লুটপাটের নতুন আয়োজন
গ্রামীণ
অর্থনীতিতে প্রাণসঞ্চারী কাজের বিনিময়ে খাদ্য (কাবিখা) এবং টেস্ট রিলিফ
(টিআর) কর্মসূচি নিয়ে ষড়যন্ত্র চলছে। দুস্থ জনগণকে সরকারের মুখোমুখি দাঁড়
করিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কর্মসূচি দুটি বদলে দেয়া হচ্ছে। এখন
থেকে টিআর কাবিখায় বরাদ্দকৃত অর্ধেক অর্থ সোলার প্যানেল ও ব্যায়োগ্যাস
স্থাপনের কাজে ব্যয় বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। বাকি টাকায় হবে অবকাঠামো
উন্নয়ন। এ লক্ষ্যে প্রকল্প সংক্রান্ত নির্দেশিকা জারি হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীকে অন্ধকারে রেখে এ ধরনের দুস্থবান্ধব কর্মসূচির জন্য
বরাদ্দের অর্থ দিয়ে সোলার প্যানেল স্থাপনের নির্দেশনা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে
ষড়যন্ত্রের অংশ বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, গ্রামের গরিব
মানুষগুলোকে বিরোধী দলের হাতে তুলে দেয়ার জন্য, গ্রামীণ জনপদকে অস্থিতিশীল
করে তোলার লক্ষ্যে ষড়যন্ত্রমলূকভাবে এসব করা হচ্ছে। তাদের মতে, সোলার
প্যানেল বায়োগ্যাস প্লান্ট স্থাপনের নামে অতি দরিদ্র জনগণের অর্থ লোপাটের
আয়োজনে সহায়তা করেছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। প্রকল্পের
চাল, গম বিক্রি করে নগদায়নের কথা বলা হয়েছে। চাল, গম বিক্রির সময় এবার
দুর্নীতি হবে। সোলার প্যানেল কেনার সময় হবে আরেক দফায় দুর্নীতি। পুরনো কিনে
বলা হবে নতুন। কম দামে কিনে দেখানো হবে বেশি দাম। না কিনেও দেখা হবে কেনার
ভুয়া কাগজপত্র। এর মাধ্যমে নানাভাবে অর্থ লোপাটের নতুন ক্ষেত্র উন্মোচন
করা হচ্ছে। শুধু লুটপাটই নয়, এর পাশাপাশি এই প্রকল্পের নেপথ্যে লুকিয়ে আছে
খোদ সরকারবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্রের জাল। এই কর্মসূচির মাধ্যমে দেশের অর্ধেকের
বেশি জনগোষ্ঠীকে সরকারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া হচ্ছে। এসবের সঙ্গে তিন
মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী, সরকারবিরোধী একাধিক এনজিও, বিদেশী একটি
সিন্ডিকেট, দুর্নীতিবাজ একাধিক আমলা মিলে গড়ে ওঠা চক্র জড়িত বলে অভিযোগ
উঠেছে। চক্রটি সরকারপ্রধানকে অন্ধকারে রেখে গ্রামের দরিদ্র মানুষগুলোর জন্য
বরাদ্দকৃত হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা করছে।
সরকারপ্রধানকে ভুল বুঝিয়ে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যে চক্রটি এ ধরনের ষড়যন্ত্র
করছে দ্রুত তদন্তের মাধ্যমে তাদের মুখোশ উন্মোচনের দাবি জানান সমাজের
বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার প্রতিনিধিরা।
পরিবর্তনের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজ আগ্রহ থেকে এ উদ্যোগ নিয়েছেন। বিদ্যুতের ব্যাপারে তিনি খুবই সিরিয়াস। যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেখানে টিআর ও কাবিখার মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিচ্ছে। আর আলাদা প্রজেক্ট নিলে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি তো হতেই পারে। এটি নতুন একটি কনসেপ্ট। সে হিসেবে কিছু অনিয়মও থাকতে পারে। পরে তা ঠিক হয়ে যাবে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত মোটেও সঠিক নয়। দরিদ্র মানুষের জন্য নেয়া কর্মসূচিতে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। যাদের খাবার পয়সা নেই তারা বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিয়ে কি করবে? এমনিতেই গরিবরা তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। গরিব মানুষের সহায়তার জন্য নেয়া কর্মসূচিতে যেন তাদের সহায়তার ব্যবস্থাই বহাল রাখা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি। সরকারের এ পদক্ষেপকে আপনি কিভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, কোনো বিশেষ শ্রেণীর ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার এটা করে থাকতে পারে।
জানা গেছে, অভাবের সময় গ্রামের দুস্থ মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর থেকে কাবিখা এবং টিআর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রতি বছর এ দুই খাতে চাল, গম বরাদ্দ দেয়া হয়। সাধারণত গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই প্রকল্পের অধীনে কাজ করে পরিবারের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। চলতি অর্থবছরে টিআর কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লাখ মেট্রিক টন গম। কাবিখা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন গম। টাকার অংকে দুই খাতের বরাদ্দের মূল্য তিন হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই দুস্থ মানুষগুলোর পাওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি প্রথমবারের মতো জারি করা নির্দেশিকার কারণে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ দেড় হাজার কোটি টাকা চলে যাবে সোলার প্যানেল খাতে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- সোলার প্যানেল এবং বায়োগ্যাস স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য সম্পূর্ণ বিক্রি করে নগদায়ন করতে হবে। বরাদ্দের ৫০ ভাগ অর্থ এ খাতে ব্যয় হবে। পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রহস্যময় এই গভীর ষড়যন্ত্রের মূল ইন্দনদাতা হচ্ছে একটি বিদেশী সিন্ডিকেট। নেপথ্যে থেকে তাদের অর্থ ও শক্তি জোগাচ্ছে বিশেষ ব্যাংক নামধারী দেশীয় একটি শক্তিশালী এনজিও। যাদের দেশব্যাপী একটি বৃহৎ সোলার প্রকল্প রয়েছে। অভিযোগ আছে, কিছুদিন আগেও এই এনজিওর মালিকের গভীর ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতু থেকে অর্থ বরাদ্দ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ চক্রটি ওই এনজিওকে আর্থিক সুবিধা দিতে টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেকই সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতে ব্যয়ের প্রকল্প তৈরি করেছে। অভিযোগ- প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিন্ডিকেট চলতি অর্থবছরেই দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়বে গ্রামীণ অবকাঠামো ও তৃণমূলের অর্থনীতি। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠবে লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ। গ্রামে গ্রামে তীব্র হবে সরকারিবিরোধী আন্দোলন। মোটকথা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশে দুর্যোগ নেমে আসার আশংকা রয়েছে।
এ উদ্যোগে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলকে সুযোগ করে দেয়ার ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, যাদের জন্য কর্মসূচি, সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবেন। আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে, তবে তা টিআর-কাবিখা কর্মসূচির মাধ্যমে কেন? এর মাধ্যমে সমাজে যাদের ভালো অবস্থান তাদেরই সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এতে আর্থিক অনিয়মেরও আশংকা থাকছে। কারণ মান সুনির্দিষ্ট না থাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কম দামে পণ্য কিনে তা বেশি দামে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নিতে পারে।
এর সুবিধাভোগী কারা হবেন তা নির্ধারণ না করায় এক ধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হবে উল্লেখ করে ড. ইফতেখার আরও বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের সরকারদলীয় লোকেরা এ থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত ব্যবসায়ীরাও ফায়দা নিতে পিছ-পা হবেন না।
দেশের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সংকট আগের চেয়ে কম। এ খাতে নেয়া নতুন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০২১ সালের মধ্যে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচি কাটছাঁট করে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার পরিকল্পনার মধ্যে দুর্নীতির গন্ধ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে- নিম্নমানের সোলার প্যানেলের কারণে ইতিমধ্যেই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটির সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুস্থবান্ধব কর্মসূচি থেকে অর্থ বের করে সোলার প্যানেল খাতে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলে তারা মন্তব্য করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে মুহূর্তে আশংকা করা হচ্ছে যে, সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বড় আন্দোলন করতে পারে। ঠিক সেই সময় তাদের হাতে এ রকম বড় ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যু তুলে দেয়া হচ্ছে। এটি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া কিছুই নয়। তাদের মতে, এ প্রক্রিয়াকে প্রকাশ্য দুর্নীতি বললেও ভুল হবে না। কারণ প্রথমদিকে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস রিমোট এরিয়ায় করার কথা বলা হলেও নির্দেশনায় সারা দেশেই তা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। তাহলে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস রয়েছে সেখানে কেন সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপনের নামে হতদরিদ্র জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করতে হবে?
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, হঠাৎ করে টিআর-কাবিখা খাতের অর্ধেক টাকা সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট কেনার নেপথ্যে রয়েছে সরকারবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে টিআর-কাবিখা প্রকল্প তৈরি করেছিল সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতে অর্ধেক টাকা ব্যয় করা হলে এর পুরো উদ্দেশ্যটাই ভেস্তে যাবে। তার মতে, মূলত গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীই টিআর-কাবিখা প্রকল্প থেকে সহায়তা পেয়ে থাকেন। আর এই শ্রেণীর জনগণই মূলত যে কোনো দেশের একটি সরকারকে নড়বড়ে করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি অবিলম্বে টিআর-কাবিখা খাত থেকে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। অন্যথায় এই একটি প্রকল্পই যে কোনো মুহূর্তে সরকারের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে তিনি বলেন, সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতকে উৎসাহিত করা খুবই জরুরি। কারণ গ্রামীণ জনপদকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম সোলার প্রজেক্ট। কিন্তু সেক্ষেত্রে টিআর-কাবিখার বরাদ্দ কাটছাঁট করে সোলার প্রজেক্টকে উৎসাহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজন হলে সোলার খাতে আলাদা অর্থ বরাদ দিয়ে হলেও টিআর-কাবিখা প্রকল্পটি রক্ষা করার পরামর্শ দেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সোলার কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-অধিদফতরের পাশাপাশি কতিপয় বিএনপি-জামায়াতপন্থী দুর্নীতিবাজ জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট অফিসারের গোপন যোগসাজশ রয়েছে। মূলত এ কারণেই তড়িঘড়ি করে রাতারাতি সিন্ডিকেট পুরো টিআর-কাবিখা প্রকল্পের নির্দেশিকা সংশোধন করেছে।
কয়েকটি সোলার কোম্পানি এ চক্রের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের একটি বড় সোলার কোম্পানিও আছে। অভিযোগ সরকারের ৩ জন প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই সোলার কোম্পানিটি বর্তমানে চট্টগ্রামে স্পর্শকাতর স্থানে কাজ করছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটকে রিপাওয়ারিং করার প্রকল্পেও ওই সোলার কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত একটি বৃহৎ সোলার প্যানেল কোম্পানিও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। দেশের সবচেয়ে বড় সুপারশপের মালিকানাধীন ওই সোলার কোম্পানিটি বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশ সোলারের চাহিদা পূরণ করছে। এর বাইরেও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকার সোলার প্যানেল বিক্রি করে এমন দুই শতাধিক এনজিও জড়িত বলে জানা গেছে। প্রকল্পটি তৈরির জন্য দেশী-বিদেশী এই সিন্ডিকেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তিনজন পরিচালককে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। পরিচালকদের মধ্যে ২ জনকে অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অধিদফতরে আনা হয়েছে। বিনিময়ে তারও মোটা অংকের টাকা সুবিধা পেয়েছেন।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এমনিতেই টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। ‘নেতাকর্মী পালনের কর্মসূচি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে টিআর-কাবিখা। সব সরকারের আমলেই টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। কিন্তু তারপরও বাস্তবে ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। এতে দেশের ঘূর্ণায়মান অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এখন টিআর-কাবিখা কর্মসূচির মোট বরাদ্দের অর্ধেক যদি সোলার বা বায়োগ্যাস প্রকল্পে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় তবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মেছবাহ উল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই বিনা পয়সায় গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা এসেছে। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সেখানে এটা কাজে দেবে। যেখানে প্রয়োজন নেই সেটা আমরা দেখব। যেখানে বিদ্যুৎ আছে সেখানে এর প্রয়োজন নেই, এমন নির্দেশনা আমরা এখনই দিচ্ছি না।
যেহেতু সোলার ও বায়োগ্যাস খাতে বরাদ্দের ৫০ শতাংশ খরচ করা বাধ্যতামূলক তাই বিদ্যুৎ ও গ্যাস রয়েছে সেসব এলাকায় ওই বরাদ্দ কোন খাতে খরচ করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ওই টাকা কি করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা নেই। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আরও ৬ মাস সময় রয়েছে। এটুকু বলতে পারি, বাস্তবতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এ বন্দোবস্ত কিনা- এমন প্রশ্নে মেছবাহ উল আলম বলেন, আমাদের নির্দেশনায় কোথাও অমুক বিশেষ কোম্পানির কাছ থেকে সোলার কিনতে হবে এমন কথা বলা নেই। এটা বলার সুযোগও নেই। কারণ স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিই এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। ওই কমিটি এসব বিষয় মনিটরিং করবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ও বিএনপি নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, সরকার দেশের রিমোট এরিয়ায় সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস দেবে এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা টিআর-কাবিখা কর্মসূচির টাকায় কেন? এ দুটি কর্মসূচি গরিব মানুষের কর্মসংস্থান ও উপকারের জন্য। এ কর্মসূচির টাকা অনেক সময় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা নয়-ছয় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপরও ওই টাকা গ্রামাঞ্চলেই থাকে। কিন্তু সোলার ও বায়োগ্যাস দিলে তা যাবে এনজিও বা ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে। এতে গ্রামাঞ্চলের কোনো উপকারই হবে না বরং এ কর্মসূচিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও বাড়বে।
তবে বিষয়টির সঙ্গে একমত নন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কারও ফায়দা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় প্রজেক্ট কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে কারা এ সুযোগ পাবেন এবং কোন কোম্পানির সোলার বা বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নেয়া হবে। এসবের মান খারাপ হলে কমিটিকে দায়িত্ব নিতে হবে। অনিয়ম হলে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হবে। ডিসিদের ইতিমধ্যে এ বিষয়ে মনিটরিং বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচিতে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মহাপরিচালক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, সরকারের লক্ষ্য হলো গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। মূলত সে কারণেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিএনপির গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুও অভিন্ন মত প্রকাশ করে যুগান্তরকে বলেন, সরকারের এ পদক্ষেপে গরিব ও হতদরিদ্র মানুষের কোনো উপকারই হবে না। উপকার হবে আওয়ামী ব্যবসায়ীদের। ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী ও নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হয়েছে।
পরিবর্তনের বিষয়ে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বলেন, প্রধানমন্ত্রী নিজ আগ্রহ থেকে এ উদ্যোগ নিয়েছেন। বিদ্যুতের ব্যাপারে তিনি খুবই সিরিয়াস। যেখানে বিদ্যুৎ পৌঁছানো সম্ভব নয়, সেখানে টিআর ও কাবিখার মাধ্যমে সরকার বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিচ্ছে। আর আলাদা প্রজেক্ট নিলে দীর্ঘ সময় প্রয়োজন। অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে মন্ত্রী বলেন, দুর্নীতি তো হতেই পারে। এটি নতুন একটি কনসেপ্ট। সে হিসেবে কিছু অনিয়মও থাকতে পারে। পরে তা ঠিক হয়ে যাবে। যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া যাবে তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া হবে।
সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) প্রধান বদিউল আলম মজুমদার এ প্রসঙ্গে যুগান্তরকে বলেন, সরকারের এ সিদ্ধান্ত মোটেও সঠিক নয়। দরিদ্র মানুষের জন্য নেয়া কর্মসূচিতে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্রকল্প অন্তর্ভুক্ত করা তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপের শামিল। যাদের খাবার পয়সা নেই তারা বিদ্যুৎ ও গ্যাস দিয়ে কি করবে? এমনিতেই গরিবরা তাদের ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত। গরিব মানুষের সহায়তার জন্য নেয়া কর্মসূচিতে যেন তাদের সহায়তার ব্যবস্থাই বহাল রাখা হয় সে বিষয়টি নিশ্চিতের দাবি জানান তিনি। সরকারের এ পদক্ষেপকে আপনি কিভাবে দেখছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে বদিউল আলম বলেন, কোনো বিশেষ শ্রেণীর ব্যবসায়ীর স্বার্থ রক্ষার জন্য সরকার এটা করে থাকতে পারে।
জানা গেছে, অভাবের সময় গ্রামের দুস্থ মানুষগুলোর মুখে খাবার তুলে দেয়ার লক্ষ্যে স্বাধীনতার পর থেকে কাবিখা এবং টিআর প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়নের নামে প্রতি বছর এ দুই খাতে চাল, গম বরাদ্দ দেয়া হয়। সাধারণত গ্রামের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে এই প্রকল্পের অধীনে কাজ করে পরিবারের অন্নসংস্থানের ব্যবস্থা করে থাকে। চলতি অর্থবছরে টিআর কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল দেড় লাখ মেট্রিক টন চাল ও আড়াই লাখ মেট্রিক টন গম। কাবিখা কর্মসূচিতে বরাদ্দ ছিল এক লাখ ৯৫ হাজার মেট্রিক টন চাল ও এক লাখ ৮০ হাজার মেট্রিক টন গম। টাকার অংকে দুই খাতের বরাদ্দের মূল্য তিন হাজার কোটি টাকা। যার পুরোটাই দুস্থ মানুষগুলোর পাওয়ার কথা। কিন্তু সম্প্রতি প্রথমবারের মতো জারি করা নির্দেশিকার কারণে অর্ধেক টাকা অর্থাৎ দেড় হাজার কোটি টাকা চলে যাবে সোলার প্যানেল খাতে। নির্দেশনায় বলা হয়েছে- সোলার প্যানেল এবং বায়োগ্যাস স্থাপন প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বরাদ্দকৃত খাদ্যশস্য সম্পূর্ণ বিক্রি করে নগদায়ন করতে হবে। বরাদ্দের ৫০ ভাগ অর্থ এ খাতে ব্যয় হবে। পাশাপাশি কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি গঠন করতে হবে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রহস্যময় এই গভীর ষড়যন্ত্রের মূল ইন্দনদাতা হচ্ছে একটি বিদেশী সিন্ডিকেট। নেপথ্যে থেকে তাদের অর্থ ও শক্তি জোগাচ্ছে বিশেষ ব্যাংক নামধারী দেশীয় একটি শক্তিশালী এনজিও। যাদের দেশব্যাপী একটি বৃহৎ সোলার প্রকল্প রয়েছে। অভিযোগ আছে, কিছুদিন আগেও এই এনজিওর মালিকের গভীর ষড়যন্ত্রে পদ্মা সেতু থেকে অর্থ বরাদ্দ বাতিল করেছিল বিশ্বব্যাংক। অথচ দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং সংশ্লিষ্ট অধিদফতরের দুর্নীতিবাজ চক্রটি ওই এনজিওকে আর্থিক সুবিধা দিতে টিআর (টেস্ট রিলিফ) ও কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে বরাদ্দকৃত টাকার অর্ধেকই সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতে ব্যয়ের প্রকল্প তৈরি করেছে। অভিযোগ- প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে সিন্ডিকেট চলতি অর্থবছরেই দেড় হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেবে। এতে লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়বে গ্রামীণ অবকাঠামো ও তৃণমূলের অর্থনীতি। সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভে ফুঁসে উঠবে লাখ লাখ হতদরিদ্র মানুষ। গ্রামে গ্রামে তীব্র হবে সরকারিবিরোধী আন্দোলন। মোটকথা প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে দেশে দুর্যোগ নেমে আসার আশংকা রয়েছে।
এ উদ্যোগে বিশেষ স্বার্থান্বেষী মহলকে সুযোগ করে দেয়ার ঝুঁকি রয়েছে উল্লেখ করে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, যাদের জন্য কর্মসূচি, সেই দরিদ্র জনগোষ্ঠী বঞ্চিত হবেন। আমাদের বিদ্যুতের প্রয়োজন আছে, তবে তা টিআর-কাবিখা কর্মসূচির মাধ্যমে কেন? এর মাধ্যমে সমাজে যাদের ভালো অবস্থান তাদেরই সুবিধা করে দেয়া হয়েছে। পাশাপাশি এতে আর্থিক অনিয়মেরও আশংকা থাকছে। কারণ মান সুনির্দিষ্ট না থাকায় প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা কম দামে পণ্য কিনে তা বেশি দামে চালিয়ে দেয়ার সুযোগ নিতে পারে।
এর সুবিধাভোগী কারা হবেন তা নির্ধারণ না করায় এক ধরনের অস্বচ্ছতা তৈরি হবে উল্লেখ করে ড. ইফতেখার আরও বলেন, স্থানীয় পর্যায়ের সরকারদলীয় লোকেরা এ থেকে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করবেন। পাশাপাশি এ সংক্রান্ত ব্যবসায়ীরাও ফায়দা নিতে পিছ-পা হবেন না।
দেশের বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে সরকারের পক্ষ থেকে ব্যাপক কর্মসূচি নেয়া হয়েছে। এতে বিদ্যুৎ সংকট আগের চেয়ে কম। এ খাতে নেয়া নতুন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হলে ২০২১ সালের মধ্যে চাহিদার চেয়ে বেশি বিদ্যুৎ উৎপন্ন করা সম্ভব হবে। এ অবস্থায় টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচি কাটছাঁট করে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে গ্রামে বিদ্যুৎ দেয়ার পরিকল্পনার মধ্যে দুর্নীতির গন্ধ খুঁজছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে- নিম্নমানের সোলার প্যানেলের কারণে ইতিমধ্যেই সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পটির সাফল্য প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতিতে দুস্থবান্ধব কর্মসূচি থেকে অর্থ বের করে সোলার প্যানেল খাতে নিয়ে যাওয়া কোনোভাবেই বুদ্ধিমানের কাজ নয় বলে তারা মন্তব্য করেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে মুহূর্তে আশংকা করা হচ্ছে যে, সরকার পতনের লক্ষ্যে বিএনপিসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো বড় আন্দোলন করতে পারে। ঠিক সেই সময় তাদের হাতে এ রকম বড় ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যু তুলে দেয়া হচ্ছে। এটি দেশ ও সরকারের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্রের অংশ ছাড়া কিছুই নয়। তাদের মতে, এ প্রক্রিয়াকে প্রকাশ্য দুর্নীতি বললেও ভুল হবে না। কারণ প্রথমদিকে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস রিমোট এরিয়ায় করার কথা বলা হলেও নির্দেশনায় সারা দেশেই তা বাস্তবায়ন করতে বলা হয়েছে। তাহলে যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ ও গ্যাস রয়েছে সেখানে কেন সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস স্থাপনের নামে হতদরিদ্র জনগণের টাকার শ্রাদ্ধ করতে হবে?
একটি গোয়েন্দা সংস্থার এক শীর্ষ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে যুগান্তরকে জানান, হঠাৎ করে টিআর-কাবিখা খাতের অর্ধেক টাকা সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট কেনার নেপথ্যে রয়েছে সরকারবিরোধী গভীর ষড়যন্ত্র। তিনি বলেন, সরকার যে উদ্দেশ্য নিয়ে টিআর-কাবিখা প্রকল্প তৈরি করেছিল সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতে অর্ধেক টাকা ব্যয় করা হলে এর পুরো উদ্দেশ্যটাই ভেস্তে যাবে। তার মতে, মূলত গ্রামের হতদরিদ্র জনগোষ্ঠীই টিআর-কাবিখা প্রকল্প থেকে সহায়তা পেয়ে থাকেন। আর এই শ্রেণীর জনগণই মূলত যে কোনো দেশের একটি সরকারকে নড়বড়ে করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন। তিনি অবিলম্বে টিআর-কাবিখা খাত থেকে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস ক্রয়ের সিদ্ধান্তটি বাতিল করার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান। অন্যথায় এই একটি প্রকল্পই যে কোনো মুহূর্তে সরকারের জন্য ভয়াবহ বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। তবে তিনি বলেন, সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস খাতকে উৎসাহিত করা খুবই জরুরি। কারণ গ্রামীণ জনপদকে আলোকিত করার ক্ষেত্রে একমাত্র মাধ্যম সোলার প্রজেক্ট। কিন্তু সেক্ষেত্রে টিআর-কাবিখার বরাদ্দ কাটছাঁট করে সোলার প্রজেক্টকে উৎসাহিত করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। প্রয়োজন হলে সোলার খাতে আলাদা অর্থ বরাদ দিয়ে হলেও টিআর-কাবিখা প্রকল্পটি রক্ষা করার পরামর্শ দেন তিনি।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং অধিদফতরের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তার সমন্বয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট সোলার কোম্পানিগুলোর বড় ধরনের আন্ডারহ্যান্ড ডিলিং হয়েছে। এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়-অধিদফতরের পাশাপাশি কতিপয় বিএনপি-জামায়াতপন্থী দুর্নীতিবাজ জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী অফিসার ও সংশ্লিষ্ট প্রকল্পের প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্ট অফিসারের গোপন যোগসাজশ রয়েছে। মূলত এ কারণেই তড়িঘড়ি করে রাতারাতি সিন্ডিকেট পুরো টিআর-কাবিখা প্রকল্পের নির্দেশিকা সংশোধন করেছে।
কয়েকটি সোলার কোম্পানি এ চক্রের সঙ্গে গোপনে হাত মিলিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামের একটি বড় সোলার কোম্পানিও আছে। অভিযোগ সরকারের ৩ জন প্রভাবশালী মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ এই সোলার কোম্পানিটি বর্তমানে চট্টগ্রামে স্পর্শকাতর স্থানে কাজ করছে। সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের একটি ইউনিটকে রিপাওয়ারিং করার প্রকল্পেও ওই সোলার কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে জানা গেছে। এছাড়া তেজগাঁও এলাকায় অবস্থিত একটি বৃহৎ সোলার প্যানেল কোম্পানিও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত আছে বলে অভিযোগ ওঠেছে। দেশের সবচেয়ে বড় সুপারশপের মালিকানাধীন ওই সোলার কোম্পানিটি বর্তমানে দেশের ৬০ শতাংশ সোলারের চাহিদা পূরণ করছে। এর বাইরেও এই সিন্ডিকেটের সঙ্গে দেশের বিভিন্ন এলাকার সোলার প্যানেল বিক্রি করে এমন দুই শতাধিক এনজিও জড়িত বলে জানা গেছে। প্রকল্পটি তৈরির জন্য দেশী-বিদেশী এই সিন্ডিকেট দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের শীর্ষ কর্মকর্তাসহ তিনজন পরিচালককে মোটা অংকের টাকা ঘুষ দিয়েছেন বলেও অভিযোগ আছে। পরিচালকদের মধ্যে ২ জনকে অবৈধভাবে বিভিন্ন প্রকল্প থেকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দিয়ে অধিদফতরে আনা হয়েছে। বিনিময়ে তারও মোটা অংকের টাকা সুবিধা পেয়েছেন।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে, এমনিতেই টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগের শেষ নেই। ‘নেতাকর্মী পালনের কর্মসূচি’ হিসেবে আখ্যায়িত হয়েছে টিআর-কাবিখা। সব সরকারের আমলেই টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ ওঠেছে। কিন্তু তারপরও বাস্তবে ৬০ থেকে ৭৫ শতাংশ কাজ হয়েছে। এতে দেশের ঘূর্ণায়মান অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। কিন্তু এখন টিআর-কাবিখা কর্মসূচির মোট বরাদ্দের অর্ধেক যদি সোলার বা বায়োগ্যাস প্রকল্পে ব্যয়ের বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয় তবে এর প্রকৃত উদ্দেশ্য ব্যর্থ হবে।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব মেছবাহ উল আলম বৃহস্পতিবার যুগান্তরকে বলেন, সরকার মহৎ উদ্দেশ্য নিয়েই বিনা পয়সায় গরিব মানুষের ঘরে বিদ্যুৎ ও গ্যাস পৌঁছে দিতে যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা এসেছে। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ নেই সেখানে এটা কাজে দেবে। যেখানে প্রয়োজন নেই সেটা আমরা দেখব। যেখানে বিদ্যুৎ আছে সেখানে এর প্রয়োজন নেই, এমন নির্দেশনা আমরা এখনই দিচ্ছি না।
যেহেতু সোলার ও বায়োগ্যাস খাতে বরাদ্দের ৫০ শতাংশ খরচ করা বাধ্যতামূলক তাই বিদ্যুৎ ও গ্যাস রয়েছে সেসব এলাকায় ওই বরাদ্দ কোন খাতে খরচ করা হবে- এমন প্রশ্নের জবাবে সচিব বলেন, ওই টাকা কি করা হবে সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো নির্দেশনা নেই। এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার আরও ৬ মাস সময় রয়েছে। এটুকু বলতে পারি, বাস্তবতার ভিত্তিতেই সিদ্ধান্ত দেয়া হবে।
বিশেষ কোনো গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতেই এ বন্দোবস্ত কিনা- এমন প্রশ্নে মেছবাহ উল আলম বলেন, আমাদের নির্দেশনায় কোথাও অমুক বিশেষ কোম্পানির কাছ থেকে সোলার কিনতে হবে এমন কথা বলা নেই। এটা বলার সুযোগও নেই। কারণ স্থানীয় পর্যায়ের কমিটিই এ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবে। ওই কমিটি এসব বিষয় মনিটরিং করবে।
এ প্রসঙ্গে সাবেক খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনামন্ত্রী ও বিএনপি নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ যুগান্তরকে বলেন, সরকার দেশের রিমোট এরিয়ায় সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস দেবে এটা নিঃসন্দেহে ভালো উদ্যোগ। কিন্তু এটা টিআর-কাবিখা কর্মসূচির টাকায় কেন? এ দুটি কর্মসূচি গরিব মানুষের কর্মসংস্থান ও উপকারের জন্য। এ কর্মসূচির টাকা অনেক সময় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা নয়-ছয় করে বলে অভিযোগ রয়েছে। তারপরও ওই টাকা গ্রামাঞ্চলেই থাকে। কিন্তু সোলার ও বায়োগ্যাস দিলে তা যাবে এনজিও বা ধনী ব্যবসায়ীদের হাতে। এতে গ্রামাঞ্চলের কোনো উপকারই হবে না বরং এ কর্মসূচিতে অনিয়ম ও দুর্নীতি আরও বাড়বে।
তবে বিষয়টির সঙ্গে একমত নন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরের মহাপরিচালক মোহাম্মদ আবদুল ওয়াজেদ। তিনি যুগান্তরকে বলেন, কারও ফায়দা নেয়ার কোনো সুযোগ নেই। স্থানীয় প্রজেক্ট কমিটিই সিদ্ধান্ত নেবে কারা এ সুযোগ পাবেন এবং কোন কোম্পানির সোলার বা বায়োগ্যাস প্ল্যান্ট নেয়া হবে। এসবের মান খারাপ হলে কমিটিকে দায়িত্ব নিতে হবে। অনিয়ম হলে আইনানুগ ব্যবস্থাও নেয়া হবে। ডিসিদের ইতিমধ্যে এ বিষয়ে মনিটরিং বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।
টিআর-কাবিখার মতো কর্মসূচিতে সোলার প্যানেল ও বায়োগ্যাস প্রকল্প অন্তর্ভুক্তির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে মহাপরিচালক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বলা হয়েছে, সরকারের লক্ষ্য হলো গ্রাম পর্যায়ে পর্যাপ্ত বিদ্যুতের ব্যবহার বাড়ানো ও জ্বালানি সাশ্রয়ের ব্যবস্থা করা। মূলত সে কারণেই এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিএনপির গ্রাম সরকারবিষয়ক সম্পাদক ও সাবেক উপমন্ত্রী অ্যাডভোকেট রুহুল কুদ্দুস তালুকদার দুলুও অভিন্ন মত প্রকাশ করে যুগান্তরকে বলেন, সরকারের এ পদক্ষেপে গরিব ও হতদরিদ্র মানুষের কোনো উপকারই হবে না। উপকার হবে আওয়ামী ব্যবসায়ীদের। ক্ষমতাসীন দলের ব্যবসায়ী ও নেতাকর্মীদের বিশেষ সুবিধা দিতেই এটা করা হয়েছে।
No comments