শূন্য সৃষ্টি করে শূন্যে চলে গেলেন by ফরিদা আখতার
বেশ কিছুদিন ধরে লতিফা আপাকে ফোন করব
ভাবছিলাম, কিন্তু করা হয়নি। ভেবেছি, হাতে একটু সময় নিয়েই ফোন করব, নইলে
তিনি সন্তুষ্ট হবেন না। এখন সেসবের ঊর্ধ্বে চলে গেছেন তিনি। ৪ ডিসেম্বর
সিরডাপ মিলনায়তনে এক সভায় গিয়েছিলাম। ফোন পেলাম, লতিফা আপা বেঁচে নেই। তিনি
রাত ১টায় মারা গেছেন। লাইফ সাপোর্টেও নাকি রাখতে হয়েছিল। আমরা কিছুই জানতে
পারিনি। কেন? লতিফা আকন্দ কি খবর হওয়ার মতো কেউ নন? তার কি কোনো অবদান নেই
এ সমাজে? কেউ কি তাকে চেনেন না? তিনি মৃত্যুর একদিন আগেও সক্রিয় ছিলেন।
একটি সভায় গিয়ে বক্তৃতাও দিয়ে এসেছেন। কাজেই লোকচক্ষুর অন্তরালে ছিলেন বলা
যাবে না। কিন্তু তিনি কোনো খবর হতে পারেননি। সন্ধ্যায় কেবল একাত্তর টিভি
এবং সম্ভবত এনটিভি ও বাংলাভিশনে স্ক্রলে দিয়েছে। ‘শিক্ষাবিদ লতিফা আকন্দ
মারা গেছেন’। ব্যাস।
সমাজ যদি আসলেই তাকে না চিনে থাকে, তাহলে একটু চিনিয়ে দিচ্ছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন ২৫ বছর। এ ছাড়াও তিনি আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। আমি যখন থেকে তাকে চিনি, অর্থাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি সময়, তখন তাকে ডাকসাইটে অধ্যাপক হিসেবে দেখিনি, দেখেছি একজন নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে রাস্তায় মিছিল করতে। তিনি উইমেন ফর উইমেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
লতিফা আপা যখন বক্তব্য রাখতেন, তখন সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। তার মধ্যে রস থাকত অনেক; আবার গভীর চিন্তার খোরাকও থাকত। কথার মাঝখানে কখন যে গভীর কথাটি বলে ফেলেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হতো না। লতিফা আপা সম্পর্কে প্রথম যে বিষয়টি জেনে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরিত্যক্ত নবজাতক শিশুদের (বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের) নিয়ে এসে নিঃসন্তান দম্পতিদের দিতেন। গরিব মায়েরা একের বেশি কন্যাসন্তান হলে শিশুটিকে ফেলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতেন। তিনি নার্সদের বলে রাখতেন, এমন ঘটনা ঘটলে যেন তাকে জানানো হয়। তিনি সেই ভোরবেলায় গিয়ে শিশুটিকে আদর-যন্ত নিয়ে আসতেন। এদের মায়ের সঙ্গে তার দেখা হতো না, কিন্তু সেই মা যদি জানত তার সন্তান একটি আশ্রয় পেয়েছে, নিশ্চয় তার মনে অনেক শান্তি হতো।
শুরুতে ভাবতাম, লতিফা আপা বুঝি শুধু নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার বিষয়ে কাজ করেন। কিন্তু যতই তিনি আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসতে শুরু করলেন, দেখলাম গাছপালা, পরিবেশ, সমাজের ছোটখাটো বিষয়- সব কিছুই তাকে টানে। কোনো গাছ কাটা হলে তিনি খুব দুঃখ পেতেন। তিনি স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। সকালে নিয়মিত হাঁটতেন রমনা পার্কে। কিন্তু সেখানেও কি তিনি নিছক হাঁটার কাজ করতেন? না। সেখানে অনেক মহিলা ডাক্তারের পরামর্শে হাঁটতে আসেন। লতিফা আপা তাদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘একটু বসি’ নামে একটি ছোট সংগঠন। তারা হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি সমাজের সেবামূলক কাজ শুরু করেন। নেতৃত্বে অবশ্যই লতিফা আপা।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা যখনই কোনো সভার আয়োজন করে, সেখানে লতিফা আপাকে লাগবেই। তিনি সভাপতিত্ব করবেন, নাকি প্রধান অতিথি হবেন, নাকি বক্তব্য রাখবেন- কিছু না কিছু তাকে করতেই হবে। এমনও হয়েছে, তিনি এর কোনোটাই করেননি, শুধুই অতিথি হয়ে এসেছেন। তবুও দর্শকের সারিতে বসে শুনেছেন। তামাকবিরোধী নারীজোট (তাবিনাজ) গঠনের শুরু থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং আমাদের সঙ্গে শেষ সভাটিতে তিনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ২০১৪ সালের মে মাসে।
লতিফা আকন্দ রোকেয়া পদক পান ২০০৭ সালে। হাসতে হাসতে ফোনে বলেছিলেন, ‘জানো, আমি কিছুই জানি না। টিভি স্ক্রলে আমার নাম দেখে আমাকে অনেকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছে, কিন্তু আমি কোনো চিঠি বা কোনো খবর বাংলা একাডেমি থেকে পাইনি।’ তিনি রোকেয়া পদক নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে একটি সংবর্ধনা দেয়া হল। সেখানে তার বিশেষ নির্বাচিত অতিথি হিসেবে আমার নাম তিনি দিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম তিনি কত বড় মনের মানুষ। তার সম্মানের সঙ্গে আমাদের শরিক করে নিতে ভোলেননি।
সবশেষে বলব লতিফা আপার হাসি ও হাততালির কথা। তিনি যখন কথা বলতেন, তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকত খোলামেলা হাসি। আর যদি খুশির হাততালি দিতেন, সেটা ছিল একেবারে শিশুর মতো। দুই হাতের বিশেষ ভঙ্গিতে হাততালি দিতেন। মুখে থাকত সেই চেনা হাসি।
এই লতিফা আপাকে আমরা হারালাম। মৃত্যুর সময় তার বয়স নব্বই হয়েছিল, কাজেই অনুযোগ করব না। কিন্তু তার প্রতি মর্যাদার অভাব ঘটলে বুঝতে হবে এ জাতি বড়ই দুর্ভাগা।
ফরিদা আখতার : নারী আন্দোলনের নেত্রী
সমাজ যদি আসলেই তাকে না চিনে থাকে, তাহলে একটু চিনিয়ে দিচ্ছি। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে অধ্যাপনা করেছেন ২৫ বছর। এ ছাড়াও তিনি আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়িয়েছেন। আমি যখন থেকে তাকে চিনি, অর্থাৎ আশির দশকের মাঝামাঝি সময়, তখন তাকে ডাকসাইটে অধ্যাপক হিসেবে দেখিনি, দেখেছি একজন নারী আন্দোলনের কর্মী হিসেবে রাস্তায় মিছিল করতে। তিনি উইমেন ফর উইমেন, বাংলাদেশ মহিলা পরিষদসহ আরও কয়েকটি সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।
লতিফা আপা যখন বক্তব্য রাখতেন, তখন সবাই মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত। তার মধ্যে রস থাকত অনেক; আবার গভীর চিন্তার খোরাকও থাকত। কথার মাঝখানে কখন যে গভীর কথাটি বলে ফেলেছেন, তা বুঝতে কষ্ট হতো না। লতিফা আপা সম্পর্কে প্রথম যে বিষয়টি জেনে অভিভূত হয়ে গিয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজে পরিত্যক্ত নবজাতক শিশুদের (বিশেষ করে মেয়ে শিশুদের) নিয়ে এসে নিঃসন্তান দম্পতিদের দিতেন। গরিব মায়েরা একের বেশি কন্যাসন্তান হলে শিশুটিকে ফেলে হাসপাতাল ছেড়ে চলে যেতেন। তিনি নার্সদের বলে রাখতেন, এমন ঘটনা ঘটলে যেন তাকে জানানো হয়। তিনি সেই ভোরবেলায় গিয়ে শিশুটিকে আদর-যন্ত নিয়ে আসতেন। এদের মায়ের সঙ্গে তার দেখা হতো না, কিন্তু সেই মা যদি জানত তার সন্তান একটি আশ্রয় পেয়েছে, নিশ্চয় তার মনে অনেক শান্তি হতো।
শুরুতে ভাবতাম, লতিফা আপা বুঝি শুধু নারী নির্যাতন ও নারী অধিকার বিষয়ে কাজ করেন। কিন্তু যতই তিনি আমাদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আসতে শুরু করলেন, দেখলাম গাছপালা, পরিবেশ, সমাজের ছোটখাটো বিষয়- সব কিছুই তাকে টানে। কোনো গাছ কাটা হলে তিনি খুব দুঃখ পেতেন। তিনি স্বাস্থ্য সচেতন ছিলেন। সকালে নিয়মিত হাঁটতেন রমনা পার্কে। কিন্তু সেখানেও কি তিনি নিছক হাঁটার কাজ করতেন? না। সেখানে অনেক মহিলা ডাক্তারের পরামর্শে হাঁটতে আসেন। লতিফা আপা তাদের নিয়ে গড়ে তুললেন ‘একটু বসি’ নামে একটি ছোট সংগঠন। তারা হাঁটাহাঁটির পাশাপাশি সমাজের সেবামূলক কাজ শুরু করেন। নেতৃত্বে অবশ্যই লতিফা আপা।
নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা যখনই কোনো সভার আয়োজন করে, সেখানে লতিফা আপাকে লাগবেই। তিনি সভাপতিত্ব করবেন, নাকি প্রধান অতিথি হবেন, নাকি বক্তব্য রাখবেন- কিছু না কিছু তাকে করতেই হবে। এমনও হয়েছে, তিনি এর কোনোটাই করেননি, শুধুই অতিথি হয়ে এসেছেন। তবুও দর্শকের সারিতে বসে শুনেছেন। তামাকবিরোধী নারীজোট (তাবিনাজ) গঠনের শুরু থেকে তিনি আমাদের সঙ্গে কাজ করেছেন এবং আমাদের সঙ্গে শেষ সভাটিতে তিনি প্রধান অতিথি হয়ে এসেছিলেন ২০১৪ সালের মে মাসে।
লতিফা আকন্দ রোকেয়া পদক পান ২০০৭ সালে। হাসতে হাসতে ফোনে বলেছিলেন, ‘জানো, আমি কিছুই জানি না। টিভি স্ক্রলে আমার নাম দেখে আমাকে অনেকে ফোন করে অভিনন্দন জানিয়েছে, কিন্তু আমি কোনো চিঠি বা কোনো খবর বাংলা একাডেমি থেকে পাইনি।’ তিনি রোকেয়া পদক নিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাকে একটি সংবর্ধনা দেয়া হল। সেখানে তার বিশেষ নির্বাচিত অতিথি হিসেবে আমার নাম তিনি দিয়েছিলেন। বুঝেছিলাম তিনি কত বড় মনের মানুষ। তার সম্মানের সঙ্গে আমাদের শরিক করে নিতে ভোলেননি।
সবশেষে বলব লতিফা আপার হাসি ও হাততালির কথা। তিনি যখন কথা বলতেন, তার একটি বড় অংশ জুড়ে থাকত খোলামেলা হাসি। আর যদি খুশির হাততালি দিতেন, সেটা ছিল একেবারে শিশুর মতো। দুই হাতের বিশেষ ভঙ্গিতে হাততালি দিতেন। মুখে থাকত সেই চেনা হাসি।
এই লতিফা আপাকে আমরা হারালাম। মৃত্যুর সময় তার বয়স নব্বই হয়েছিল, কাজেই অনুযোগ করব না। কিন্তু তার প্রতি মর্যাদার অভাব ঘটলে বুঝতে হবে এ জাতি বড়ই দুর্ভাগা।
ফরিদা আখতার : নারী আন্দোলনের নেত্রী
No comments