ডিএমপি কমিশনারের জবাবদিহি চাই by মহিউদ্দিন আহমদ
ইটালির এক শিশুকে গভীর এক গর্ত থেকে
উদ্ধার চেষ্টার স্মৃতিটা আজ ৪০ বছর পরও ভুলতে পারি না। ১৯৭৫ বা ৭৬-এর কোনো
এক সময়। আমি তখন জেনেভায় বাংলাদেশের জাতিসংঘ মিশনে কর্মরত। তখন টিভির এমন
ব্যাপক ব্যবহার ছিল না। তবু যে কটি চ্যানেল চালু ছিল- ইউরোপের প্রায় সব
বয়স্ক মানুষকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল শিশুটির উদ্ধার প্রচেষ্টার সম্প্রচার
দিয়ে।
শিশুটির বয়স তখন বোধ হয় তিন বা চার- আমাদের জিহাদের বয়সী। ইটালির সেই শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল কিনা, এখন মনে নেই। তবে মনে আছে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে আসা ইটালির প্রেসিডেন্টের এক মন্তব্য : মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে সুস্থ অবস্থায় আবার ফেরতও আনতে পারছে মানুষ। কিন্তু গর্তে পড়ে যাওয়া একটা শিশুকে উদ্ধার করার প্রযুক্তি এখনও মানুষ আবিষ্কার করতে পারল না, কী লজ্জা! ইটালির প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের পর এক্ষেত্রে গত ৪০ বছরে প্রযুক্তির বেশ উন্নতি ঘটেছে; দুনিয়ার অনেক জায়গাতেই এমন উদ্ধার করা শিশুদের কিছু বর্ণনা গতকাল আমাদের এক টিভি চ্যানেলে দেখলাম। তবে শিশু জিহাদের ব্যর্থ সরকারি উদ্ধার প্রচেষ্টায় দেখলাম, আমাদের অবস্থা যেমন ছিল তেমনই আছে। যে কোনো দুর্ঘটনার পর আমাদের সরকারগুলোর ব্যর্থতা গত কয়েক বছরে কতবারই না দেখল এদেশের মানুষ। সাভারে কয়েক বছর আগে একটি ভবনের ধস দেখল মানুষ, তাজরিন গার্মেন্ট, রানা প্লাজা ট্রাজেডি, পিনাক লঞ্চডুবি, দেশের বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনা এবং এই সিরিজে শুক্র-শনিবার শাহজাহানপুরের উল্লেখিত দুর্ঘটনা। শাহজাহানপুরের দুর্ঘটনাটি সর্বসাম্প্র্রতিক, কিন্তু সর্বশেষ দুর্ঘটনা নয় মোটেও।
জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টা শিশু জিহাদ কিভাবে কাটিয়েছে ভাবতে গেলে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। শিশুটি নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকে ডেকেছে, অন্ধকারে অঝোরে কেঁদেছে। তার বন্ধুদের কথাও তার মনে পড়েছে। কিন্তু কেউই তার কাছে যাচ্ছে না। তার গায়ে শীতের কাপড়ও নেই। আমরা ওই শিশু বয়সে যখন ভয় পেয়েছি, মায়ের বুকে ঢুকে পড়েছি, সেখানে আশ্রয়ও পেয়েছি। শাহজাহানপুরের সেই গর্তের আশপাশে যারা শিশুটির উদ্ধার তৎপরতা দেখেছে- তখন তারাও সাহায্য করতে পারছে না। তারা দেখতে পারছে, বুঝতে পারছে, একটি নিষ্পাপ নিরীহ অসহায় শিশু মারা যাচ্ছে। কিন্তু তারাও অসহায়, শিশু জিহাদের মৃত্যুটি পানিতে ডুবে কয়েক মিনিটের মৃত্যু না। মারা যাওয়ার আগে বোধহয় অচেতন হয়ে মৃত্যুও নয়। মৃত্যুর ভয়-বিভীষিকা-যন্ত্রণায় প্রতিটি সেকেন্ড তাকে সাফার করতে হয়েছে। সরকারের এ ব্যর্থতার পাশাপাশি পুলিশের নিষ্ঠুরতাও আবার ধরা পড়ল এ দুর্ঘটনায়।
জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে ১২ ঘণ্টা আটকে রাখল শাহজাহানপুর থানা পুলিশ। ছেলে বেঁচে আছে না মারা গেছে- তা জানেন না বাবা, শিশু জিহাদের মঙ্গল চিন্তায় অস্থির বাবা। কিন্তু পুলিশ তাকে র্যাবের ভয়ও দেখায়। প্রকৃত ঘটনা চাপা দেয়ার অপচেষ্টা করে আরেকটি অপরাধ করে খোদ পুলিশ। আওয়ামী লীগের এমপিদের হাতে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মারধর খাওয়া এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাসমূহের নিন্দা জানিয়ে আমি কয়েকবার আমার কলামে লিখেছি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আমার এমন সমর্থনের প্রশংসায় তৎকালীন আইজিপি, বর্তমান ক্রীড়া সচিব নূর মোহাম্মদ আমাকে চিঠিও লিখেছেন।
জিহাদের বাবা নাসির ফকিরের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতার নির্দেশ নিশ্চয়ই ওপর মহল থেকে এসেছে। কিন্তু এই ওপর মহলের ব্যক্তি কে? দেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের আইজি, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, নাকি খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে এখন একজন জোকারই মনে হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আদুরী নামে চরম নির্যাতিতা এক শিশু কাজের মেয়েকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিছু ফলমূল নিয়ে। তাকে তারিফ করে কলাম লিখেছিলাম। টেলিফোনেও তারিফ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ধরেননি। তাকে দয়াময় একজন মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আর তা মনে করতে পারছি না। তারই সরাসরি অধীনস্থ শাহজাহানপুর থানার কিছু পুলিশ সদস্য জিহাদের বাবাকে তেলাপোকার মতোই গণ্য করল!
কমিশনার বেনজীর আহমেদকে এখন আর দয়ামায়ার মানুষ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একজন প্রাচীন আমলের পুলিশ। এখন আমার আশংকা, কোনো নেতা-মন্ত্রী জিহাদের বাবা-মাকে অফিসে ডেকে নিয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দেবে এবং আবার অপমান করবে; কিন্তু মাফ চাইবে না। চারপাশের এত ব্যর্থতা ও দুর্ঘটনার পরও কয়েকজন তরুণ শিশু জিহাদকে তুলে এনে, হোক না তা একটি লাশ, মানব প্রেমের যে উদাহরণ সৃষ্টি করল তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমি মাথানত করছি। এদেশের কোটি মানুষ শিশু জিহাদকে কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু তার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া-দরুদ পড়েছে। তার বাবা-মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। সবশেষে আমার দুটি প্রশ্ন : ঢাকনা খোলা রাখার জন্য দায়ী সে কন্ট্রাক্টর এসআর কোম্পানির মালিকের নাম ঠিকানা কী? তিনি কোন দল করেন? এতসব নেতা-মন্ত্রী ঘটনাস্থলে গেলেন, কিন্তু শাহজাহানপুরের নির্বাচিত এমপি এ কয়দিন কোথায় থাকলেন? তার নাম এ দুদিনে একবারও কোথাও দেখলাম না কেন?
মহিউদ্দিন আহমদ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব
শিশুটির বয়স তখন বোধ হয় তিন বা চার- আমাদের জিহাদের বয়সী। ইটালির সেই শিশুটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল কিনা, এখন মনে নেই। তবে মনে আছে ঘটনাস্থলে পরিদর্শনে আসা ইটালির প্রেসিডেন্টের এক মন্তব্য : মানুষকে চাঁদে পাঠিয়ে সুস্থ অবস্থায় আবার ফেরতও আনতে পারছে মানুষ। কিন্তু গর্তে পড়ে যাওয়া একটা শিশুকে উদ্ধার করার প্রযুক্তি এখনও মানুষ আবিষ্কার করতে পারল না, কী লজ্জা! ইটালির প্রেসিডেন্টের ওই মন্তব্যের পর এক্ষেত্রে গত ৪০ বছরে প্রযুক্তির বেশ উন্নতি ঘটেছে; দুনিয়ার অনেক জায়গাতেই এমন উদ্ধার করা শিশুদের কিছু বর্ণনা গতকাল আমাদের এক টিভি চ্যানেলে দেখলাম। তবে শিশু জিহাদের ব্যর্থ সরকারি উদ্ধার প্রচেষ্টায় দেখলাম, আমাদের অবস্থা যেমন ছিল তেমনই আছে। যে কোনো দুর্ঘটনার পর আমাদের সরকারগুলোর ব্যর্থতা গত কয়েক বছরে কতবারই না দেখল এদেশের মানুষ। সাভারে কয়েক বছর আগে একটি ভবনের ধস দেখল মানুষ, তাজরিন গার্মেন্ট, রানা প্লাজা ট্রাজেডি, পিনাক লঞ্চডুবি, দেশের বিভিন্ন সড়ক দুর্ঘটনা এবং এই সিরিজে শুক্র-শনিবার শাহজাহানপুরের উল্লেখিত দুর্ঘটনা। শাহজাহানপুরের দুর্ঘটনাটি সর্বসাম্প্র্রতিক, কিন্তু সর্বশেষ দুর্ঘটনা নয় মোটেও।
জীবনের শেষ কয়েক ঘণ্টা শিশু জিহাদ কিভাবে কাটিয়েছে ভাবতে গেলে আমার শরীর অবশ হয়ে আসে। শিশুটি নিশ্চয়ই তার বাবা-মাকে ডেকেছে, অন্ধকারে অঝোরে কেঁদেছে। তার বন্ধুদের কথাও তার মনে পড়েছে। কিন্তু কেউই তার কাছে যাচ্ছে না। তার গায়ে শীতের কাপড়ও নেই। আমরা ওই শিশু বয়সে যখন ভয় পেয়েছি, মায়ের বুকে ঢুকে পড়েছি, সেখানে আশ্রয়ও পেয়েছি। শাহজাহানপুরের সেই গর্তের আশপাশে যারা শিশুটির উদ্ধার তৎপরতা দেখেছে- তখন তারাও সাহায্য করতে পারছে না। তারা দেখতে পারছে, বুঝতে পারছে, একটি নিষ্পাপ নিরীহ অসহায় শিশু মারা যাচ্ছে। কিন্তু তারাও অসহায়, শিশু জিহাদের মৃত্যুটি পানিতে ডুবে কয়েক মিনিটের মৃত্যু না। মারা যাওয়ার আগে বোধহয় অচেতন হয়ে মৃত্যুও নয়। মৃত্যুর ভয়-বিভীষিকা-যন্ত্রণায় প্রতিটি সেকেন্ড তাকে সাফার করতে হয়েছে। সরকারের এ ব্যর্থতার পাশাপাশি পুলিশের নিষ্ঠুরতাও আবার ধরা পড়ল এ দুর্ঘটনায়।
জিহাদের বাবা নাসির ফকিরকে ১২ ঘণ্টা আটকে রাখল শাহজাহানপুর থানা পুলিশ। ছেলে বেঁচে আছে না মারা গেছে- তা জানেন না বাবা, শিশু জিহাদের মঙ্গল চিন্তায় অস্থির বাবা। কিন্তু পুলিশ তাকে র্যাবের ভয়ও দেখায়। প্রকৃত ঘটনা চাপা দেয়ার অপচেষ্টা করে আরেকটি অপরাধ করে খোদ পুলিশ। আওয়ামী লীগের এমপিদের হাতে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মারধর খাওয়া এবং লাঞ্ছিত হওয়ার ঘটনাসমূহের নিন্দা জানিয়ে আমি কয়েকবার আমার কলামে লিখেছি। পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের প্রতি আমার এমন সমর্থনের প্রশংসায় তৎকালীন আইজিপি, বর্তমান ক্রীড়া সচিব নূর মোহাম্মদ আমাকে চিঠিও লিখেছেন।
জিহাদের বাবা নাসির ফকিরের প্রতি এমন নিষ্ঠুরতার নির্দেশ নিশ্চয়ই ওপর মহল থেকে এসেছে। কিন্তু এই ওপর মহলের ব্যক্তি কে? দেশের কোনো গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশের আইজি, ঢাকার পুলিশ কমিশনার, নাকি খোদ স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীকে এখন একজন জোকারই মনে হয়। ঢাকার পুলিশ কমিশনার বেনজীর আহমেদ গত বছরের সেপ্টেম্বরে আদুরী নামে চরম নির্যাতিতা এক শিশু কাজের মেয়েকে দেখতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়েছিলেন কিছু ফলমূল নিয়ে। তাকে তারিফ করে কলাম লিখেছিলাম। টেলিফোনেও তারিফ করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু ধরেননি। তাকে দয়াময় একজন মানুষ ভেবেছিলাম। কিন্তু এখন আর তা মনে করতে পারছি না। তারই সরাসরি অধীনস্থ শাহজাহানপুর থানার কিছু পুলিশ সদস্য জিহাদের বাবাকে তেলাপোকার মতোই গণ্য করল!
কমিশনার বেনজীর আহমেদকে এখন আর দয়ামায়ার মানুষ মনে হচ্ছে না। মনে হচ্ছে একজন প্রাচীন আমলের পুলিশ। এখন আমার আশংকা, কোনো নেতা-মন্ত্রী জিহাদের বাবা-মাকে অফিসে ডেকে নিয়ে কিছু টাকা ধরিয়ে দেবে এবং আবার অপমান করবে; কিন্তু মাফ চাইবে না। চারপাশের এত ব্যর্থতা ও দুর্ঘটনার পরও কয়েকজন তরুণ শিশু জিহাদকে তুলে এনে, হোক না তা একটি লাশ, মানব প্রেমের যে উদাহরণ সৃষ্টি করল তাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আমি মাথানত করছি। এদেশের কোটি মানুষ শিশু জিহাদকে কোনোদিন দেখেনি। কিন্তু তার জন্য আন্তরিকভাবে দোয়া-দরুদ পড়েছে। তার বাবা-মার সঙ্গে একাত্ম হয়ে উঠেছে। সবশেষে আমার দুটি প্রশ্ন : ঢাকনা খোলা রাখার জন্য দায়ী সে কন্ট্রাক্টর এসআর কোম্পানির মালিকের নাম ঠিকানা কী? তিনি কোন দল করেন? এতসব নেতা-মন্ত্রী ঘটনাস্থলে গেলেন, কিন্তু শাহজাহানপুরের নির্বাচিত এমপি এ কয়দিন কোথায় থাকলেন? তার নাম এ দুদিনে একবারও কোথাও দেখলাম না কেন?
মহিউদ্দিন আহমদ : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব
No comments