খেলাপি ঋণের চাপে ভেঙে পড়ছে ব্যাংকিং খাত
খেলাপি ঋণের মাত্রাতিরিক্ত চাপে ব্যাংকিং
খাতের মেরুদণ্ড ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে। ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়ছে
ব্যাংকগুলোর আর্থিক ভিত্তি। বিভিন্ন ব্যাংকের আর্থিক সূচকগুলোতেও পড়তে শুরু
করেছে এর নেতিবাচক প্রভাব। ব্যাংকগুলোর অর্জিত মুনাফা চলে যাচ্ছে প্রভিশন
(খেলাপি ঋণের বিপরীতে নির্ধারিত হারে অর্থ মজুদ রাখা) খাতে। ফলে
বিনিয়োগকারীরা মুনাফা পাচ্ছেন কম। আমানতকারীরাও পড়েছেন ঝুঁকির মুখে। কমানো
যাচ্ছে না ঋণের চড়া সুদ ও সার্ভিস চার্জ। এই যখন অবস্থা তখন ঋণ আদায়
বাড়ানোর জন্য জোরালো ব্যবস্থা না নিয়ে বরং যেকোনো মূল্যে খেলাপি ঋণ ১০
শতাংশের নিচে নামিয়ে আনার জন্য ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয়
ব্যাংক। এ নির্দেশ পেয়ে ব্যাংকগুলো গণহারে ‘নবায়ন ও অবলোপন’ করে খেলাপি ঋণ
কমানোর আয়োজন করেছে।
সাবেক ব্যাংকাররা এ উদ্যোগকে ‘লেজার (যেসব খাতাপত্রে ঋণের হিসাব রাখা হয়) জালিয়াতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ছুটির দিনে ব্যাংক খোলা রেখে ব্যাংকাররা এ জালিয়াতিই করেছেন। তাদের মতে, বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে বেড়ে যাওয়া খেলাপি ঋণ কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। হিসাবের জাল জালিয়াতি করে বা খেলাপি ঋণকে নবায়ন বা অবলোপন করে প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হলে একসময় এগুলো আর্থিক খাতের বিষফোঁড় হয়ে দাঁড়াবে। এর দায়দায়িত্ব তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর হিসাবে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা থেকে প্রভিশন ও স্থগিত সুদ বাদ দিয়ে নিট খেলাপি ঋণ আরও কম দেখাচ্ছে। বাস্তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঘোষিত তথ্যের চেয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ৪ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ খেলাপি। এ হিসাব ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। বাস্তবে এর সঙ্গে আরও যোগ হবে অবলোপন করা ঋণ। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করে তাদের হিসাব থেকে বাদ দিয়েছে। বাস্তবে এসব ঋণও খেলাপি। বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো নিজস্বভাবে করেছে আরও কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে যেগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য, কিন্তু খেলাপি করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে আরও কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ যেগুলো খেলাপি করার নির্দেশ দেয়ার পরও করা হয়নি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় : গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খেলাপি হওয়া ঋণ ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নবায়ন, ডাউনপেমেন্ট (এককালীন নগদ পরিশোধ) নির্ধারণ ও ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম দফায় ১০, দ্বিতীয় দফায় ১৫, তৃতীয় দফায় ২৫ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হয়। ওই সার্কুলার জারির পর ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক চাপে অনেক খেলাপির ঋণ কোনো রকম ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য পুনর্গঠন করেছে। এতে ব্যাংকগুলোর কোনো আয় হয়নি। ঋণও ফেরত আসেনি। অথচ ওই ঋণের ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যাংকের খরচ বেড়েছে। ফলে বেড়েছে ব্যাংকের ব্যয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আর্থিক সূচকে। প্রায় সব ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রকট হয়ে উঠেছে এই নেতিবাচক প্রভাব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো রকম ডাউনপেমেন্ট ছাড়া বা নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট নিয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে কিস্তি পরিশোধ না করায় বেশিরভাগই আবার হয়ে যাচ্ছে খেলাপি। এতে আবার যেমন আশংকা করা হচ্ছে খেলাপি ঋণ হয়ে যাওয়ার, তেমনি এই ঋণ যাতে আর না বাড়ে সে কারণে পুনর্গঠন বা পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে একটি গ্রুপেরই প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি গ্রুপের এক থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছিল। সেগুলোকেও একইভাবে নবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে : নূরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, ইলিয়াস ব্রাদার্স, এসএ গ্রুপ ও মোস্তফা গ্রুপের নাম। ব্যাংকিং ভাষায় এসব ঋণ নিয়মিত হলেও এগুলোর বিপরীতে ব্যাংকের কোনো আয় নেই। অর্থাৎ নন পারফরমিং। যা এক ধরনের খেলাপির পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
এ তো গেল শুধু বড় অংকের ঋণের হিসাব। এর বাইরে রয়েছে ছোট অংকের, এসএমই ও কৃষি ঋণ। ওইগুলো ব্যাংকাররা নিজ ক্ষমতায়ই নবায়ন করতে পারেন, খেলাপি হলেও তা না করে নিয়মিত রেখে দিতে পারেন। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে প্রায়ই ধরা পড়ছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে সেগুলো আবার খেলাপি করা হচ্ছে। এভাবে যেসব খেলাপি করা হচ্ছে সেগুলো ওই প্রান্তিকের হিসাবে আসছে না। আসছে পরের প্রান্তিকে। এ রকম প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত বছর শুধু বেসিক ব্যাংকেই তদন্ত করে ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক তা করেনি। এ অভিযোগে এমডিকে অপসারণের পর সেগুলো খেলাপি করা হয়েছে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, ন্যাশনাল ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকেও অনেক ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি হওয়ার যোগ্য এমন অনেক ঋণ ব্যাংকগুলো খেলাপি করেনি। কমার্স ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবে এসবি গ্রুপের ঋণ খেলাপি করেনি। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই ঋণ আদায়, অন্যথায় খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকে এমন ঋণ কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ব্যাংকগুলো নিজ ক্ষমতায় ছোট অংকের, কৃষি, এসএমই ঋণ নবায়ন করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে খেলাপিযোগ্য ঋণ রাখা হয়েছে নিয়মিত। খেলাপি করা হলেও বিধি না মেনেই দ্রুত করা হয়েছে নবায়ন। কারণ, খেলাপি হলেই শাখার বদনাম, বিশেষ বোনাস না পাওয়ার সম্ভাবনা, পদোন্নতিও আটকে যেতে পারে। ফলে শাখা পর্যায় থেকেই খেলাপি না করার প্রবণতা শুরু। এ অবস্থা চলে আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়েও। এভাবে ব্যাংকগুলো আরও কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ কম খেলাপি দেখায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে না পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সুশাসন না থাকলে ব্যাংক ভালো চলবে না। ভালো না চললে ঋণ খেলাপি হবে। এর দায় টানতে হবে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে বিদেশে এলসির গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি দিতে হয়। এতে বাড়ে খরচ। খেলাপি ঋণ বাড়লে বেশি পরিমাণে প্রভিশন রাখতে হয়। তখন মুনাফা চলে যায় প্রভিশন খাতে। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকির আওতায় আসতে হয়। এসব কারণে ব্যাংকগুলো যথাসম্ভব তাদের খেলাপি ঋণ কম দেখানোর চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে। একসময় তা আর ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না, প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন ব্যাংক বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে এ ধরনের ঘটনা সাবেক ওরিয়েন্টাল (আইসিবি ইসলামিক), সিটি, ইউসিবি, ন্যাশনাল, পূবালী, উত্তরা ও আল আরাফাহ ব্যাংকে হয়েছে। এগুলো প্রবলেম ব্যাংকের আওতায় পড়েছিল। বিশেষ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে।
ওই অভিজ্ঞতার পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, এই ডিসেম্বরের মধ্যে যে করেই হোক খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পেয়ে ব্যাংকগুলো এখন তো আর আদায় বাড়াতে পারছে না। ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন, অবলোপন করছে। নবায়নের ব্যাপারে ডাউনপেমেন্ট দিতে না পারলেও আগাম চেক নিয়েও পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। যা ব্যাংকিং আইনে বিধিসম্মত নয়। এ ছাড়া আগাম চেকের মাধ্যমে টাকা আদায় হয় না। এ ধরনের চেকের নামে প্রতারণা করায় কমার্স, অগ্রণী, জনতা ও সোনালী ব্যাংক থেকে একাধিক মামলা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে চিন্তিত নই। খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের খেলাপি ঋণের কারণেই সার্বিকভাবে এর পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে খেলাপি ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এগুলো বাদ দিলে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ শতাংশের মতো।
সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্টের ৪৯১ কোটি, বেসিকের ৬ হাজার ১৫০ কোটি, কৃষির ৪ হাজার ৫৬৩ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়নের ১ হাজার ৪৬০ কোটিসহ চার ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। সরকারি সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সরকারি আট ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক : ব্যাংকাররা বলেছেন, কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত তা বেড়েছে ১০ হাজার ৭৬২ টাকা।
এদিকে গত সাত বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২০ হাজার ১০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। ওই সাত বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২০ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার ১০৩ শতাংশ। এর সঙ্গে গত নয় মাসের আরও প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
সাবেক ব্যাংকাররা এ উদ্যোগকে ‘লেজার (যেসব খাতাপত্রে ঋণের হিসাব রাখা হয়) জালিয়াতি’ হিসেবে আখ্যায়িত করে বলেছেন, ছুটির দিনে ব্যাংক খোলা রেখে ব্যাংকাররা এ জালিয়াতিই করেছেন। তাদের মতে, বাস্তবতা স্বীকার করে নিয়ে বেড়ে যাওয়া খেলাপি ঋণ কীভাবে কমানো যায় সে বিষয়ে ব্যাংকগুলোকে নিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ নেয়া উচিত। হিসাবের জাল জালিয়াতি করে বা খেলাপি ঋণকে নবায়ন বা অবলোপন করে প্রকৃত চিত্র আড়াল করা হলে একসময় এগুলো আর্থিক খাতের বিষফোঁড় হয়ে দাঁড়াবে। এর দায়দায়িত্ব তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংককেই নিতে হবে। প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ব্যাংকগুলোর হিসাবে যে পরিমাণ খেলাপি ঋণ দেখাচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক তা থেকে প্রভিশন ও স্থগিত সুদ বাদ দিয়ে নিট খেলাপি ঋণ আরও কম দেখাচ্ছে। বাস্তবে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ঘোষিত তথ্যের চেয়ে খেলাপি ঋণের পরিমাণ আরও বেশি। গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে মোট ঋণ ছিল ৪ লাখ ৯৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে খেলাপি ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। মোট ঋণের ১১ দশমিক ৬০ শতাংশ খেলাপি। এ হিসাব ব্যাংকগুলোর দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি। বাস্তবে এর সঙ্গে আরও যোগ হবে অবলোপন করা ঋণ। এখন পর্যন্ত ব্যাংকগুলো প্রায় ৩৩ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ অবলোপন করে তাদের হিসাব থেকে বাদ দিয়েছে। বাস্তবে এসব ঋণও খেলাপি। বিশেষ বিবেচনায় নবায়ন করা হয়েছে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকগুলো নিজস্বভাবে করেছে আরও কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা। আর কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা রয়েছে যেগুলো খেলাপি হওয়ার যোগ্য, কিন্তু খেলাপি করা হয়নি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে ধরা পড়েছে আরও কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকার মতো ঋণ যেগুলো খেলাপি করার নির্দেশ দেয়ার পরও করা হয়নি।
রাজনৈতিক বিবেচনায় : গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে জারি করা এক সার্কুলারে রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে খেলাপি হওয়া ঋণ ব্যাংক গ্রাহক সম্পর্কের ভিত্তিতে নবায়ন, ডাউনপেমেন্ট (এককালীন নগদ পরিশোধ) নির্ধারণ ও ঋণ পুনর্গঠনের ক্ষমতা দেয়া হয় ব্যাংকগুলোকে। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী খেলাপি ঋণ নবায়নের ক্ষেত্রে প্রথম দফায় ১০, দ্বিতীয় দফায় ১৫, তৃতীয় দফায় ২৫ শতাংশ ডাউনপেমেন্ট দিতে হয়। ওই সার্কুলার জারির পর ব্যাংকগুলো রাজনৈতিক চাপে অনেক খেলাপির ঋণ কোনো রকম ডাউনপেমেন্ট ছাড়াই নবায়ন এবং দীর্ঘ সময়ের জন্য পুনর্গঠন করেছে। এতে ব্যাংকগুলোর কোনো আয় হয়নি। ঋণও ফেরত আসেনি। অথচ ওই ঋণের ব্যবস্থাপনা খাতে ব্যাংকের খরচ বেড়েছে। ফলে বেড়েছে ব্যাংকের ব্যয়। যার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে আর্থিক সূচকে। প্রায় সব ব্যাংকের ক্ষেত্রেই প্রকট হয়ে উঠেছে এই নেতিবাচক প্রভাব। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে রাজনৈতিক বিবেচনায় কোনো রকম ডাউনপেমেন্ট ছাড়া বা নামমাত্র ডাউনপেমেন্ট নিয়ে প্রায় ৩০ হাজার কোটি টাকার খেলাপি ঋণ নবায়ন করা হয়েছে। এসব ঋণের বিপরীতে কিস্তি পরিশোধ না করায় বেশিরভাগই আবার হয়ে যাচ্ছে খেলাপি। এতে আবার যেমন আশংকা করা হচ্ছে খেলাপি ঋণ হয়ে যাওয়ার, তেমনি এই ঋণ যাতে আর না বাড়ে সে কারণে পুনর্গঠন বা পরিশোধের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে। এভাবে একটি গ্রুপেরই প্রায় চার হাজার কোটি টাকার ঋণের মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি গ্রুপের এক থেকে দুই হাজার কোটি টাকার ঋণ খেলাপি হয়েছিল। সেগুলোকেও একইভাবে নবায়ন করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে : নূরজাহান গ্রুপ, ইমাম গ্রুপ, ইলিয়াস ব্রাদার্স, এসএ গ্রুপ ও মোস্তফা গ্রুপের নাম। ব্যাংকিং ভাষায় এসব ঋণ নিয়মিত হলেও এগুলোর বিপরীতে ব্যাংকের কোনো আয় নেই। অর্থাৎ নন পারফরমিং। যা এক ধরনের খেলাপির পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করেন ব্যাংকাররা।
এ তো গেল শুধু বড় অংকের ঋণের হিসাব। এর বাইরে রয়েছে ছোট অংকের, এসএমই ও কৃষি ঋণ। ওইগুলো ব্যাংকাররা নিজ ক্ষমতায়ই নবায়ন করতে পারেন, খেলাপি হলেও তা না করে নিয়মিত রেখে দিতে পারেন। যা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তদন্তে প্রায়ই ধরা পড়ছে। পরে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশে সেগুলো আবার খেলাপি করা হচ্ছে। এভাবে যেসব খেলাপি করা হচ্ছে সেগুলো ওই প্রান্তিকের হিসাবে আসছে না। আসছে পরের প্রান্তিকে। এ রকম প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকার বেশি ঋণ কেন্দ্রীয় ব্যাংক খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করেছে। গত বছর শুধু বেসিক ব্যাংকেই তদন্ত করে ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকার ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। ব্যাংক তা করেনি। এ অভিযোগে এমডিকে অপসারণের পর সেগুলো খেলাপি করা হয়েছে। সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, ন্যাশনাল ও মার্কেন্টাইল ব্যাংকেও অনেক ঋণ খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
খেলাপি হওয়ার যোগ্য এমন অনেক ঋণ ব্যাংকগুলো খেলাপি করেনি। কমার্স ব্যাংক রাজনৈতিক প্রভাবে এসবি গ্রুপের ঋণ খেলাপি করেনি। ফলে ডিসেম্বরের মধ্যে ওই ঋণ আদায়, অন্যথায় খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। বিভিন্ন ব্যাংকে এমন ঋণ কমপক্ষে ১০ হাজার কোটি টাকা হতে পারে বলে জানিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা।
ব্যাংকগুলো নিজ ক্ষমতায় ছোট অংকের, কৃষি, এসএমই ঋণ নবায়ন করতে পারে। এসব ক্ষেত্রে খেলাপিযোগ্য ঋণ রাখা হয়েছে নিয়মিত। খেলাপি করা হলেও বিধি না মেনেই দ্রুত করা হয়েছে নবায়ন। কারণ, খেলাপি হলেই শাখার বদনাম, বিশেষ বোনাস না পাওয়ার সম্ভাবনা, পদোন্নতিও আটকে যেতে পারে। ফলে শাখা পর্যায় থেকেই খেলাপি না করার প্রবণতা শুরু। এ অবস্থা চলে আঞ্চলিক ও প্রধান কার্যালয়েও। এভাবে ব্যাংকগুলো আরও কমপক্ষে ১০ থেকে ১২ হাজার কোটি টাকার ঋণ কম খেলাপি দেখায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকগুলোকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত রাখতে না পারলে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। সুশাসন না থাকলে ব্যাংক ভালো চলবে না। ভালো না চললে ঋণ খেলাপি হবে। এর দায় টানতে হবে আমানতকারী ও ঋণগ্রহীতাদের।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক সূত্র জানায়, ব্যাংকগুলোর বেশি খেলাপি ঋণ থাকলে বিদেশে এলসির গ্রহণযোগ্যতা কমে যায়। ফলে তৃতীয় পক্ষের গ্যারান্টি দিতে হয়। এতে বাড়ে খরচ। খেলাপি ঋণ বাড়লে বেশি পরিমাণে প্রভিশন রাখতে হয়। তখন মুনাফা চলে যায় প্রভিশন খাতে। বিনিয়োগকারীদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। আর্থিক ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কঠোর তদারকির আওতায় আসতে হয়। এসব কারণে ব্যাংকগুলো যথাসম্ভব তাদের খেলাপি ঋণ কম দেখানোর চেষ্টা করে। এর মাধ্যমে ব্যাংকের প্রকৃত অবস্থা আড়াল করে। একসময় তা আর ঢেকে রাখা সম্ভব হয় না, প্রকাশ হয়ে পড়ে। তখন ব্যাংক বাঁচাতে হস্তক্ষেপ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আগে এ ধরনের ঘটনা সাবেক ওরিয়েন্টাল (আইসিবি ইসলামিক), সিটি, ইউসিবি, ন্যাশনাল, পূবালী, উত্তরা ও আল আরাফাহ ব্যাংকে হয়েছে। এগুলো প্রবলেম ব্যাংকের আওতায় পড়েছিল। বিশেষ চিকিৎসা দিয়ে সুস্থ করা হয়েছে।
ওই অভিজ্ঞতার পরও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বলা হচ্ছে, এই ডিসেম্বরের মধ্যে যে করেই হোক খেলাপি ঋণের হার ১০ শতাংশের নিচে নামাতে হবে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ নির্দেশনা পেয়ে ব্যাংকগুলো এখন তো আর আদায় বাড়াতে পারছে না। ব্যাপক হারে খেলাপি ঋণ নবায়ন, অবলোপন করছে। নবায়নের ব্যাপারে ডাউনপেমেন্ট দিতে না পারলেও আগাম চেক নিয়েও পুনঃতফসিল করা হচ্ছে। যা ব্যাংকিং আইনে বিধিসম্মত নয়। এ ছাড়া আগাম চেকের মাধ্যমে টাকা আদায় হয় না। এ ধরনের চেকের নামে প্রতারণা করায় কমার্স, অগ্রণী, জনতা ও সোনালী ব্যাংক থেকে একাধিক মামলা করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, খেলাপি ঋণ নিয়ে চিন্তিত নই। খেলাপি ঋণ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হলেও এতে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। মাত্র কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের খেলাপি ঋণের কারণেই সার্বিকভাবে এর পরিমাণ বেড়েছে। কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকসহ কয়েকটি রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাদ দিলে খেলাপি ঋণ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই। এগুলো বাদ দিলে বর্তমানে খেলাপি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ২ শতাংশের মতো।
সূত্র জানায়, গত সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্টের ৪৯১ কোটি, বেসিকের ৬ হাজার ১৫০ কোটি, কৃষির ৪ হাজার ৫৬৩ কোটি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়নের ১ হাজার ৪৬০ কোটিসহ চার ব্যাংকের মোট খেলাপি ঋণ ১২ হাজার ৬৬২ কোটি টাকা। সরকারি সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ২০ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। সরকারি আট ব্যাংকেই খেলাপি ঋণ ৩৩ হাজার ৪৬২ কোটি টাকা।
পরিস্থিতি উদ্বেগজনক : ব্যাংকাররা বলেছেন, কেউ স্বীকার করুক আর নাই করুক ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণ পরিস্থিতি উদ্বেগজনক। জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর এই নয় মাসে বেড়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা। গত বছর ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। গত সেপ্টেম্বরে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫৭ হাজার ৩০০ কোটি টাকায়। গত জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৭ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকা। জুন পর্যন্ত তা বেড়েছে ১০ হাজার ৭৬২ টাকা।
এদিকে গত সাত বছরে ব্যাংকিং খাতে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। ২০০৬ সালের ডিসেম্বরে খেলাপি ঋণ ছিল ২০ হাজার ১০ কোটি টাকা। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪০ হাজার ৫৮৩ কোটি টাকা। ওই সাত বছরে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েছে ২০ হাজার ৫৭৩ কোটি টাকা। শতকরা হিসাবে এ বৃদ্ধির হার ১০৩ শতাংশ। এর সঙ্গে গত নয় মাসের আরও প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা যোগ করলে খেলাপি ঋণ বাড়ার পরিমাণ দাঁড়ায় সাড়ে ৩৭ হাজার কোটি টাকা।
No comments