শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয় : ড. মো. ইফতেখারুল আলম by মোকাম্মেল হোসেন
যুগান্তর : জিহাদের মৃত্যু পুরো জাতিকে
স্পর্শ করেছে। এ ধরনের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যু রোধ করতে হলে কোন কোন বিষয়ের
ওপর আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে?
ড. মো. ইফতেখারুল আলম : জীবন এবং মৃত্যু- এ শব্দ দুটির সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই সম্পৃক্ত হচ্ছি। তবে কিছু কিছু মৃত্যু মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী কষ্টদায়ক চিত্র এঁকে দেয়, যা সহজে ভোলা যায় না। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। জিহাদের মৃত্যুর কথা ভাবলেই চোখের সামনে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হল- একটি চার বছরের উজ্জ্বল, হাসিখুশি প্রাণবন্ত শিশু খেলতে খেলতে মৃত্যুকূপে পড়ে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা গভীর সরু পাইপের মধ্যে অসহায়ভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে, ঘটনাটি যে একটি দুর্যোগ বা ঝুঁকির দিকে গড়াবে- এ বিষয়টিই আমাদের ভাবনায় ছিল না। দুর্যোগ বলতে সাধারণত আমরা মনে করি, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদিকে। এ জাতীয় ঘটনাও যে ঝুঁকি বা দুর্যোগ হয়ে উঠতে পারে- এটা আমাদের ভাবনা বা চিন্তায় আনতে হবে এবং এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণত যেসব স্থানে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়- সেখানে বড় আকারের সাইনবোর্ড দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তারপরও দুর্ভাগ্যবশত কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ অন্যদের যথার্থ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা থাকতে হবে।
যুগান্তর : জিহাদের মৃত্যুর দায় কি রাষ্ট্রের? যদি তাই হয়, তাহলে এ ঘটনা থেকে রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষণীয় কী আছে?
ই. আ. : কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছা ও আগ্রহের বিষয়টি অনুধাবন করে রাষ্ট্র তাকে বাঁচানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ২০০ ফুট গভীর নলকূপের নিচের ৩৬০ ফুট শীতল পানিতে ভর্তি আর ওপরে ২৪০ ফুট বায়ুপূর্ণ অংশের নিচেরটুকু বিষাক্ত ঈড়২ পূর্ণ। শিশু জিহাদ কূপের ওপর থেকে ২১০ ফুট গভীরতায় প্রথম পানিকে স্পর্শ করে এবং কয়েক মিনিট বা ঘণ্টা পর ৩৬০ ফুট পানির গভীরে চলে যায়, আবার ধীরে ধীরে পানি থেকে ওপরে ভাসতে থাকে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকারী কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। উদ্ধারকর্মীরা এ ধরনের মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সঙ্গে আগে কখনোই পরিচিত ছিল না। তাই কী করা উচিত, কী করব, কীভাবে করব- কিছুই তাদের জানা ছিল না। তবুও তাদের নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি, জ্ঞান-দক্ষতা দিয়ে উদ্ধার কার্য শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখানে রাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করা ঠিক হবে না। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের দায়িত্ব অবহেলাকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান- যে বা যারাই হোক, তারা যদি কারও মৃত্যুর কারণ হয়, তখন তাদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার ভার রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।
যুগান্তর : জিহাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের দুর্যোগ বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী সংস্থাকে কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন?
ই. আ. : গভীর নলকূপটি হয়তো ডিসচার্জ কম হওয়ার কারণে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। পাশেই অন্য একটি নলকূপ স্থাপন করা হয় এবং এটির মাথায় একটি পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, যাতে কেউ এর ভেতর পড়তে না পারে। পাথর দিয়ে ঢাকনা দেয়া কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নয়। এ চিত্র থেকে অনুমান করা যায়, পুরনো পরিত্যক্ত নলকূপের ভেতরে ৩৬০ ফুট গভীরতার একটি সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন করে পানি উত্তোলন করে নতুন নলকূপটি স্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হলে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, যা ক্রয় করে ব্যবহার করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এজন্য নতুন নলকূপটি খননকালে পরিত্যক্ত নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন করা হয়েছে। এ কাজে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। নতুন নলকূপটি খনন কাজ শেষ হওয়ার পর পরিত্যক্ত নলকূপটি সিল করা হয়নি। যে কারণে এটি একটি বিপজ্জনক মরণফাঁদে পরিণত হয়। বলা প্রয়োজন, গভীর নলকূপ খননের কয়েকটি ধাপ আছে। এগুলো হল- ১. প্রথমে ড্রিলিং করা এবং ড্রিলিংয়ের গভীরতা হবে পর্যাপ্ত পানি সমৃদ্ধ একুইফার পর্যন্ত ২. ওয়েল ডিজাইন ৩. ফিকচার লোয়ারিং, ৪. গ্রাভেল প্যাকিং ৫. টেস্টিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ৬. কমিশনিং। সম্ভবত নতুন নলকূপটি ৪ ধাপ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছিল।
সাধারণত দুর্যোগ বলতে আমরা যা বুঝি, সেগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অনেক সামর্থ্য-সক্ষমতা ও সফলতা অর্জন করেছে। ’৭০-এর দশকে জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বর্তমানে এটাকে সফলভাবে আমরা মোকাবেলা করতে পারছি। একই মাত্রার দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা এখন সিঙ্গেল ডিজেটে নেমে এসেছে। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
যুগান্তর : রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশিত ছিল। জিহাদ মরে প্রমাণ করল- প্রত্যাশার ন্যূনতম মাত্রাও পূরণ হয়নি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এই যে ব্যবধান- এটা ঘোচাতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি?
ই. আ. আমাদের চারপাশে অদৃশ্যমান অনেক দুর্যোগ আছে, যেগুলোর ব্যাপারে আগেভাগে সতর্ক হওয়া সম্ভব নয়। রানা প্লাজা বা জিহাদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর জন্য দায়ী যে ভবনধস বা পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত গভীর নলকূপ- এসব হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাসহ গাজীপুর ও ভালুকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সমুদ্রের গড় উচ্চতার ৩০ থেকে ৫৫ মিটার নিচে নেমে যাওয়া, দক্ষিণের সাগরের লবণ পানি ভূগর্ভস্থ হয়ে ধীরগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়াসহ অন্যান্য কারণে আমরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছি। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেল আছে। এর সঙ্গে অপ্রচলিত দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় এ সেলের অধীনে আলাদা একটা ডিভিশন থাকা উচিত। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বা বিষয় সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা বা পূর্বাভাস প্রচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
যুগান্তর : ওয়াসা-ডিসিসি-বাংলাদেশ রেলওয়ে- এ ত্রয়ীর দায়িত্বহীনতার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ই. আ. : এখানে মূল দায়বদ্ধতার জায়গাটি হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও তাকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর। সড়কের ম্যানহোল, ড্রেন ও খালের ব্যাপারে ডিসিসির দায়-দায়িত্ব আছে। গভীর নলকূপের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের ওপর তাদের কোনো হাত নেই।
যুগান্তর : ওয়াসার অনুমতি ছাড়া তো ঢাকা শহরে কোনো নলকূপ স্থাপন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাদেরও তো দায়িত্বের প্রশ্নটি এসে যায়?
ই. আ. : হ্যাঁ। ওয়াসা অনুমতি না দিলে ঢাকায় কোনো নলকূপ বা গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। কাজেই শাহজাহানপুরের পরিত্যক্ত ঘোষিত গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। বস্তুত কতটুকু দূরত্বে একেকটি নলকূপ স্থাপন করা যাবে- আমি জানি না, এ ধরনের কোনো নীতিমালা ওয়াসার আছে কিনা। না থাকলে দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
যুগান্তর : অগ্নিকাণ্ড, ভূমিধস, দুর্ঘটনা ইত্যাদি মানুষসৃষ্ট দুর্যোগ ছাড়াও আমাদের সামনে বহুবিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ রকম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে ভূমিকম্প। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ৬ রিখটার স্কেল বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঢাকায় আঘাত হানলে আমাদের পরিণতি কী হবে?
ই. আ. : ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি। তবে মাটির গর্তে বাস করা কিছু কিছু অনুজীব ভূমিকম্পের আভাস পায় বলে জনশ্র“তি আছে। এ বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কতটা সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আসা যায়- সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। ’৮০ দশকে ঢাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১০ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে ওঠানামা করত। এখন সেটা ২২০ থেকে ২৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে মাটির সহনক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকায় ভূমিকম্প হলে একটা অংশ দেবে যাবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে ভূগর্ভস্থ পানির। মাটি থেকে ৭০ ফুট গভীরে আছে বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের নদী ও জলাশয়ের বিষাক্ত পানি। এ বিষাক্ত পানির নিচে কাদা ও পলিথিনের ১০ থেকে ১৮ ফুটের স্তর রয়েছে, যা বিষাক্ত পানিকে ঢাকার পানযোগ্য মিঠাপানি থেকে আলাদা করে রেখেছে। ভূমিকম্পে নদীর তলদেশ এবং কাদা ও পলিথিনের স্তর ফেটে গেলে পানীয় জলের পুরোটাই দূষিত হবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণমুক্ত করতে যে প্রযুক্তি, সময় ও অর্থ লাগবে, তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি প্রযুক্তি, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণমুক্ত করতে। ভূমিকম্পে অন্য ক্ষয়ক্ষতির কথা বাদ দিলেও পানির অভাবেই ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ঢাকা জনশূন্য হয়ে পড়বে।
যুগান্তর : আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই ভূমিকম্প পাল্টে দিতে পারে একটি দেশের পুরো মানচিত্র। এ ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার।
ই. আ. : পানির স্তর নেমে যাওয়ার বিষয়টি অদৃশ্যমান। তাই বিপদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা আঁচ করতে পারছি না। এটা জানতে ও বুঝতে হলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট একটা সংস্থা বা বিভাগকে দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও কর্মী তৈরি করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : নিজের সন্তান যখন গভীর অন্ধকার একটি পাইপে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, তখন পুলিশ জিহাদের বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে অমানবিক আচরণ করেছে। পুলিশের এ আচরণ কী প্রমাণ করে?
ই. আ. : নিষ্পাপ হাসিখুশি কোনো শিশু যখন গভীর কোনো নলকূপে পড়ে যায়, তখন যে বিপদগুলো তার সামনে আসে তা হল- একটি অন্ধকার জনমানবশূন্য ভুতুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে ২৫-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার অন্ধকার গভীর পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বাতাসের পরিবর্তে ঈড়২ এবং পরে পানি তার নাক-মুখ দিয়ে পেটে চলে যায়। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তবে তখনও সে যে জীবন্ত, বাঁচার একটি আকুতি, করুণ আবেদন তার মনের কোণে ভাসতে থাকে। তার আজন্ম চেনা মমতাময়ী মায়ের ছবি তার মনে জাগতে থাকে। বিশ্বাস করে- মা তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোলে সে ফিরে যাবে। কিন্তু জিহাদের এ আকুতি তার মায়ের কাছে পৌঁছায়নি। পৃথিবীর আলো দেখার আর সুযোগ তার হয়নি। অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাকে চলে যেতে হল না ফেরার দেশে। এই ছেলেটি যদি আমার বা আপনার বা ওই ঠিকাদারের হতো, তাহলে তার কেমন লাগত? জিহাদ সবার কাছে একটি প্রশ্ন রেখে গেল- আমার কী অপরাধ? যাদের জন্য আমার এই অকালমৃত্যু- তারা কি কেউ বিচারের সম্মুখীন হবে? জনগণের বন্ধু হিসেবে এ বিষয়গুলো পুলিশের মাথায় থাকা উচিত ছিল। পুলিশের অনেক সফলতার পাশাপাশি কিছু কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। ভুল তথ্য বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবেই এমনটি ঘটে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসল সত্যটা তারা জানতে পারে না। পুলিশেরও এ ধরনের দুর্ঘটনা, ঝুঁকি ও দুর্যোগ সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
যুগান্তর : কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা আমাদের ব্যর্থতাগুলোকে ধামাচাপা দিতে চাই। জিহাদের ঘটনায়ও তা লক্ষ্য করা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় তা প্রমাণও হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ জাতীয় আচরণ জাতিকে কী বার্তা দেয়?
ই. আ. : দেশের মানুষ এ ধরনের মৃত্যু দেখতে চায় না। আর এজন্যই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শীতের রাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং দীর্ঘসময় উদ্ধার কাজে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেন। টিভি চ্যানেলগুলো নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। উৎসুক কোটি কোটি মানুষ জিহাদের সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলেও তাকে পাওয়া যায় না। তখন এক ধরনের ধূম্রজাল তৈরি হয়। এটা মূলত অজ্ঞতার কারণে ঘটেছে। বিষয়টি তাদের কাছে অস্পষ্ট ছিল। পুলিশ বা সংশ্লিষ্টদের কাছে যে কোনোভাবেই হোক, একটা ভুলবার্তা চলে গেছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয়।
যুগান্তর : জিহাদের উদ্ধার কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। দেখা গেছে, পুলিশ পুলিশের মতো চিন্তা করছে, ফায়ার সার্ভিস তাদের মতো চিন্তা করছে। মন্ত্রী আরেক রকম। যে কোনো দুর্যোগে বিভিন্ন সংস্থা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয় কতটা জরুরি।
ই. আ. : এটা একটা বড় জিনিস। কো-অপারেশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশনের দারুণ অভাব রয়েছে আমাদের মধ্যে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ঝুঁকি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
যুগান্তর : জাতি হিসেবে চরিত্রগতভাবেই কি আমরা বিশৃঙ্খল? জিহাদের ঘটনা কি তাই প্রমাণ করে?
ই. আ. : আমি বিশৃংখল বলব না। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। মূলত ব্রিটিশদের যে কলোনিয়াল সিস্টেম, তা থেকে আমরা এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। জিহাদের উদ্ধার তৎপরতার ক্ষেত্রে প্রথমে এর মধ্যে স্থাপিত সাব-মার্সিবল পাম্পটি উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৩৬০ ফুট দীর্ঘ এ পাম্পটি তুলতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আশা ছিল, এ পাম্পটির নিচে এমন কিছু আছে যার সঙ্গে আটকে জিহাদ উঠে আসবে আমাদের কাছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হল। শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে এক যুবক এগিয়ে এলো নলকূপে নেমে জিহাদকে উঠানোর জন্য। কিন্তু ওই ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে পাইপের ভেতরে কোনো মানুষকে রশি বেঁধে নামানো হলে তার নিজের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এ বিষয়টি যখন টিভি চ্যানেল থেকে জানানো হল, তখন এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত হল সে। এটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। অন্যথায় অজ্ঞতার কারণে পুরো জাতি আর একজন জীবন্ত যুবককে মারার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত না। এরপর শোনা গেল, বুয়েটের কিছু প্রকৌশলী ‘ক্যাচার’ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন এবং এর দ্বারা ওই শিশুকে সহজে ওপরে তুলে আনা সম্ভব হবে। মানুষ আবার নতুন আশায় ভর করে অপেক্ষা করছিল। এ সময় ওয়াসা ও একটি বেসরকারি সংস্থা কূপের মধ্যে ক্যামেরা নামিয়ে ছবি সংগ্রহ করে এবং জানায়- কূপের ভেতর কোনো শিশুর অস্তিত্ব নেই। সবাই হতাশ হয়ে গেল। তখন সন্দেহ হল- জিহাদ আসলেই ওই কূপে পড়েছে কিনা। এর মধ্যে অন্যান্য টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদে উদ্ধার কর্মীরাও সন্দিহান হয়ে গেল। ক্যামেরা সরিয়ে নেয়া হল, ক্যাচারের যন্ত্রাংশ খোলা হল এবং তারা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। এসব বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঘটেছে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যুগান্তর : মৃত জিহাদকে উদ্ধারে স্থানীয় প্রযুক্তি সফলতা পেয়েছে। কিন্তু এ ধরনের প্রযুক্তি বড় মাপের কোনো দুর্যোগ বা ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় জনআগ্রহকে কাজে লাগিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে সুফল পাওয়া যাবে কি?
ই. আ. : যে কোনো মুহূর্তে উদ্ধার কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা হতে পারে- এমন একটা অবস্থায় একজন বিশেষজ্ঞের কথা প্রচার করা হল- যেহেতু দুজন শিশু একসঙ্গে মাঠে খেলা করছিল, তাদের একজন কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর আরেকজন দৌড়ে গিয়ে জিহাদের মাকে খবর দিয়েছে, জিহাদ কূপে পড়ে গেছে। এ সংবাদ মিথ্যা হতে পারে না। নিষ্পাপ শিশুরা মিথ্যা বলতে পারে না। জিহাদের দেহ অবশ্যই ওই কূপে আছে এবং এটা তোলা সম্ভব। স্থানীয় জনতা আগ্রহী হয়ে উঠলেন তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিহাদকে তোলার জন্য। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হল না। অনেকের ধারণা, যারা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তারা প্রভাব খাটিয়ে জিহাদের মৃতদেহ নলকূপ থেকে না তুলে নলকূপে আদৌ কেউ পড়েনি, তা প্রমাণ করার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা শুরু করে। ফলে এক সময় বলা হয়, কূপের মধ্যে জিহাদ নেই এবং উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। উৎসুক জনতা বিষয়টি বুঝতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়লে কয়েক মিনিট পর স্থানীয় লোকদের স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে অব্যাহত প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ৬০০ ফুট গভীরতার ৩৮৫ ফুট গভীর থেকে তুলে আনা হল জিহাদকে। সবাই অবাক দৃষ্টিতে দেখল- বাঁ-হাতের বাহু দিয়ে চোখ ঢেকে সে ঘুমিয়ে আছে। সবাই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল, জিহাদের দেহে প্রাণ নেই। এটা অবশ্যই একটা শিক্ষণীয় ঘটনা। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা যেতে পারে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় এ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রযুক্তির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।
যুগান্তর : যে কোনো দুর্ঘটনা রোধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের কী ভূমিকা হওয়া উচিত?
ই. আ. : ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কোথায় আড্ডা বা খেলাধুলা করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে- এটার দেখার দায়িত্ব মূলত পরিবারের। রাষ্ট্রের পক্ষে তো প্রতিটি মানুষের দেখভাল করা সম্ভব নয়। এ কাজ বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদেরই করতে হবে। তবে রাষ্ট্র যেটা করতে পারে তা হল- একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, যত্নশীল হতে পারে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ই. আ. : আপনাকেও ধন্যবাদ।
ড. মো. ইফতেখারুল আলম : জীবন এবং মৃত্যু- এ শব্দ দুটির সঙ্গে আমরা প্রতিনিয়তই সম্পৃক্ত হচ্ছি। তবে কিছু কিছু মৃত্যু মানুষের মনে দীর্ঘস্থায়ী কষ্টদায়ক চিত্র এঁকে দেয়, যা সহজে ভোলা যায় না। এ ধরনের মৃত্যু আমাদের মনকে গভীরভাবে নাড়া দেয় এবং হৃদয়ে গভীর ক্ষতের সৃষ্টি করে। জিহাদের মৃত্যুর কথা ভাবলেই চোখের সামনে যে চিত্রটি ভেসে ওঠে তা হল- একটি চার বছরের উজ্জ্বল, হাসিখুশি প্রাণবন্ত শিশু খেলতে খেলতে মৃত্যুকূপে পড়ে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা গভীর সরু পাইপের মধ্যে অসহায়ভাবে ধীরে ধীরে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। এখানে প্রথম কথা হচ্ছে, ঘটনাটি যে একটি দুর্যোগ বা ঝুঁকির দিকে গড়াবে- এ বিষয়টিই আমাদের ভাবনায় ছিল না। দুর্যোগ বলতে সাধারণত আমরা মনে করি, সাইক্লোন, ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা ইত্যাদিকে। এ জাতীয় ঘটনাও যে ঝুঁকি বা দুর্যোগ হয়ে উঠতে পারে- এটা আমাদের ভাবনা বা চিন্তায় আনতে হবে এবং এ ব্যাপারে মানুষের মধ্যে প্রয়োজনীয় সচেতনতা সৃষ্টি করতে হবে। সাধারণত যেসব স্থানে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়- সেখানে বড় আকারের সাইনবোর্ড দিয়ে গণবিজ্ঞপ্তির ব্যবস্থা করতে হবে। এছাড়া সার্বক্ষণিক পাহারার ব্যবস্থা থাকা উচিত। তারপরও দুর্ভাগ্যবশত কোনো দুঃখজনক ঘটনা ঘটলে তা মোকাবেলার জন্য ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সসহ অন্যদের যথার্থ প্রশিক্ষণ ও দক্ষতা থাকতে হবে।
যুগান্তর : জিহাদের মৃত্যুর দায় কি রাষ্ট্রের? যদি তাই হয়, তাহলে এ ঘটনা থেকে রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষণীয় কী আছে?
ই. আ. : কোটি কোটি মানুষের ইচ্ছা ও আগ্রহের বিষয়টি অনুধাবন করে রাষ্ট্র তাকে বাঁচানোর জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু ২০০ ফুট গভীর নলকূপের নিচের ৩৬০ ফুট শীতল পানিতে ভর্তি আর ওপরে ২৪০ ফুট বায়ুপূর্ণ অংশের নিচেরটুকু বিষাক্ত ঈড়২ পূর্ণ। শিশু জিহাদ কূপের ওপর থেকে ২১০ ফুট গভীরতায় প্রথম পানিকে স্পর্শ করে এবং কয়েক মিনিট বা ঘণ্টা পর ৩৬০ ফুট পানির গভীরে চলে যায়, আবার ধীরে ধীরে পানি থেকে ওপরে ভাসতে থাকে। ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের উদ্ধারকারী কর্মীরা ঘটনাস্থলে পৌঁছে উদ্ধার কাজ শুরু করে। উদ্ধারকর্মীরা এ ধরনের মানবসৃষ্ট দুর্যোগের সঙ্গে আগে কখনোই পরিচিত ছিল না। তাই কী করা উচিত, কী করব, কীভাবে করব- কিছুই তাদের জানা ছিল না। তবুও তাদের নিজস্ব বিচার-বুদ্ধি, জ্ঞান-দক্ষতা দিয়ে উদ্ধার কার্য শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এখানে রাষ্ট্রকে সরাসরি দায়ী করা ঠিক হবে না। তবে প্রকল্প বাস্তবায়নকারী সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানের গাফিলতি অবশ্যই ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এ ধরনের দায়িত্ব অবহেলাকারী ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান- যে বা যারাই হোক, তারা যদি কারও মৃত্যুর কারণ হয়, তখন তাদের বিচার ও শাস্তি নিশ্চিত করার ভার রাষ্ট্রের ওপর বর্তায়।
যুগান্তর : জিহাদের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে আমাদের দুর্যোগ বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার করুণ চিত্র পরিস্ফুট হয়েছে। এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনকারী সংস্থাকে কার্যকর ও যুগোপযোগী করতে হলে কী কী পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন?
ই. আ. : গভীর নলকূপটি হয়তো ডিসচার্জ কম হওয়ার কারণে পরিত্যক্ত ঘোষিত হয়। পাশেই অন্য একটি নলকূপ স্থাপন করা হয় এবং এটির মাথায় একটি পাথর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়, যাতে কেউ এর ভেতর পড়তে না পারে। পাথর দিয়ে ঢাকনা দেয়া কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যবস্থা নয়। এ চিত্র থেকে অনুমান করা যায়, পুরনো পরিত্যক্ত নলকূপের ভেতরে ৩৬০ ফুট গভীরতার একটি সাব-মার্সিবল পাম্প স্থাপন করে পানি উত্তোলন করে নতুন নলকূপটি স্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, একটি গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হলে প্রচুর পানির প্রয়োজন হয়, যা ক্রয় করে ব্যবহার করা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। এজন্য নতুন নলকূপটি খননকালে পরিত্যক্ত নলকূপ থেকে পানি উত্তোলন করা হয়েছে। এ কাজে কয়েকদিন থেকে কয়েক সপ্তাহ লেগেছে। নতুন নলকূপটি খনন কাজ শেষ হওয়ার পর পরিত্যক্ত নলকূপটি সিল করা হয়নি। যে কারণে এটি একটি বিপজ্জনক মরণফাঁদে পরিণত হয়। বলা প্রয়োজন, গভীর নলকূপ খননের কয়েকটি ধাপ আছে। এগুলো হল- ১. প্রথমে ড্রিলিং করা এবং ড্রিলিংয়ের গভীরতা হবে পর্যাপ্ত পানি সমৃদ্ধ একুইফার পর্যন্ত ২. ওয়েল ডিজাইন ৩. ফিকচার লোয়ারিং, ৪. গ্রাভেল প্যাকিং ৫. টেস্টিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ও ৬. কমিশনিং। সম্ভবত নতুন নলকূপটি ৪ ধাপ পর্যন্ত সমাপ্ত হয়েছিল।
সাধারণত দুর্যোগ বলতে আমরা যা বুঝি, সেগুলো মোকাবেলায় বাংলাদেশ ইতিমধ্যে অনেক সামর্থ্য-সক্ষমতা ও সফলতা অর্জন করেছে। ’৭০-এর দশকে জলোচ্ছ্বাসে লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটেছে। বর্তমানে এটাকে সফলভাবে আমরা মোকাবেলা করতে পারছি। একই মাত্রার দুর্যোগে মৃত্যুর সংখ্যা এখন সিঙ্গেল ডিজেটে নেমে এসেছে। এটা বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত।
যুগান্তর : রানা প্লাজা ট্রাজেডির পর আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক পরিবর্তন সঙ্গত কারণেই প্রত্যাশিত ছিল। জিহাদ মরে প্রমাণ করল- প্রত্যাশার ন্যূনতম মাত্রাও পূরণ হয়নি। প্রত্যাশা ও প্রাপ্তির এই যে ব্যবধান- এটা ঘোচাতে হলে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া জরুরি?
ই. আ. আমাদের চারপাশে অদৃশ্যমান অনেক দুর্যোগ আছে, যেগুলোর ব্যাপারে আগেভাগে সতর্ক হওয়া সম্ভব নয়। রানা প্লাজা বা জিহাদের অনাকাক্সিক্ষত মৃত্যুর জন্য দায়ী যে ভবনধস বা পরিত্যক্ত ও অরক্ষিত গভীর নলকূপ- এসব হচ্ছে তারই দৃষ্টান্ত। এক্ষেত্রে আমাদের সচেতন ও দায়িত্বশীল হওয়ার কোনো বিকল্প নেই। ঢাকাসহ গাজীপুর ও ভালুকার ভূগর্ভস্থ পানির স্তর সমুদ্রের গড় উচ্চতার ৩০ থেকে ৫৫ মিটার নিচে নেমে যাওয়া, দক্ষিণের সাগরের লবণ পানি ভূগর্ভস্থ হয়ে ধীরগতিতে উত্তর দিকে প্রবাহিত হওয়াসহ অন্যান্য কারণে আমরা খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছি। আমাদের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সেল আছে। এর সঙ্গে অপ্রচলিত দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় এ সেলের অধীনে আলাদা একটা ডিভিশন থাকা উচিত। তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ব্যবহারের সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। নিয়মিত মনিটরিংয়ের মাধ্যমে ঝুঁকিপূর্ণ স্থান বা বিষয় সম্পর্কে আগাম সতর্কবার্তা বা পূর্বাভাস প্রচারের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
যুগান্তর : ওয়াসা-ডিসিসি-বাংলাদেশ রেলওয়ে- এ ত্রয়ীর দায়িত্বহীনতার বিষয়টিকে আপনি কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
ই. আ. : এখানে মূল দায়বদ্ধতার জায়গাটি হচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ও তাকে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের ওপর। সড়কের ম্যানহোল, ড্রেন ও খালের ব্যাপারে ডিসিসির দায়-দায়িত্ব আছে। গভীর নলকূপের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের ওপর তাদের কোনো হাত নেই।
যুগান্তর : ওয়াসার অনুমতি ছাড়া তো ঢাকা শহরে কোনো নলকূপ স্থাপন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তাদেরও তো দায়িত্বের প্রশ্নটি এসে যায়?
ই. আ. : হ্যাঁ। ওয়াসা অনুমতি না দিলে ঢাকায় কোনো নলকূপ বা গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায় না। কাজেই শাহজাহানপুরের পরিত্যক্ত ঘোষিত গভীর নলকূপের ক্ষেত্রে তাদেরও একটা দায়িত্ব আছে। বস্তুত কতটুকু দূরত্বে একেকটি নলকূপ স্থাপন করা যাবে- আমি জানি না, এ ধরনের কোনো নীতিমালা ওয়াসার আছে কিনা। না থাকলে দ্রুত নীতিমালা প্রণয়ন করা উচিত।
যুগান্তর : অগ্নিকাণ্ড, ভূমিধস, দুর্ঘটনা ইত্যাদি মানুষসৃষ্ট দুর্যোগ ছাড়াও আমাদের সামনে বহুবিদ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এ রকম একটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে ভূমিকম্প। বিশ্বের ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলগুলোর মধ্যে ঢাকা অন্যতম। ৬ রিখটার স্কেল বা তার চেয়ে বেশি মাত্রার একটি ভূমিকম্প ঢাকায় আঘাত হানলে আমাদের পরিণতি কী হবে?
ই. আ. : ভূমিকম্প সম্পর্কে পূর্বাভাস দেয়ার মতো কোনো প্রযুক্তি এখন পর্যন্ত পৃথিবীতে আবিষ্কার হয়নি। তবে মাটির গর্তে বাস করা কিছু কিছু অনুজীব ভূমিকম্পের আভাস পায় বলে জনশ্র“তি আছে। এ বিষয়ে গবেষণার পাশাপাশি ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতি কতটা সহনশীল অবস্থায় নিয়ে আসা যায়- সেদিকে মনোযোগ দিতে হবে। ’৮০ দশকে ঢাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর ১০ থেকে ২০ ফুটের মধ্যে ওঠানামা করত। এখন সেটা ২২০ থেকে ২৪০ ফুট নিচে নেমে গেছে। একই সঙ্গে মাটির সহনক্ষমতা অনেকটাই হ্রাস পেয়েছে। এ অবস্থায় ঢাকায় ভূমিকম্প হলে একটা অংশ দেবে যাবে। সবচেয়ে বড় ক্ষতি হবে ভূগর্ভস্থ পানির। মাটি থেকে ৭০ ফুট গভীরে আছে বুড়িগঙ্গাসহ আশপাশের নদী ও জলাশয়ের বিষাক্ত পানি। এ বিষাক্ত পানির নিচে কাদা ও পলিথিনের ১০ থেকে ১৮ ফুটের স্তর রয়েছে, যা বিষাক্ত পানিকে ঢাকার পানযোগ্য মিঠাপানি থেকে আলাদা করে রেখেছে। ভূমিকম্পে নদীর তলদেশ এবং কাদা ও পলিথিনের স্তর ফেটে গেলে পানীয় জলের পুরোটাই দূষিত হবে। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, ভূ-উপরিস্থ পানি দূষণমুক্ত করতে যে প্রযুক্তি, সময় ও অর্থ লাগবে, তার চেয়ে ১০ গুণ বেশি প্রযুক্তি, সময় ও অর্থ ব্যয় করতে হবে ভূগর্ভস্থ পানি দূষণমুক্ত করতে। ভূমিকম্পে অন্য ক্ষয়ক্ষতির কথা বাদ দিলেও পানির অভাবেই ঢাকা শহর বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়বে। ঢাকা জনশূন্য হয়ে পড়বে।
যুগান্তর : আগাম কোনো ঘোষণা ছাড়াই ভূমিকম্প পাল্টে দিতে পারে একটি দেশের পুরো মানচিত্র। এ ধরনের ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলায় আমাদের কী ধরনের প্রস্তুতি থাকা দরকার।
ই. আ. : পানির স্তর নেমে যাওয়ার বিষয়টি অদৃশ্যমান। তাই বিপদের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমরা আঁচ করতে পারছি না। এটা জানতে ও বুঝতে হলে সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের উদ্যোগ নিতে হবে। এ ব্যাপারে নির্দিষ্ট একটা সংস্থা বা বিভাগকে দায়িত্ব দেয়ার পাশাপাশি এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও কর্মী তৈরি করার পদক্ষেপ নিতে হবে।
যুগান্তর : নিজের সন্তান যখন গভীর অন্ধকার একটি পাইপে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছে, তখন পুলিশ জিহাদের বাবাকে ধরে থানায় নিয়ে অমানবিক আচরণ করেছে। পুলিশের এ আচরণ কী প্রমাণ করে?
ই. আ. : নিষ্পাপ হাসিখুশি কোনো শিশু যখন গভীর কোনো নলকূপে পড়ে যায়, তখন যে বিপদগুলো তার সামনে আসে তা হল- একটি অন্ধকার জনমানবশূন্য ভুতুড়ে ভয়াবহ পরিবেশ, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই সে ২৫-২৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার অন্ধকার গভীর পানিতে হাবুডুবু খেতে থাকে। তার শ্বাস-প্রশ্বাস বন্ধ হয়ে যায়। বাতাসের পরিবর্তে ঈড়২ এবং পরে পানি তার নাক-মুখ দিয়ে পেটে চলে যায়। তার শ্বাসরুদ্ধ হয়ে যায়। সে কথা বলার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে। তবে তখনও সে যে জীবন্ত, বাঁচার একটি আকুতি, করুণ আবেদন তার মনের কোণে ভাসতে থাকে। তার আজন্ম চেনা মমতাময়ী মায়ের ছবি তার মনে জাগতে থাকে। বিশ্বাস করে- মা তাকে এ বিপদ থেকে উদ্ধার করবে। পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোলে সে ফিরে যাবে। কিন্তু জিহাদের এ আকুতি তার মায়ের কাছে পৌঁছায়নি। পৃথিবীর আলো দেখার আর সুযোগ তার হয়নি। অনেক যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে তাকে চলে যেতে হল না ফেরার দেশে। এই ছেলেটি যদি আমার বা আপনার বা ওই ঠিকাদারের হতো, তাহলে তার কেমন লাগত? জিহাদ সবার কাছে একটি প্রশ্ন রেখে গেল- আমার কী অপরাধ? যাদের জন্য আমার এই অকালমৃত্যু- তারা কি কেউ বিচারের সম্মুখীন হবে? জনগণের বন্ধু হিসেবে এ বিষয়গুলো পুলিশের মাথায় থাকা উচিত ছিল। পুলিশের অনেক সফলতার পাশাপাশি কিছু কিছু ব্যর্থতাও রয়েছে। ভুল তথ্য বা প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতার অভাবেই এমনটি ঘটে থাকে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায়, আসল সত্যটা তারা জানতে পারে না। পুলিশেরও এ ধরনের দুর্ঘটনা, ঝুঁকি ও দুর্যোগ সম্পর্কে যথাযথ প্রশিক্ষণ থাকা দরকার।
যুগান্তর : কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনা ঘটলে আমরা আমাদের ব্যর্থতাগুলোকে ধামাচাপা দিতে চাই। জিহাদের ঘটনায়ও তা লক্ষ্য করা গেছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী থেকে শুরু করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের কর্মকর্তাদের কথাবার্তায় তা প্রমাণও হয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের এ জাতীয় আচরণ জাতিকে কী বার্তা দেয়?
ই. আ. : দেশের মানুষ এ ধরনের মৃত্যু দেখতে চায় না। আর এজন্যই স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী, অন্যান্য উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা, ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের মহাপরিচালকসহ সমাজের সর্বস্তরের মানুষ শীতের রাতে ঘটনাস্থলে ছুটে যান এবং দীর্ঘসময় উদ্ধার কাজে বিভিন্নভাবে অংশগ্রহণ করেন। টিভি চ্যানেলগুলো নিয়মিত সংবাদ পরিবেশন করতে থাকে। উৎসুক কোটি কোটি মানুষ জিহাদের সুস্থ অবস্থায় ফিরে আসার অপেক্ষায় থাকলেও তাকে পাওয়া যায় না। তখন এক ধরনের ধূম্রজাল তৈরি হয়। এটা মূলত অজ্ঞতার কারণে ঘটেছে। বিষয়টি তাদের কাছে অস্পষ্ট ছিল। পুলিশ বা সংশ্লিষ্টদের কাছে যে কোনোভাবেই হোক, একটা ভুলবার্তা চলে গেছে। এ ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। শিশু জিহাদের মৃত্যুর ঘটনাই যেন শেষ ঘটনা হয়।
যুগান্তর : জিহাদের উদ্ধার কার্যক্রমে সমন্বয়হীনতা লক্ষ্য করা গেছে। দেখা গেছে, পুলিশ পুলিশের মতো চিন্তা করছে, ফায়ার সার্ভিস তাদের মতো চিন্তা করছে। মন্ত্রী আরেক রকম। যে কোনো দুর্যোগে বিভিন্ন সংস্থা ও দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের মধ্যে সমন্বয় কতটা জরুরি।
ই. আ. : এটা একটা বড় জিনিস। কো-অপারেশন অ্যান্ড কো-অর্ডিনেশনের দারুণ অভাব রয়েছে আমাদের মধ্যে। রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে একটা নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ঝুঁকি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা নিয়ে কাজ করতে হবে। এ ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ গ্রহণ করতে হবে।
যুগান্তর : জাতি হিসেবে চরিত্রগতভাবেই কি আমরা বিশৃঙ্খল? জিহাদের ঘটনা কি তাই প্রমাণ করে?
ই. আ. : আমি বিশৃংখল বলব না। মনে রাখতে হবে, বিশ্বের অন্যতম শক্তিশালী একটা সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে যুদ্ধ করেই আমরা স্বাধীন হয়েছি। মূলত ব্রিটিশদের যে কলোনিয়াল সিস্টেম, তা থেকে আমরা এখনও পুরোপুরি মুক্ত হতে পারিনি। জিহাদের উদ্ধার তৎপরতার ক্ষেত্রে প্রথমে এর মধ্যে স্থাপিত সাব-মার্সিবল পাম্পটি উত্তোলনের প্রক্রিয়া শুরু হয়। ৩৬০ ফুট দীর্ঘ এ পাম্পটি তুলতে প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা সময় লেগে যায়। আশা ছিল, এ পাম্পটির নিচে এমন কিছু আছে যার সঙ্গে আটকে জিহাদ উঠে আসবে আমাদের কাছে। কিন্তু সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ হল। শুধু আবেগের বশবর্তী হয়ে এক যুবক এগিয়ে এলো নলকূপে নেমে জিহাদকে উঠানোর জন্য। কিন্তু ওই ১৪ ইঞ্চি ব্যাসের ৬০০ ফুট দৈর্ঘ্যরে পাইপের ভেতরে কোনো মানুষকে রশি বেঁধে নামানো হলে তার নিজের মৃত্যুকে বরণ করে নেয়া ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। এ বিষয়টি যখন টিভি চ্যানেল থেকে জানানো হল, তখন এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত হল সে। এটা একটি বুদ্ধিমানের কাজ হয়েছে। অন্যথায় অজ্ঞতার কারণে পুরো জাতি আর একজন জীবন্ত যুবককে মারার দায়িত্ব থেকে মুক্তি পেত না। এরপর শোনা গেল, বুয়েটের কিছু প্রকৌশলী ‘ক্যাচার’ নিয়ে সেখানে উপস্থিত হয়েছেন এবং এর দ্বারা ওই শিশুকে সহজে ওপরে তুলে আনা সম্ভব হবে। মানুষ আবার নতুন আশায় ভর করে অপেক্ষা করছিল। এ সময় ওয়াসা ও একটি বেসরকারি সংস্থা কূপের মধ্যে ক্যামেরা নামিয়ে ছবি সংগ্রহ করে এবং জানায়- কূপের ভেতর কোনো শিশুর অস্তিত্ব নেই। সবাই হতাশ হয়ে গেল। তখন সন্দেহ হল- জিহাদ আসলেই ওই কূপে পড়েছে কিনা। এর মধ্যে অন্যান্য টিভি চ্যানেলে প্রচারিত সংবাদে উদ্ধার কর্মীরাও সন্দিহান হয়ে গেল। ক্যামেরা সরিয়ে নেয়া হল, ক্যাচারের যন্ত্রাংশ খোলা হল এবং তারা ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিল। এসব বিশৃঙ্খলার মধ্যে ঘটেছে- এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
যুগান্তর : মৃত জিহাদকে উদ্ধারে স্থানীয় প্রযুক্তি সফলতা পেয়েছে। কিন্তু এ ধরনের প্রযুক্তি বড় মাপের কোনো দুর্যোগ বা ঝুঁকি মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। এ ক্ষেত্রে দুর্যোগ ও ঝুঁকি মোকাবেলায় জনআগ্রহকে কাজে লাগিয়ে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী গড়ে তুলে সুফল পাওয়া যাবে কি?
ই. আ. : যে কোনো মুহূর্তে উদ্ধার কাজ পরিত্যক্ত ঘোষণা হতে পারে- এমন একটা অবস্থায় একজন বিশেষজ্ঞের কথা প্রচার করা হল- যেহেতু দুজন শিশু একসঙ্গে মাঠে খেলা করছিল, তাদের একজন কূপের মধ্যে পড়ে যাওয়ার পর আরেকজন দৌড়ে গিয়ে জিহাদের মাকে খবর দিয়েছে, জিহাদ কূপে পড়ে গেছে। এ সংবাদ মিথ্যা হতে পারে না। নিষ্পাপ শিশুরা মিথ্যা বলতে পারে না। জিহাদের দেহ অবশ্যই ওই কূপে আছে এবং এটা তোলা সম্ভব। স্থানীয় জনতা আগ্রহী হয়ে উঠলেন তাদের নিজস্ব প্রযুক্তি ব্যবহার করে জিহাদকে তোলার জন্য। দীর্ঘ সময় পার হয়ে গেল, কিন্তু তাদের অনুমতি দেয়া হল না। অনেকের ধারণা, যারা এ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী, তারা প্রভাব খাটিয়ে জিহাদের মৃতদেহ নলকূপ থেকে না তুলে নলকূপে আদৌ কেউ পড়েনি, তা প্রমাণ করার জন্য নানাভাবে প্রচেষ্টা শুরু করে। ফলে এক সময় বলা হয়, কূপের মধ্যে জিহাদ নেই এবং উদ্ধার কাজ সমাপ্ত ঘোষণা করা হয়। উৎসুক জনতা বিষয়টি বুঝতে পেরে ক্ষোভে ফেটে পড়লে কয়েক মিনিট পর স্থানীয় লোকদের স্থানীয় প্রযুক্তির মাধ্যমে অব্যাহত প্রচেষ্টার ফসল হিসেবে ৬০০ ফুট গভীরতার ৩৮৫ ফুট গভীর থেকে তুলে আনা হল জিহাদকে। সবাই অবাক দৃষ্টিতে দেখল- বাঁ-হাতের বাহু দিয়ে চোখ ঢেকে সে ঘুমিয়ে আছে। সবাই আনন্দে উচ্ছ্বসিত হল। কিন্তু পরক্ষণেই দেখা গেল, জিহাদের দেহে প্রাণ নেই। এটা অবশ্যই একটা শিক্ষণীয় ঘটনা। এ থেকে শিক্ষা নিয়ে দুর্যোগ মোকাবেলায় স্বেচ্ছাসেবী দল গঠন করা যেতে পারে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার সময় এ দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছে। সাধারণ মানুষ সরকারি বাহিনীর পাশাপাশি উদ্ধার কাজে অংশ নিয়েছিল। তবে এ ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রযুক্তির সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা উদ্ভাবন ও ব্যবহারের ওপর জোর দিতে হবে।
যুগান্তর : যে কোনো দুর্ঘটনা রোধে রাষ্ট্রের পাশাপাশি সমাজ ও পরিবারের কী ভূমিকা হওয়া উচিত?
ই. আ. : ছেলেমেয়ে কোথায় যাচ্ছে, কোথায় আড্ডা বা খেলাধুলা করছে, কাদের সঙ্গে মিশছে- এটার দেখার দায়িত্ব মূলত পরিবারের। রাষ্ট্রের পক্ষে তো প্রতিটি মানুষের দেখভাল করা সম্ভব নয়। এ কাজ বাবা-মা ও আত্মীয়-স্বজনদেরই করতে হবে। তবে রাষ্ট্র যেটা করতে পারে তা হল- একটা জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে, যত্নশীল হতে পারে।
যুগান্তর : আপনাকে ধন্যবাদ।
ই. আ. : আপনাকেও ধন্যবাদ।
No comments