‘বার্গম্যানের রায় পর্যবেক্ষকদের মতামত দেয়ার সুযোগ সঙ্কীর্ণ করেছে’
আদালত
অবমাননার অভিযোগে সাংবাদিক ডেভিড বার্গম্যানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) ২রা ডিসেম্বর যে রায় দিয়েছে তা
যুদ্ধাপরাধ বিচার প্রক্রিয়ায় পর্যবেক্ষকদের মতামত দেয়ার সুযোগ আরও সঙ্কীর্ণ
করে দিয়েছে। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা অ্যামনেস্টি
ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট এ
কথা বলেছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের ওয়েবসাইটে তিন সংস্থার পক্ষে প্রকাশিত
এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়
আন্তর্জাতিক আইনের গর্হিত লঙ্ঘনে দায়ীদের বিচারের আওতায় আনার জন্য বিশেষ
আদালত গঠন করা হয়। ট্রাইব্যুনালটি গঠিত হওয়ার পর থেকে এর আইনি বিধিমালা,
বিচার প্রক্রিয়ার নিয়মকানুন এবং চর্চা নিয়ে নানা উদ্বেগ প্রকাশ করেছে
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক এবং আইন বিশেষজ্ঞরা। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের
এশিয়া প্রশান্ত এলাকার পরিচালক রিচার্ড বেনেট বলেন, মতামত প্রকাশের
স্বাধীনতাকে সম্মান দেখানোর পরিবর্তে আইসিটি তাদের কতিপয় সমালোচকের
বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার প্রক্রিয়া চালিয়েছে। আর এতে যাদের অভিযুক্ত করা
হয়েছে তাদের আপিল করার অধিকার নেই। তিনি আরও বলেন, বার্গমানের রায় সাংবাদিক
আর মানবাধিকার রক্ষায় সচেষ্ট কর্মীদের উদ্দেশ্যে এক শীতল বার্তা পাঠিয়েছে।
তা হলো আইসিটি পক্ষপাতহীন সমালোচনা গ্রাহ্য করবে না। প্রতিবেদনে আরও বলা
হয়, আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে যারা সমালোচনামূলক মন্তব্য করেছেন বেছে
বেছে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার অভিযোগ আনা হয়েছে। সমালোচনা থামিয়ে
দেয়ার স্পষ্ট প্রচেষ্টায়, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, দ্য ইকোনোমিস্টের সাংবাদিক
এবং স্থানীয় সাংবাদিকদেরকে আইসিটি সংক্রান্ত সমালোচনামূলক বিষয়বস্তু
প্রকাশের জন্য অবমাননার অভিযোগে বিচার করা হয়েছে। বার্গম্যানের বিরুদ্ধে
রায়ে আইসিটি তার বিশেষ একটি ব্লগ পোস্টকে আমলে নিয়েছে, যেখানে তিনি ১৯৭১
সালে নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বাংলাদেশ সরকার নিয়মিত বলেছে, এ
যুদ্ধে নিহত হয়েছেন ৩০ লাখ মানুষ। এ সংখ্যাকে প্রমাণিত সত্য বলে ঘোষণা
দিয়েছে আইসিটি। কিছু পরিদর্শক বলেছেন, নিহতের সংখ্যা তিন লাখের মতো হতে
পারে। এছাড়া অন্যরা তিন লাখ থেকে শুরু করে তিরিশ লাখ পর্যন্ত বিভিন্ন
সংখ্যা বলেছেন। আদালতের রায় অনুযায়ী, নিহতের সংখ্যা নিয়ে প্রশ্ন তুলে
বার্গম্যান দেশের পবিত্র অনুভূতির অপমান এবং মর্যাদাহানি করেছেন এবং
আদালতের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনার উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত বিদ্বেষপূর্ণ অভিপ্রায়ের
ভিত্তিতে এমনটা করা হয়েছে। একই সঙ্গে আদালত বার্গম্যানকে ঐতিহাসিকভাবে
প্রতিষ্ঠিত ইস্যুগুলো নিয়ে লেখালেখি থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিয়েছেন।
আইসিটি আরও বলেছে, এ বিষয়ে বা অন্য একটি ব্লগপোস্টে ‘অনুপস্থিতিতে বিচারের
বৈধতা’ প্রসঙ্গে যে প্রবন্ধ বার্গম্যান লিখেছেন, তার কোন বৈধ জনস্বার্থ ছিল
না। ৭১-এর যুদ্ধের সময় নিহতের সংখ্যা নিয়ে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ, দ্য
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের কোন
অবস্থান নেই। কিন্তু তাদের বিশ্বাস এ বিষয়ে যুক্তিপরায়ণ এবং পক্ষপাতহীন
মানসিকতার মানুষজন কোন প্রকার বিদ্বেষমূলক অভিপ্রায় ছাড়াই দ্বিমত পোষণ করতে
পারেন। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের এশিয়া বিষয়ক পরিচালক ব্র্যাড অ্যাডামস বলেন,
বার্গম্যান যে ইস্যুগুলো উত্থাপন করেছেন তা মতামত প্রকাশের বৈধ সীমারেখার
মধ্যেই ছিল। এগুলো জটিল ধরনের তথ্যমূলক এবং আইনি ইস্যু- যেগুলোর সঙ্গে
বিশ্বের নানা প্রান্তের যুদ্ধাপরাধ ট্রাইবুন্যালগুলোকে সমাধানের চেষ্টা
করতে হবে। বার্গম্যান এসব গর্হিত অপরাধের বিচারের পক্ষে দীর্ঘদিনের একজন
সমর্থক। কাজেই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন উত্থাপন করায় তাকে অভিযুক্ত করা
যুক্তিবিরুদ্ধ। ট্রাইবুন্যালের বিচারপ্রক্রিয়া এবং সংশ্লিষ্ট ইস্যুর
সমালোচনা করার জন্য একজন সাংবাদিককে যদি আদালত অবমাননার অভিযোগে অভিযুক্ত
করা যেতে পারে তাহলে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক মার্কিন রাষ্ট্রদূত স্টিফেন র্যাপকে
কেন নয়, যিনি একই ধরনের অনেক উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। আন্তর্জাতিক
মানবাধিকার সংস্থাগুলো মনোযোগ আকর্ষণ করে বলেছে, আদালতের রায়ের মধ্যে কিছু
ভাষা আছে যা চরম অস্পষ্ট এবং সমালোচকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার বিস্তৃত
সুযোগ আইসিটিকে করে দিয়েছে। এছাড়াও আদালতের বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে সংবাদ
প্রতিবেদনের বৈধ বিষয়বস্তুর মধ্যে কি কি আছে সে বিষয়ে রায়ে যে ব্যাখ্যা
দেয়া হয়েছে, তা দুর্বলভাবে সংজ্ঞায়িত। ইন্টারন্যাশনাল কোভেন্যান্ট অন সিভিল
অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস (আইসিসিপিআর)-এর স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে
বিচারবিভাগসহ বাংলাদেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের সকল অংশকে মত প্রকাশের
স্বাধীনতাকে অবশ্যই শ্রদ্ধা এবং সুরক্ষা করতে হবে। বাকস্বাধীনতার ওপর কোন
নিষেধাজ্ঞাকে অবশ্যই জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষা, আইনশৃঙ্খলা, জনস্বাস্থ্য,
মূল্যবোধ বা অন্যের অধিকারের সঙ্গে সুস্পষ্টভাবে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া
বাঞ্ছনীয়। বার্গম্যানের ব্লগে এগুলোর কোনটাই ঝুঁকির মধ্যে ছিল না। মতামত
প্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ক বিশেষ র্যাপোর্টিয়ারসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার
সংস্থাগুলো বাকস্বাধীনতার অধিকার হরণমূলক আইনি ধারা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ
করেছেন। জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিটি, যাদের ওপর রাষ্ট্রসমূহে আইসিসিপিআর
বাস্তবায়ন পরিদর্শনের বাধ্যবাধকতা রয়েছে তারা ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছেন যে, যে
সব আইন ঐতিহাসিক তথ্য নিয়ে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে সে সব
আইন মতপ্রকাশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে ওই রাষ্ট্রগুলোর
বাধ্যবাধকতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। জাতিসংঘের ওই কমিটি আরও বলেছে,
সুপ্রিম কোর্টের রায়কে ‘লজ্জাজনক’ বলায় দু’বছরের কারাদণ্ড দেয়ার ঘটনা ছিল
আইসিসিপিআরের অধীনে প্রতিশ্রুত মত প্রকাশের স্বাধীনতা অধীকারের লঙ্ঘন। দ্য
ইউরোপিয়ান কোর্ট অব হিউম্যান রাইটস বলেছে, একটি বিচার ব্যবস্থার
কার্যকারিতা সংক্রান্ত ইস্যুগুলোই জনস্বার্থের প্রশ্নগুলো তৈরি করে।
ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টের এশিয়া পরিচালক স্যাম জারিফি বলেন,
আইসিটি চরম জটিল তথ্যগত এবং আবেগঘন ইস্যু নিয়ে কাজ করছে- যা বাংলাদেশের
মানুষের কাছে এবং পুরো বিশ্বজুড়ে প্রচণ্ড স্বার্থসংশ্লিষ্ট। আর এ
প্রক্রিয়ার একটি অংশ হলো আইনি প্রক্রিয়ার ওপর জনগণের আস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
তিনি আরও বলেন, বিশ্বাসযোগ্য এবং অত্যন্ত সুপরিচিত একজন সাংবাদিককে
গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপনের জন্য আদালত অবমাননায় অভিযুক্ত করলে আইসিটির
নৈপুণ্য ঘিরে যে বিতর্ক রয়েছে তা শেষ হয়ে যাবে না। প্রকৃতপক্ষ ন্যায়
বিচারের ক্ষেত্রে অঙ্গীকারাবদ্ধ আদালত, এটা সেই আস্থাকে দুর্বল করে দেয়।
প্রতিবেদনে শেষে বলা হয়, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালের আইন অনুযায়ী
রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগ বার্গম্যানের নেই। শুধুমাত্র আইসিটি
অ্যাক্টের ৩ অনুচ্ছেদের অধীনে গণহত্যা, মানবতাবিরোধী এবং শান্তিবিরোধী
কতিপয় অপরাধে অভিযুক্তরা আপিল করতে পারবে।
No comments