শিক্ষার গোড়ায় গলদ by মো. সিদ্দিকুর রহমান
ইদানীং উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশের মেধাবীদের
সম্পর্কে নানা ধরনের নেতিবাচক আলোচনা গণমাধ্যমে প্রকাশ পাচ্ছে। ক্রমান্বয়ে এ
আলোচনা পথে-প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ছে। বেশিরভাগ মানুষের প্রশ্ন, শিক্ষার মানের
কেন এ হাল? পাবলিক পরীক্ষায় অসাধারণ পাসের হারে সবার মনে খুশির বন্যা বয়ে
যাওয়া বিচিত্র কিছু নয়। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, কর্তৃপক্ষ সর্বোপরি মিষ্টি
বিক্রেতারাও একযোগে এ আনন্দ উপভোগ করেন। এ মহা-আনন্দে শিক্ষার্থীর অর্জন
কতটুকু, একজন শিক্ষক হিসেবে তা আমাকে ভাবিয়ে তুলেছে। নানা প্রতিবন্ধকতা,
মৌখিক নির্দেশনার বদৌলতে শিক্ষার্থীকে কাক্সিক্ষত জ্ঞান না দিতে পারা একজন
শিক্ষকের জন্য কতটা বেদনাদায়ক তা বোঝানো সত্যি কষ্টকর ব্যাপার। বেশি নম্বর
দিয়ে ফেলকে টেনে পাস করানোর ভুতুড়ে নির্দেশনা নিয়ে শুরু হয় পরীক্ষার খাতা
দেখার প্রক্রিয়া।
কয়েক বছর আগেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে অর্ধেক পুরনো বই সংগ্রহ করে ছেঁড়া বই ছাত্রদের হাতে তুলে দেয়া হতো। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত চলে এ অবস্থা। দীর্ঘ সময় অর্ধেক পুরনো বই দেয়ার পর শিশু মনে লেখাপড়া সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ যেন একই তেলে বারবার পুরি ভাজার মতো অবস্থা। শিশু শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেয়া বর্তমান সরকারের একটি সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শিক্ষার জন্য সরকারের এ বিশাল উদ্যোগ ম্লান হয়ে গেছে বিভিন্ন অবাস্তব কার্যক্রম গ্রহণের ফলে। আজও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাঠদানবহির্ভূত কাজের বোঝা লাঘব হয়নি। বরং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ শিক্ষকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। এছাড়া সমাপনী পরীক্ষা চলাকালীন স্কুলে ক্লাস বন্ধ থাকে। ফলাফল ঘোষণা পর্যন্তই মূলত এ পরিস্থিতি কার্যকর থাকে। পাশাপাশি ছক পূরণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিদ্যালয়ে অসংখ্য কমিটির তাঁবেদারি এর উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন কাজ পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি এগিয়ে আছে। মার্চ-এপ্রিলে অনেকটা গণহারে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। মে-জুন মাসে ট্রেনিংয়ের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ বিদেশী অর্থ ল্যাপস হয়ে যাবে।
শিক্ষাকে ফলপ্রসূ ও অধিকতর কার্যকর করার জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যাহত করে কোনো কাজ করাই সমীচীন নয়। ছুটির পর্বে ট্রেনিং দেয়াই শ্রেয়। কাজের ব্যাপকতা কমানোর জন্য শুধু শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়ে বিদ্যালয়ে একটি কার্যকর কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। রাজনীতির ছায়া থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তির নমিনেশন বন্ধ করা দরকার। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কাজ কিছুটা লাঘব করার জন্য মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক শিক্ষাবোর্ড গঠন করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে শিশু শিক্ষাকে ব্যাহত করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা আছে। প্রতিটি শ্রেণীতে নির্দিষ্ট যোগ্যতা আছে। শিক্ষক স্বল্পতা ও শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে যোগ্যতাগুলোর কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভব হয় না। যোগ্যতাভিত্তিক/ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির নামে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব শিক্ষক, অভিভাক, শিক্ষার্থীর কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তককে গুরুত্ব না দিয়ে নোট-গাইডের দ্বারস্থ হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ, বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ্যবই থেকে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যায় না। পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী সেকেলে। আরেকটি কারণ, পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত প্রশ্নের ধারণা নেয়া। এককথায় শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবাই মিলে পাঠ্যপুস্তককে অকার্যকর করে ফেলেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশের পরিবর্তে ভালো রেজাল্টের প্রতি বেশি সম্মান দেখাচ্ছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকার সবাই মিলেমিশে একযোগে চাচ্ছে বেশি ও ভালো পাস। শিক্ষার্থীর কতটুকু জ্ঞান অর্জন হল, মেধার বিকাশ কতটুকু হল এ বিষয়টি নিয়ে শিশু থেকে শুরু করে এইচএসসি শিক্ষার্থী পর্যন্ত আমরা কতটুকু ভাবছি? অনেকে বলছে, কেউ এসএসসি ও এইচএসসিতে উজ্জ্বল ফল নিয়েও কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলায় ৫৯ শতাংশ নম্বর পাবে? ইংরেজিতে কেন মাত্র দু’জন পাস করবে? এ চিত্র নিছক উচ্চশিক্ষার ভর্তির ক্ষেত্রে নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থারই গুরুতর গলদ স্পষ্ট করেছে।
পাসের উচ্চ হার নিয়ে কারও সঙ্গে বিতর্ক করতে চাই না। শুধু বলব, ভালো জ্ঞান অর্জন হয়নি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে শিশুকে কঠিন ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করিয়ে ইংরেজ বানানোর প্রতিযোগিতা আমাদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে। আজও সে প্রবণতা বন্ধ তো হয়ইনি বরং বেড়েছে। আমাদের অভিভাবকদের বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বেশি বই, বেশি বেশি পড়া, বেশি ইংরেজি লেখাই শিশুদের ভবিষ্যতে ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলবে। অনেকটা বাল্যবিয়ের মতো। সুপাত্র-পাত্রী দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া। বাল্যবিয়ের যে খারাপ ফল বা যন্ত্রণা আমরা দেখতে পাই, অনুরূপভাবে বাল্যকালে যথার্থ শিক্ষার অভাব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনকে পিছিয়ে দিচ্ছে বা অকার্যকর করে ফেলছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে আলোকপাত করছি। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি প্রদত্ত মার্কিং স্কিমে দেখা গেছে, বানানের জন্য নম্বর কাটা যাবে না। কোনোরকম বোঝা গেলেই পুরো নম্বর। এতে মেধাবী শিক্ষার্থী ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্নের বদৌলতে প্রত্যেক শিশুর ঘরে পৌঁছে গেছে নোট বা গাইড। কোনো কোনো শিক্ষকের মনে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে সহযোগিতা করার উদারতা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত প্রশ্ন, সেহেতু পরীক্ষক মনেও উদার চিত্তে নম্বর দেয়ার মানসিকতা থাকা বিচিত্র কিছু নয়। পরীক্ষার্থীকে ফেল করানো যাবে না। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বিদ্যালয় সর্বোপরি সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেখে পরীক্ষা ক্ষেত্রে এ এক উদ্ভট ব্যবস্থাপনা।
শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বস্তরে, বিশেষত গোড়ায় গলদ বেশি। গোড়ায় গলদ দূরীকরণার্থে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি :
* তৃণমূল পর্যায় থেকে সুপারিশ ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষাব্যবস্থাকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে;
* শিশু মনোবিজ্ঞানবহির্ভূত শিশু মেধাবিনাশ পুস্তক বাতিল করতে হবে। শিশু শিক্ষার জন্য রচিত সব বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে;
* পাঠ্যপুস্তকে অবশ্যই বাস্তবভিত্তিক মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে;
* অনুশীলনীতে অবশ্যই পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো মোতাবেক নির্দেশনা থাকতে হবে;
* শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বইয়ের প্রতিটি শব্দ, বাক্য, অধ্যায় ভালোভাবে আয়ত্ত করে সামনে এগোতে হবে;
* না বুঝে মুখস্থ করার সব প্রবণতা দূর করতে হবে। এককথায়, শিশু যা বোঝে না, তোতা পাখির মতো তা মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়ার মানসিকতা দূর করতে হবে;
* শিশু শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোনোক্রমেই খোলা আকাশের নিচে পাঠদান চলবে না, ভৌত অবকাঠামোগত সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
* বিদ্যালয় দখল ও শিক্ষার অধিকার বিনষ্টকারীকে সামাজিকভাবে লালন না করে কঠিন শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হব;
* শিশুর শিক্ষার অধিকার বিনষ্টকারী অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
* খাতা-কলমের নম্বরের ওপর নির্ভর না করে সবদিক মূল্যায়ন করে আধুনিক পরীক্ষা-ব্যবস্থা চালু করা;
* কোনো কারণে যেন শিক্ষার্থীর ক্লাস কামাই না হয়, সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতালমুক্ত রাখতে হবে;
* প্রাথমিক শিক্ষায় (সম্মান) কোর্স পদ্ধতি চালু করতে হবে;
* বিদ্যালয়ের অসংখ্য কমিটি বাতিল করে রাজনীতিমুক্ত শিক্ষক-অভিভাবক কমিটি গঠন করতে হবে;
* জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে;
* শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সব শিক্ষককে ১ম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
* শিক্ষাদান ব্যাহত হয় এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষকদের অব্যাহতি দান করতে হবে;
* শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষকের অভাবমুক্ত রাখতে হবে;
* পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দিয়ে পাস করানো বা নম্বর বাড়িয়ে ভালো রেজাল্ট দেখানো অথবা এ সংক্রান্ত মৌখিক নির্দেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
* পুরো শিক্ষাব্যবস্থা কঠোর নিয়মনীতির আওতায় এনে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
শিক্ষার্থীর কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করানো শিক্ষকের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করা হলে দূর হবে শিক্ষার গোড়ার গলদসহ সার্বিক প্রতিবন্ধকতা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি
কয়েক বছর আগেও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে অর্ধেক পুরনো বই সংগ্রহ করে ছেঁড়া বই ছাত্রদের হাতে তুলে দেয়া হতো। ১৯৭৫ সালের পর থেকে বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত চলে এ অবস্থা। দীর্ঘ সময় অর্ধেক পুরনো বই দেয়ার পর শিশু মনে লেখাপড়া সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেছে। এ যেন একই তেলে বারবার পুরি ভাজার মতো অবস্থা। শিশু শ্রেণী থেকে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বিনামূল্যে বই দেয়া বর্তমান সরকারের একটি সাহসী ও যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শিক্ষার জন্য সরকারের এ বিশাল উদ্যোগ ম্লান হয়ে গেছে বিভিন্ন অবাস্তব কার্যক্রম গ্রহণের ফলে। আজও প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকদের পাঠদানবহির্ভূত কাজের বোঝা লাঘব হয়নি। বরং অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষার বিশাল কর্মযজ্ঞ শিক্ষকদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। এছাড়া সমাপনী পরীক্ষা চলাকালীন স্কুলে ক্লাস বন্ধ থাকে। ফলাফল ঘোষণা পর্যন্তই মূলত এ পরিস্থিতি কার্যকর থাকে। পাশাপাশি ছক পূরণ ক্রমান্বয়ে বেড়েই চলেছে। বিদ্যালয়ে অসংখ্য কমিটির তাঁবেদারি এর উল্লেখযোগ্য। শিক্ষা ক্ষেত্রের বিভিন্ন কাজ পিছিয়ে থাকলেও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি এগিয়ে আছে। মার্চ-এপ্রিলে অনেকটা গণহারে ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়। মে-জুন মাসে ট্রেনিংয়ের ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ বিদেশী অর্থ ল্যাপস হয়ে যাবে।
শিক্ষাকে ফলপ্রসূ ও অধিকতর কার্যকর করার জন্য প্রশিক্ষণের বিকল্প নেই। শিশুদের শিক্ষাদান কার্যক্রম ব্যাহত করে কোনো কাজ করাই সমীচীন নয়। ছুটির পর্বে ট্রেনিং দেয়াই শ্রেয়। কাজের ব্যাপকতা কমানোর জন্য শুধু শিক্ষক-অভিভাবক সমন্বয়ে বিদ্যালয়ে একটি কার্যকর কমিটি গঠন করা প্রয়োজন। রাজনীতির ছায়া থেকে মুক্ত করার লক্ষ্যে কমিটিতে রাজনৈতিক ব্যক্তির নমিনেশন বন্ধ করা দরকার। প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষার কাজ কিছুটা লাঘব করার জন্য মাধ্যমিকের মতো প্রাথমিক শিক্ষাবোর্ড গঠন করা জরুরি। প্রাথমিক শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে শিশু শিক্ষাকে ব্যাহত করা হচ্ছে। প্রাথমিক শিক্ষায় ২৯টি প্রান্তিক যোগ্যতা আছে। প্রতিটি শ্রেণীতে নির্দিষ্ট যোগ্যতা আছে। শিক্ষক স্বল্পতা ও শিক্ষকদের নানা কাজে ব্যস্ত রেখে যোগ্যতাগুলোর কাক্সিক্ষত অর্জন সম্ভব হয় না। যোগ্যতাভিত্তিক/ সৃজনশীল পরীক্ষা পদ্ধতির নামে ৩য় থেকে ১০ম শ্রেণী পর্যন্ত পাঠ্যপুস্তকের গুরুত্ব শিক্ষক, অভিভাক, শিক্ষার্থীর কাছে হারিয়ে যেতে বসেছে।
শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা পাঠ্যপুস্তককে গুরুত্ব না দিয়ে নোট-গাইডের দ্বারস্থ হচ্ছে, যার অন্যতম কারণ, বর্তমান পরীক্ষা পদ্ধতিতে পাঠ্যবই থেকে পুরোপুরি ধারণা পাওয়া যায় না। পাঠ্যবইয়ের অনুশীলনী সেকেলে। আরেকটি কারণ, পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত প্রশ্নের ধারণা নেয়া। এককথায় শিক্ষক, অভিভাবক ও শিক্ষার্থী সবাই মিলে পাঠ্যপুস্তককে অকার্যকর করে ফেলেছে। বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা শিক্ষার্থীর মেধার বিকাশের পরিবর্তে ভালো রেজাল্টের প্রতি বেশি সম্মান দেখাচ্ছে। শিক্ষার্থী, শিক্ষক, অভিভাবক ও সরকার সবাই মিলেমিশে একযোগে চাচ্ছে বেশি ও ভালো পাস। শিক্ষার্থীর কতটুকু জ্ঞান অর্জন হল, মেধার বিকাশ কতটুকু হল এ বিষয়টি নিয়ে শিশু থেকে শুরু করে এইচএসসি শিক্ষার্থী পর্যন্ত আমরা কতটুকু ভাবছি? অনেকে বলছে, কেউ এসএসসি ও এইচএসসিতে উজ্জ্বল ফল নিয়েও কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় বাংলায় ৫৯ শতাংশ নম্বর পাবে? ইংরেজিতে কেন মাত্র দু’জন পাস করবে? এ চিত্র নিছক উচ্চশিক্ষার ভর্তির ক্ষেত্রে নয়, গোটা শিক্ষাব্যবস্থারই গুরুতর গলদ স্পষ্ট করেছে।
পাসের উচ্চ হার নিয়ে কারও সঙ্গে বিতর্ক করতে চাই না। শুধু বলব, ভালো জ্ঞান অর্জন হয়নি। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময় ধরে শিশুকে কঠিন ইংরেজি শব্দ মুখস্থ করিয়ে ইংরেজ বানানোর প্রতিযোগিতা আমাদের মাঝে লক্ষ্য করা গেছে। আজও সে প্রবণতা বন্ধ তো হয়ইনি বরং বেড়েছে। আমাদের অভিভাবকদের বদ্ধমূল ধারণা, বেশি বেশি বই, বেশি বেশি পড়া, বেশি ইংরেজি লেখাই শিশুদের ভবিষ্যতে ইংরেজি শিক্ষায় পারদর্শী করে তুলবে। অনেকটা বাল্যবিয়ের মতো। সুপাত্র-পাত্রী দেখে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেয়া। বাল্যবিয়ের যে খারাপ ফল বা যন্ত্রণা আমরা দেখতে পাই, অনুরূপভাবে বাল্যকালে যথার্থ শিক্ষার অভাব শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ জীবনকে পিছিয়ে দিচ্ছে বা অকার্যকর করে ফেলছে।
প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা নিয়ে আলোকপাত করছি। জাতীয় প্রাথমিক শিক্ষা একাডেমি প্রদত্ত মার্কিং স্কিমে দেখা গেছে, বানানের জন্য নম্বর কাটা যাবে না। কোনোরকম বোঝা গেলেই পুরো নম্বর। এতে মেধাবী শিক্ষার্থী ও দুর্বল শিক্ষার্থীদের একসঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হচ্ছে। পাঠ্যবইবহির্ভূত প্রশ্নের বদৌলতে প্রত্যেক শিশুর ঘরে পৌঁছে গেছে নোট বা গাইড। কোনো কোনো শিক্ষকের মনে শিক্ষার্থীকে পরীক্ষার হলে সহযোগিতা করার উদারতা সৃষ্টি হয়েছে। যেহেতু পাঠ্যপুস্তকবহির্ভূত প্রশ্ন, সেহেতু পরীক্ষক মনেও উদার চিত্তে নম্বর দেয়ার মানসিকতা থাকা বিচিত্র কিছু নয়। পরীক্ষার্থীকে ফেল করানো যাবে না। শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষক, বিদ্যালয় সর্বোপরি সরকারের সুনাম ক্ষুণ্ন হচ্ছে দেখে পরীক্ষা ক্ষেত্রে এ এক উদ্ভট ব্যবস্থাপনা।
শিক্ষাব্যবস্থায় সর্বস্তরে, বিশেষত গোড়ায় গলদ বেশি। গোড়ায় গলদ দূরীকরণার্থে কতিপয় সুপারিশ উপস্থাপন করছি :
* তৃণমূল পর্যায় থেকে সুপারিশ ও অভিজ্ঞতার আলোকে শিক্ষাব্যবস্থাকে জ্ঞান অর্জনের মাধ্যম হিসেবে গড়ে তুলতে হবে;
* শিশু মনোবিজ্ঞানবহির্ভূত শিশু মেধাবিনাশ পুস্তক বাতিল করতে হবে। শিশু শিক্ষার জন্য রচিত সব বই জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড কর্তৃক অনুমোদন বাধ্যতামূলক করতে হবে;
* পাঠ্যপুস্তকে অবশ্যই বাস্তবভিত্তিক মেধার বিকাশ ঘটাতে হবে;
* অনুশীলনীতে অবশ্যই পরীক্ষার প্রশ্নকাঠামো মোতাবেক নির্দেশনা থাকতে হবে;
* শিক্ষার্থীকে অবশ্যই বইয়ের প্রতিটি শব্দ, বাক্য, অধ্যায় ভালোভাবে আয়ত্ত করে সামনে এগোতে হবে;
* না বুঝে মুখস্থ করার সব প্রবণতা দূর করতে হবে। এককথায়, শিশু যা বোঝে না, তোতা পাখির মতো তা মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় ঢেলে দিয়ে ভালো নম্বর পাওয়ার মানসিকতা দূর করতে হবে;
* শিশু শিক্ষার সুষ্ঠু পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কোনোক্রমেই খোলা আকাশের নিচে পাঠদান চলবে না, ভৌত অবকাঠামোগত সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
* বিদ্যালয় দখল ও শিক্ষার অধিকার বিনষ্টকারীকে সামাজিকভাবে লালন না করে কঠিন শাস্তির বিধান নিশ্চিত করতে হব;
* শিশুর শিক্ষার অধিকার বিনষ্টকারী অভিভাবক, শিক্ষক, কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে আইনের মাধ্যমে জবাবদিহিতা ও শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
* খাতা-কলমের নম্বরের ওপর নির্ভর না করে সবদিক মূল্যায়ন করে আধুনিক পরীক্ষা-ব্যবস্থা চালু করা;
* কোনো কারণে যেন শিক্ষার্থীর ক্লাস কামাই না হয়, সেজন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে হরতালমুক্ত রাখতে হবে;
* প্রাথমিক শিক্ষায় (সম্মান) কোর্স পদ্ধতি চালু করতে হবে;
* বিদ্যালয়ের অসংখ্য কমিটি বাতিল করে রাজনীতিমুক্ত শিক্ষক-অভিভাবক কমিটি গঠন করতে হবে;
* জাতীয় বাজেটে শিক্ষা খাতে বরাদ্দ বাড়াতে হবে;
* শিক্ষকদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি না করে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো সব শিক্ষককে ১ম শ্রেণীর মর্যাদা প্রদান ও সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে;
* শিক্ষাদান ব্যাহত হয় এমন সব কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষকদের অব্যাহতি দান করতে হবে;
* শিক্ষাঙ্গনকে শিক্ষকের অভাবমুক্ত রাখতে হবে;
* পরীক্ষার খাতায় বেশি নম্বর দিয়ে পাস করানো বা নম্বর বাড়িয়ে ভালো রেজাল্ট দেখানো অথবা এ সংক্রান্ত মৌখিক নির্দেশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে সংশ্লিষ্টদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
* পুরো শিক্ষাব্যবস্থা কঠোর নিয়মনীতির আওতায় এনে অপরাধীকে শাস্তির আওতায় আনতে হবে;
শিক্ষার্থীর কাক্সিক্ষত যোগ্যতা অর্জন করানো শিক্ষকের দায়িত্ব। দায়িত্ব পালনে সহযোগিতা করা অভিভাবকসহ সংশ্লিষ্টদের কর্তব্য। দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে যথাযথ ভূমিকা গ্রহণ করা হলে দূর হবে শিক্ষার গোড়ার গলদসহ সার্বিক প্রতিবন্ধকতা।
মো. সিদ্দিকুর রহমান : সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি
No comments