রাজনৈতিক সহিংসতা- ক্ষমতায় থেকেও খুনোখুনি by শরিফুজ্জামান
গত
ছয় বছরে (২০০৯-১৪) সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও
ছাত্রলীগের অন্তত ১৭২ জন নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও
চরমপন্থীদের হাতে খুন হয়েছেন আরও ৭৪ জন। ২০০৯ থেকে এ বছরের নভেম্বর
পর্যন্ত ক্ষমতায় থেকেও দলটি এই ২৪৬ নেতা-কর্মীকে রক্ষা করতে পারেনি। মানবাধিকার
সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) তথ্য সংরক্ষণ ইউনিট, প্রথম আলোর ৬৪
জেলা প্রতিনিধির সংগৃহীত তথ্য, প্রথম আলোয় প্রকাশিত এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন
এবং সার্চ ইঞ্জিন গুগলের মাধ্যমে পাওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই ও বিশ্লেষণ করে
অভ্যন্তরীণ কোন্দলের এ চিত্র পাওয়া গেছে। এসব হত্যার পাশাপাশি দলীয়
কোন্দলে সৃষ্ট সংঘর্ষে ছয় বছরে আহত ব্যক্তির সংখ্যা ছিল ১৩ হাজার ৬৯১।
এঁদের প্রায় সবাই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। এই সময়ে নিজেদের মধ্যে সহিংস
ঘটনা ঘটেছে ১ হাজার ১১১টি। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকতে দলের এত
বেশিসংখ্যক নেতা-কর্মী খুন হওয়ার বিষয়টি দলের নীতিনির্ধারকদের ভাবিয়ে
তুললেও খুনের এ মিছিল থামছে না। কয়েক দিন পর পর দেশের কোথাও না কোথাও
দলীয় কোন্দলে নিহত হচ্ছেন সংগঠনের নেতা-কর্মীরা। আর এ ক্ষেত্রে এগিয়ে আছে
ছাত্রলীগ। গত ছয় বছরে অভ্যন্তরীণ কোন্দলে ছাত্রলীগের ৪০ নেতা-কর্মী নিহত
হলেও এসব ঘটনায় দায়ের করা মামলাগুলোর প্রায় সব কটিই তদন্ত পর্যায়ে আটকে
আছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগের গত মেয়াদের
(২০০৯-১৩) প্রথম বছরের তুলনায় বর্তমান মেয়াদের প্রথম বছরে দলীয় কোন্দল ও
বিরোধ আরও বেড়েছে। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর প্রথম এক বছরে
দলীয় কোন্দলে খুন হয়েছিলেন সংগঠনটির ২০ নেতা-কর্মী। আর ২০১৪ সালে
ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ১১ মাসে খুন হয়েছেন কমপক্ষে ৩২ নেতা-কর্মী। এ সময়
নিজেদের মধ্যে ১৪৫ বার মারামারি হয়েছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী
লীগের একজন কেন্দ্রীয় নেতা প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের
মেয়াদে বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের প্রায় ২০০ নেতা-কর্মী খুন
হয়েছিলেন। এখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায়। কিন্তু নিজেদের কোন্দলে একদিকে
খুন হচ্ছে, অন্যদিকে বিচারও হচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রের যুগসন্ধিক্ষণ চলছে। রাজনৈতিক দল, সরকার, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। এর অভাবে এবং অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রে ঘাটতি থাকায় এ ধরনের সহিংসতা চলছে।
বিএনপির ঘাঁটিতে আ.লীগের কোন্দলে খুনোখুনি: বগুড়া জেলা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ জেলায় খুনোখুনি হচ্ছে সরকারদলীয় নেতাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। গত প্রায় ছয় বছরে সেখানে আওয়ামী লীগের ৩৬ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৩১ জনই দলীয় কোন্দলে। বাকি পাঁচজন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের হাতে খুন হয়েছেন।
বগুড়ায় ৩৬ জন খুন হলেও সেখানকার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ভেতরে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের নেতা শিমুল হক হত্যাকাণ্ড ছাড়া পুলিশ আর কোনো ঘটনাকেই রাজনৈতিক বলতে রাজি নয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী খুন হলেও বেশির ভাগ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, জমি দখল, দরপত্র নিয়ে বিরোধ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিরোধ।
বগুড়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম জানান, দলের নেতা-কর্মী খুন হলে বিচার না হওয়াটা দুঃখজনক। তবে রাজনৈতিক কারণে নয়, আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন।
অস্থির জেলা: নারায়ণগঞ্জে কাগজে-কলমে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হলেও এগুলো ছিল চাঞ্চল্যকর। এর একটি হচ্ছে বাবার ওপর আক্রোশ মেটাতে শিশুপুত্র ও মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড। অপরটি ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড। দুটি হত্যাকাণ্ডেই সন্দেহের তির ওসমান পরিবারের দিকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ত্বকী হত্যার তদন্ত করছে র্যাব। আর মিঠু হত্যার অভিযোগপত্র দাখিল হলেও বিচার শুরু হয়নি। তবে আলোচিত সাত খুনের ঘটনা র্যাব ঘটালেও এর পেছনেও সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে।
এক জেলায় এক ডজন খুন: নরসিংদী জেলায় সরকারদলীয় কোন্দলে নিহতের সংখ্যা এক ডজন। নরসিংদী সদর আসনের সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতাসীন দলের হয়েও হত্যার শিকার হওয়াটা দুঃখজনক। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই রাজনৈতিক কারণে নয়, ব্যক্তিগত বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঘটছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় খুনোখুনির সংখ্যা টাঙ্গাইলে কম। তবে সেখানে ‘খান পরিবার’ টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আসায় খান পরিবারের বর্তমান সাংসদ আমানুর রহমান খানসহ তাঁরা চার ভাই পলাতক রয়েছেন।
মেহেরপুরে ছয় বছরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন পাঁচ নেতা-কর্মী। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মিয়াজান আলী প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত রাজনীতির চেয়ে ক্ষমতার স্বাদ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এ জন্য তাঁরা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে খুনের মতো জঘন্য কাজ করছেন।
শরীয়তপুরে নিহত ১২ জনের সবাই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। সবাই খুন হয়েছেন দলীয় কোন্দলে। জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মূলত এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
শরীয়তপুর সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি লোকমান মাতবর দলীয় কোন্দলে খুন হলেও বিচার পাচ্ছেন না তাঁর স্ত্রী ফরিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে বিপদে আছি। হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর আমাদের হুমকি দিচ্ছেন।’
বিচার পাচ্ছে না নিহতের পরিবার: প্রথম আলোর ৬৪ জেলা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ক্ষমতায় থাকলেও সরকারি দলের নিহত নেতাদের পরিবার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিচার পাওয়া দূরে থাক, উল্টো অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ ধরনের মামলার শেষ কোথায় কেউ জানে না। অধিকাংশ ঘটনার কথিত তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র জমা দিতেই কেটে যাচ্ছে তিন থেকে পাঁচ বছর। এতে বিচারপ্রার্থীদের হতাশা, ক্ষোভ ও হাহাকার বাড়ছে।
গত কয়েক বছরে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে একমাত্র বিশ্বজিতের পরিবার বিচার পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে হত্যার পর এ নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের চাপে ঘটনাটি সরকারের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
তবে যুবলীগের কোন্দলে রাজধানীর আরেক আলোচিত হত্যাকাণ্ড রিয়াজুল হক (মিল্কি) হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত যুবলীগের দুই প্রভাবশালী নেতার নাম বাদ দিয়ে র্যাব অভিযোগপত্র দেওয়ায় গত ৯ জুন নিহতের ভাই আদালতে নারাজি আবেদন করেন। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদককে গত বছরের ২৯ জুলাই গুলশানে একটি বিপণিবিতানের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার দৃশ্য সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল।
আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবুবকর খুন হলেও সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন দলীয় কোন্দলে নিহত হলেও মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও খুলনার ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহীদ ইকবাল বিথার ২০০৯ সালের ১১ জুলাই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হওয়ার পর সাড়ে পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু বিচার হচ্ছে না।
এ ছাড়া পঞ্চগড়ে পুকুর ইজারাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল পৌর ছাত্রলীগের নেতা ফারুক হোসেন নিহত হন। চার দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর পঞ্চমবার সরকারি দলের ১৩ আসামির নাম বাদ দিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ-১০ আসনের সাংসদ গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদের ব্যক্তিগত সহকারী ও যুবলীগ নেতা মেহেদী হাছান ইলিয়াসকে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর সামনে হত্যা করে মাথা নিয়ে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় যুবলীগের একজন কর্মী র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেলেও তদন্ত এগোয়নি।
বান্দরবানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছোটন মল্লিক নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগের ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সবাই জামিনে আছেন।
গত ২৮ অক্টোবর মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাসে পৌর ছাত্রলীগ নেতা রাজন খানকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
দলীয় কোন্দলে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বুঝতে হবে, যোগ্যতার বদলে প্রভাব, চাপ বা তদবিরের মাধ্যমে দরপত্র পেলে এবং এ পাওয়ার কারণে সৃষ্ট বিরোধে তিনি যদি নিহত বা আহত হন, তাহলে তাঁর পরিবার বিচার পাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। এর ফলে নিহতের পরিবার বা স্বজনেরাই যে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন এমনটি নয়, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ঘাটতি প্রশাসনকেও গ্রাস করে। এই অবস্থায় প্রশাসনের ওপরও মানুষের আস্থা কমে যায়।
প্রথম আলো>>{তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আনোয়ার পারভেজ (বগুড়া), আকমল হোসেন (মৌলভীবাজার), আসাদুল্লাহ সরকার (দিনাজপুর), নেয়ামতউল্যাহ (ভোলা), হরি কিশোর চাকমা (রাঙামাটি), মীর মাহমুদুল হাসান (নীলফামারী), কামনাশীষ শেখর (টাঙ্গাইল), আসিফ হোসেন (নারায়ণগঞ্জ), তুহিন আরণ্য (মেহেরপুর), মনিরুজ্জামান (নরসিংদী), সুমন চক্রবর্তী (খুলনা), শহীদুল ইসলাম (পঞ্চগড়), কামরান পারভেজ (ময়মনসিংহ), বুদ্ধজ্যোতি চাকমা (বান্দরবান), সৈকত দেওয়ান (খাগড়াছড়ি), কবির হোসেন (মাগুরা), সত্যজিৎ ঘোষ (শরীয়তপুর) ও মুক্তার হোসেন (নাটোর)}
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর সদস্য সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত বলেন, বহুদলীয় গণতন্ত্র ও অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রের যুগসন্ধিক্ষণ চলছে। রাজনৈতিক দল, সরকার, গণমাধ্যমসহ সর্বত্রই গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির চর্চা নিশ্চিত করতে হবে। এর অভাবে এবং অন্তর্দলীয় গণতন্ত্রে ঘাটতি থাকায় এ ধরনের সহিংসতা চলছে।
বিএনপির ঘাঁটিতে আ.লীগের কোন্দলে খুনোখুনি: বগুড়া জেলা বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত। কিন্তু এ জেলায় খুনোখুনি হচ্ছে সরকারদলীয় নেতাদের মধ্যে আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে। গত প্রায় ছয় বছরে সেখানে আওয়ামী লীগের ৩৬ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন। এর মধ্যে ৩১ জনই দলীয় কোন্দলে। বাকি পাঁচজন প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের হাতে খুন হয়েছেন।
বগুড়ায় ৩৬ জন খুন হলেও সেখানকার আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের ভেতরে বঙ্গবন্ধু সৈনিক লীগের নেতা শিমুল হক হত্যাকাণ্ড ছাড়া পুলিশ আর কোনো ঘটনাকেই রাজনৈতিক বলতে রাজি নয়।
বগুড়ার পুলিশ সুপার মো. মোজাম্মেল হক প্রথম আলোকে বলেন, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী খুন হলেও বেশির ভাগ ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে আধিপত্য বিস্তার, জমি দখল, দরপত্র নিয়ে বিরোধ, মাদক ব্যবসা, অবৈধ বালু উত্তোলনসহ ব্যক্তিগত স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিরোধ।
বগুড়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি রেজাউল করিম জানান, দলের নেতা-কর্মী খুন হলে বিচার না হওয়াটা দুঃখজনক। তবে রাজনৈতিক কারণে নয়, আধিপত্য বিস্তার ও ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে বেশির ভাগ নেতা-কর্মী খুন হয়েছেন।
অস্থির জেলা: নারায়ণগঞ্জে কাগজে-কলমে দুটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হলেও এগুলো ছিল চাঞ্চল্যকর। এর একটি হচ্ছে বাবার ওপর আক্রোশ মেটাতে শিশুপুত্র ও মেধাবী ছাত্র তানভীর মুহাম্মদ ত্বকী হত্যাকাণ্ড। অপরটি ছাত্রলীগ নেতা শহীদুল ইসলাম হত্যাকাণ্ড। দুটি হত্যাকাণ্ডেই সন্দেহের তির ওসমান পরিবারের দিকে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ত্বকী হত্যার তদন্ত করছে র্যাব। আর মিঠু হত্যার অভিযোগপত্র দাখিল হলেও বিচার শুরু হয়নি। তবে আলোচিত সাত খুনের ঘটনা র্যাব ঘটালেও এর পেছনেও সরকারি দলের অভ্যন্তরীণ বিরোধ রয়েছে।
এক জেলায় এক ডজন খুন: নরসিংদী জেলায় সরকারদলীয় কোন্দলে নিহতের সংখ্যা এক ডজন। নরসিংদী সদর আসনের সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নজরুল ইসলাম বলেন, ক্ষমতাসীন দলের হয়েও হত্যার শিকার হওয়াটা দুঃখজনক। কিন্তু এসব হত্যাকাণ্ডের বেশির ভাগই রাজনৈতিক কারণে নয়, ব্যক্তিগত বিরোধ, আধিপত্য বিস্তার ও মাদক ব্যবসাকে কেন্দ্র করে ঘটছে।
রাজনৈতিক সহিংসতায় খুনোখুনির সংখ্যা টাঙ্গাইলে কম। তবে সেখানে ‘খান পরিবার’ টাঙ্গাইল আওয়ামী লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করছে। জেলা আওয়ামী লীগের নেতা ফারুক আহমেদ হত্যার পরিকল্পনাকারী হিসেবে নাম আসায় খান পরিবারের বর্তমান সাংসদ আমানুর রহমান খানসহ তাঁরা চার ভাই পলাতক রয়েছেন।
মেহেরপুরে ছয় বছরে আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে খুন হয়েছেন পাঁচ নেতা-কর্মী। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা পরিষদের প্রশাসক মিয়াজান আলী প্রথম আলোকে বলেন, প্রকৃত রাজনীতির চেয়ে ক্ষমতার স্বাদ খোঁজায় ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকেই। এ জন্য তাঁরা নিজ দলের নেতা-কর্মীদের প্রতিদ্বন্দ্বী ভেবে খুনের মতো জঘন্য কাজ করছেন।
শরীয়তপুরে নিহত ১২ জনের সবাই সরকারি দলের নেতা-কর্মী। সবাই খুন হয়েছেন দলীয় কোন্দলে। জেলা পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন বলেন, আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মূলত এসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে।
শরীয়তপুর সদর উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি লোকমান মাতবর দলীয় কোন্দলে খুন হলেও বিচার পাচ্ছেন না তাঁর স্ত্রী ফরিদা বেগম। তিনি বলেন, ‘স্বামী হত্যার বিচার চেয়ে বিপদে আছি। হত্যাকারীরা আওয়ামী লীগের বড় নেতাদের ছত্রচ্ছায়ায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন, আর আমাদের হুমকি দিচ্ছেন।’
বিচার পাচ্ছে না নিহতের পরিবার: প্রথম আলোর ৬৪ জেলা প্রতিনিধির পাঠানো প্রতিবেদন থেকে ধারণা পাওয়া যায়, ক্ষমতায় থাকলেও সরকারি দলের নিহত নেতাদের পরিবার দু-একটি ব্যতিক্রম ছাড়া বিচার পাওয়া দূরে থাক, উল্টো অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে। এ ধরনের মামলার শেষ কোথায় কেউ জানে না। অধিকাংশ ঘটনার কথিত তদন্ত শেষ করে অভিযোগপত্র জমা দিতেই কেটে যাচ্ছে তিন থেকে পাঁচ বছর। এতে বিচারপ্রার্থীদের হতাশা, ক্ষোভ ও হাহাকার বাড়ছে।
গত কয়েক বছরে আলোচিত হত্যাকাণ্ডগুলোর মধ্যে একমাত্র বিশ্বজিতের পরিবার বিচার পেয়েছে। এর কারণ হিসেবে বলা হচ্ছে, রাজধানীতে প্রকাশ্য দিবালোকে নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে হত্যার পর এ নিয়ে গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন মহলের চাপে ঘটনাটি সরকারের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করেছিল।
তবে যুবলীগের কোন্দলে রাজধানীর আরেক আলোচিত হত্যাকাণ্ড রিয়াজুল হক (মিল্কি) হত্যাকাণ্ডের বিচার প্রশ্নের মুখে পড়েছে। হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকায় অভিযুক্ত যুবলীগের দুই প্রভাবশালী নেতার নাম বাদ দিয়ে র্যাব অভিযোগপত্র দেওয়ায় গত ৯ জুন নিহতের ভাই আদালতে নারাজি আবেদন করেন। মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের এই সাংগঠনিক সম্পাদককে গত বছরের ২৯ জুলাই গুলশানে একটি বিপণিবিতানের সামনে নিষ্ঠুরভাবে হত্যার দৃশ্য সিসি ক্যামেরায় ধারণ করা হয়েছিল।
আবার ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের গোলাগুলিতে পড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্র আবুবকর খুন হলেও সেই হত্যার বিচার আজও হয়নি।
২০১১ সালের ১ নভেম্বর নরসিংদীর পৌর মেয়র ও শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক লোকমান হোসেন দলীয় কোন্দলে নিহত হলেও মামলাটি হাইকোর্টে স্থগিত হয়ে আছে।
যুবলীগের কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও খুলনার ওয়ার্ড কাউন্সিলর শহীদ ইকবাল বিথার ২০০৯ সালের ১১ জুলাই দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলে নিহত হওয়ার পর সাড়ে পাঁচ বছর পার হয়েছে। কিন্তু বিচার হচ্ছে না।
এ ছাড়া পঞ্চগড়ে পুকুর ইজারাকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগ ও যুবলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ২০১০ সালের ৮ এপ্রিল পৌর ছাত্রলীগের নেতা ফারুক হোসেন নিহত হন। চার দফা তদন্ত কর্মকর্তা পরিবর্তনের পর পঞ্চমবার সরকারি দলের ১৩ আসামির নাম বাদ দিয়ে তিনজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় পুলিশ।
২০১১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহ-১০ আসনের সাংসদ গিয়াস উদ্দিন আহম্মেদের ব্যক্তিগত সহকারী ও যুবলীগ নেতা মেহেদী হাছান ইলিয়াসকে সদ্য বিয়ে করা স্ত্রীর সামনে হত্যা করে মাথা নিয়ে চলে যায় সন্ত্রাসীরা। এ ঘটনায় যুবলীগের একজন কর্মী র্যাবের ‘ক্রসফায়ারে’ মারা গেলেও তদন্ত এগোয়নি।
বান্দরবানে স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও ছাত্রলীগের সংঘর্ষে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছোটন মল্লিক নিহত হওয়ার পর ছাত্রলীগের ১১ জনের বিরুদ্ধে মামলা হলেও সবাই জামিনে আছেন।
গত ২৮ অক্টোবর মাগুরা সরকারি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ ক্যাম্পাসে পৌর ছাত্রলীগ নেতা রাজন খানকে হত্যার ঘটনায় ছাত্রলীগ ও যুবলীগের ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা হয়।
দলীয় কোন্দলে নিহত ব্যক্তিদের বিচারের দীর্ঘসূত্রতা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেন, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীদের বুঝতে হবে, যোগ্যতার বদলে প্রভাব, চাপ বা তদবিরের মাধ্যমে দরপত্র পেলে এবং এ পাওয়ার কারণে সৃষ্ট বিরোধে তিনি যদি নিহত বা আহত হন, তাহলে তাঁর পরিবার বিচার পাবে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক সহিংসতার ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হওয়ার ঘটনা বেশি ঘটে। এর ফলে নিহতের পরিবার বা স্বজনেরাই যে ন্যায়বিচার থেকে বঞ্চিত হন এমনটি নয়, ন্যায়বিচার প্রাপ্তির ঘাটতি প্রশাসনকেও গ্রাস করে। এই অবস্থায় প্রশাসনের ওপরও মানুষের আস্থা কমে যায়।
প্রথম আলো>>{তথ্য দিয়ে সহায়তা করেছেন আনোয়ার পারভেজ (বগুড়া), আকমল হোসেন (মৌলভীবাজার), আসাদুল্লাহ সরকার (দিনাজপুর), নেয়ামতউল্যাহ (ভোলা), হরি কিশোর চাকমা (রাঙামাটি), মীর মাহমুদুল হাসান (নীলফামারী), কামনাশীষ শেখর (টাঙ্গাইল), আসিফ হোসেন (নারায়ণগঞ্জ), তুহিন আরণ্য (মেহেরপুর), মনিরুজ্জামান (নরসিংদী), সুমন চক্রবর্তী (খুলনা), শহীদুল ইসলাম (পঞ্চগড়), কামরান পারভেজ (ময়মনসিংহ), বুদ্ধজ্যোতি চাকমা (বান্দরবান), সৈকত দেওয়ান (খাগড়াছড়ি), কবির হোসেন (মাগুরা), সত্যজিৎ ঘোষ (শরীয়তপুর) ও মুক্তার হোসেন (নাটোর)}
No comments