গ্রামীণ গীত রক্ষার সংগ্রাম দুই বোনের by ফয়সাল মাহমুদ
পিঠাপুলির আয়োজনে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েরা মেতে উঠেছে নবান্ন উৎসবেষ ছবি |
শৈত্যপ্রবাহের
কনকনে শীত। শিশিরভেজা সড়ক। সড়কের দু'ধারে গগনবিস্তৃত সরষে ক্ষেত।
আঁকাবাঁকা পিচঢালা সড়ক আমাদের নিয়ে গেল ছোট্ট একটি গ্রামে। গ্রাম ঘেঁষে বয়ে
গেছে পুনর্ভবা নদী। নদীর কারণে বিশেষ আকৃতি পাওয়া এই গ্রামের নাম
বাবুরঘোন। চাঁপাইনবাবগঞ্জের গোমস্তাপুর উপজেলার নিভৃত একটি গ্রাম। ২৬
ডিসেম্বর, সকাল পৌনে ১০টা। সূর্যের দেখা মেলেনি তখনও। আমরা গিয়ে থামলাম
গ্রামের মসজিদের পাশের একটি বাড়ির সামনে। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে
গ্রামীণ গীতের সুর। সমবেত কণ্ঠের ওই সুর সুমধুরও বটে। ভেতরে যেতেই দেখলাম,
একটি মাটির উনুনকে ঘিরে বসে আছে শিশু-কিশোরী-তরুণী থেকে মধ্য বয়সীরাও।
সাজেও ষোলআনা বাঙালিআনা। লাল পেড়ে হলুদ শাড়ি। খোঁপায় ফুল। কেউবা নাকে নথ
পরেছেন। কারও সিঁথিতে ঝুলছে মানটিপ। কম বয়সী সবার মাথায়ই কমলা রঙের কাগজের
ফুলের মালা।
কিছুক্ষণ পরই দল বেঁধে তারা বেরিয়ে গেলেন ঘাটে পানি আনতে। সেখানে গাইলেন 'জল আনার গীত'। ফিরে এসে ঢেঁকিতে ধান ভানলেন। সেখানে 'ধান কুটার গীত'। গীত গাইলেন যাঁতায় আটা পেষার সময়ও। এরপর আবারও উনুন ঘিরে গোল হয়ে বসলেন পিঠা তৈরি করতে। আবারও গীত। একেক স্থানে একেক ধরনের গীত।
গ্রামের নারীরাই রচনা করেছেন এসব গীত। কিন্তু কোন সময়ে তা কেউ জানে না। মুখে মুখে চলে আসছে এসব। লিখিতও নেই কারও কাছে। শুধু এতটুকু জেনেছেন, ওই সময়ের নারীরা কাজকে উপভোগ্য করে তুলতে গীত গাইতেন। জা, ননদ বা প্রতিবেশীদের নিয়ে একসঙ্গে গাইতেন। এসব গীতে ফুটে উঠেছে গ্রামের বধূর ভালোলাগা, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি, আবার যন্ত্রণা-কষ্ট_ সবকিছুই। আগে বিয়েসহ যে কোনো উৎসবে গাওয়া হতো এসব গীত। কিন্তু এখন সেটা আর হয় না। আয়োজক তরুণী জানালেন, একটি একটি করে তারা ৬৯টি গীত সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত চর্চাও করেন এগুলোর। উৎসবের এই দিনে যতগুলো গাওয়া যায়, গাইবেন। এটি মূলত নবান্ন উৎসব। কৃষিনির্ভর এই গ্রামে ধান কাটা-মাড়াই শেষ। বাড়িতে বাড়িতে গোলাভর্তি ধান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান তুলেই এই আয়োজন। তিন বছর ধরে নিয়মিতই হচ্ছে।
গীতে মগ্ন আমরা। আয়োজকদের একজন সামনের টেবিলে রাখলেন পিঠা-পুলি। ভাপা পিঠা, তিল পিঠা, আন্ধাসা, ক্ষীর। ছয় ধরনের পিঠা বানানো হয়েছে। পুুলি আছে দুই ধরনের। একটু একটু করে সবই খেলাম। যে স্বাদ পেয়েছি, মনে থাকবে অনেক দিন।
আয়োজনের সমন্বয় করেন গ্রামের দুই বোন মমতাজ ও শামীমা। দু'জনেই শিক্ষিকা। গ্রামের গোঁড়ামি কাটিয়ে তারাই তিন বছর ধরে নিয়মিত আয়োজন করছেন এই উৎসবের। এবারও অনেক পরিবার থেকে ধান দেওয়া হয়নি। আসতে দেওয়া হয়নি ছেলেমেয়েদের। একটি গোষ্ঠী গ্রামের প্রচার দিয়েছে_ ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে নাচ-গান করলে মেয়েদের বিয়ে হবে না। আরও কত কী বলেছে! কিন্তু যারা এসেছে তাদের নিয়েই এই আয়োজন।
'আমার কাছে এটা একটা সংগ্রাম। গীত রক্ষার সংগ্রাম। সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম।' বলছিলেন মমতাজ খাতুন। যারা আজও এর বিরোধিতা করছে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার জন্য তারাই দায়ী। গ্রামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্যই তারা সুকৌশলে এটা করেছে। কারণ সংস্কৃতিই একটি জাতির রক্ষাকবচ। কে, কী ভাবল বা কে কীভাবে সমর্থন দিল-দিল না এতে আমাদের কিছুই যায়-আসে না। সংগ্রাম চালিয়ে যাব, আমার মেয়েদের নিয়ে। মমতাজের বলা অনেক কথার সারমর্ম এটাই। তবে শেষে তিনি এভাবেই বললেন, 'আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা ছড়িয়ে পড়ুক আবহমান বাংলার গ্রামে গ্রামে। তবেই মৌলবাদ আগ্রাসন বন্ধ হবে বাংলাদেশে।'
সময়ের কাঁটা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আজকের মতো থামবে সমবেত কণ্ঠ, সুর। কিন্তু সংগ্রাম থামবে না। মমতাজ-শামীমার সংগ্রাম চলছে, চলবে। ঐতিহ্যের ধারক এই সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
কিছুক্ষণ পরই দল বেঁধে তারা বেরিয়ে গেলেন ঘাটে পানি আনতে। সেখানে গাইলেন 'জল আনার গীত'। ফিরে এসে ঢেঁকিতে ধান ভানলেন। সেখানে 'ধান কুটার গীত'। গীত গাইলেন যাঁতায় আটা পেষার সময়ও। এরপর আবারও উনুন ঘিরে গোল হয়ে বসলেন পিঠা তৈরি করতে। আবারও গীত। একেক স্থানে একেক ধরনের গীত।
গ্রামের নারীরাই রচনা করেছেন এসব গীত। কিন্তু কোন সময়ে তা কেউ জানে না। মুখে মুখে চলে আসছে এসব। লিখিতও নেই কারও কাছে। শুধু এতটুকু জেনেছেন, ওই সময়ের নারীরা কাজকে উপভোগ্য করে তুলতে গীত গাইতেন। জা, ননদ বা প্রতিবেশীদের নিয়ে একসঙ্গে গাইতেন। এসব গীতে ফুটে উঠেছে গ্রামের বধূর ভালোলাগা, ভালোবাসা, আবেগ-অনুভূতি, আবার যন্ত্রণা-কষ্ট_ সবকিছুই। আগে বিয়েসহ যে কোনো উৎসবে গাওয়া হতো এসব গীত। কিন্তু এখন সেটা আর হয় না। আয়োজক তরুণী জানালেন, একটি একটি করে তারা ৬৯টি গীত সংগ্রহ করেছেন। নিয়মিত চর্চাও করেন এগুলোর। উৎসবের এই দিনে যতগুলো গাওয়া যায়, গাইবেন। এটি মূলত নবান্ন উৎসব। কৃষিনির্ভর এই গ্রামে ধান কাটা-মাড়াই শেষ। বাড়িতে বাড়িতে গোলাভর্তি ধান। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ধান তুলেই এই আয়োজন। তিন বছর ধরে নিয়মিতই হচ্ছে।
গীতে মগ্ন আমরা। আয়োজকদের একজন সামনের টেবিলে রাখলেন পিঠা-পুলি। ভাপা পিঠা, তিল পিঠা, আন্ধাসা, ক্ষীর। ছয় ধরনের পিঠা বানানো হয়েছে। পুুলি আছে দুই ধরনের। একটু একটু করে সবই খেলাম। যে স্বাদ পেয়েছি, মনে থাকবে অনেক দিন।
আয়োজনের সমন্বয় করেন গ্রামের দুই বোন মমতাজ ও শামীমা। দু'জনেই শিক্ষিকা। গ্রামের গোঁড়ামি কাটিয়ে তারাই তিন বছর ধরে নিয়মিত আয়োজন করছেন এই উৎসবের। এবারও অনেক পরিবার থেকে ধান দেওয়া হয়নি। আসতে দেওয়া হয়নি ছেলেমেয়েদের। একটি গোষ্ঠী গ্রামের প্রচার দিয়েছে_ ওই অনুষ্ঠানে গিয়ে নাচ-গান করলে মেয়েদের বিয়ে হবে না। আরও কত কী বলেছে! কিন্তু যারা এসেছে তাদের নিয়েই এই আয়োজন।
'আমার কাছে এটা একটা সংগ্রাম। গীত রক্ষার সংগ্রাম। সংস্কৃতি-ঐতিহ্য রক্ষার সংগ্রাম।' বলছিলেন মমতাজ খাতুন। যারা আজও এর বিরোধিতা করছে এই ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়ার জন্য তারাই দায়ী। গ্রামের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্যই তারা সুকৌশলে এটা করেছে। কারণ সংস্কৃতিই একটি জাতির রক্ষাকবচ। কে, কী ভাবল বা কে কীভাবে সমর্থন দিল-দিল না এতে আমাদের কিছুই যায়-আসে না। সংগ্রাম চালিয়ে যাব, আমার মেয়েদের নিয়ে। মমতাজের বলা অনেক কথার সারমর্ম এটাই। তবে শেষে তিনি এভাবেই বললেন, 'আমরা যে উদ্যোগ নিয়েছি, তা ছড়িয়ে পড়ুক আবহমান বাংলার গ্রামে গ্রামে। তবেই মৌলবাদ আগ্রাসন বন্ধ হবে বাংলাদেশে।'
সময়ের কাঁটা বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে ধাবিত হচ্ছে। আজকের মতো থামবে সমবেত কণ্ঠ, সুর। কিন্তু সংগ্রাম থামবে না। মমতাজ-শামীমার সংগ্রাম চলছে, চলবে। ঐতিহ্যের ধারক এই সংস্কৃতি বেঁচে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম।
No comments