বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের by মিজানুর রহমান ও কাজী সুমন
যুক্তরাষ্ট্রকে
নিয়ে সরকারের তরফে অব্যাহত নেতিবাচক বক্তব্যে দেশটির সঙ্গে সম্পর্কের
অবনতির আশঙ্কা করছেন আন্তর্জাতিক বিশ্লেষকরা। তারা মনে করছেন, দেশটির সঙ্গে
সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে শুধু সরকার নয়, পুরো জাতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে সরকারপ্রধান ও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের বক্তব্যে
বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হতে পারে বলেও মনে করছেন তারা।
শুক্রবার সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুক্তরাষ্ট্রের বিষয়ে
তার অবস্থান খোলাসা করেন। এর আগে খুলনায় এক দলীয় সভায় যুক্তরাষ্ট্রের
দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে
‘দুই আনার মন্ত্রী’ ও মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ‘কাজের মেয়ে মর্জিনা’ বলে
সম্বোধন করেন। সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে এ ধরনের বক্তব্য আসায় দেশটির সঙ্গে
সম্পর্কে প্রভাব পড়বে বলে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সূত্র থেকে এরই মধ্যে
আভাস দেয়া হয়েছে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যে ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে তাতে বিদ্যমান সম্পর্ক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার মতে, পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় বন্ধু বাড়ানোর বিষয়টি মুখ্য থাকে। বাংলাদেশেরও তা-ই করা উচিত। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, নেতিবাচক কথাবার্তায় যে কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ওই প্রফেসর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র কি প্রতিক্রিয়া দেখায়- এখন সেটাই দেখার বিষয়। সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা না করা এক ধরনের ক্ষতি। কারণ বিশ্বায়নের এই যুগে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর যে সব উদ্যোগ নিচ্ছে সেটাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, নবপ্রতিষ্ঠিত মোদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে চাইছে। আগামী মাসেই বারাক ওবামা ভারত সফর করবেন। আর ঢাকার পাশ দিয়েই তো তিনি সেদিন মিয়ানমার ঘুরে গেলেন। প্রফেসর ইমতিয়াজ মনে করেন, দেশ দু’টি যে ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এবং নতুন নির্বাচনের তাগিদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিই ঢাকা সফরে আসছেন তারা নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর তারা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে নির্বাচনকে নিয়ে যে কথাবার্তা বলেছিলেন, এখনও তারা একই বিষয় বারবার বলছেন। সব মিলিয়ে সরকার একটি চাপে আছে। প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়টি বলেছেন- সেটি তারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন ওই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে একটি দেশকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে বাংলাদেশ কি অর্জন করবে- এমন প্রশ্নে প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেন, জানি না কি অর্জন হবে। তবে এটা সত্য, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি। তারা কেন অংশ নেয়নি সেটি বিচার-বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এমন একটি বিরোধী দল পেয়েছি যারা সরকারে আছে, বিরোধী বেঞ্চেও আছে। সাধারণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনটি থাকার কথা নয়। সব মিলিয়ে জনগণও অপেক্ষায় আছে- কবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হয়। তারা চিন্তিত। সরকারও একটি বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এত দিন হয়ে গেল এখনও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া বিষয়টির কোন সুরাহাও হচ্ছে না। আর সুরাহা হচ্ছে না বলেই আন্তর্জাতিক চাপও কমছে না। আমি মনে করি, নির্বাচনের ওই বিষয়টি সমাধান হয়ে গেলেই ওই সব কথাবার্তা থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বিভাগের আরেক প্রফেসর শাহিদুজ্জামান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেবল সরকার নয়, পুরো জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে। কারণ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ওই দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যখন অবিশ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলো তখন সেখানে অব্যাহতভাবে ড্রোন হামলা হয়েছে। এতে ওই দেশের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। এটি শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কথা বলছে সেই প্রেক্ষাপট টেনে তিনি বলেন, ওই নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে এমন ধারণা দেয়া হয়েছিল যে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর সাধারণ নিয়মেই আরেকটি নির্বাচন হবে। যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। সরকার সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, উল্টো এখন বিভিন্ন দেশকে দোষারোপ করছে। এটা কাম্য নয়। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে- সরকারপ্রধানের এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, এটি কতটা সত্য তা জানতে হবে। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আরও খোলাসা করবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তারেক শামসুর রেহমান পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগেও বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, আমার কাছে এই ব্যাপারে কোন তথ্য নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই প্রথম শুনেছি। তার কাছে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। তার মতে, আর যা-ই হোক যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ারকে অগ্রাহ্য করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হবে না।
৭১ সালে যুুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষাবিদ বলেন, সেদিনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে আমাদের চেতনার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সময় দক্ষিণ এশিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক ছিল সে কারণেই তাদের ওই বিরোধিতা ছিল। আজকে ৪৩ বছর পর সেটিকে সামনে আনা হলে দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তার মতে, এত বছরে দুই দেশের সম্পর্ক আজ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সেখানে দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জড়িয়ে গেছে। সেগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মার্কিন সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন সে প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। তা বাংলাদেশীদের মানসিকতা ও ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সম্পর্কের অবনতি তো ঘটবেই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত কিনা বিশেষ করে একাত্তর সালে ভারত-সোভিয়েত কেন্দ্রিক যে পররাষ্ট্রনীতি ছিল তাতে বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলে ওই বিশ্লেষক বলেন, আমার মনে হয় সেটি গবেষণা করা প্রয়োজন। যদি তা-ই হয়, তবে বলতে হয় ৭১ আর ২০১৪ বা ১৫-এর প্রেক্ষাপট এক নয়। ৪৩ বছর আগের নীতি দিয়ে বিশ্বায়নের এই যুগে অচল। আমাদের বুঝতে হবে ৭১-এর চীনের অবস্থান কি ছিল। আজকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি কাছের-দূরের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজনীয়।
যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা পেশাদার কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, কোন দেশকে অগ্রাহ্য করে সামনে অগ্রসর হওয়া যায় না। কারণ এখানে নানামুখী স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকে তো অবশ্যই নয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি- সকল সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমরা সেটিকে ধারণ করে সবার সঙ্গে সম্মানের সম্পর্ক গড়তে চাই। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেটি সাংঘাতিক ও গুরুতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি জানি না তার কাছে কি তথ্য আছে। তবে তার বক্তব্য থেকে আমি যেটা ধারণা করতে পারি তা হলো- দুই দেশের সম্পর্কে এক ধরনের ‘অস্বস্তি’ রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন বাংলাদেশেরও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন রয়েছে। এখানে উভয়ের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়নে দেশটির অবদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের কয়েক লাখ লোক রয়েছেন যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশটিতে উন্নত পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এখানে আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। নেতিবাচক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সম্ভাবনা নষ্ট করা ঠিক হবে না। বরং ওই সম্ভাবনাগুলোকে আরও বেশি করে কিভাবে কাজে লাগানো যায়- তা নিয়ে ভাবতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব আলাপ-আলোচনা হয় সেখানে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে প্রশংসা করে দেশটি। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। আমরা উন্নতি করছি- এটা তারা স্বীকার করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আমাদের নেতৃত্বের যে অস্বস্তি রয়েছে সেটা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন করা সম্ভব। কাঠমান্ডুতে প্রধানমন্ত্রী কানেক্টিভিটির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, এই কানেক্টিভিটি কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ গোটা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা দুনিয়ার অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের মধ্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ বের হওয়া উচিত। শুধু আন্তর্জাতিক চাপ নিরসনই নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ, জনমনে স্বস্তি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি।
ওয়াশিংটনে দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে সদ্য দেশে ফেরা পেশাদার কূটনীতিক আকরামুল কাদের মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বা ছেদ পড়ার মতো তেমন কিছু নেই। তিনি ইতিহাসের একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যেটি সত্য। তার মতে, গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বায়নের এই যুগে কোন দেশকে বাদ দিয়ে যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয় তেমনি কোন দেশের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাও সমীচীন নয়। প্রধানমন্ত্রী সেটিই বলেছেন। তিনি খুব খারাপ কিছু বলেননি দাবি করে আকরামুল কাদের বলেন, আমাদের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল। প্রথমে এটাকে তারা সিলেকশন বলেছে। এরপর ইলেকশন মেনে নিয়েছে। তবে তাদের সুর উচ্চ ছিল। এখন যা অনেকটা নেমেছে। তারা বাস্তব অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। আশা করি- তারা একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্বাচনে এক-চতুর্থাংশ প্রতিনিধি (ডেমোক্রেট) বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও এখন এমন ঘটনা ঘটছে। তারা হয়তো বাংলাদেশের বিষয়টিও অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। অনেকে অংশ নিয়েছে। অনেকে নেয়নি। আমরা মনে করি, নির্বাচন হয়েছে নির্বাচনের মতোই। ৫ই জানুয়ারির পর আরেকটি নির্বাচন হতে পারে- সরকারের তরফে এমন বক্তব্য দেয়া হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, আমি অন্তত এমনটি বলিনি এবং শুনিনি। আমি সব সময় বলেছি, নির্বাচন যখন হওয়ার তখনই হবে। সরকার যে কোন সময় নির্বাচন দিতে পারে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে দুই ভাইয়ের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে ওই কূটনীতিক বলেন, সংসারে দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ হতে পারে। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করে দু’জন দু’পথে চলে যায় না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যেসব ছোটখাটো ভিন্নমত রয়েছে- তা নিরসনের উপায় খোঁজা হবে বলে জানান সদ্য বিদায়ী ওই কূটনীতিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আমেনা মহসিন বলেন, শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে চলেছে। তারা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি গুম-খুন, নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার রয়েছে- এটি হয়তো সরকারের পছন্দ নয়। আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করছি- যে সব দেশ বাংলাদেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার প্রশ্নে নীরব রয়েছে- সরকার তাদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। যদিও জাপান সফর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার এই আমলের বিদেশ সফর শুরু করেছেন। একটি কথা ভুললে চলবে না- তখন জাপানও বাংলাদেশের ডেমোক্রেসির কথা বলেছে। প্রফেসর আমেনা মহসিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোন দেশকেই বাদ দিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কথা বলেছেন তার প্রসঙ্গ টেনে আমেনা মহসিন বলেন, এটা অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশীদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেতে, এখানকার শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের স্কলারশিপ পেতে সমস্যা হতে পারে। সার্বিক অর্থে দেশের ইমেজ সঙ্কটে পড়তে পারে। জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্ন আসতে পারে- এমন আশঙ্কা করে তিনি বলেন, নারীর মর্যাদা এবং নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ মডেল হতে যাচ্ছে। এখানে কাজের বুয়ারা নারী। তাদেরকে হেয় করে কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য পুরো জাতির মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সরকার দেশের মানুষের বিশেষ করে নাগরিক সমাজ ও ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করতে পারছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারাই এই সরকারের সমালোচনা করছেন তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধীর তকমা দেয়া হচ্ছে। কাজের বুয়াদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে নারীবাদীদের নীরবতার সমালোচনা করেন তিনি।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক প্রফেসর ইমতিয়াজ আহমেদ মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে যে ধরনের কথাবার্তা হচ্ছে তাতে বিদ্যমান সম্পর্ক নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। তার মতে, পররাষ্ট্রনীতিতে সব সময় বন্ধু বাড়ানোর বিষয়টি মুখ্য থাকে। বাংলাদেশেরও তা-ই করা উচিত। কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, নেতিবাচক কথাবার্তায় যে কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের ওই প্রফেসর বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্র কি প্রতিক্রিয়া দেখায়- এখন সেটাই দেখার বিষয়। সম্প্রতি এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, কোন দেশের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর চেষ্টা না করা এক ধরনের ক্ষতি। কারণ বিশ্বায়নের এই যুগে এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের সম্পর্ক বাড়ানোর নানামুখী উদ্যোগ থাকে। বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভারত এবং মিয়ানমার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক বাড়ানোর যে সব উদ্যোগ নিচ্ছে সেটাকে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরে তিনি বলেন, নবপ্রতিষ্ঠিত মোদি সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক গড়তে চাইছে। আগামী মাসেই বারাক ওবামা ভারত সফর করবেন। আর ঢাকার পাশ দিয়েই তো তিনি সেদিন মিয়ানমার ঘুরে গেলেন। প্রফেসর ইমতিয়াজ মনে করেন, দেশ দু’টি যে ভাবে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া উচিত।
৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ এবং নতুন নির্বাচনের তাগিদ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রতিনিধিই ঢাকা সফরে আসছেন তারা নির্বাচনের তাগিদ দিচ্ছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর তারা যে প্রতিক্রিয়া দিয়েছিলেন, সেখানে নির্বাচনকে নিয়ে যে কথাবার্তা বলেছিলেন, এখনও তারা একই বিষয় বারবার বলছেন। সব মিলিয়ে সরকার একটি চাপে আছে। প্রধানমন্ত্রী যে বিষয়টি বলেছেন- সেটি তারই বহিঃপ্রকাশ বলে মনে করেন ওই আন্তর্জাতিক বিশ্লেষক। সরকারের সর্বোচ্চ মহল থেকে একটি দেশকে নিয়ে নেতিবাচক মন্তব্য করে বাংলাদেশ কি অর্জন করবে- এমন প্রশ্নে প্রফেসর ইমতিয়াজ বলেন, জানি না কি অর্জন হবে। তবে এটা সত্য, ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে অনেক দল অংশগ্রহণ করেনি। তারা কেন অংশ নেয়নি সেটি বিচার-বিবেচনায় নিতে হবে। তাছাড়া ওই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এমন একটি বিরোধী দল পেয়েছি যারা সরকারে আছে, বিরোধী বেঞ্চেও আছে। সাধারণত গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এমনটি থাকার কথা নয়। সব মিলিয়ে জনগণও অপেক্ষায় আছে- কবে সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন হয়। তারা চিন্তিত। সরকারও একটি বিব্রতকর অবস্থায় আছে। এত দিন হয়ে গেল এখনও ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এছাড়া বিষয়টির কোন সুরাহাও হচ্ছে না। আর সুরাহা হচ্ছে না বলেই আন্তর্জাতিক চাপও কমছে না। আমি মনে করি, নির্বাচনের ওই বিষয়টি সমাধান হয়ে গেলেই ওই সব কথাবার্তা থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্তর্জাতিক বিভাগের আরেক প্রফেসর শাহিদুজ্জামান মনে করেন, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেবল সরকার নয়, পুরো জাতিকে এর খেসারত দিতে হবে। কারণ দেশটির সঙ্গে বাংলাদেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট নানা বিষয় রয়েছে। তিনি পাকিস্তানের প্রসঙ্গ টেনে বলেন, ওই দেশটির সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের ভাল সম্পর্ক ছিল। কিন্তু যখন অবিশ্বাস চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছলো তখন সেখানে অব্যাহতভাবে ড্রোন হামলা হয়েছে। এতে ওই দেশের মানুষও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সৈয়দ আশরাফের বক্তব্যের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, এ ধরনের বক্তব্য কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভূত। এটি শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব ফেলবে। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র যে কথা বলছে সেই প্রেক্ষাপট টেনে তিনি বলেন, ওই নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সম্প্রদায়কে এমন ধারণা দেয়া হয়েছিল যে ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনটি হয়ে যাওয়ার পর সাধারণ নিয়মেই আরেকটি নির্বাচন হবে। যেখানে সব দলের অংশগ্রহণ থাকবে। সরকার সেই অঙ্গীকারের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, উল্টো এখন বিভিন্ন দেশকে দোষারোপ করছে। এটা কাম্য নয়। পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা রয়েছে- সরকারপ্রধানের এমন অভিযোগের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, এটি কতটা সত্য তা জানতে হবে। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বিষয়টি আরও খোলাসা করবেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর তারেক শামসুর রেহমান পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের নেতিবাচক ভূমিকা সংক্রান্ত প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগেও বিস্ময় প্রকাশ করেন। বলেন, আমার কাছে এই ব্যাপারে কোন তথ্য নেই। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকেই প্রথম শুনেছি। তার কাছে এ ব্যাপারে নিশ্চয়ই তথ্য আছে। তার মতে, আর যা-ই হোক যুক্তরাষ্ট্রের মতো সুপার পাওয়ারকে অগ্রাহ্য করে আমাদের জাতীয় স্বার্থ রক্ষা হবে না।
৭১ সালে যুুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে ওই শিক্ষাবিদ বলেন, সেদিনের ভূমিকা নিঃসন্দেহে আমাদের চেতনার বিরুদ্ধে ছিল। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে সেই সময় দক্ষিণ এশিয়া পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যে সম্পর্ক ছিল সে কারণেই তাদের ওই বিরোধিতা ছিল। আজকে ৪৩ বছর পর সেটিকে সামনে আনা হলে দুই দেশের সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। তার মতে, এত বছরে দুই দেশের সম্পর্ক আজ নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। সেখানে দুই দেশের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক বিষয় জড়িয়ে গেছে। সেগুলোর ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। সরকারের সিনিয়র মন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম মার্কিন সহকারী মন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়ালকে যেভাবে আক্রমণ করেছেন সে প্রসঙ্গ টেনে বলেছেন, এটি অনাকাঙ্ক্ষিত। তা বাংলাদেশীদের মানসিকতা ও ভাবমূর্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সম্পর্কের অবনতি তো ঘটবেই। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের পররাষ্ট্রনীতিতে কোন পরিবর্তনের ইঙ্গিত কিনা বিশেষ করে একাত্তর সালে ভারত-সোভিয়েত কেন্দ্রিক যে পররাষ্ট্রনীতি ছিল তাতে বাংলাদেশ ফিরে যাচ্ছে কিনা সেই প্রশ্ন তুলে ওই বিশ্লেষক বলেন, আমার মনে হয় সেটি গবেষণা করা প্রয়োজন। যদি তা-ই হয়, তবে বলতে হয় ৭১ আর ২০১৪ বা ১৫-এর প্রেক্ষাপট এক নয়। ৪৩ বছর আগের নীতি দিয়ে বিশ্বায়নের এই যুগে অচল। আমাদের বুঝতে হবে ৭১-এর চীনের অবস্থান কি ছিল। আজকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে চীনের যেমন প্রয়োজন আছে তেমনি কাছের-দূরের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক বাড়ানো প্রয়োজনীয়।
যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করা পেশাদার কূটনীতিক হুমায়ুন কবির বলেন, কোন দেশকে অগ্রাহ্য করে সামনে অগ্রসর হওয়া যায় না। কারণ এখানে নানামুখী স্বার্থ রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশকে তো অবশ্যই নয়। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি- সকল সঙ্গে বন্ধুত্ব কারও সঙ্গে বৈরিতা নয়- আমরা সেটিকে ধারণ করে সবার সঙ্গে সম্মানের সম্পর্ক গড়তে চাই। যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী যে কথা বলেছেন, সেটি সাংঘাতিক ও গুরুতর উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি জানি না তার কাছে কি তথ্য আছে। তবে তার বক্তব্য থেকে আমি যেটা ধারণা করতে পারি তা হলো- দুই দেশের সম্পর্কে এক ধরনের ‘অস্বস্তি’ রয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রকে যেমন বাংলাদেশের প্রয়োজন বাংলাদেশেরও যুক্তরাষ্ট্রকে প্রয়োজন রয়েছে। এখানে উভয়ের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিষয় রয়েছে। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তায় যুক্তরাষ্ট্রের সম্পৃক্ততা রয়েছে। আমাদের বাণিজ্য, বিনিয়োগ তথা সার্বিক অর্থনীতির উন্নয়নে দেশটির অবদান রয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রে আমাদের কয়েক লাখ লোক রয়েছেন যারা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছেন। আমাদের শিক্ষার্থীরা দেশটিতে উন্নত পড়াশোনার জন্য যাচ্ছেন। সব মিলিয়ে এখানে আমাদের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। নেতিবাচক কথাবার্তার মধ্য দিয়ে আমাদের সেই সম্ভাবনা নষ্ট করা ঠিক হবে না। বরং ওই সম্ভাবনাগুলোকে আরও বেশি করে কিভাবে কাজে লাগানো যায়- তা নিয়ে ভাবতে হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের যেসব আলাপ-আলোচনা হয় সেখানে বাংলাদেশের সামাজিক উন্নয়নে প্রশংসা করে দেশটি। এটি অবশ্যই ইতিবাচক দিক। আমরা উন্নতি করছি- এটা তারা স্বীকার করছে। বাংলাদেশ সম্পর্কে যুক্তরাষ্ট্রের যে উদ্বেগ রয়েছে এবং যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে আমাদের নেতৃত্বের যে অস্বস্তি রয়েছে সেটা আলাপ-আলোচনার মধ্য দিয়ে নিরসন করা সম্ভব। কাঠমান্ডুতে প্রধানমন্ত্রী কানেক্টিভিটির যে সংজ্ঞা দিয়েছেন তার উদ্ধৃতি দিয়ে ওই কূটনীতিক বলেন, এই কানেক্টিভিটি কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পূর্ব-পশ্চিম, উত্তর-দক্ষিণ গোটা বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে হওয়া উচিত। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র তথা পশ্চিমা দুনিয়ার অবস্থান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, নির্বাচন প্রশ্নে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানের মধ্য নিয়ে সামনে অগ্রসর হওয়ার পথ বের হওয়া উচিত। শুধু আন্তর্জাতিক চাপ নিরসনই নয়, দেশের সার্বিক উন্নয়ন-অগ্রগতির জন্য গণতান্ত্রিক পরিবেশ, জনমনে স্বস্তি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অত্যন্ত জরুরি।
ওয়াশিংটনে দীর্ঘ পাঁচ বছরের বেশি সময় দায়িত্ব পালন করে সদ্য দেশে ফেরা পেশাদার কূটনীতিক আকরামুল কাদের মনে করেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার বা ছেদ পড়ার মতো তেমন কিছু নেই। তিনি ইতিহাসের একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন যেটি সত্য। তার মতে, গ্লোবাল ভিলেজ বা বিশ্বায়নের এই যুগে কোন দেশকে বাদ দিয়ে যেমন উন্নয়ন সম্ভব নয় তেমনি কোন দেশের প্রতি অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতাও সমীচীন নয়। প্রধানমন্ত্রী সেটিই বলেছেন। তিনি খুব খারাপ কিছু বলেননি দাবি করে আকরামুল কাদের বলেন, আমাদের নির্বাচন নিয়ে শুরু থেকে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগ ছিল। প্রথমে এটাকে তারা সিলেকশন বলেছে। এরপর ইলেকশন মেনে নিয়েছে। তবে তাদের সুর উচ্চ ছিল। এখন যা অনেকটা নেমেছে। তারা বাস্তব অবস্থা বোঝার চেষ্টা করছেন। আশা করি- তারা একেবারেই ঠাণ্ডা হয়ে যাবেন। অতিসম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের একটি নির্বাচনে এক-চতুর্থাংশ প্রতিনিধি (ডেমোক্রেট) বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশেও এখন এমন ঘটনা ঘটছে। তারা হয়তো বাংলাদেশের বিষয়টিও অনুধাবনের চেষ্টা করছেন। ৫ই জানুয়ারির নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছে দাবি করে তিনি বলেন, সব দলের অংশগ্রহণের সুযোগ ছিল। অনেকে অংশ নিয়েছে। অনেকে নেয়নি। আমরা মনে করি, নির্বাচন হয়েছে নির্বাচনের মতোই। ৫ই জানুয়ারির পর আরেকটি নির্বাচন হতে পারে- সরকারের তরফে এমন বক্তব্য দেয়া হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, আমি অন্তত এমনটি বলিনি এবং শুনিনি। আমি সব সময় বলেছি, নির্বাচন যখন হওয়ার তখনই হবে। সরকার যে কোন সময় নির্বাচন দিতে পারে। বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্ককে দুই ভাইয়ের সম্পর্কের সঙ্গে তুলনা করে ওই কূটনীতিক বলেন, সংসারে দুই ভাইয়ের মধ্যে মতবিরোধ হতে পারে। তাই বলে সম্পর্ক ছিন্ন করে দু’জন দু’পথে চলে যায় না। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে যেসব ছোটখাটো ভিন্নমত রয়েছে- তা নিরসনের উপায় খোঁজা হবে বলে জানান সদ্য বিদায়ী ওই কূটনীতিক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর আমেনা মহসিন বলেন, শুরু থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে চলেছে। তারা দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি গুম-খুন, নির্যাতনের বিষয়ে সোচ্চার রয়েছে- এটি হয়তো সরকারের পছন্দ নয়। আমরা একটি জিনিস লক্ষ্য করছি- যে সব দেশ বাংলাদেশের রাজনীতি ও মানবাধিকার প্রশ্নে নীরব রয়েছে- সরকার তাদের দিকেই ধাবিত হচ্ছে। যদিও জাপান সফর দিয়ে প্রধানমন্ত্রী তার এই আমলের বিদেশ সফর শুরু করেছেন। একটি কথা ভুললে চলবে না- তখন জাপানও বাংলাদেশের ডেমোক্রেসির কথা বলেছে। প্রফেসর আমেনা মহসিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের উন্নয়ন সম্ভব নয়। কোন দেশকেই বাদ দিয়ে নয়। প্রধানমন্ত্রী ও তার কেবিনেটের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী যেভাবে যুক্তরাষ্ট্রকে নিয়ে কথা বলেছেন তার প্রসঙ্গ টেনে আমেনা মহসিন বলেন, এটা অবশ্যই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বাংলাদেশীদের যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পেতে, এখানকার শিক্ষার্থীদের যুক্তরাষ্ট্রের স্কলারশিপ পেতে সমস্যা হতে পারে। সার্বিক অর্থে দেশের ইমেজ সঙ্কটে পড়তে পারে। জাতি হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তির প্রশ্ন আসতে পারে- এমন আশঙ্কা করে তিনি বলেন, নারীর মর্যাদা এবং নারী উন্নয়নে বাংলাদেশ মডেল হতে যাচ্ছে। এখানে কাজের বুয়ারা নারী। তাদেরকে হেয় করে কোন দায়িত্বশীল ব্যক্তির মন্তব্য পুরো জাতির মানসিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলবে। সরকার দেশের মানুষের বিশেষ করে নাগরিক সমাজ ও ভিন্নমতের কাউকে সহ্য করতে পারছে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, যারাই এই সরকারের সমালোচনা করছেন তাদেরকে স্বাধীনতাবিরোধীর তকমা দেয়া হচ্ছে। কাজের বুয়াদের মানবাধিকার লঙ্ঘনে নারীবাদীদের নীরবতার সমালোচনা করেন তিনি।
No comments