমেয় আছি। যারা কোন দলের বিরোধিতা করি না। কোন লেজুড়বৃত্তি করি না। কিন্তু আমাদের ভয়েস তো খুব কম। এটাই সমস্যা আর কি। সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য গণমাধ্যমের সহায়তা কামনা করেন। তিনি বলেন, আমাদের আরও চেষ্টা করতে হবে। আমরা যারা নিরপেক্ষ দেশের জন্য চিন্তা করি। কারও ক্ষমতায় আনার জন্য বা ক্ষমতা থেকে নামানোর জন্য নয়। দেশে যে বিভাজন হয়েছে সেটা যারা সমর্থন করে না তাদের ঐক্যবদ্ধ করতে গণমাধ্যমকে ভূমিকা রাখতে হবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল বলেন, আমাদের দেশে সুশীল সমাজের সংজ্ঞাতেই সমস্যা আছে। মূলত সুশীল সমাজকে সংজ্ঞায়িত করলে দেখা যাবে আসলে কোন বিভক্তি নেই। সুশীল সমাজের মধ্যে যারা এই সরকারের আমলে বা আগের সরকারের আমলে বিভিন্নভাবে সুবিধাপ্রাপ্ত হয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হয়েছেন, অথবা কমিশনের চেয়ারম্যান হয়েছে অথবা টেলিভিশনের লাইসেন্স পেয়েছেন, অথবা অর্থবিত্ত, ব্যবসা-বাণিজ্য বিভিন্ন সরকারের আমলে পেয়েছেন তারা সিভিল সোসাইটির ভান ধরে থাকেন। তারা আসলে পার্টি দলের রাজনীতিই বহন করেন। শত নাগরিক কমিটি ও সহস্র নাগরিক কমিটির বহুলোক আছেন যারা সিভিল সোসাইটির মধ্যে পড়েন না। তারা আসলে পলিটিক্যাল সোসাইটি। তারা রাজনৈতিক দলের মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন। তাদের মধ্যে বিভক্তি আছে। যেটা আগেও ছিল। তিনি আরও বলেন, নিঃস্বার্থভাবে যারা সকল সরকারের অন্যায়ের সম্পর্কে কথা বলে তাদের মধ্যে কোন বিভক্তি আসেনি। তারা সকল সময় ইস্যুভিত্তিক সরকারের সমালোচনা করেন। কোন সরকার ক্ষমতায় এটা তাদের বিবেচনার বিষয় না। যেটা খাটি সুশীল সমাজ সেটা রাজনৈতিক সমাজের অংশ হয় না। এর মধ্যে কোন বিভক্তি আসেনি।
সরকারের দমন নীতির কারণে প্রকৃত সুশীল সমাজ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে দাবি করে তিনি বলেন, প্রকৃত সুশীল সমাজের মধ্যে বিভক্তি আসেনি। প্রকৃত সুশীল সমাজের একটা অংশ সরকারের দমন-নীতির কারণে, বিভিন্ন আইনের কারণে সরকারের বিভিন্ন হয়রানির কারণে নিষ্ক্রিয়, হতবুদ্ধি ও নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। এজন্য মনে হয় তাদের শক্তি কমে গেছে। আগে কখনই কোন গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে ভিন্নমত পোষণের জন্য, বাক স্বাধীনতা প্রয়োগের জন্য এই পরিমাণ দমন-নিপীড়ন বা ভোগান্তির শিকার হতে হয়নি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে কেন্দ্র করে সুশীল সমাজের বিভাজন হয়েছে বলে মনে করেন ইন্ডিপেন্ডেন্ট ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ও সুচিন্তা ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এ আরাফাত। তিনি বলেন, সুশীল সমাজের এ বিভাজন সকল সময়ে ছিল। যে যার জায়গা থেকে চিন্তা করে। তবে এ বিভাজন মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। একটা সুশীল সমাজ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে। আবার কারও কারও অবস্থান ভিন্ন। এছাড়া এনজিও ও ননএনজিও সুশীল সমাজ রয়েছে। তিনি আরও বলেন, এই বিভাজনের মাঝখানে নিরপেক্ষ কিছু বলার সুযোগ নেই। তবে সকল কিছুর ঊর্ধ্বে থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে হবে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না।
No comments