ডিসেম্বরে স্মরি রাজনীতির কবিকে by মাহমুদুল বাসার
ডিসেম্বর আমাদের বিজয়ের মাস। বাঙালি জাতি
দীর্ঘ ৯ মাস সশস্ত্র যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালের এই মাসে পাকিস্তানের দখলদার
বাহিনীকে পরাজিত করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। এই বিজয় ছিল বাংলাদেশের মানুষের,
সমগ্র বাঙালি জাতির এবং সমগ্র মানবসমাজের। ভারত, রাশিয়া, ভুটানসহ বিশ্ব
বিবেকের সমর্থন না পেলে শুধু অস্ত্র দিয়ে, জীবন উৎসর্গ করে আমরা বিজয়ী হতে
পারতাম না। মার্কিন প্রশাসন আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে ছিল, কিন্তু
দেশটির বিবেকবান নাগরিক সেদিন আমাদের পক্ষে ছিল। যুক্তরাজ্যের প্রশাসন অতটা
আমাদের পক্ষে না থাকলেও সমগ্র ব্রিটেনের বিবেকবান নাগরিক আমাদের পক্ষে
ছিল। ব্রিটেনে অবস্থান নিয়েই বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পক্ষে
লড়াই করেছিলেন। প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠিত করেছিলেন। সেদিন বিশ্বের
আকাশে-বাতাসে, জনপদে, শহরে-বন্দরে, দুটো নাম সগৌরবে উচ্চারিত হতো- বাংলাদেশ
ও বঙ্গবন্ধু ।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। স্বাধীনতার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এ সিদ্ধান্ত ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালে তিনি বাঙালির কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন, বাঙালিরা তাকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। পাকিস্তানি হঠকারী শাসকরা তাকে ক্ষমতা না দিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেই পরিস্থিতিতে তিনি ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। একজন গবেষকের ভাষায় এ ভাষণ ছিল সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, যখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; তখন মনে হল বিশ্বে একটি নতুন দেশের জন্ম হল। জিয়াউর রহমানসহ সব সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণকে গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। জিয়া তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছিলেন। তারা দেশের রাজধানী নির্ধারণ করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন মুজিবনগর। তারাই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। তারাই অস্থায়ী সরকারের নামকরণ করেছিলেন, মুজিবনগর সরকার। তারাই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। তারাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তখন এমন একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না, যিনি বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হননি।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এক নম্বর শত্রু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাক বেতারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলন, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর, নাউ হি উইল নট গো আনপানিশড। আর কারও ক্ষেত্রেই এ কথা বলা হয়নি, স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুর নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল। আর কারও নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়নি।
১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার পর তিনি এদেশের নামকরণ করেন বাংলাদেশ। কত বড় সাহসের নমুনা! বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে তার পেছনে ছিল, এজন্য তিনি এই সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা দেন। জিয়ার অনুসারীরা চেষ্টা করেছিল অন্য কোনো গানকে জাতীয় সঙ্গীত করতে; কিন্তু পারেনি।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের বিশ্বনন্দিত সংবিধান রচিত হয় মুজিবনগর সরকার প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ মোতাবেক। সেখানে রাষ্ট্রের স্তম্ভ হিসেবে চারটি মূলনীতি সংযোজন করা হয়। ৭২-এর সংবিধান তছনছ করার পরও বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বিচ্যুত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল- এই দীর্ঘ সময়ের রাজনীতিতে যদি বঙ্গবন্ধু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অলীক স্বপ্নে পরিণত হতো। জীবনের সবটুকু ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকলে, পিছুটান থাকলে, সাহসের ঘাটতি থাকলে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কম থাকলে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে, তিনি পরিশ্রমবিমুখ হলে, শৌখিন রাজনীতিবিদ হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
স্বাধীনতাই ছিল তার রাজনীতির টার্গেট। অন্য বিকল্প রাজনীতি তিনি করেননি। এজন্য তার গোটা পরিবার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তার গোটা পরিবারই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তার ও তার পরিবারের রক্ত ১৯৭১-এর শহীদদের রক্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। প্রয়াত দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, ইতিহাসে মহান নায়কদের নাম আছে। সানইয়াত সেন, লেনিন, স্ট্যালিন, গান্ধীজী, পণ্ডিত নেহেরু প্রমুখ নেতার কথা আমরা পড়েছি। কিন্তু ইতিহাস মানেই অতীত। তা আমার কাছে দূর আর অপ্রত্যক্ষ। আর তাই ইতিহাসের এককালের মহান নায়কদের জীবনের সঙ্গে অন্যকালের পাঠক আবেগময় যোগ উপলব্ধি করতে পারে না। বুদ্ধি দিয়েই ইতিহাসের মহান নেতাদের জীবনের তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জীবনের যে আবেগময় সম্পর্ক রয়েছে, একদিন হয়তো তার ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হবে, কিন্তু আজ তা আমাদের প্রতিটি জীবনের গর্বের, গৌরবের আর আনন্দের সাক্ষাৎ উপলব্ধি। আর ইতিহাসেরও এক অপার বিস্ময়।
এক সময় স্লোগান উঠেছিল, এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। এই স্লোগান বাংলার মাটিতে আর কারও নামে উচ্চারিত হবে না, জনগণ তা গ্রহণও করবে না।
মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকাটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুকেই রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করেছিল, আর কাউকে নয়। বাঙালি জাতিকে তিনি কবিদের মতোই প্রভাবিত করেছিলেন। ত্রিশ লাখ লোক তার কথায় জীবন দিয়েছিল। তার কথায় নিরস্ত্র বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিল। সরদার ফজলুল করিমের কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করব, দূর মধ্যপ্রাচ্যের ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘ দেহ মানুষটি লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন : আমি আবার আপনাদের সামনে এসেছি। লাখ লাখ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে- তখন এমন বাঙালি ছিল না, যার নিজের চোখে পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। স্বাধীনতার ঘোষণা একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, এ সিদ্ধান্ত ৭ মার্চের ভাষণের মাধ্যমে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু, আমরা তা মেনে নিয়েছিলাম। ১৯৭০ সালে তিনি বাঙালির কাছে ম্যান্ডেট চেয়েছিলেন, বাঙালিরা তাকে ম্যান্ডেট দিয়েছিল। পাকিস্তানি হঠকারী শাসকরা তাকে ক্ষমতা না দিয়ে যুদ্ধের ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। সেই পরিস্থিতিতে তিনি ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণ প্রদান করেন। একজন গবেষকের ভাষায় এ ভাষণ ছিল সরাসরি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা। ড. আনিসুজ্জামান বলেছেন, যখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম; তখন মনে হল বিশ্বে একটি নতুন দেশের জন্ম হল। জিয়াউর রহমানসহ সব সেনা অফিসার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের অগ্নিগর্ভ ভাষণকে গ্রিন সিগন্যাল হিসেবে মেনে নিয়েছিলেন। জিয়া তার বেতার ভাষণে বলেছিলেন, আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে আমরা স্বাধীনতা ঘোষণা করছি।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করেছিলেন। তারা দেশের রাজধানী নির্ধারণ করেছিলেন। নাম রেখেছিলেন মুজিবনগর। তারাই বঙ্গবন্ধুকে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়কের পদে অভিষিক্ত করেছিলেন। তারাই অস্থায়ী সরকারের নামকরণ করেছিলেন, মুজিবনগর সরকার। তারাই বঙ্গবন্ধুকে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি নিয়োগ করেছিলেন। তারাই স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলেছেন, বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। তখন এমন একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন না, যিনি বঙ্গবন্ধুর প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হননি।
পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠীর এক নম্বর শত্রু ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এজন্য আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি ছিলেন তিনি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে পাক বেতারে ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেছিলন, মুজিব ইজ এ ট্রেইটর, নাউ হি উইল নট গো আনপানিশড। আর কারও ক্ষেত্রেই এ কথা বলা হয়নি, স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার অপরাধে বঙ্গবন্ধুর নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়েছিল। আর কারও নামে রাষ্ট্রদ্রোহের মামলা করা হয়নি।
১৯৬৯ সালে জেল থেকে মুক্তি পেয়ে বঙ্গবন্ধু উপাধি পাওয়ার পর তিনি এদেশের নামকরণ করেন বাংলাদেশ। কত বড় সাহসের নমুনা! বাঙালি ঐক্যবদ্ধভাবে তার পেছনে ছিল, এজন্য তিনি এই সাহস দেখাতে পেরেছিলেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই তিনি রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে ঘোষণা দেন। জিয়ার অনুসারীরা চেষ্টা করেছিল অন্য কোনো গানকে জাতীয় সঙ্গীত করতে; কিন্তু পারেনি।
১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশের বিশ্বনন্দিত সংবিধান রচিত হয় মুজিবনগর সরকার প্রণীত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের আদর্শ মোতাবেক। সেখানে রাষ্ট্রের স্তম্ভ হিসেবে চারটি মূলনীতি সংযোজন করা হয়। ৭২-এর সংবিধান তছনছ করার পরও বঙ্গবন্ধুর অবস্থান বিচ্যুত করা সম্ভব হয়নি।
১৯৪৯ থেকে ১৯৭১ সাল- এই দীর্ঘ সময়ের রাজনীতিতে যদি বঙ্গবন্ধু সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করতেন, তাহলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অলীক স্বপ্নে পরিণত হতো। জীবনের সবটুকু ঝুঁকি তিনি নিয়েছেন স্বাধীনতার জন্য। তার নিজের জীবনের প্রতি মায়া থাকলে, পিছুটান থাকলে, সাহসের ঘাটতি থাকলে, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা কম থাকলে, আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি থাকলে, তিনি পরিশ্রমবিমুখ হলে, শৌখিন রাজনীতিবিদ হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না।
স্বাধীনতাই ছিল তার রাজনীতির টার্গেট। অন্য বিকল্প রাজনীতি তিনি করেননি। এজন্য তার গোটা পরিবার রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল। তার গোটা পরিবারই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। তার ও তার পরিবারের রক্ত ১৯৭১-এর শহীদদের রক্তের সঙ্গে একাত্ম হয়ে গেছে। প্রয়াত দার্শনিক সরদার ফজলুল করিম বলেছেন, ইতিহাসে মহান নায়কদের নাম আছে। সানইয়াত সেন, লেনিন, স্ট্যালিন, গান্ধীজী, পণ্ডিত নেহেরু প্রমুখ নেতার কথা আমরা পড়েছি। কিন্তু ইতিহাস মানেই অতীত। তা আমার কাছে দূর আর অপ্রত্যক্ষ। আর তাই ইতিহাসের এককালের মহান নায়কদের জীবনের সঙ্গে অন্যকালের পাঠক আবেগময় যোগ উপলব্ধি করতে পারে না। বুদ্ধি দিয়েই ইতিহাসের মহান নেতাদের জীবনের তাৎপর্য আমরা উপলব্ধি করি। কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে ১৯৭১ সালের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের জীবনের যে আবেগময় সম্পর্ক রয়েছে, একদিন হয়তো তার ব্যঞ্জনা ও তাৎপর্য ইতিহাসের গবেষণার বিষয় হবে, কিন্তু আজ তা আমাদের প্রতিটি জীবনের গর্বের, গৌরবের আর আনন্দের সাক্ষাৎ উপলব্ধি। আর ইতিহাসেরও এক অপার বিস্ময়।
এক সময় স্লোগান উঠেছিল, এক নেতা এক দেশ, বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ অভিন্ন সত্তা। এই স্লোগান বাংলার মাটিতে আর কারও নামে উচ্চারিত হবে না, জনগণ তা গ্রহণও করবে না।
মার্কিন প্রভাবশালী পত্রিকাটি একমাত্র বঙ্গবন্ধুকেই রাজনীতির কবি বলে আখ্যায়িত করেছিল, আর কাউকে নয়। বাঙালি জাতিকে তিনি কবিদের মতোই প্রভাবিত করেছিলেন। ত্রিশ লাখ লোক তার কথায় জীবন দিয়েছিল। তার কথায় নিরস্ত্র বাঙালি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। হাসতে হাসতে জীবন দিয়েছিল। সরদার ফজলুল করিমের কথা দিয়ে লেখাটি শেষ করব, দূর মধ্যপ্রাচ্যের ইয়াহিয়ার বন্দিশালার দুর্বিষহ নিঃসঙ্গতা আর চিন্তায় শুকিয়ে যাওয়া দীর্ঘ দেহ মানুষটি লাখ লাখ জনতার সামনে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে মুছতে যখন বললেন : আমি আবার আপনাদের সামনে এসেছি। লাখ লাখ ভাই, মা আর বোন নিজেদের জীবনের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন, আমাকে মুক্ত করেছেন। আমার প্রতি ভালোবাসার কোনো পরিমাপ নেই। এর কোনো প্রতিদান আমি দিতে পারিনে- তখন এমন বাঙালি ছিল না, যার নিজের চোখে পানি জমেনি এবং আবেগে গলাটা রুদ্ধ হয়ে আসেনি।
মাহমুদুল বাসার : কলাম লেখক, গবেষক
No comments