ফুটবলারের চেয়েও বড়

লিসবনে বেনফিকা স্টেডিয়ামের সামনে ইউসেবিওর মূর্তিতে চুমু খাচ্ছেন এক ভক্ত ইন্টারনেট
নিমন্ত্রণটা পেয়েছিলেন শৈশবের আদর্শ আলফ্রেড ডি স্টেফানোর কাছ থেকে। সান্তিয়াগো বার্নাব্যুতে সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন তৎকালীন বিশ্বের সবচেয়ে দামি ফুটবলার, ৮০ মিলিয়ন ইউরো মূল্যের ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। বৈশ্বিক এ তারকা যখন বার্নাব্যুর মঞ্চে দাঁড়িয়ে, ডি স্টেফানো তখন কনুই দিয়ে গুঁতো মারলেন তার অনুজপ্রতিম বন্ধুকে। ইউসেবিওকে কিছুটা খোঁচার স্বরেই রিয়াল কিংবদন্তি বললেন, 'তুমি চাইলে ওই জায়গাটাও দখল করতে পারতে!'
জর্জ উইয়াহ, দিদিয়ের দ্রগবা, মাইকেল এসিয়েন কিংবা স্যামুয়েল ইতোদের আগমনের অনেক আগেই তার আবির্ভাব ঘটেছিল। তিনি ইউসেবিও দ্য সিলভা ফেরেইরা। পেলে, জর্জ বেস্ট, ইয়োহান ত্রুক্রয়েফদের যুগে তার উত্থান অনেকটা উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো! জন্ম মোজাম্বিকে। বাবা ছিলেন জাতিতে অ্যাঙ্গোলিয়ান। দুটি দেশই তখন পর্তুগালের অধীনে থাকায় বর্তমানের 'ইউরোপের ব্রাজিল'দের হয়ে খেলার সুযোগ পেয়ে যান ইউসেবিও। দেশের জার্সিতে ৬৪ ম্যাচে তার করা ৪১ গোল কেবলই কিছু নীরেট সংখ্যা মাত্র। বোকা পরিসংখ্যান কি আর কখনও প্রতিভার তল ঠাহর করতে পেরেছে? বেনফিকা এখন তাই করছে। পর্তুগালের ক্লাবটির বাইরে ইউসেবিওর একটি মূর্তি আছে। রোববার থেকেই সেখানে পা ফেলার জায়গা নেই। ফুল, প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুনের শ্রদ্ধার্ঘ্যে মৌ মৌ করছে জায়গাটা। কিন্তু যার জন্য এত নৈবেদ্য, সেই ইউসেবিওই এখন না ফেরার দেশে।
ফুটবলের গুটিকয় কিংবদন্তির উঠে আসার মতোই ইউসেবিওর গল্পটা। শৈশবে কী দিয়ে বল বানাননি তিনি! মোজা, প্লাস্টিকের টুকরা, কাগজ, যা পেয়েছেন তা দিয়েই গোলাকার বস্তুটি বানিয়ে ছুটেছেন। তখন দম ছিল। ১০০ মিটার স্প্রিন্ট শেষ করতেন মাত্র ১১ সেকেন্ডে! তা দেখে বেনফিকার তৎকালীন কোচ বেলা গাটম্যান মন্তব্য করেছিলেন, 'এ তো সোনার টুকরো।' ইউসেবিওর বয়স তখন ১৮ বছর। স্পোর্টিং লিসবনও আগ্রহী ছিল তাকে কেনার জন্য; কিন্তু গোপনে মোজাম্বিকের ক্লাব স্পোর্টিং লরেন্সের হাতে সাড়ে সাত হাজার পাউন্ড ধরিয়ে দিয়ে ইউসেবিওকে কিনে নেয় বেনফিকা। তাকে লুকিয়ে রাখা হয় পর্তুগালের গ্রাম আলভাগ্রেতে। পরিস্থিতি শান্ত হওয়ার পর ১৯৬১ সালে বেনফিকার হয়ে অভিষেক ম্যাচেই ইউরোপিয়ান ফুটবলে ইউসেবিওর উত্থান ঘটে হ্যাটট্রিক করে। বাকিটা ইতিহাস।
পরবর্তী ১৫ বছরে বেনফিকাকে তিনি উপহার দিয়েছেন একটা যুগ। প্রীতি ম্যাচগুলো বাদ দিয়েই ৪৪০ ম্যাচে ৪৭৩ গোল! ১১টি লীগ শিরোপা, সাতবার পর্তুগিজ লীগের সর্বোচ্চ গোলদাতা। ১৯৬২ সালে ডি স্টেফানো-পুসকাস-জেন্টোর রিয়াল মাদ্রিদকে পরাজিত করে জিতে নেন ইউরোপিয়ান কাপের (চ্যাম্পিয়ন্স লীগ) শিরোপা। বিশ্বকাপ খেলেছেন মাত্র একটি। ১৯৬৬ সালের সেই আসরের সেমিতে ইংলিশদের কাছে হেরে বিদায় নেয় পর্তুগাল; কিন্তু ইউসেবিও ততক্ষণে ইতিহাস। কোয়ার্টার ফাইনালে উত্তর কোরিয়ার বিপক্ষে মাত্র ২৫ মিনিটেই ৩-০ গোলে পিছিয়ে পড়ে পর্তুগাল। তারপর একাই চার গোল করে ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা প্রত্যাবর্তনের রূপকথাটা লিখে রাখেন গতি, ক্ষিপ্রতা আর ডান পায়ে কামানের গোলা দাগার ক্ষমতার জন্য সবার আদরের 'কালো চিতা'।
হোসে মরিনহোর চোখে তাই ইউসেবিওর জায়গা পেলে, চার্লটন, বেকেনবাওয়ারের পাশে। বাকি তিনজনকে এখনও দেখা যাচ্ছে। শুধু ইউসেবিওকে হারানোর মাতম করতেই তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক প্রকাশ করেছে পর্তুগাল সরকার। গতকাল লিসবনে তার শেষকৃত্যানুষ্ঠানে জমায়েত হন ফুটবলের অগণিত সাবেক ও বর্তমান তারকা। সেখানে ছিলেন সাবেক ম্যানইউ গোলরক্ষক অ্যালেক্স স্টেপানি। '৬৮-তে ইউরোপিয়ান কাপের ফাইনালে ১৫ গজ দূর থেকে নেওয়া ইউসেবিওর একটি শট রুখে দেওয়ার পর তাকে 'স্যালুট' করেছিলেন পর্তুগিজ এ কিংবদন্তি। সম্মানটা ফিরিয়ে দিতে এসে স্টেপানি শুধু বলতে পেরেছেন, 'বিদায় কিংবদন্তি'।

No comments

Powered by Blogger.